১ম পর্ব
২য় পর্ব
১ম ও ২য় পর্ব থেকে যদি সার সংক্ষেপ কিছু নিতে চান তাহলে নিচের উপলব্ধি গুলো গুরুত্বপূর্ণ ।
১। আজকের বিশ্বে কর্পোরেট দুনিয়া আমরা কি খাব, কি পরবো, কি রকম বাড়িতে বাস করবো, কি ধরনের মূল্যবোধকে দাম দেব, কিসে বিনোদিত হবো , কাকে বিয়ে করবো , কোন অবস্থানকে জীবনের সাফল্য আর কোনটাকে জীবনের ব্যর্থতা হিসেবে মানবো - এই সব কিছুই ঠিক করে দেয় । ( কারন, একই মালিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান , শিক্ষা প্রতিষ্ঠান , সেবা খাত আর পলিটিকাল দলকে চালায়)
২। এই কর্পোরেট দুনিয়ার সবচেয়ে শক্তিশালী মাধ্যম হইলো মিডিয়া । বিশেষ করে মাল্টি মিডিয়া যা প্রতিনয়ত এই ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এর সুবিধা ও লাভ অনুযায়ী আমাদের ভ্যালু সিস্টেম ( কিসের মূল্য কত টুকু) , আমাদের কালচার, আমাদের জীবন দর্শনকে বদলে দেওয়ার চেষ্টা করছে । যা কিছু ব্যবসার সহায়ক তাকে উৎসাহ দিচ্ছে , যা কিছু ব্যবসার পথে প্রতিবন্ধক তাকে খারাপ বলে শিক্ষা দিচ্ছে ।
৩। এইটা করাটা খুব বেশি জরুরী কারন মানুষ যুক্তি বুদ্ধি দিয়ে চিন্তা করা শুরু করলেই এই দানব মাল্টিন্যাশনাল গুলা হুড়মুড় করে ভেঙ্গে পড়বে । আরো একটা কারণে এই মিডিয়ার প্রচার প্রয়োজন কারণ , পুঁজিবাদ বেঁচে থাকার জন্য একটা কাজ প্রতিনিয়ত করে তা হলো প্রফিট । অর্থাৎ , প্রফিট বা লাভ ছাড়া পুঁজিবাদী মার্কেটিং সিস্টেম বাঁচতে পারে না । এইটা কোন সেলফ সাস্টেইনেবল সিস্টেম না বরং সেলফ ডিস্ট্রাক্টিভ সিস্টেম। ক্রমাগত বাড়তে না পারলে পুঁজিবাদী মার্কেট ভেঙে পড়ে ।
একটা উদাহরণ দিয়ে বুঝাই । আগের পোস্টের গরুটাকে মনে আছে ? ওই যে , লাভ করার জন্য আপনি পাড়াপ্রতিবেশীকে গাভী বেচে দেওয়ার জন্য ছল, বল ও কৌশল ব্যবহার করলেন? এখন এই পুরা উৎপাদন প্রক্রিয়াটিতে কর্পোরেট পুঁজিবাদ লাভ করে দুই ভাবে । এক হলো , শোষন ( শ্রম শোষণ) , আর ২য় হল উৎপাদনের বেশি দামে বিক্রি ।
কর্পোরেট বাণিজ্য-তে আপনার গরু (ছিলো), আপনার গরুর দুধ এখন একবার দুয়ানোর জন্য ( আমি কিনে নেওয়ার পর) শ্রম দিবেন, তারপর কেনার জন্য শ্রম দেবেন , তারপর বেঁচার জন্য শ্রম দিবেন । সুতরাং, কইয়ের তেলে কই-ই শুধু ভাঁজছি না আমি , একটা মাত্র উৎপাদন প্রক্রিয়ার মাঝে আমি আপনাকে তিনটি ভিন্ন ভিন্ন ধাপে শোষনও করছি ।
২য় পদ্ধতিতে লাভ করতে হলে চাই বিক্রি । বিক্রি করতে হলে চাই ডিমান্ড । ডিমান্ড ক্রিয়েট করতে হলে চাই নতুন নতুন বাজার বা কঞ্জিউমার / ক্রেতা। মানে, বাজারে সকল ক্রেতার কাছেই যদি দুধ থাকে তাহলে আমার দুধ আর বিক্রি হবে না । সুতরাং হয় আমাকে,
১। সকলের দুধ শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে (স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় ডিমান্ড তৈরী)
২। নাইলে নতুন ক্রেতা খুঁজে নিতে হবে ( নতুন ক্রেতা মানে নতুন ডিমান্ড)
৩। বা মানুষের দরকার থাকুক আর নাই থাকুক , ক্রেতাকে দিয়ে যে কোন মূল্যে দুধ কেনাতে হবে । ( কৃত্রিম ডিমান্ড বা মিথ্যা ডিমান্ড তৈরী)
আমাদের লাক্স কিংবা চ্যানেল আই বাঁচে এই ৩য় প্রকার ডিমান্ড তৈরী করার মধ্য দিয়ে । প্রসাধন জীবন ধারনের জন্য প্রয়োজনীয় না । যেমন জরুরী না টিভি দেখা । এমন কি খাদ্য কিংবা জীবন্রক্ষাকারী ওষুধ এর মত জরুরী পণ্য হলেও যদি তা প্রয়োজনের তুলনায় বেশি পরিমাণে উৎপাদিত হয় (মার্কেট স্যাচুরেশন করে ফেলে, যেমন পানিতে লবণ ঢালতে ঢালতে এক সময় যখন পানি আর লবণ নিতে পারে না) অথবা দাম বেশি বলে ক্রেতার ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে যায়, তখন কর্পোরেট পুঁজিকে দৌড়াতে হয় নতুন ক্রেতা ধরতে - থাকলে খুঁজে নাও , না থাকলে বানাও ।
বিল গেটস শিক্ষা দীক্ষা নিয়ে আকুল হইতেন না; যদি না কম্পিউটার কেনার জন্য এবং ব্যবহারের জন্য একটা নির্দিষ্ট লেভেলের শিক্ষা, দরকার না হইত ।
এখন পৃথিবীর সকল জায়গায় কোন দুইটা জিনিসের ডিমান্ড চিরকাল থাকবে , যতদিন মানুষ থাকবে , ততদিন থাকবে?
১। খাদ্য । যেইখানেই জীবন থাকবে সেইখানেই ক্ষুধা থাকবে।
২। সেক্স । যেইখানেই মানুষ থাকবে , সেইখানেই সেক্স থাকবেই ।
লাক্স চ্যানেল আই সুপারস্টার এই দ্বিতীয় বাজারটির কারবারী । কি করতে হবে? সুন্দর হইতে হবে । কেন সুন্দর হইতে হবে? সুন্দর হইলে সুপারস্টার হওয়া যাবে । কেন সুপারস্টার হইতে হবে? সুপারস্টার হইলে সেক্সের বাজারে দাম বাড়বে ( সেই সেক্স বিবাহের বাইরেই হোক আর ভিতরে ) । এর সাথে আনুসাঙ্গিক হিসেবে টাকা, প্রভাব, খ্যাতি - কে না চায় এই সব?
কি ভাবে মিথ্যা ডিমান্ড তৈরী করে টিভি মিডিয়া ?
আমাদের চাওয়া এবং প্রয়োজনের বোধকে প্রতিনিয়ত পরিবর্তন করে দিয়ে।
হাত ধোয়ার সাবানের মার্কেট শেষ । তাইলে সাবান এখন কেন দরকার? সুন্দর হওয়ার জন্য । শীত বা গরম ও লজ্জা থেকে বাঁচার জন্য যতটুকু কাপড় মানুষ এর দরকার হয় , এখন তার চেয়ে অনেক বেশি কাপড় উৎপাদিত হয় । তাই কি দরকার ? ফ্যাশন । বিউটি সোপ আর ফ্যাশনেবল কাপড় এ বাজার ছেয়ে গেছে । তাইলে এখন কি দরকার ? এখন দরকার সুপারস্টার হওয়া ।
আসেন দেখি কর্পোরেট পুঁজিবাদ ইউনিলিভার কি ভাবে এই ফলস ডিমান্ড তৈরী করে?
বিশ্ব ব্যাপী সুন্দরের যেই সংঙ্গা কর্পোরেট গুলা তৈরী করেছে , তার মূলে আছে মানুষের অদম্য কামনা । যা মানুষ হতে পারবে না কোন দিন -তাকেই আদর্শ হিসেবে সেট করে দেওয়া হচ্ছে প্রতিনিয়ত হাজার হাজার মিডিয়া বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে । কি রকম?
১। আফ্রিকা ও এশিয়ার উপমহাদেশে সারাক্ষণ প্রচার হচ্ছে ফর্সা হউন।
ইউরোপ ও আমেরিকায় সারাক্ষণ প্রচার হচ্ছে , কালো (ট্যান) হউন।
২। কালো চুলের মেয়েদের সারাক্ষণ দেখানো হচ্ছে , কালোদের স্ট্রেইট চুলে বেশি ভালো লাগে। আর যাদের চুল এম্নিতেই স্ট্রেইট , সেই সাদাদের দেখানো হচ্ছে কোকড়া চুল বেশি সেক্সি ।
৩। শুকনা মেয়েদের - তোমার বড় বুক নেই । মোটা মেয়েদের - তোমার চিকন কোমর নেই।
৪। খাট পুরুষদের - লম্বা হউন। লম্বা পুরুষদের - মাস্কুলার হউন। মাস্কুলার পুরুষদের - যৌণ শক্তি বাড়ান।
মানে , আপনি ফর্সা, কালো, খাট - লম্বা, চিকন - মোটা - যাই হোন না কেন , আপনার শান্তি নাই । আপনি কিছুতেই সেক্সের যোগ্য না । প্রেমের যোগ্য না। ভালোবাসার যোগ্য না। সম্মানের যোগ্য না । আপনি কিছুতেই সফল না না না না না, যতক্ষণ না তাদের পণ্যটি ব্যবহার করছেন । আমি যতই বলি আপনি পারফেক্ট , আপনি বিশ্বাস করবেন না , কারণ মিডিয়া আপনাকে সারাক্ষণ শিখাচ্ছে , আপনি পারফেক্ট নন। ইউ নিড মোর । মোর মানি।মোর সেক্স । মোর মোর মোর ।
এই ঝামেলায় কি খালি মেয়েরাই? নাহ। নিঃসন্দেহে মেয়েরা তাদের দেহ এবং রুপ দিয়ে বিচার্য হয় বলে ৯০% টার্গেট মেয়েদের শরীর । ত্বক, বুক, নিতম্ব, মুখমন্ডল - আমাদের সমস্যার অন্ত নেই আর কোম্পানি গুলার সমাধানেরও অন্ত নেই । কিন্তু ছেলেরাও কম ঝামেলায় নেই । ৪২ ইঞ্চি ছাতি , ব্র্যাড পিটের নিতম্ব আর সিক্স প্যাক না হইলে চলবে না । এদিকে আবার দুনিয়ার সবচেয়ে ধনী পুরুষ গুলা সব ভুড়িয়াল , তাতে কি? সব কয়টা নোবেল প্রাইজ উইনারও অতি সাধারন দেখতে, তাতে কি? অবশ্য পুরুষের সাফল্য মানে সাধারণত দেহ নয়, কাড়ি কাড়ি টাকা । সোজা ভাষায় যা আপনি হইতে পারবেন না ( বায়োলজি, ইকোনমি কিংবা সোসাল কারনে), তা হইতে উদ্বুদ্ধ করাটাই হইলো মার্কেটিং , ব্রেইন ওয়াশিং এর কাজ ।
অতএব লাক্স এবং চ্যানেল আই এর কাজ হইলো বঙ্গবাসীকে আগে এইটা শিখানো ,
হোয়াট ইজ সেক্সি? ( উত্তর অতি অবশ্যই লাক্স সুন্দরী। এইটা তো লাল সালুর ব্লগে প্রমান হয়েই গেছে যে লাক্স এই কাজে পুরাপুরি সফল হয়েছে )
এই জন্য চোখ , ঠোঁট আর ভঙ্গিমায় আবেদন খুঁজে বেড়াইলেন আমাদের দাদু শামসুল হক ।
পরের ধাপ হইলো ,
হু ইজ সেক্সি ? ( উত্তর অতি অবশ্যই যারা লাক্স সুন্দরীদের মত দেখতে, চলনে, বলনে ইত্যাদি । এইখানেও তারা সফল)
এর পরের ধাপ, মানে আসল ধাপ , আপনি কিভাবে সেক্সি হবেন? ( লাক্স , জগৎজোড়া বিখ্যাত কোম্পানির প্রসাধন ব্যবহার করতে হবে )
প্রথম পোস্টের কথা মনে আছে ? ঐ যে বলেছিলাম , একই কর্পোরেট অঙ্গের বিভিন্ন ব্যবসার হাত? মিমি কাপড়ের ব্যবসা, সুবর্ণা এ্যাড মেকার , শামসুল হক চিত্রনাট্য লেখক । তাহসিন, ইষানা , মেহজাবিনরা পণ্য নন , পণ্যের বিক্রেতা । এরা একই কর্পোরেট বাণিজ্যের এক একটি অনুসঙ্গ । সকলেই একটি মাত্র উৎপাদন থেকে বিক্রি প্রক্রিয়ার বিভিন্ন পর্যায়ে জড়িত !
দর্শকদের দেহ কামনাঃ
আগেই বলেছি , যেখানেই মানুষ থাকবে সেইখানেই সেক্স থাকবে। হয় প্রকাশ্যে নয় গোপনে। এইটা মানুষের মৌলিক চাহিদা । এর ডিমান্ডের শেষ নাই । তাই সাপ্লাইএর ও শেষ নাই। যারা " মা বোনেরা বেশ্যা হয়ে গেলো " বলে বোল তুলেছে তাদের জ্ঞাতার্থে বলি, ২০০০ বছর আগেও বঙ্গে বেশ্যালয় ছিল। তখন লাক্স চ্যানেল আই ছিলো না । কিন্তু আমার-আপনার বাপ, ভাইয়েরা ছিলো বলে ডিমান্ড ছিলো । তাই সাপ্লাইও ছিলো । ইট ইজ দ্যাট সিম্পল। লাক্স চ্যানেল আই ডিমান্ড তৈরী করছে না । তৈরী হয়ে থাকা ডিমান্ড নিয়ে ব্যবসা করছে শুধু ।
সেক্স হলো বর্তমান বিশ্বে সবচেয়ে বেশি বিক্রিত পণ্য । হয় সেক্স , না হয় সেক্সুয়ালিটি। ৪ বিলিওন মানুষ এর ক্রেতা অথবা বিক্রেতা ( এক তৃতীয়াংশ মানুষকে শিশু ধরে নিয়ে বাদ দিলাম) সারা বিশ্ব জুড়ে । তাহলে বুঝেন এর ডিমান্ড কেমন?
লাক্স, ইউনি লিভার এর নতুন করে ডিমান্ড তৈরী করার দরকারই নাই , দরকার শুধু এই ডিমান্ডের সাথে তাদের পণ্য গুলাকে এলাইন করা , আমাদের বুঝানো যে তাহাদের পণ্য , মাখিলেই বন্য!
তার মানে কি তারা নারীকে পণ্য করছে না? অবশ্যই করছে । শুধু নারী কেন, তারা পুরুষ ও বাচ্চাদেরও পণ্য করছে । কেন খেয়াল করেন নাই? ২০০০ বছরে হয় নাই , আজ কাল হঠাৎ করেই বাচ্চাদের ত্বক শুষ্ক আর খসখসে হয়ে উঠেছে ? যেই দিন থেকে লাক্স বেবি লোশন ক্রিম নিয়ে মাঠে নেমেছে সেইদিন থেকে আমাদের শিশুরা ত্বকের আর্দ্রতা হারাচ্ছে ?
আগেই বলেছি , নতুন ক্রেতার বাজার তৈরী করতে না পারলে এই সর্বগ্রাসী প্রফিট ওরিয়েন্টেড কর্পোরেট পুঁজিবাদ বেঁচে থাকতে পারে না । মা বোনের , কিশোর কিশোরীদের মার্কেট স্যাচুরেটেড হয়ে গেছে , এখন তাই বাচ্চার চামড়া দরকার , ব্যবসার জন্য !
আমি খুবই দুঃখিত, এই পর্বেও শেষ করতে পারলাম না । পরের পর্বে আশা করি শেষ করতে পারবো ।
পড়ুন শেষ পর্ব ।