এক
১৯৭১ সালের ৩ অক্টোবর। চারজন দলছুট
মুক্তিযোদ্ধা নড়াইল-লোহাগড়া পাঁকা
রাস্তা পাড় হয়ে উত্তর থেকে দক্ষিণ দিকে
যাবে। নড়াইল লোহাগড়া রাস্তা বেশ উঁচু।
রাস্তার উত্তরে এবং দক্ষিণে উভয় দিকে
তিনশ থেকে চারশ গজের মত ধান, পাটের
ক্ষেত। বর্ষার পানিতে ডুবে গিয়েছিল। এখন
পানি কমে এসেছে। কম বেশি হাটুপানি হবে।
পানির মধ্যে অসংখ্য চিকন চিকন শাপলার
লতা পানির উপরে ছোট ছোট পাতা মেলে
দাড়িয়ে আছে।
উত্তর দিকে ধুড়ে এবং জঙ্গল গ্রাম।
রাস্তার দক্ষিণে রামচন্দ্রপুর। রাস্তার
উপরে আঠারো বিশজন রাজাকারের একটি
দল। পূর্ব থেকে পশ্চিম দিকে টহল দিচ্ছে, একবার
যাচ্ছে, আর এক বার আসছে। প্রত্যেকের
ঘাড়ে একটি করে থ্রি নট থ্রি রাইফেল।
টহলের কারণ হল মুক্তিযোদ্ধাদের একটি
বীরত্বপূর্ন কাজ। মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকে পাক
সেনারা এই রাস্তা ধরে নড়াইল লোহাগড়া
যাতায়াত করতো এবং রাস্তার দু’পাশে
বিভিন্ন গ্রামে অগ্নি সংযোগ করে লুটপাট
করতো। রাজাকার বাহিনী তৈরী হবার পর
উপদ্রপ আরো বেড়ে গেল। তাই বর্ষার পানি
বেড়ে যাওয়ার পর তিনটি গ্র“পের
মুক্তিযোদ্ধারা যুক্তি করে কাশিপুর পয়েন্টে
রাস্তাটি কেটে দিয়েছিল। চার-পাঁচ হাত
কাটা রাস্তা, পানির তোড়ে বিশাল এক
খালে পরিণত হল। উত্তর দিকের পানির চাপে
এই খালে এখন প্রচন্ড স্রোত এবং পানিতে
জায়গায় জায়গায় প্রচন্ড ঘূর্ণিপাক।
দেখলে ভয় পাওয়ার মত।
ফলে পাক সেনা ও রাজাকারদের গাড়ী
নিয়ে সরাসরি লোহাগড়া যাওয়া বন্ধ হয়ে
গেল। তারা এখন নৌকায় করে কাটা
যায়গা থেকে দুর দিয়ে দুর দিয়ে, এক পার থেকে
আরেক পারে যাতায়াত করে। তাদের মধ্যে
কেউ কেউ নৌকায় উঠতে ভয় পায় বলে কোন
রকমে একটি বাঁশের সাকো তৈরী হয়েছে।
সেখানে রাজাকাররা সব সময় পাহারায়
থাকে।
নড়াইল লোহাগড়া রাস্তায় বড় ব্রিজটি হ’ল
হ্ওাইখালীতে। মুক্তিযোদ্ধারা রাস্তাা
কাটার পর সেখানেও পাহারা বসানো
হয়েছে। সেখানেও রাজাকারদের পাহারা।
পাহারায় থাকা রাজাকাররা আবার
মাঝে মাঝে রাস্তায় টহল দিতে থাকে।
মুক্তিযোদ্ধারা গ্রামের প্রান্তে আসতে
আসতে ফজরের আজান হয়ে গেল। চারদিক
ফর্সা হয়ে আসছে, পানি এবং রাস্তা পার
হতে হবে। রাস্তার ওপারেও পানি কাদার
ভিতর দিয়ে যেতে হবে। কিন্তু পানির গভীরতা
কম, সমতল ভূমি। রাস্তা থেকে পানির শেষ
মাথা পর্যন্ত দেখা যায়। কেবল রাস্তার
পাশ দিয়ে কিছু আকন্দ গাছ এবং কাশ বনের
ঝোপ।
মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে সময় নেই। যেটুকু আফসা
অন্ধকার তার মধ্যেই হয় রাস্তা পার হতে
হবে, না হয় আবার পিছন দিকে ফিরে যেতে হবে।
ভাবার সময় নাই। আবার রাস্তার ঐপারে
যাওয়াটাও অসম্ভব জরুরী।
মুক্তিযোদ্ধারা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল, যে
ভাবেই হোক রাস্তা পার হতে হবে। সিদ্ধান্ত
হল নাক ডুবিয়ে পানির ভিতর দিয়ে ধান পাটের
ক্ষেত পার হতে হবে এবং টহল দলকে অপ্রস্তুত
অবস্থায় গুলি চালিয়ে ধাওয়া করতে হবে।
ওরা ঘাড়ের রাইফেল নামিয়ে, রাইফেলের
চেম্বারে গুলি ঢুকিয়ে, শুট করতে যে সময় নেবে,
তার মধ্যেই মুক্তিযোদ্ধারা রাস্তা পার হয়ে
যাবে। তাছাড়া মুক্তিযোদ্ধারা অনুমান
করলো যে, গোলাগুলি শুরু হতেই অপ্রস্তুত
রাজাকাররা হয় ভয়ে পালিয়ে যাবে, না হয়
নিরাপত্তার জন্য মাটিতে শুয়ে পজিশন নিবে।
যে কথা সেই কাজ। চারজন মুক্তিযোদ্ধা
পানি পার হয়ে রাস্তার ধারে আকন্দ
গাছের আড়ালে অবস্থান নিল।
রাজাকাররা তখন পূব থেকে পশ্চিম দিকে
গেল। মুক্তিযোদ্ধারা অপেক্ষায় থাকলো।
কিছুক্ষণ পর রাজাকাররা আবার পশ্চিম
থেকে পূর্ব দিকে ফিরলো। কাছে আসতেই চার
মুক্তিযোদ্ধা একটি ষ্টেনগান, একটি চাইনিজ
রাইফেল এবং দুটি এসএলআর থেকে গুলি ছুড়তে
ছুড়তে চিৎকার দিয়ে রাজাকারদের উপর
ঝাপিয়ে পড়লো। তবে সরাসরি রাজাকারদের
গুলি না করে গুলি উপরের দিকে ছুড়তে লাগলো।
কিন্তু সমস্যা দেখা দিল। মুক্তিযোদ্ধাদের
চিন্তা এবং পরিকল্পনা মত, রাজাকাররা
মাটিতে শুয়ে পড়লো না, পজিশনও নিল না।
তারা কেউ কেউ অস্ত্র ফেলে এবং কেউ কেউ
অস্ত্র ঘাড়ে ঝুলানো অবস্থায় হাত দিয়ে
চেপে ধরে পশ্চিম দিকে দৌড় শুরু করলো। এখন
মুক্তিযোদ্ধারা সমস্যায় প’ড়লো। এই অবস্থায়
রাস্তা ছেড়ে পানিতে নামলেই
রাজাকাররা তাদের গুলি করবে। ওদিকে
রাজাকাররা সারেন্ডারও করছে না।
আবার মুক্তিযোদ্ধারা যদি রাজাকারদের
পিছু ধাওয়া না করে উল্টা দিকে দৌড় দেয়
কিংবা দাড়িয়ে পরে তাহলেও রাজাকাররা
পাল্টা গুলি চালাবে। এই রকম একটি
পরিস্থিতিতে মুক্তিযোদ্ধারা নিরুপায় হয়ে গুলি
এবং ধাওয়া অব্যাহত রাখলো।
কিন্তু ধাওয়া করে পশ্চিম দিকে বেশি দূর
যাওয়া যাবে না। কারণ নড়াইল বেশি দূরে
নয়। সেখান থেকে পাকসেনাদের গাড়ী বা
অতিরিক্ত রাজাকার চলে আসতে পারে।
মাইল দেড়েক দৌড়ানোর পর কিছু রাজাকার
রাস্তা ছেড়ে গ্রামে ঢুকে পড়লো, বিশেষ করে
যারা খালি হাতে ছিল। তাদের আবার অন্য
ভয় আছে। গ্রামের লোক রাজাকার হাতে
পেলে রাম ধোলাই দিতে পারে। দাবড় খেয়ে
বেশীর ভাগ রাজাকার হ্ওাইখালী ব্রিজ
থেকে নীচে পানিতে ঝাপ দিয়ে স্রোতে ভেসে
উত্তর দিকে চলে গেল। মাত্র চার পাঁচ জন
রাজাকার তখনো রাস্তা বরাবর পশ্চিম
দিকে দৌড়াচ্ছে। মুক্তিযোদ্ধারাও ক্লান্ত।
তাদের গুলির পরিমাণও কমে এসেছে (যদিও দূরের
যাত্রায় পর্যাপ্ত গুলি সাথে নিয়ে যাত্রা
শুরু করেছিল)। হঠাৎ করে অবশিষ্ট চার পাঁচ
জন রাজাকার পাশের একটি পুকুরে ঝাপিয়ে
পড়লো। মুক্তিযোদ্ধারা যখন পুকুরের পাড়ে গিয়ে
পৌছালো তখন দুই জন রাজাকার বুক পানিতে
দাড়িয়ে হিষ্ট্রিয়াগ্রস্থের মত অশ্রব্য ভাষায়
গালি-গালাজ করছে। বাকি তিন জনের খবর
নেই। মুক্তিযোদ্ধারা ত্বরিত সিদ্ধান্ত নিয়ে,
স্থান ত্যাগ করে আবার পূর্ব দিকে দৌড় শুরু
করলো। ফেরার আগে একজন মুক্তিযোদ্ধা
পানির মধ্যে দাড়িয়ে থাকা দুই রাজাকারের
দিকে গুলি চালালো। তবে ফলাফল দেখার
সুযোগ হল না।
রামচন্দ্রপুর গ্রামে এসে মুক্তিযোদ্ধারা
পাকা রাস্তা ছেড়ে দিয়ে, দক্ষিণে সড়াতলা
গ্রামের দিকে চলে গেল। তারপর সেখান থেকে
বহু কষ্টে একটি নৌকা জোগাড় করে গন্তব্যে
যাত্রা করলো।
দুই
১৯৭৩ সাল। যশোর কেন্দ্রীয় কারাগার।
জুটমিলের কর্মচারী, শ্রমিক ইউনিয়ন নেতা
প্রগতিশীল মুক্তিযোদ্ধা জেলখানায়। ট্রেড
ইউনিয়ন করার পাশাপাশি প্রগতিশীল
রাজনীতিতে যুক্ত থাকায় মুক্তিযোদ্ধাকে
সেল-এ রাখা হয়েছে। যশোর জেলখানার
পুরাতন সেল।
প্রতিদিন সকালে পুরাতন সেলে দরজা খুলে
দেয়ার পর অনান্য বন্ধুদের সাথে
মুক্তিযোদ্ধাও হাটাহাটি করেন। জেলখানায়
তখন গিজ গিজ করছে অসংখ্য রাজাকার।
এছাড়া আছে জাসদ এবং গোপন বাম
রাজনৈতিক দলের বহু কর্মী এবং সাধারণ
অপরাধী। ধারণ ক্ষমতা ৫৭৫, বন্দীর
সংখ্যা ২৮০০ এরও বেশি।
হাটাহাটি, মাঝে মাঝে দাবা খেলা এবং
মানুষের সাথে গল্প সল্প করে সময় কাটে।
যাদের সুযোগ আছে তারা লাইব্রেরী থেকে
বই নিয়েও পড়তে পারে। গল্প সল্প ও
কথাবার্তা অনেকের সাথে হয়। মাঝে মাঝে
রাজাকারদের সাথেও হয়। তাছাড়া সেই
সময় মুক্তিযোদ্ধা ও বাম রাজনীতির সাথে
যারা যুক্ত, রাজাকাররা তাদের একটু
সমীহ করেই চলতো। কারণ ১৯৭২-৭৩ দুই বছরে
কিছু রাজাকার নেতা জেলখানার ভিতরে
রাম ধোলাইর শিকার হয়েছিল।
তো এই রাজাকারদের মধ্যে একজন
রাজাকারের গালের ডান পাশে বড় একটা
ছিদ্র ছিল। ছিদ্রটা এত বড় যে তার মধ্যে এক
সাথে তিনটা আঙ্গুল ঢুকিয়ে দেয়া যায়।
গালের মধ্যে জিহ্বা মাড়ি সব দেখা যায়।
তার গালে সাকুল্যে বাম পাশের মাড়িতে
উপর নীচে পাঁচ ছয়টি এবং সামনে ডান দিকে
গোটা চারেক দাঁত আছে, আর কোন দাঁত নাই।
মুক্তিযোদ্ধা অনেকবার ভেবেছেন লোকটাকে
জিজ্ঞেস করবেন, তার কি হয়েছিল। কিন্তু একটি
লোকের শরীরের খুত সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা
অনেকটা অশোভনীয় মনে করে মুক্তিযোদ্ধা
অনেকদিন তাকে কিছু জিজ্ঞেস করেন নি। শেষে
একদিন তার কাছে জানতে চাইলেন যে, তার
কি হয়েছিল। রাজাকার মাথা নিচু করে
বিড়বিড় করে বলেছিল, “ভাই, এটা আপনাদেরই
দান। আপনারা পুকুর পাড় থেকে পানির মধ্যে
যখন আমাদের গুলি করেন, তখন একটি গুলি
আমার ডান চোয়ালে আঘাত করে ভেতরে ঢুকে
মনে হয় দাঁতে গুতো খেয়েছিল। গুলিটা সোজা
বাম গাল দিয়ে বের না হয়ে সামনের দিকে বের
হয়ে যায়। যাবার সময় আমার এই অল্প
কয়েকটি দাঁত ছাড়া বাকি সব গুলো দাঁত নিয়ে
গেছে। গ্রামের লোকেরা ধরাধরি করে আমাকে
নড়াইল হাসপাতারে নিয়ে গিয়েছিল বলে
এখনো পরানে বেঁচে আছি”। রাজাকার মাথা
নীচু করে মিটিমিটি হাসতে হাসতে বললো, “ভাই
কোন আফসোস নাই। জানে বেঁচে আছি সেটাই
বড় কথা”
মুক্তিযোদ্ধার মনে পড়লো পুকুর পাড় থেকে ফিরে
আসার মুহুর্তে একজন সহযোদ্ধা বুক পানিতে
দাড়িয়ে থাকা দুই রাজাকারের দিকে গুলি
ছুড়েছিল।
আলাপে রাজাকার লোকটি বলেছিল তার
বাড়ী লোহাগাড়া থানার বেলগাছা
গোপিকান্তপুর (রূপক) গ্রামে এবং তার নাম
মোখলেছ (রূপক)।
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৫ দুপুর ২:৩৮