somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

এ জীবন শালিকের জীবন ....

০৪ ঠা ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ রাত ১:৩৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :






আজকের দিনটা মনোরম কি না বোঝা যাচ্চে না । উত্তরী হাওয়া শীতের আগমনী খবর বয়ে এনেছে। সূর্য্যের তাপ প্রখর হলেও রোদে বসে থাকতে ভালো লাগছে । সূর্য্যের তীব্রতা আর একটু একটু হিমেল বাতাস দুয়ে মিলে মাখামাখি। আকাশটাও স্বেদহীন নীলাভ। শরতের শেষে হেমন্তের সাঁজ সাঁজ রব । দেখে মনে হচ্ছে প্রকৃতি পরিবর্তনের এক মহা আনন্দের মহড়া চলছে।

দু`টো শালিক উঠোনের ঠিক মাঝখানে পড়ে থাকা এক টুকরো টোস্ট বিস্কুট নিয়ে তুমুল ঠুকাঠুকিতে ব্যস্ত । তাদের হুড়োহুড়ি ব্যস্ততা দেখে মনে হচ্ছে এক্ষুনি শত্রুপক্ষের কেউ এসে ছিনিয়ে নেবে। একটি শালিক বারে বারে এদিক ওদিক ঘাড় ঘুরিয়ে দেখছে। মনুষ্য জাতির কেউ আছে কিনা। সব দিক দিয়ে সদা সর্তক । তারা এখন আত্মরক্ষা আর খাবার আহরণের কঠিন যুদ্ধে নেমেছে। যে কোন মূল্যে জয়ী তাদের হতেই হবে।

উঠোনের দখিনের কোনায় পেয়ারা গাছটার নীচে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন রাত জাগা কুকুর। প্রশান্তিময় ঘুম দেখে মনে হচ্ছে নিজের দায়িত্বটুকু খুব বিস্বস্ততার সাথে পালন করেছে।এখন সে ভার মুক্ত, নিশ্চিন্ত। কুকুরের রাত জাগা ক্লান্তি জানান দিচ্ছে তার নি:শ্বাসের ভারে উঠা নামা পেটের অবস্থান দেখে ।চোখ বন্ধ চার পা এলিয়ে কি নিশ্চিন্তেই না ঘুমাচ্ছে।

আজ বাড়িটা সত্যিই অনেক নিরিবিলি । কেউ নেই। নির্জন নি:শব্দ। আছে শুধু তিন প্রকারের তিনটা প্রানী । তারা যে যার অবস্থানে চুপচাপ। আচ্ছা, নির্জনতা কি প্রশান্তির প্রতীক নাকি নি:সংগতার আরেক নাম।তবে ঠিক এই মূহুর্তে বাড়িটার নির্জন পরিবেশ দু`টো শব্দেরই যথার্ততা প্রকাশ করছে। যেমন- নির্জনতার জন্য জন্য কুকুরটা খুব নি:শ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে আর শালিক দু`টোর জন্য নির্জনতা যুদ্ধে জয়ী হবার অপার আনন্দ। আবার অন্যদিকে, নির্জনতা আমার জন্য নি:সংগতার কঠিন ভয়াবহ রুপ। কুকুরের প্রশান্তিমাখা ঘুম বা শালিকের যুদ্ধ জয়ের আনন্দ আমাকে কোনভাবেই একাকিত্ব থেকে মুক্তি দিচ্ছে না।

আনমনে হেসে উঠলো তনয়া । দিনে দিনে আমি পাগল নাকি দার্শনিক হয়ে যাচ্ছি। কি সব আবোল তাবোল ভাবছি । শালিকের কাজ শালিক আর কুকুরের কাজ কুকুর করছে। তাতে আমার কি ! নিজেকে নিয়ে পরিবার কে নিয়ে আমার কত ভাবনা। অসহায় বিধবা মা আর ছোট দু`টো বোন। কিভাবে আমি তাদের সুন্দর একটা ভবিষত উপহার দিবো।কিভাবে দু:খিনি মায়ের মুখে হাসি ফুটাবো। তাদের সকল চাওয়া পাওয়া এখন শুধু আমারই কাছে। এখন আমি নিজেকে নিয়ে না যতটুকু ভাবী তার চেয়ে বেশি ভাবি আমার পরিবার নিয়ে । তাদের ভবিষৎ নিয়ে। সামনে ধেয়ে আসা কঠিন বাস্তবতা নিয়ে।

তনয়া আজ বাড়িতে একা । তার মা আর ছোট দুবোন মামার বাড়ি গেছে কিছু টাকা ধার আনতে । আসলে ধার না ধারের উছিলায় গেছে টাকা চাইতে । ধার করলে সেটা পরিশোধ করার ক্ষমতা তনয়ার মায়ের নেই । তনয়ার বাবা মারা যাওয়ার পর তার মা তিন মেয়ে নিয়ে খুবি অর্থ কষ্টে দিন যাপন করছেন । অল্প পড়াশুনা জানা তনয়ার মা পাড়ার ছোট ছোট ছেলে মেয়েদের প্রাইভেট পড়িয়ে সংসারের ব্যয় কিছুটা নির্বাহ করেন । তনয়াকে পড়াশুনা করানোর জন্য তার মাকে অনেক কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে ।

মোবাইল ফোনের শব্দে তনয়ার ভাবনার ছেদ পড়ে । ফিরে আসে বাস্তব জীবনে।ঘরের মধ্যে উঠে গিয়ে সে ফোনটা রিসিভ করে । তনয়ার মায়ের ফোন ।
...... হ্যালো মা... বল ।
... ... কি করছিস? ... কত করে আমাদের সাথে আসতে বললাম আসলি না । তোর মামী তোর কথা বলছিল । শোন তোর মামা কিছু টাকা দিয়েছে । আমি কি তোর যাওয়ার জন্য বাসের টিকিট কেটে নিয়ে আসবো ?
...... ঠিক আছে মা নিয়ে আস।
...... আচ্ছা রাখি।

মোবাইল ফোনটা রাখতেই তনয়ার পড়ার টেবিলের দিকে চোখ পড়ে । গতকাল কুরিয়ার সার্ভিসে শিহাব পাঠিয়েছে । নিমাই ভট্রাচার্য্যের" মেম সাহেব" উপন্যাসটা । সেই কিশোর বেলায় চুরি করে পড়া প্রেমের প্রথম উপন্যাস । দ্রুত শেষ করাই হয়তো সেই তৃষ্ণাটা মনের মাঝে এখনও রয়ে গেছে। এক সময় রাজশাহীর সোনা দীঘির মোড়ের বই বিপণী গুলোতে তনয়া বইটা কত যে খুঁজেছে কিন্তু বার বার হতাশ হয়েছে । সেই গল্প শিহাবকে অনেক বার শুনতে হয়েছে ।

বইটা হাতে নিয়েই তনয়ার গাল গড়িয়ে একটা স্মিত হাসি খেলে গেল। এক সময় এটা পাওয়ার জন্য কত আকুলতা ছিল তার মনের ভেতর । না পাওয়ার হতাশাও কম ছিলনা । কিন্তু যখন পাওয়ার আকুলতা বোধ তেমন থাকেনা হতাশা যখন শূন্যে অদৃশ্য হয় তখন আর পাওয়ার ব্যকুলতা কাজ করে না। প্রত্যাশিত জিনিস যদি যথাসময়ে পাওয়া যায় তখন আনন্দটাও দিগুন হয় । পাওয়ার উচ্ছ্বাস টা বুকের গভীর থেকে আসে । আবার অসময়ে পেলেও ভাল লাগে কিন্তু পাওয়ার উচ্ছ্বাস টা থাকে দীর্ঘশ্বাসের মতো । কষ্ট করে সুখি হওয়ার মেকি চেষ্টা । তনয়ার বেলাও ঠিক একি রকম হল ।

এই সব সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে তনয়া বইটা বুকের উপর আলতো করে চেপে ধরে বালিশে মাথা রাখে । উদাস বদনে ঘরের দেয়ালের দিকে তাকিয়ে থাকে । দীর্ঘশ্বাসকে আড়াল করে আপন মনে নিজের সাথে কথা বলে । কেন মানুষের জীবন এমন হয় । কেন মানুষ অনিচ্ছা সত্বেও সময়ের কাঁটায় আটকে যায়? কেন সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনা নিজের ইচ্ছা মত ??

মায়ের এ টানা পোড়েনের সংসারে একটু সাহায্য করার জন্য তনয়া অনার্স ফাইনাল পরিক্ষার পর চাকরির জন্য একটি ফার্মে আবেদন করেছিল। সেখান থেকে তার ডাক এসেছে। জরুরী ভিত্তিতে যোগ দিতে বলেছে। এমন সুযোগ তনয়া হাত ছাড়া করতে রাজি না।যদিও অনেক দুরে বলে তার মা প্রথম দিকে আপত্তি করেছিলেন কিন্তু মেয়ের আগ্রহ আর সংসারের কথা চিন্তা করে তিনি রাজি হয়ে গেছেন। হয়তো মা হয়েও বিষয়টা স্বার্থপরের মতোই হয়ে গেছে। যে বয়সে মেয়েকে বিয়ে দিয়ে ঘর সংসার গুছিয়ে দেওয়ার কথা সেই বয়সে মেয়েকে পাঠাচ্ছে টাকা রোজগার করাতে । তনয়াও মায়ের কষ্ট টা বুঝেছিল বলেই সে ভেতর ভেতরের নিজেকে শক্ত করতে পেরেছে।লুকাতে পেরেছে নিজেকে।

বই টার সাথে শিহাব একটা চিঠি পাঠিয়েছে । আর একবার নতুন করে ভাবার জন্য । কিন্তু তনয়ার ভাবার আর কিছু নেই। নিজের সুখের জন্য দুঃখিনী মা আর ছোট ছোট বোনদের ভবিষৎ অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিতে পারবেনা। মায়ের স্বপ্ন পূরণই এখন তনয়ার একমাত্র এবং প্রধান লক্ষ্য । নিজের স্বপ্ন সাধ বিসর্জন দিয়ে আজ রাতের বাসেই তনয়া রাজশাহী ছেড়ে কুমিল্লার পথে পা বাড়াবে।শুরু করবে নতুন এক সংগ্রামী জীবন সেখানে আসুক যত প্রতিবন্ধকতা প্রতিরোধ করবে তা যে কোন মূল্যেই। আনমনে শিহাবের চিঠিটা তনয়া চোখের সামনে মেলে ধরে ....

::::::::: ভেবে দেখ আরো একবার । তোমার সবটুকু ভার কাধে নিতে চাই। সহযাত্রী হতে চাই তোমার চলার পথের। তবু যদি সাথে নিতে না চাও মনে রেখ আমার হৃদয় ঘরের খোলা দরজায় সব সময় তোমাকে স্বাগত জানাই । যেদিন মন চায় চলে এসো । তোমার ফিরে আসার অপেক্ষায় ............

তনয়ার মনের অজান্তে দুচোখের কোল ঘেঁষে গড়িয়ে পড়ে অশ্রু ধারা । আর মনে মনে ভাবে এখন আমি একটু ক্ষুধার্ত শালিক। খাবার সংগ্রহের যুদ্ধে নেমেছি। জয়ী আমাকে হতেই হবে। তনয়ার মনের গভীর থেকে বড় একটা দীর্ঘনিশ্বাসের সাথে বেরিয়ে যায় " এ জীবন শালিকের জীবন। "



সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ রাত ১:৫৮
৩০টি মন্তব্য ২৯টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

যেকোন বাংগালীর ইন্টারভিউর সময়, 'লাই-ডিটেক্টটর' যোগ করে ইন্টারভিউ নেয়ার দরকার।

লিখেছেন সোনাগাজী, ০৫ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:০৭



আপনার এনলাকার এমপি, প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী কামাল সাহেব, যেকোন সেক্রেটারী, যেকোন মেয়র, বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান, বিএনপি'র রিজভী, আওয়ামী লীগের ওয়ায়দুল কাদের, আপনার থানার ওসি, সীমান্তের একজন বিজিবি সদস্য, ঢাকার... ...বাকিটুকু পড়ুন

ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করা সকলের দায়িত্ব।

লিখেছেন নাহল তরকারি, ০৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:৩৮



এগুলো আমার একান্ত মতামত। এই ব্লগ কাউকে ছোট করার জন্য লেখি নাই। শুধু আমার মনে জমে থাকা দুঃখ প্রকাশ করলাম। এতে আপনারা কষ্ট পেয়ে থাকলে আমি দায়ী না। এখনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

তাবলীগ এর ভয়ে ফরজ নামাজ পড়ে দৌড় দিয়েছেন কখনো?

লিখেছেন লেখার খাতা, ০৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:২৬


আমাদের দেশের অনেক মসজিদে তাবলীগ এর ভাইরা দ্বীন ইসলামের দাওয়াত দিয়ে থাকেন। তাবলীগ এর সাদামাটাভাবে জীবনযাপন খারাপ কিছু মনে হয়না। জামাত শেষ হলে তাদের একজন দাঁড়িয়ে বলেন - °নামাজের... ...বাকিটুকু পড়ুন

এখনো নদীপারে ঝড় বয়ে যায় || নতুন গান

লিখেছেন সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই, ০৫ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:২০

এ গানের লিরিক আমাকে অনেক যন্ত্রণা দিয়েছে। ২৪ বা ২৫ এপ্রিল ২০২৪-এ সুর ও গানের প্রথম কয়েক লাইন তৈরি হয়ে যায়। এরপর ব্যস্ত হয়ে পড়ি অন্য একটা গান নিয়ে। সে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ফেতনার সময় জামায়াত বদ্ধ ইসলামী আন্দোলন ফরজ নয়

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০৫ ই মে, ২০২৪ রাত ১১:৫৮



সূরাঃ ৩ আলে-ইমরান, ১০৩ নং আয়াতের অনুবাদ-
১০৩। তোমরা একত্রে আল্লাহর রজ্জু দৃঢ়ভাবে ধর! আর বিচ্ছিন্ন হবে না। তোমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ স্মরণ কর।যখন তোমরা শত্রু ছিলে তখন তিনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×