আজ একটা বেবি ডলের গল্প শুনাই। ক্লাসের সবচেয়ে ছোট্ট পুতুল এটি। গাল দুটি ফোলা ফোলা, চোখ দুটি বড় বড় কি এক মায়ায় ভরা চেহারা। ঠিক যেন শো কেস এ সাজিয়ে রাখা কোনও পুতুল। না উপমাটা ঠিক হলনা। ওকেই দেখে যেন পুতুলের কারিগররা পুতুল বানায়। কিন্তু আমার এই বেবি ডলের সমস্যা হল ও যেন সত্যিই ডল হয়েই থাকতে চায়। ধনুক ভাঙ্গা পণ তার কোনও কথাই সে বলবে না। এমন কি মামনি কিংবা বাবার সাথেও না। সব কথাই সে ইশারায় বলবে। কোনও কিছুতেই সে তার মহামূল্য বাক্য খরচ করতে রাজী নয়। আর তাই তো তার কথা ফুটানোর জন্য তার বাবা মা অন্য কোনও উপায় না পেয়ে স্কুলেই ভর্তি করে দিয়েছে।
প্রথম দিনই তার মা আমাকে ওর সমস্যাটার কথা জানিয়ে দিলেন। আমি লক্ষ্য করলাম ওর কথা বলায় কেন যেন চরম অনিহা। হয়ত বাসায় ওর সাথে বকবক করার লোকের অভাব ছিল আর তাই কথা বলার অভ্যেসটা গড়ে উঠেনি সেভাবে। যদিও সে সব কথাই বুঝতে পারে। অতঃপর শুরু হল ওকে কথা বলানোর মিশন।
না সে কিছুতেই কথা বলবেনা। পিপাসা পেয়েছে? গুটগুট করে আমার কাছে এসে আমার হাতটা ধরে টেনে নিয়ে যাবে ওয়াটারপটগুলো যেখানে ঝুলানো থাকে সেখানে। তারপর ওর পটটার দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকবে। আমি পটের মুখটা খুলে দিলে পানি খেয়ে আমার হাতে আবার পটটি ধরিয়ে দিয়ে গুটগুট করে চলে গেল সে নিজের টেবিলে। কিন্তু এই তাবৎ প্রক্রিয়ার মধ্যে তার কোনও শব্দ কেউ শুনতে পারবেনা। শুধুমাত্র যদি কোনও বাচ্চা কাঁদে তখন ও কেমন যেন অস্থির হয়ে যায়। আমার কাছে এসে চোখ বড়বড় করে সেই বাচ্চার দিকে আঙ্গুল নির্দেশ করে আধো আধো বুলিতে অনেক কস্ট করে বলবে.."বাবুতা কাছ্ছেএএএএএ???" যদি বলি "হ্যাঁ বাবুটা ওর মামনির জন্য কাঁদছে" সে তখন খুব বুঝেছে এমন একটা ভঙ্গি করে চলে যাবে ওর টেবিলে। তারপর দুই মিনিট যেতে না যেতেই আবার চলে এসেছে আমার কাছে। এবং ঠিক একই ভাবে আবার প্রশ্ন, "বাবুতা কাছ্ছেএএএএএ??? অতঃপর এই চলমান প্রক্রিয়া চলতেই থাকবে।
যাই হোক ওকে কথা বলাতেই হবে কারণ দুস্টুটা তো বলতে পারে সবই কিন্তু সমস্যা হল বলতে চায়না। ওর কথা বলার এই অনিহাটা কাটানো দরকার। ওর সাথে প্রচুর বকবক করতে লাগলাম। ও মুখ ফুটে না বলা পর্যন্ত ওর কোন কথাই শোনা হত না। এভাবে ধীরে ধীরে আমার বকবক করার কারণেই হোক কিংবা অন্য বাচ্চাদের সঙ্গে মিশেই হোক খুলে গেল ওর কথার ডালা। তার পরের ইতিহাস? বড়ই করুণ (আমার জন্য)। মা গো মা এত কথাই জমা ছিল ওই এক ফুট মানুষটার পেটে! কথা আর কিসের শুধুই অভিযোগ। মিছ্ ও চেয়াল থেকে উথেছে, মিছ্ ও দুততামি কলে, মিছ্ ও পেনছিল দেয়না, মিছ্ ও চিৎকাল কলে, মিছ্ ও আমাকে মালে, মিছ্ ও দৌলায়, মিছ্ ও বাইলে গেল ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি। ওর কথা না শুনেও কি রেহায় আছে? দুই হাত দিয়ে আমার মুখটা ধরে ঘুরিয়ে নিবে ওর দিকে। তারপর ও খুলে বসবে ওর অভিযোগের ডালা। এবং অভিযুক্তদের প্রতি এ্যাকসন না নেয়া পর্যন্ত আমার আর রক্ষে নেই। এদিকে ও নিজে যে হাতে পেন্সিল পাওয়া মাত্রই দাগ এঁকে দিচ্ছে ওর বন্ধুদের শার্ট এ সেটার কোনও খবর নেই। কি দুঃখে যে এই ডল কে কথা শেখালাম। ইশারাই তো ভাল ছিল। এমনই অবস্হা আমার।
স্কুলে কালচারাল প্রোগ্রাম হবে। ক্ষুদে বিচ্ছুদেরও ইভেন্ট আছে। রাইমস এর সাথে সাথে হাত পা নেড়ে নেড়ে অভিনয়। প্রথম দিন রিহার্সাল করাতে গেলাম। সি ডি তে রাইমস ছাড়া মাত্রই সে এক দেখার মত দৃশ্য। ওরা তো আমার দেখানো অঙ্গভঙ্গির ধারে কাছেও না গিয়ে ইচ্ছেমত হাত পা ছুড়তে লাগল।আমি যদি বলি এক লাইনে দাঁড়াতে ওরা দেখি একে অপরের ঘাড়ে উঠে বসে আছে। হাত সামনে বাড়াতে বলছি তো হাত বাড়িয়ে সামনের জনের মাথার চুল টেনে ধরছে। নয়ত হাত বাড়িয়ে পাশের জনকে চিমটি কাটছে।ওদের এহেন কর্মকান্ড দেখে তো আমার নিজেরই চুল ছেড়ার দশা।যাই হোক অনেক কস্টে কোনও রকমে সবগুলোকে সাইজে আনলাম। হঠাৎ দেখি ওদের মধ্যে একটা নাচুনে পুতুল যেন প্রাণ ফিরে পেয়েছে। আমার সেই বেবি ডল। হাত উপরে তুলে কোমর দুলিয়ে ঘুরে ঘুরে তার সে কি নাচ। আমি হা হয়ে শুধু তার নাচই দেখছি। নাচতে নাচতে একসময় দেখি সে তার পাশের জনকে দিল জোরসে এক ধাক্কা। সে তো রেগে কটমট করে ওর দিকে এগুতে যাবে এর মধ্যে সে আরেকজনকে ধাক্কা মেরে দিয়েছে। মুহূর্তের মধ্যে ক্লাসরুমটি একটা ছোটখাট রণক্ষেত্রে পরিণত হল। সবাই তো মহা ক্ষ্যাপা এই পিচকির উপর। পারলে ধরে ওর পিঠে দুমাদুম লাগিয়ে দেয় আর কি। আমি অনেক কস্টে এই বিক্ষুব্দ জনতাকে আটকে রেখেছি। কিন্তু যার কারণে এই রণাঙ্গনের সৃষ্টি তার বিন্দুমাত্র ভ্রূক্ষেপ নেই এদিকে। সে কিন্তু রাইমস এর তালে তালে আগের মতই নেচে চলেছে। একসময় আমার চোখে চোখ পরতেই সে বলে উঠে "মিছ্ দেখো দেখো আমি নাতি" ।
অতঃপর.................আমি গালে হাত দিয়ে ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে রইলাম ওর দিকে আর ও ওদিকে নেচেই চলেছে ' হিক্রি ডিক্রি ডক দ্যা মাউস রান আপ দ্য ক্লক'।
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই আগস্ট, ২০০৯ রাত ৮:২৬