somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

নাস্তিকতা-প্রাচীন ভারতীয় ধর্ম ও দর্শনে।

১১ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১২ ভোর ৬:৫২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

পাশ্চাত্যের ঐতিহাসিকদের দাবি অনুসারে নাস্তিকতা বা Atheism টার্মটার উৎপত্তি ১৬শ শতাব্দিতে, যদিও ১৮শ শতাব্দির আগ পর্যন্তও কেউ ধর্মবিরোধী কথা বলে কল্লা নিয়ে বাসায় ফিরতে পারত না!!! (গ্রীক-রোমান সাম্রাজ্যে অনেকে নাস্তিকতাধর্মী মতবাদ প্রকাশ করেছেন যেমনঃ ডায়াগোরাস, সক্রেটিস...কিন্তু সেই যুগে কখনও তা সেইরকম ব্যপ্তিতে আসে নি) ইতিহাসের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই, খ্রীস্টের জন্মের ৫-৬০০ বছর পূর্বে ইউরোপের লোকজন যখন বর্বর প্যাগান বিশ্বাসে নিমগ্ন ছিল, তখন আমাদের এদিকে দার্শনিকগণ সরে এসেছেন সৃষ্টিকর্তা ঈশ্বরের অস্তিত্বের ধারনা থেকে, প্রচার করেছেন মানবতার বাণী। বৌদ্ধ, জৈন বিশ্বাসে, হিন্দু ধর্মের কিছু কিছু দর্শনে (সাংখ্য, মিমাংসা ইত্যাদি মতবাদ), চীনাদের তাওবাদ, চার্বাক দর্শন ইত্যাদি অনেক ক্ষেত্রে উঠে এসেছে মানবতাবাদ, যুক্তিবাদ, সংশয়বাদিতার মত আধুনিক চিন্তা-ভাবনার বিষয়গুলো। অনেক ক্ষেত্রে এসব মতবাদে নিয়ে এসেছেন আধ্যাত্মিকতা। অনেক ক্ষেত্রে আবার এসেছে স্বর্গ- নরক ও দেব-দেবি। কিন্তু শক্তিশালী পরাক্রমশালী অত্যাচারী ঈশ্বর এই মতবাদগুলোতে বেশ অস্তিত্বহীন। দেখি আমরা মতবাদগুলো কে কি বলে!!!!

বৌদ্ধ দর্শন বুদ্ধদেবের শিক্ষায় অবশ্য কোথাও সর্বশক্তিমান ঈশ্বর খুজে পাওয়া যায় না। বুদ্ধের শিক্ষামতে মানব জীবনের মুল উদ্দেশ্য হল নির্বাণ লাভ। নির্বাণ কি? নির্বাণ মানে নিভে যাওয়া। প্রদীপ নিভে গেলে যেমন কিছু থাকে না, মানুষ নিভে গেলেও কিছু থাকে না!! মানুষ বারবার জন্ম নিবে, পুন্য করবে শুধুমাত্র নিজের সত্তাকে বিলুপ্ত করার জন্য!!! বড় কঠিন কথা। বর্তমান যুগে আমরা পুনর্জন্মে বিশ্বাস না করলেও মানুষের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে তার সত্তার বিলোপ... এটা নাস্তিক মাত্রই বিশ্বাস করেন!!
আমি মারা যাওয়ার সাথে সাথে আমি বলে কিছু থাকবে না এটা আমাদের পক্ষে মেনে নেয়াটা যেমন খুব কষ্টকর, সেই আমলেও লোক জন খুব ১টা মেনে নিতে চায় নি! পরবর্তীতে নাগার্জুন ও অন্যান্য ভিক্ষুরা নির্বাণের ব্যাপারটাকে জটিল থেকে জটিলতর করে উপস্থাপন করতে থাকেন। নির্বাণ লাভের পর মানুষ করুনা, নিরাত্মা ইত্যাদি লাভ করে!!! সকৃদাগামী, অনাগামী, স্ব- উপাধী, নিরুপাদী ইত্যাদি অনেক ধরনের নির্বাণ পন্থা উদ্ভাবিত হয়!!! দেব দেবী স্বর্গ নরক ইত্যাদি ধারনা অনুপ্রবেশ করতে থাকে! বৌদ্ধ বিশ্বাস অনুসারে বিশ্ব ব্যবস্থা চিরন্তন! এখানে কোন সৃষ্টিকর্তা নেই! বৌদ্ধ ধর্মের দর্শন মানবতাবাদি। সহিংসতা, জীবহত্যা, হানাহানি এসবের বিরুদ্ধে বৌদ্ধ প্রচারক ও দার্শনিকগণ অবস্থান গ্রহন করেন। গৌতম বুদ্ধের পন্থা হল মধ্যম পন্থা!

জৈন দর্শনঃ জৈন ধর্মের ইতিহাস অনেক বেশি প্রাচীন। এই ধর্ম সম্পর্কে যতদুর জানা যায়, ভারতে আর্য-আগমনের পূর্বেই এই ধর্মের অনেক রীতি-নীতি ততকালীন সমাজে প্রচলিত ছিল। তবে জৈন ধর্মকে প্রাতিষ্ঠানিক রুপ প্রদান করেন পার্শ্বনাথ ও মহাবীর। মহাবীর গৌতম বুদ্ধের সমসাময়িক। জৈন ধর্মের বিশ্ব ধারনায় দেখা যায় বিশ্ব জগত আত্মা ও পদার্থ এই ২ধরনের বস্তু দিয়ে গঠিত। বিশ্ব জগত অনন্ত ও এর কোন সৃষ্টি নেই। জৈন ধর্মেও সর্বশক্তিমান সৃষ্টিকর্তা ঈশ্বরের ধারনা নেই। তবে জৈন ধর্ম কিছু দেবতা ও অতিপ্রাকৃত শক্তির কথা বলে। কিন্তু এরা মানুষের জগতে খুব ১টা প্রভাব ফেলতে পারে না। এরা বিশ্বজগত সৃষ্টির সাথেও জড়িত না। এরা শুধুমাত্র মানব আত্মাকে সঠিক নির্দেশনা দিতে পারে!!!! জৈন ধর্মের মুল নীতিও অহিংসা ও শান্তি। এই ধর্ম বিশ্বাস করে মানুষের নিজ চেষ্টায় আত্মার উন্নতি লাভ করতে পারে ও ইন্দ্রিয়ের উপর নিয়ন্ত্রন স্থাপন করতে পারে। এই ক্ষেত্রে কারও উপাসনার দরকার নেই। জৈন সমাজে শিক্ষার হার খুব উচ্চ। প্রাচীনকাল থেকেই এই ধর্মাবলম্বীরা শিক্ষায় অনেক বেশি অগ্রসর!

চার্বাক দর্শনঃ চার্বাক প্রাচীন ভারতের বস্তুবাদী দর্শন। চার্বাক শব্দটির ব্যুৎপত্তি, চার+বাক। যার অর্থ মিষ্ট্য বাক্য। এই দর্শন অনুসারে এই জগতের বাইরে আর কোন জগত নেই। এই দর্শন ঈশ্বর এমন কি আত্মার ধারনাকেও অস্বীকার করে। এই দর্শন অনুসারে মৃত্যুর পর কোন জীবন নেই। সৃষ্টিতত্ত্ব সম্পর্কে এর মতবাদ হচ্ছে সব কিছুই প্রকৃতি থেকে উৎপত্তি লাভ করেছে, কেউ এগুলো সৃষ্টি করে নি। তাদের মতে ধর্মও মানুষের সৃষ্টি। চার্বাক ৫ম-৭ম শতাব্দীর দিকে বেশ প্রচলিত ছিল। ধারনা করা হয় ১৫শ শতাব্দির শেষের দিকে এই মতবাদ বিলুপ্ত হয়ে যায়। কিন্ত চার্বাক দর্শনের ভিত্তি হিসেবে যে গ্রন্থকে ধরা হয়, সেই "বৃহস্পতি সুত্র" কালের অতল গহ্বরে হারিয়ে গিয়েছে। এজন্য চার্বাক সম্পর্কে বিস্তারিত ধারনা লাভ করা যায় না। এই গ্রন্থের কিছু খন্ডিত অংশ পাওয়া গিয়েছে যা থেকে আমরা এই বস্তুবাদী দর্শন সম্পর্কে জানতে পারি। সেই যুগে এই রকম মুক্তচিন্তার বিকাশ যথেষ্ট বিস্ময়ের বিষয়!

মিমাংসা মতবাদঃ এটা হিন্দু ধর্মের ১টা মতবাদ। মিমাংসা একটা সংস্কৃত শব্দ যার অর্থ হল তদন্ত। এই মতবাদ বেদ অনুসারে ধর্মকে মেনে নেয়...কিন্তু অস্বীকার করে ঈশ্বরের ও দেবতাদের অস্তিত্তে। এই মতবাদ অনুসারে ঈশ্বরের অস্তিত্তের স্বপক্ষে পর্যাপ্ত প্রমান অনুপস্থিত। এই মতবাদ অবশ্য বেদের অলৌকিকত্বে বিশ্বাসী। তাদের দাবি অনুসারে দেবতাদের অস্তিত্ব শুধুমাত্র বৈদিক শ্লোকে!!

সাংখ্য মতবাদঃ এটিও হিন্দু মতবাদ। ঋষি কপিল কর্তৃক প্রবর্তিত। এই মতবাদ দ্বৈত এ বিশ্বাসী। মতবাদ অনুসারে বিশ্বজগত ২টা জিনিস নিয়ে গঠিত প্রকৃতি ও পুরুষ। এখানে প্রকৃতি হল বস্তুজগত আর পুরুষ হল স্বত্বা। সাংখ্য মতবাদ ঈশ্বরের ধারনাকে অস্বীকার করে। তাদের মতে চির পরিবর্তনশীল বিশ্বজগতের আসলে স্থির ঈশ্বর থাকতে পারে না। এই মত অনুসারে ঈশ্বর যদি দয়ালু হয়ে থাকেন তাহলে পৃথিবীতে শুধু সুখী প্রানী থাকার কথা। সাংখ্য প্রশ্ন করে, মানুষের দুর্দশা নিয়ে। এই মতানুসারে সত্তা অনন্ত। যখনই তা শরীরের সাথে একত্রিত হয় তখন তা না পাপ দ্বারা দূষিত হতে থাকে। যখন তপস্যার মাধ্যমে সত্তা/পুরুষ প্রকৃতির বন্ধন থেকে মুক্ত হতে পারে, এই অবস্থাকে বলে মোক্ষ! মোক্ষলাভের পথ হচ্ছে সাধনা ও যোগ। সাংখ্য থেকে যোগ ও বেদান্তের উৎপত্তি। অনেকে দাবি করেন সাংখ্য থেকে বুদ্ধ ধর্মের উৎপত্তি হয়েছে। কিন্তু এর সপক্ষে তেমন কোন যুক্তি খুজে পাওয়া যায় না।

জানা যায়, প্রাচীন ভারতে এইরকম আরো অনেক মতামত প্রচলিত ছিল যার অধিকাংশের ভিত্তি নাস্তিকতা। এর মধ্যে অধিকাংশ মতামতের অস্তিত্ব বর্তমানে আর খুঁজে পাওয়া যায় না।
৪টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আরো একটি সফলতা যুক্ত হোলো আধা নোবেল জয়ীর একাউন্টে‼️

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৮:৪০



সেদিন প্রথম আলো-র সম্পাদক বলেছিলেন—
“আজ শেখ হাসিনা পালিয়েছে, প্রথম আলো এখনো আছে।”

একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে আজ আমি পাল্টা প্রশ্ন রাখতে চাই—
প্রথম আলোর সম্পাদক সাহেব, আপনারা কি সত্যিই আছেন?

যেদিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

হামলা ভাংচুর অগ্নিসংযোগ নয়, আমরা শান্তি চাই

লিখেছেন নতুন নকিব, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১০:১১

হামলা ভাংচুর অগ্নিসংযোগ নয়, আমরা শান্তি চাই

ছবি এআই জেনারেটেড

হামলা ভাংচুর অগ্নিসংযোগ প্রতিবাদের ভাষা নয় কখনোই
আমরা এসব আর দেখতে চাই না কোনভাবেই

আততায়ীর বুলেট কেড়ে নিয়েছে আমাদের হাদিকে
হাদিকে ফিরে পাব না... ...বাকিটুকু পড়ুন

তৌহিদি জনতার নামে মব সন্ত্রাস

লিখেছেন কিরকুট, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১১:৫৪




ছবিঃ অনলাইন থেকে সংগৃহীত।


দেশের বিভিন্ন স্থানে সাম্প্রতিক সময়ে ধর্মের নাম ব্যবহার করে সংঘটিত দলবদ্ধ সহিংসতার ঘটনা নতুন করে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। বিশেষ করে তৌহিদি জনতা পরিচয়ে সংঘবদ্ধ হয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুখ গুজে রাখা সুশীল সমাজের তরে ,,,,,,,,

লিখেছেন ডঃ এম এ আলী, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৪:০৫


দুর্যোগ যখন নামে আকাশে বাতাশে আগুনের ধোঁয়া জমে
রাস্তা জুড়ে কখনো নীরবতা কখনো উত্তাল প্রতিবাদের ঢেউ
এই শহরের শিক্ষিত হৃদয়গুলো কি তখনও নিশ্চুপ থাকে
নাকি জ্বলে ওঠে তাদের চোখের ভেতর নাগরিক বজ্র
কেউ কেও... ...বাকিটুকু পড়ুন

নজরুল পরিবারের প্রশ্ন: উগ্রবাদী হাদির কবর নজরুলের পাশে কেন?

লিখেছেন মাথা পাগলা, ২১ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৩:০১



প্রায় অর্ধশতাব্দী আগে কাজী নজরুল ইসলামের দেহ সমাধিস্থ করা হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদের পাশে। শনিবার বাংলাদেশের স্থানীয় সময় বিকেল ৪টে নাগাদ সেখানেই দাফন করা হল ভারতবিদ্বেষী বলে পরিচিত ইনকিলাব মঞ্চের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×