আমি আমার প্রিয় ঢাকা শহরকে নিয়ে ১টা প্রবন্ধ লেখব। আমার জন্ম, বেড়ে উঠা এই শহরে, শহরটাকে আমি অনেক ভালোবাসি। শহরের অনেক সমস্যা থাকলেও এর যে ঐতিহ্য, ইতিহাস আছে এটা পৃথিবীর অনেক শহরের নেই। গুপ্ত যুগে বুড়িগঙ্গার পাড়ে ১টা নৌঘাঁটি থেকে যে শহরের শুরু আজকে সে শহর মেগাসিটিতে পরিনত হয়েছে। মাঝখানে শহরটা পার করে এসেছে মোঘল শাসনে সমৃদ্ধ ১সময়। দেখেছে ব্রিটিশ আমলে নানা উত্থান-পতন, ঘাটি হিসেবে কাজ করেছে নানা আন্দোলন সংগ্রামের। পাকিস্তান পিরিয়ডে এই অঞ্চলের রাজধানী থেকে অবশেষে আমাদের মহান স্বাধীনতার পর এটা হল স্বাধীন দেশের রাজধানী। অনেক ইতিহাসের নীরব সাক্ষী ঢাকার বর্তমান অবস্থাটা খুব ১টা আশাব্যাঞ্জক নয়। ২০১১ সালে ঢাকার জনসংখ্যা দেড় কোটির কাছাকাছি। জনসংখ্যার ঘনত্ব , আবাসনের ঘনত্ব দিনদিন বেড়েই চলছে। বিভিন্ন বছরের পরিসংখ্যান দেখলে বুঝা যায়, আমাদের শহরটা আসলে কতটা বাজেভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ১৯৯১-২০০১ সাল পর্যন্ত ঢাকা শহরে আবাসন বৃদ্ধি হয়েছে ৮০ শতাংশ। সেই হারে বাড়ে নি শহরের আয়তন। (১৪৬৩ বর্গকিমি থেকে ১৪৫৯ বর্গকিমি হয়েছে! আদমশুমারী বলে শহর একটু ছোট হয়েছে!!) জনসংখ্যার ঘনত্ব সেই ১০ বছরে ৩৯৯০ থেকে ৫৮৩১ হয়েছিল!!! জানি না ২০১১ সালের আদমশুমারীর ডাটাগুলো বের হলে পড়ে সুস্থ থাকতে পারব কিনা। ঢাকার অধিবাসীদের দম ফেলার একটু জায়গার খুব অভাব। বন্ধের দিনে কই ঘুরতে যাবো সেটা নিয়ে মস্তিস্কটা অনেক বেশি ব্যবহার করতে হয়। শর্ট পীচ ক্রিকেট আর পিসিতে গেম খেলে বেড়ে উঠা ঢাকার শিশুরা জানে না খোলা মাঠে প্রান খুলে দৌড়ানোর উল্লাস, প্রেমিক-প্রেমিকারা ফাস্টফুডে ডেট মারতে মারতে হয়ত ১দিন ভুলে যাবে অবারিত উদ্যানে যুগে যুগে আঁকা প্রেমময় সব স্বপ্ন ছবির গল্প!!! ১টা শহরের জন্য যতটা বিনোদনমুলক ব্যবস্থা থাকা উচিত তার তুলনায় অনেক পিছিয়ে আছে ঢাকা। উদ্যান প্রয়োজনীয়তার তুলনায় রীতিমত নগন্য। ঢাকা সিটি করপোরেশনের নিয়ম অনুসারে প্রতিটা ওয়ার্ডে পার্ক থাকার কথা থাকলেও সেগুলার অস্তিত্ব খুজে পাওয়া দুস্কর। যেগুলো আছে সেগুলোর অবস্থা শোচনীয়। উদ্যানের অভাব শুধু শহরের অধিবাসিদের বিনোদন বিঘ্নিত করছে না, পর্যাপ্ত উদ্যান না থাকায় শহরে সবুজ এলাকা বলতে গেলে নেই। যা অবশিষ্ট সবুজ আছে তা ধ্বংস করে ঘর-বাড়ি বানানো হচ্ছে। সবুজের অভাবে ঢাকার বাতাসে বেড়েই চলছে বিষ। আজকে ঢাকার বাতাসে শ্বাস নেয়া যায় না। যোগাযোগের পর্যাপ্ত রাস্তা ও যানবাহনের খুব অভাব। যোগাযোগ ব্যবস্থা আধুনিক করার জন্য উদ্যোগ খুব ১টা নেয়াও হয় না। নিতে গেলেও কেন জানি খুব ১টা সফল হয় না। খিলগাঁও ফ্লাই-ওভার হল, এলাকার মানুষের দুর্গতি কিছুটা লাঘব করল। বন্ধ হয়ে গেল, দুর্গতি আগের চেয়ে বাড়িয়ে দিয়ে গেল!! বেগুনবাড়ি লেক প্রকল্প ২০১১ সালে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও এখনও শেষ হওয়ার নাম-গন্ধ নাই। মেট্রোরেল নিয়ে কত কাহিনী হয়ে গেল। বিমান বাহিনীর এমন দাবিও শুনতে হল, মহান সংসদ ভবনের ল্যান্ডস্কেপের উপর দিয়ে মেট্রোর লাইন নিতে হবে। নিরাপত্তার কারনে পুরানো বিমানবন্দরে অবস্থিত তাদের ঘাটির পাশ দিয়ে নেয়া যাবে না! দেশের প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত তাদের সমর্থন দেয়! শেষ পর্যন্ত আদালতে গিয়ে রায় আনতে হয়েছে-সংসদ ভবন ১টা ঐতিহাসিক নিদর্শন!!!! তাই অত্র এলাকায় মেট্রো নির্মাণ হবে না!! সংসদ ভবনের সৌন্দর্য রক্ষার জন্য কোর্টে যাওয়া লাগে, আন্দোলন করা লাগে। মহান স্থপতি লুই কান বেচে থাকলে শোকে হয়ত হৃদরোগে আক্রান্ত হতেন!! সেই সময় দেশের স্থপতি, পরিকল্পনাবিদ, বিভিন্ন পেশাজীবি, সুশীল সমাজ সহ সচেতন নাগরিকরা প্রতিবাদ না করলে এই স্বৈরাচারী উদ্যোগ হয়ত বাস্তবায়ন হয়ে যেত।
তেজগাঁও পুরানো বিমানবন্দর প্রসঙ্গে আসা যাক। এই বিমানবন্দরটি ১৯৪১সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। ২য় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশরা রয়াল ইন্ডিয়ান এয়ারফোরসের ঘাটি হিসেবে এটা নির্মাণ করে। যুদ্ধকালীন সময়ে ব্রিটিশ ও মার্কিন বাহিনী বিভিন্ন অভিযানে এই ঘাটি ব্যবহার করে। পাকিস্তান আমলে এই বিমানবন্দর বেসামরিক বিমানবন্দর হিসেবে ব্যবহৃত হয়। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বিমানবন্দর হিসেবে এর ব্যবহার অব্যহত থাকে। ১৯৮১সালে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর (প্রাক্তন জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর) নির্মাণের পর এই বিমানবন্দর বেসামরিক বিমানবন্দর হিসেবে পরিত্যাক্ত হয়। তখন থেকে এটা বিমানবাহিনীর দখলে আছে। বর্তমানে এখানে বিমানবাহিনী ও আর্মি এভিয়েশনের কার্যক্রম চলে। এখানে পুরানো বিমানবন্দর প্রসংগ টেনে আনার কারনটা হয়ত বুঝতে পারবেন যদি আপনি একটু চোখ বন্ধ করে জায়গাটার গুগল আর্থ ভিউ চিন্তা করেন। (যাদের এই কষ্ট করার আগ্রহ নাই কিন্তু ব্যাপারটা বুঝতে চান, তাদের জন্য আমি গুগল আর্থ থেকে নেয়া ১টা ছবি দিয়ে দিলাম!) আমাদের গ্যাঞ্জামের শহর ঢাকার মাঝে এত বড় ১টা জায়গা প্রায় অর্থহীন কাজে দেয়াল দিয়ে ঘিরে অব্যবহৃত অবস্থায় ফেলে রাখা হয়েছে। এই জায়গায় আর কিছু না হোক কয়েকটা সংযোগকারী রাস্তা হলেও বিজয় সরনীর উপর চাপ অনেকাংশে লাঘব হয়। বিমানবন্দর ও ক্যান্টনমেন্টের কারনে আমাদের শহরের অনেকটুকু অংশ বিচ্ছিন্ন অবস্থায় আছে। জানি না, পৃথিবীর কোন দেশে শহরের ভিতরে প্রতিরক্ষার দোহাই দিয়ে এভাবে ক্যান্টনমেন্ট স্থাপন করে নাগরিকদের সুবিধা হরন করা হয় নাকি। আশেপাশের এলাকাগুলোর (নাখালপাড়া, আগারগাও, মোহাম্মদপুর, তেজগাও ইত্যাদি) ঘনত্ব ক্রমশ বৃদ্ধি পেলেও ক্যন্টনমেন্টের ঘনত্ব খুব ১টা বৃদ্ধি পায় না। শহরের ভিতরে সামরিক লোকজনের আবাসন দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। গড়ে উঠছে নিউ ডিওএইচএস এর মত এলাকা। যাই হোক সামরিক আবাসন নিয়ে আমার খুব ১টা অনুযোগ নেই, যদিও আমি বিশ্বাস করি ক্যন্টনমেন্ট শহরের বাইরে সরিয়ে নেয়া উচিত। আমাদের শহরের স্বার্থে এই মুহুরতে খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে পুরানো বিমানবন্দরের ৪০০ একর জায়গা। শহরের ঠিক হৃদপিণ্ড বরাবর ১টা বিমান ঘাটি বসানোর নজির পৃথিবীর কোন দেশে আছে কিনা জানি না। তবে এই জায়গায় যে ১টা বিমান ঘাটির চেয়ে ১টা Breathing Space বেশি গুরুত্বপূর্ণ, এটা বোঝার জন্য বিশেষজ্ঞ হওয়া লাগে না। পুরানো বিমানবন্দরের জায়গায় ১টা আরবান পার্ক হতে পারে যেটা হবে শহরের ফুসফুস। শত শত গাছ থাকবে, নগরীর বাতাস অনেকাংশে বিশুদ্ধ হয়ে উঠবে। পার্কটার ৪০০ একরে ফুটে উঠতে পারে ঢাকা ও পুরা বাংলাদেশের ইতিহাস। শহরবাসী বন্ধের দিন এই জায়গাটায় যেতে পারবে, শিশুদের খেলার মাঠের স্বপ্ন সত্য হবে। হতে পারে বেশ কয়েকটা জাদুঘর। দেখাতে পারি আমাদের কৃষ্টি , সংস্কৃতি। ১টা বিমানের হ্যাঙ্গার হয়ে উঠতে পারে ১টা জাতির স্বপ্নের উঠান, ১টা শহরের ফুসফুস। ঢাকাকে ভবিষ্যতের জন্য বাসযোগ্য করতে আমাদের আরো অনেক কিছু করা লাগবে, অনেকাংশে ঢাকার বিকেন্দ্রিকরন করা লাগবে। কিন্তু বর্তমান অধিবাসিদের নাগরিক সুবিধা প্রদানের লক্ষ্যে এই প্রজেক্টটার মত আরও কয়েকটা কাজ হওয়া দরকার। এই জায়গাটার ভিতর দিয়ে সংযোগকারি কয়েকটা সড়ক টানলেই ঐ এলাকার যোগাযোগ অনেক উন্নত হবে। (যেমনঃ জাহাঙ্গির গেট থেকে আগারগাও সংযোগ সড়ক) এরকম অনেক আইডিয়া আসতে পারে যা আমাদের শহরের জন্য দরকারি।
কানাডার টরেন্টোর ডাউনস ভিউ পার্ক (http://en.wikipedia.org/wiki/Downsview_Park) এর ইতিহাসটা অনেকটা এইরকম। এটা আগে বিমানবাহিনীর ঘাটি ছিল। পরবর্তীতে বিমানবাহিনী ও শহর কর্তৃপক্ষ আলোচনা করে জায়গাটাকে আরবান পার্কে রুপান্তরের সিদ্ধান্ত নেন। পার্কের বিভিন্ন মিউজিয়াম ও খেলাধুলা দেখতে প্রতিদিন অনেক মানুষের ভিড় হয়। আশা করব আমাদের বিমানবাহিনীও জনস্বার্থে জায়গাটাকে নগরের জন্য ছেড়ে দিবে। ধ্বংসের পথের এগিয়ে চলা ঢাকার জন্য এটা হয়ত শেষ ভরসা। এভাবে চলতে থাকলে ২০২০ সাল নাগাদ শহরে কেউ থাকতে পারবে না। আমরা আমাদের শেষ সুযোগটা কি নিব না আমাদের প্রিয় নগরীর ধ্বংসের জন্য অপেক্ষা করব??

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




