ভারতীয় উপমহাদেশে সবচেয়ে বেশিবার উদ্ধৃত সাধক-কবিদের ভিতর অন্যতম একজন হলেন আল্-সাতগুরু "কবির"(হিন্দি - कबीर, পাঞ্জাবী - ਕਬੀਰ, উর্দূ - کبير) মুলত: ইসলাম ধর্মানুসারে ঈশ্বরের ৯৯ টি নামের একটি নাম। বাংলাতে যার অর্থ মহান বা মহৎ। এছাড়া, তিনি "কবির দাস" নামেও পরিচিত। শিখদের ধর্মগ্রন্থ "গুরু গ্রন্থ সাহিব " 'য়েই তাঁর প্রায় ৫০০'র বেশি বাণী রয়েছে।
"কবির"-এর জন্ম, মৃত্যু এবং জীবন নিয়ে অনেক কাহিনী প্রচলিত আছে। ধারণা করা হয় তাঁর জন্ম (আনুমানিক) ১৩৯৮ খৃষ্টাব্দে কিংবা এর আশেপাশে। তবে, তাঁর জন্মের বিষয়টি বেশ রহস্যাবৃত। অনেকে বলেন, যিশুখৃষ্টের মত তিনিও কুমারী মাতার গর্ভে জন্মগ্রহন করেন। আবার অনেকে বলেন, তিনি ছিলেন মুলত: এক বিধবা ব্রাম্মণের সন্তান। শিশু অবস্থায় বিধবা মাতার কাছে পরিত্যাক্ত হওয়ার পর, মিরু এবং নিলীমা নামের এক সন্তানহীন মুসলিম দম্পতি তাঁকে দত্তক নেয়। এবং এদের কাছেই তিনি বেড়ে ওঠেন। তবে, তাঁর জন্ম সম্পর্কে সবচেয়ে জনপ্রিয় বিশ্বাস হল.. তিনি ছিলেন একজন অবতার। সরাসরি মনুষ্য-শিশু হিসেবে তিনি পৃথিবীতে অবতীর্ন হয়েছিলেন। তাঁর আসলে পার্থিব নিয়মে কখনও জন্মই-ই হয়নি!
পেশায় তাঁতী এই "কবির"-কে পৃথিবী সবচেয়ে বড় কবিদের ভিতর গণ্য করা হয়। যদিও "কবির" ছিলেন নিরক্ষর! জীবিকা নির্বাহের জন্য পালক পিতা-মাতা'র মত তিনিও তাঁতে কাপড় বুনতেন।
তিনি অবশ্য প্রথম যুগের উত্তর-ভারতীয় "ভক্তি"-সাধক হিসেবেও পরিচিত।কবিগুরু রবীন্দ্রনাথঠাকুর সর্বপ্রথম কবিরের গানের ইংরেজী অনুবাদ (The Songs of Kabir) করেন।
এই বইয়ে (The Songs of Kabir) আমার প্রিয় কয়েকটা লাইন আপনাদের সাথে শেয়ার করলাম
The Songs of Kabir, tr. by Rabindranath Tagore, intro. by Evelyn Underhill, [1915], New York, The Macmillan Company.
"candâ jhalkai yahi ghat mâhîn"
THE moon shines in my body, but my blind eyes cannot see it:
The moon is within me, and so is the sun.
The unstruck drum of Eternity is sounded within me; but my deaf ears cannot hear it.
So long as man clamours for the I and the Mine, his works are as naught:
When all love of the I and the Mine is dead, then the work of the Lord is done.
For work has no other aim than the getting of knowledge:
When that comes, then work is put away.
The flower blooms for the fruit: when the fruit comes, the flower withers. [p. 50]
The musk is in the deer, but it seeks it not within itself: it wanders in quest of grass.
বর্তমানে বইটি বিশ্ব-সাহিত্যে'র এক অমূল্য সম্পদ। ১৯২৩ সালের পূর্বে প্রকাশিত হওয়ায় এটি বর্তমানে public domain এর অন্তর্ভূক্ত। আর তাই আপনারা ইচ্ছে করলে বইটি অনলাইনেই পড়তে পারবেন। বইটি পড়ার জন্য এই লিংক এ ক্লিক করুন।
এছাড়া বর্তামানে কবিরের কবিতার modern adaptation হল Robert Bly'র The Kabir Book: Forty-Four of the Ecstatic Poems of Kabir. ব্যাপকভাবে সমালোচিত ও জনপ্রিয় এই বইটি প্রকাশ পায় ১৯৭৭ সালে।
কবির সেই সময়ে প্রচলিত তৎকালীন ধর্মবিশ্বাসগুলোর সরাসরি সমালোচনা করে ভারতীয় দর্শনের এক নতুন সূচনা ঘটান। তাঁর সহজ সাবলীল ভঙ্গীমায় উপস্থাপন বিশ্বব্যাপী ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়। ( অনেকটা আমাদের "লালন "-এর মতন )
তবে তিনি কখনও সরাসরি উল্লেখ করেন নি যে তিনি কোন ধর্মের প্রতি অনুরোক্ত ছিলেন কিনা। তাঁর ঈশ্বর-বিষয় ধারনা ছিল অনেকটা অসাপ্রদায়িক এবং সার্বজানীন। যেমন তার লেখায় পাওয়া যায় :
aisâ lo nahîn taisâ lo
O HOW may I ever express that secret word?
O how can I say He is not like this, and He is like that? [p. 53]
If I say that He is within me, the universe is ashamed:
If I say that He is without me, it is falsehood.
He makes the inner and the outer worlds to be indivisibly one;
The conscious and the unconscious, both are His footstools.
He is neither manifest nor hidden, He is neither revealed nor unrevealed:
There are no words to tell that which He is.
কবিরের দর্শন মুলত: পুরনো ব্রাম্মীক হিন্দু, হিন্দু ও বৌদ্ধধর্মের "তন্ত্র-সাধনা", নয়-গুরু'র শিক্ষা এবং নিরাকার ঈশ্বর ভিত্তিক ইসলাম ধর্ম দ্বারা প্রভাবিত। তাঁর বাণী এবং উদ্ধৃতিগুলোতে এর প্রমাণ মেলে। তবে, কবিরের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কীর্তি হল "বীজক্" (Bijak ) (The Seeds) । এই সংকলনের কবিতাগুলোয় ধর্ম এবং আধ্যাত্বিকতা সম্পর্কে তাঁর নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি একে একে বর্নিত হয়েছে ।
লোকমুখে শোনা যায়, কবির ১২০ বছর বয়সে দেহত্যাগ করেন। এবং তাঁর মৃত্যু সম্পের্কে খুবই বিখ্যাত একটি গল্প প্রচলিত আছে।যে, তিনি মারা যাওয়ার পর মরাদেহ নিয়ে তাঁর হিন্দু এবং মুসলিম ধর্মের অনুসারিদের মাঝে বিবাদ শুরু হয়। একপর্যায়ে তার মরাদেহের উপর থেকে কাপড় সরানো হলে দেখা যায় সেখানে লাশের পরিবর্তে কিছু ফুল পড়ে আছে। সেই ফুলের অর্ধেক হিন্দু অনুসারীরা নিয়ে গিয়ে দাহ্ করেন এবং বাকি অর্ধেক মুসলমান অনুসারীরা নিয়ে গিয়ে দাফন করেন। এখনও পর্যন্ত "বানারাসী, Varanasi "( হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের তীর্থস্থান, যা "কাশি" নামেও পরিচিত ) তে সেই অস্থি-সৌধ এবং সমাধি পাশাপাশি রয়েছে।
"কবির দাসের" জন্ম হয় (আনুমানিক) ১৩৯৮ সালে অর্থৎ "গুরু নানক দেব "-এর জন্মের প্রায় ৭১ বছর আগে। শিখ ধর্মের যাবতিয় শিক্ষা , "ভক্তি" ও "সুফি"বাদে অন্য সবার তুলনায় কবিরের অবদানই সবচেয়ে বেশি। কবিরের জীবদ্দশায় অর্থাৎ পনেরশ শতক সময়টি ছিল ভারতীর রাজনৈতিক ইতিহসের জন্যও একটি ক্রান্তিকাল। কিন্তু, বিভিন্ন ধর্মগুরুদের তুলনায় তাঁর সম্পর্কে প্রাপ্ত ঐতিহাসিক তথ্যের পরিমান খুবই নগন্য। যদিও তাঁকে নিয়ে গল্প বা উপাখ্যানের কোন অভাব নেই।
কবিরপন্থীরা ছিল নিন্ম বর্গের মানুষ মূলতঃ তাঁতি, যাদের উচ্চ বর্গের মানুষরা জোলা নামে তাচ্ছিল করতো।আমাদের ইতিহাস চর্চার একটি পক্ষপাত দুষ্ট চরিত্র হচ্ছে এটা মূলত রাজণ্য বর্গের ইতিহাস। এখানে তাই নিন্মবর্গের মানুষের চিন্তা-চেতনা -সংস্কৃতির কোন স্থান নেই।
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই সেপ্টেম্বর, ২০০৯ সকাল ১০:৫৩