সময় সর্বদাই বহমান। কখনো স্থির থাকে না। সময় চলতে থাকে তার আপন গতিতে। কারো কথা শোনে না। কারো বাধা মানে না। সময় চলে গেলেও ধারণ করে রেখে যায় কিছু স্মৃতি। যা ইতিহাসের পাতায় চির অমলিন। সেই স্মৃতিগুলো আবার আমাদের টেনে নিয়ে যায় সেই হারানোর সময়ের কাছে। ২০১১ আমাদের কাছে অত্যন্ত স্মৃতিবহ একটি বছর।
স্বাধীনতার চলি্লশ বছর অতিক্রান্ত হলেও আমরা পারিনি যুদ্ধাপরাধীমুক্ত একটি বাংলাদেশ গড়তে। চলি্লশ বছর পর সেই '৭১-এর মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার কার্যক্রম ২০১১ সালে শুরু হয়েছে। তাই ২০১১ আমাদের আর এক '৭১-এর স্বাদ দিচ্ছে। কারণ '৭১ সালে আমরা পাকিস্তানিদের পরাজিত করেছিলাম। এ দেশ থেকে ওদেরকে বিতাড়িত করেছিলাম। কিন্তু ওদের সৃষ্ট দেশীয় দোসরদের আজ চলি্লশ বছর পর বিচারের সম্মুখীন করতে পারায় আমরা পাব রাজাকারমুক্ত একটি দেশ। তাই আমাদের স্বাধীনতার ইতিহাসে ২০১১ আর একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করল। শুধু বাংলাদেশ নয়। আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও ২০১১ অত্যন্ত ঘটনাবহুল একটি বছর। কেননা গোটা পৃথিবী যখন জঙ্গি তৎপরতায় অস্থির। পৃথিবীর সব মানুষই যখন নিরাপদ জীবন নিয়ে শঙ্কিত। ঠিক সেই মুহূর্তে বিশ্ব আলোচিত জঙ্গিনেতা ওসামাবিন লাদেন আমেরিকার সৈন্য কর্তৃক পাকিস্তানের ভূখন্ডে প্রাণ হারায়। যার ফলে পৃথিবীর বুকে শান্তির আলো ফুটে ওঠে।
২০১১ সালে সবচেয়ে ভয়াবহ ঘটনার জন্ম দিয়েছে মধ্যপ্রাচ্য। মধ্যপ্রাচ্যের প্রায় দেশেই শাসকগোষ্ঠীর ক্ষমতার মসনদ ছিল দীর্ঘদিনের। ক্ষমতাধর ব্যক্তিরা কোনোদিন একথা কল্পনাও করতে পারেনি যে, তাদের মসনদ একদিন জনতার বিক্ষোভে ভেঙে পড়বে। দীর্ঘদিনের সেই মজবুত মসনদে ভাঙন শুরু হয় ২০১১ সালের প্রথমদিকে। বছর শেষ হতে না হতে মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাসে বিশাল পরিবর্তন। জনতার রোষানালে পড়ে বেশ কয়েকজন দীর্ঘমেয়াদি স্বৈরাশাসক ক্ষমতা ছেড়ে পালায়। কিন্তু ভিন্ন ইতিহাসের জন্ম দিয়েছে শতাব্দির সবচেয়ে দীর্ঘদিনের রাষ্ট্রপ্রধান লিবিয়ার শাসক কর্নেল মুয়াম্মার গাদ্দাফি। তিনি ৪২ বছরের শাসক হওয়ার পরও ক্ষমতা ছাড়তে রাজি হননি। বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত টিকতে পারেননি। এক সময়কার লিবিয়ার মানুষের প্রিয় নেতা মুয়াম্মার গাদ্দাফিকে তার দেশের সাধারণ জনগণের হাতেই প্রাণ হারাতে হয়। মধ্যপ্রাচ্যের দেশে দেশে আন্দোলনের ঢেউ এখনো বইছে। হয়ত এ আন্দোলন এত তাড়াতাড়ি শেষ হওয়ারও নয়। তবে এর শুরুটা হয়েছে ২০১১-তে। এবং বড় ধরনের পরিবর্তনও ঘটিয়েছে। আগামী দিনের কোনো ইতিহাস হয়তো ২০১১-কে ছাড়িয়ে যেতে পারবে না। দীর্ঘ দশ বছর মার্কিন সৈন্যরা ইরাকে যুদ্ধ করার পর মার্কিন সৈন্যরা ইরাক ছেড়েছে। ইরাকে মার্কিনিদের যুদ্ধ কতটা সঠিক বা বেঠিক ছিল তা দেখার বিষয় নয়। তবে ২০১১-তে ইরাক বিদেশি সৈনিক মুক্ত হয়েছে। আবার মার্কিনদের সঙ্গে আফগানে তালেবানদের শান্তি আলোচনায় শুভবার্তা বয়ে এনেছে। যা দীর্ঘদিন পরে পৃথিবীর বুকে একটি শান্তিকামী সফল আলোচনা। যাই হোক বিশ্বজুড়ে ২০১১-কে শান্তি ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার বছর বলা যায়। তবে প্রাকৃতিক দুর্যোগও ছিল স্মরণে রাখার মতো। জাপানে কালের ভয়াবহ সুনামি। থাইল্যান্ডে বন্যা, সবশেষ ফিলিপাইনের বন্যায়ও আমরা অনেককে হারিয়েছি। অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। আবার ২০১১-কে আমরা অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের বছরও বলতে পারি। কেননা বাংলাদেশের শেয়ার ব্যবসায়ীদের কাছে এ বছরটি বিপর্যয়ের বছর। কারণ এ বছরেই অনেক ব্যবসায়ী সর্বস্ব হারিয়ে পথে বসেছে। শুধু বাংলাদেশ নয়। বিশ্বে শক্তিশালী দেশ আমেরিকায়ও অর্থনৈতিক বিপর্যয় নিয়ে আন্দোলন হয়েছে। যা ওয়ালস্ট্রিট আন্দোলন নামে পরিচিত।
২০১১ বাংলাদেশের সফলতার ইতিহাস যেমন জন্ম নিয়েছে। তেমনি ব্যর্থতার ইতিহাসও জন্ম নিয়েছে। ২০১১ বাংলাদেশের ইতিহাসে সড়ক দুর্ঘটনার ভয়াবহ এক রেকর্ড। আবার গুম-হত্যাও কম হয়নি। রয়েছে রাজনৈতিক অস্থিরতাও। বিরোধী দল ২০১১-এর মাঝপর্যায়ে সরকারের নানা কর্মকা-ের বিরোধিতা করে মাঠে নেমেছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি। বিরোধী দল চাচ্ছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দ্বারাই পরবর্তী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। অন্যদিকে সরকার তত্ত্বাবধায়ক ছাড়াই নির্বাচন করবেন। এ নিয়ে সৃষ্ট জটিলতা রাজনৈতিক মাঠে কম জল ঘোলা করেনি। কিন্তু এর কোনো সমাধান ২০১১-তে হয়নি। হয়ত এ জটিলতা ২০১২ সালেও ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করবে। এমন পরিস্থিতি শুধুমাত্র বাংলাদেশে নয়। বিশ্বের অন্যান্য দেশেও রয়েছে। ২০১১-এর সৃষ্ট জটিলতা তাদেরও বয়ে বেড়াতে হবে ২০১২-তে। উত্তর কোরিয়ার প্রেসিডেন্টের মৃত্যুতে আন্তর্জাতিকভাবে সে দেশটি যে সমস্যার সম্মুখীন হলো তা তাদের ২০১২-তেই মোকাবেলা করতে হবে।
আবার ইরানের সঙ্গে মার্কিনদের যে বৈরী সম্পর্ক তা জটিল আকার ধারণ করল ২০১১-এর শেষদিকে এসেই। বছরের শেষদিকে মার্কিনিদের একটি ড্রোন বিমান প্রযুক্তির কৌশল ব্যবহার করে ইরান ধরে ফেলে। যার ফলে মার্কিনিরা হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। খোদ প্রেসিডেন্ট নিজেই বিমানটি ফেরত দেয়ার জন্য ইরানের কাছে অনুরোধ করেন। কিন্তু ইরান কোনোভাবেই তাদের সে প্রস্তাবে রাজি হচ্ছে না। অর্থাৎ তারা আর বিমানটি ফেরত দিচ্ছে না। ইরানের ওপর মার্কিনিদের ক্ষোভ বহুগুণে বেড়ে গেল। যার বহিঃপ্রকাশ ২০১২ সালে ঘটার সম্ভাবনা রয়েছে। কারণ ইতোমধ্যে আমেরিকা তাদের অন্যান্য রণক্ষেত্রের কার্যক্রম খুব তাড়াতাড়ি ঘুটিয়ে ফেলতে শুরু করেছে। ইতোমধ্যে ইরাক থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করেছে। আফগানে তালেবানদের সঙ্গে শান্তি আলোচনাও বেশ সফলতার সঙ্গে অগ্রসর হচ্ছে। হয়ত এই আলোচনা শেষে আফগান থেকেও তাদের সৈন্যবাহিনী ফিরিয়ে নিবে। তারপর হয়ত ঐক্যবদ্ধভাবে তাদের সমরশক্তি ইরানের বিরুদ্ধে প্রয়োগ করবে। আর তার রূপ হবে ভয়াবহ। এমন কিছু হলে পড়ে মনে রাখতে হবে এর বিজ বুনেছিলো ২০১১-তেই।
২০১১ বাংলাদেশের জন্য তেমন কোনো সুখবার্তা বয়ে আনেনি। নানা প্রতিকূলতার মধ্য দিয়েই এই সময়টা আমরা অতিবাহিত করেছি। তাই আমরা চাইনা ২০১১-এর পূর্ণরূপ ২০১২-তে আমাদের জীবনে ফিরে আসুক। ২০১২ হোক আমাদের জীবনে সফলতা বর্ষ। ২০১২-কে অর্থবহ করতে হলে ২০১১ থেকে আমাদের শিক্ষা নিতে হবে। কিন্তু আমরা সহজে অতীত থেকে শিক্ষাগ্রহণ করতে চাই না। তাই বারবার একই ব্যর্থতা আমাদের জীবনে বহুবার ফিরে আসে। ২০১১-তে ব্যর্থতা ও ভুল রয়েছে, আমাদের রাজনীতিতে, অর্থনীতিতে, সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালনায়। এমনকি সংসার পরিচালনায়ও রয়েছে আমাদের অনেক ব্যর্থতা। এসব ব্যর্থতা ও ভুল থেকে আমাদের শিক্ষা নিতে হবে। না হয় ২০১২ আমাদের জীবনে আরো ভয়াবহ যন্ত্রণাদায়ক বার্তা বহন করে নিয়ে আসবে। বিশেষ করে আমাদের রাজনীতি। আমাদের রাজনৈতিক অঙ্গনে লু হাওয়া বইছে। যা ইতোমধ্যেই রাজনীতির মাঠকে উত্তপ্ত করতে শুরু করেছে। আমরা যদি প্রতিহিংসার রাজনীতি পরিহার করে সঠিক গণতন্ত্র চর্চা করতে না পারি তাহলে আমাদের রাজনীতিতে সৃষ্টি হবে এক সংঘাতময় পরিবেশের। ২০১১ রাজনৈতিক অঙ্গনে যেসব ইস্যুর জন্ম দিয়েছে ২০১২ সালে সংঘাত সৃষ্টি করতে তাই যথেষ্ট। তবে এসব থেকে বেরিয়ে আসতে আমাদের মানসিকতার পরিবর্তনও জরুরি। তাই নতুন বছরের আগমনে আমাদের মনেও আসুক উচ্ছ্বাস।
২০১১ সালের ব্যর্থতা, পুরনো দিনের সব গ্লানি ভুলে গিয়ে আমাদের দীপ্ত শপথ নেয়ার এখনই সময় যে, আমরা একটা সুন্দর দেশ ও সমাজ গড়বো, সেই সঙ্গে নিজেও সুন্দর হব। কেননা কুটিল মনের মানুষ দিয়ে সুন্দর কিছু করা যেমন সম্ভব নয়, তেমনি দেশ গড়াও সম্ভব নয়। আসুন আমরা ২০১২ সালে পরিশুদ্ধ হই।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




