somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সংক্ষোভ

০৬ ই এপ্রিল, ২০১৮ বিকাল ৩:০৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

দক্ষিণের জানালার ফাঁক দিয়ে আলোর রেখা ঢুকছে ঘরের ভেতর। এই জানালাটা দিনের বেশিরভাগ সময় ভারী পর্দার আড়ালে ঢাকা থাকে। এখন অবশ্য একদিকে আলতো করে সরিয়ে দেয়ায় ছোট্ট একটা ফাঁক বের হয়ে আছে, উজ্জ্বল আলোর রেখাটা ঢুকছে সেদিক দিয়েই। একটানা চেয়ে থাকলে সেই রেখার ভেতর ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ধূলিকণার অস্তিত্ব লক্ষ্য করা যায়। যেন হাজার হাজার কিলবিলে পোকা নির্দিষ্ট গতিপথ ধরে দলবেঁধে ঢুকে পড়ছে। আলোর রেখার ভেতর উড়ন্ত এই ধূলিকণাগুলোর বেশ গালভরা একটা নাম আছে, ত্রসরেণু।
সকালের এই সময়টায় আমি বেশ আয়োজন করে ত্রসরেণু দেখি। নাস্তা সেরে ফরহাদ অফিসের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যায়, আর নুসরাত যায় স্কুলে। ভোরের ব্যস্ততা ফুরোনোর পর, বাড়িটা ফাঁকা হয়ে যায় বেশ খানিকক্ষণের জন্য। এই সময় গরম চায়ের কাপ হাতে ঘরের এই কোনায় আমি রকিং চেয়ারে গা এলিয়ে দেই। হালকা ভলিউমে কোন একটা ব্লুজ মিউজিক বাজতে থাকে, আর তার সাথে তাল মিলিয়ে প্রবেশ করে ত্রসরেণুর মিছিল। চায়ে চুমুক দিতে দিতে উদ্দেশ্যহীন ভঙ্গিতে এই দৃশ্যটা দেখতে ভালোই লাগে আমার।
অবশ্য, ইদানীং দৃশ্যপটে একটা পরিবর্তন ঘটেছে। ফরহাদ আর নুসরাত বেরিয়ে যাবার পরও আমি আর একা থাকি না। দোলনায় অথবা খাটে শুয়ে আরেকজন আমাকে সঙ্গ দেয়; নুহিন, আমার ছোট মেয়ে। মাস দেড়েক হলো পৃথিবীর মুখ দেখেছে।
সঙ্গী হিসেবে অবোধ শিশুরা বেশ মজার। অর্থহীন দৃষ্টিতে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকা, হঠাৎ ফোকলা মুখে একটু ফ্যাক করে হেসে ফেলা, আবার কখনও চোখ বড় বড় করে বিস্ময়ভরে তাকানো-এইসব ভাবভঙ্গির সাহায্যে ওরা যে অকৃত্রিম আনন্দ ছড়িয়ে দেয়, তার সাথে আর কোন কিছুর তুলনা হয় না।
মিউজিক প্লেয়ারে দ্য ইংক স্পটস-এর গান বাজছিল, ‘আই ডোন্ট ওয়ান্ট টু সেট দ্য ওয়ার্ল্ড অন ফায়ার...’, চল্লিশের দশকের পুরনো গানটা শুনতে শুনতে কখন যেন চোখ লেগে এসেছিল আমার। তন্দ্রাভাব ছুটে গেলো নুহিনের কান্নার আওয়াজে। পাশের ঘর থেকে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করছে আমার ছোট মেয়েটা। আশ্চর্য, একটু আগেই তো ভরাপেটে ঘুম পাড়িয়ে দিলাম ওকে!
কান্না শুনে ছুটে গেলাম দোলনার কাছে।
ঠিক পায়ের দিকটায় দাঁড়িয়ে আছে নুসরাত। অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে নিজের ছোট বোনের দিকে। নড়াচড়ার লক্ষণ নেই, শ্বাস নিতে পর্যন্ত ভুলে গেছে যেন। শীতল চোখের দৃষ্টিতে বরফের মতো জমাট বাধা অব্যক্ত অনুভূতি।
‘নুসরাত!’
কোন উত্তর নেই।
‘নুসরাত! ঘুম ভাঙালে কেন ওর? কতবার না করেছি!’ ধমক না দিয়ে পারলাম না।
‘আমি কিছু করিনি।’ শীতল কণ্ঠে উত্তর দিলো ও।
‘আবার মিথ্যা বলছো। যাও, ঘরে যাও!’
নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো নুসরাত, যেন সম্মোহিত হয়ে আছে। তারপর মাথা নিচু করে চুপচাপ ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলো।
গ্রিন লিভস ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের স্ট্যান্ডার্ড ওয়ানের ছাত্রী আমার বড় মেয়েটা। বয়স মাত্র সাত, সে হিসেবে অনেকটাই চুপচাপ। তবে এই স্বভাবটা আগে ছিল না; ওর বয়সী আর দশটা বাচ্চার মতোই স্বাভাবিক ভঙ্গিতে হাসতো, খেলতো। চিৎকার ঘরে ছুটে বেড়াতো বাড়ির এদিক থেকে ওদিক। হঠাৎ কী হলো কে জানে। আজ কয়েক মাস হলো ওর স্বভাবের পরিবর্তনটা খুব চোখে পড়ার মতো। বাসায় তেমন কথাবার্তা বলে না, খাবার টেবিলেও আনমনে প্লেট-চামচ নাড়াচাড়া করে অনেকক্ষণ ধরে। মেজাজও কেমন খিটমিটে হয়ে গেছে, ঘর থেকে তেমন একটা বের হয় না। বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে মোম রঙ দিয়ে অদ্ভুত সব ছবি আঁকে। ছবিগুলো মনোযোগ দিয়ে দেখেছি আমি, অর্থহীন আঁকিবুঁকি ছাড়া আর কিছু নয়।
এই সময়টায় ওর স্কুলে থাকার কথা, তবে ঈদের ছুটির কারণে এই সপ্তাহে স্কুল বন্ধ। ছুটির দিন সকালবেলা ফরহাদ ওকে আইসক্রিম খেতে বাইরে নিয়ে যেতে চেয়েছিল, আজ ওরও অফিস ছুটি কিনা। প্রতিদিন ঘর থেকে বেরোবার আগে নুহিনকে কোলে নিয়ে অনেকক্ষণ গালের সাথে গাল লাগিয়ে রাখে ফরহাদ। আজকেও তাই করছিল। রেডি হয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এসে সেই দিকে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে ছিল নুসরাত। তারপর কোন কথা না বলে ঘরে ঢুকে গেলো আবার। ফরহাদ কয়েকবার দরজায় ধাক্কা দিয়েও লাভ হলো না। ভেতর থেকে বলল ও, আইসক্রিম খেতে ইচ্ছে করছে না। পুরো ব্যাপারটার মধ্যে কেমন যেন একটা অসামঞ্জস্যতা আছে। আমি সেটা ভালোভাবেই আঁচ করতে পারি।
নুহিনকে কোলে নিয়ে বুকের সাথে চেপে ধরলাম আমি। ওর গায়ে পাউডার আর ঘাম মেশানো কী সুন্দর একটা ঘ্রাণ! মায়ের ছোঁয়া পেয়ে মেয়েটা শান্ত হয়ে গেলো সাথে সাথে। গুনগুন করে ঘুমপাড়ানি গান শোনাতেই ঘুমের রাজ্যে হারিয়ে গেলো আমার ছোট্ট পরী।
‘ডিং ডং...’
কলিংবেল বাজছে। ফরহাদ এসে পড়লো বুঝি।

***

‘জিনিসটা খুব কাজের কিন্তু,’ ফরহাদের কণ্ঠে খুশির স্পষ্ট ছাপ। ‘জার্মানিতে দেখেছি, একবারে আস্ত পর্ক বেলি গ্রিল করে ফেলে।’
ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করার পর জার্মানিতে মাস্টার্স করতে গিয়েছিল ফরহাদ। সেই সময়ের স্মৃতিগুলো একটু সুযোগ পেলেই বিড়বিড় করে ও। আমি অবশ্য সহজে বিরক্ত হই না, শুনতে ভালোই লাগে। কিন্তু ঈদের আগের দিন এমন উটকো ঝামেলা দেখলে মেজাজ খারাপ হওয়াটা স্বাভাবিক।
সকালে অফিস না থাকলে ফরহাদ মাঝেমধ্যে এরকম উদ্ভট কাজ করে বসে। এই যেমন আজকে হঠাৎ করে এই স্টিলের ওয়াড্রবের মতো বাক্স নিয়ে হাজির হয়েছে!
আমার কপালে বোধহয় বিরক্তির ছাপ ফুটে উঠেছিল, সেটা খেয়াল করেই ফরহাদ মিনমিন করলো, ‘প্রফেশনাল কনভেকশন ওভেন এতো কম দামে পাওয়া অসম্ভব। দেখে আর লোভ সামলাতে পারলাম না...’
‘এখন এই বিশাল জিনিসটাকে কোথায় আঁটাব?’
‘ডাইনিং এর বাম কোনায় রাখা যায় না? ফ্রিজের পাশে? ওখানে একটু সরিয়ে নিলেই হবে।’
‘আমার মনে হয় না। আচ্ছা, ফরহাদ, হুট করে যা মাথায় আসে তাই করতে হবে? এই কনভেকশন ওভেনগুলো রেস্টুরেন্টে ব্যবহার করা হয়। ইন্ড্রাস্টিয়াল ইউজ, দেখো লেবেলে বড় করে লেখাই আছে। আমরা এটা দিয়ে কী করব?’
‘কুরবানির ঈদের মৌসুম, তানিয়া। বিফ স্টেক তো তুমিও পছন্দ করো। আর একসাথে অনেকগুলো চিকেন গ্রিল করার অপশন আছে। মশলা মাখিয়ে ভেতরে ঢুকিয়ে দিলেই ব্যস! আহ, আমি তো এখনই গন্ধ পাচ্ছি। খিদে লেগে গেলো!’
ডাইনিং টেবিলের পাশে খুট করে একটা শব্দ হলো। নুসরাত দাঁড়িয়ে আছে। গভীর মনোযোগ দিয়ে ওভেনটা দেখছে ও। আমি তাকাতেই চোখ সরিয়ে নিলো। এদিকে ফরহাদ খুব ইতিবাচক ভঙ্গিতে ফ্রিজ সরাতে ব্যস্ত। ঠেলেঠুলে জায়গা বের করেই ফেললো শেষপর্যন্ত। কনভেকশন ওভেনটা এক পাশে ঠেশ দিয়ে রেখে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলো সেদিকে। যেন ওভেন নয়, সালভাদর দ্যালির কোন বিখ্যাত চিত্রকর্ম দেখছে!
‘আচ্ছা, বাবা, ওভেন তো অনেক ছোট হয়। আমাদের একটা মাইক্রো ওয়েভ আছে যে...’ জানতে চাইলো নুসরাত।
‘হ্যাঁ, মা। এটা আলাদা জিনিস, ইন্ডাস্ট্রিয়াল ওভেন। রেস্টুরেন্টে থাকে, একসাথে অনেকের খাবার রান্না করার জন্য।’
‘দেখতে খুব সুন্দর।’
‘তাই না? আর এদিকে তোমার মা তো বুঝতেই চাচ্ছে না।’ মেয়ের সমর্থন পেয়ে ফরহাদ খুব খুশি।
‘এটা কীভাবে চালু করে, বাবা?’
‘খুবই সহজ।’ সকেটে তার লাগিয়ে দিয়েছে ফরহাদ। ‘এই যে এই বাটনটা চেপে, নিচের নবটা ঘুরিয়ে দিলেই হয়। আর এই যে এখানে টেম্পারেচার এডজাস্ট করে...’
মেয়ের আগ্রহ দেখে ফরহাদ একটানা বকবক করেই যাচ্ছে। নুসরাত হাসিমুখে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে বাবার দিকে। অনেকদিন পর কোন কিছু নিয়ে ওর আগ্রহ দেখছি। যাক, সবসময় এমন হাসিখুশি থাকলেই হয়।’

***

‘রাত অনেক হলো, ফরহাদ। ঘুমাও এখন, কালকে খুব দৌড়াদৌড়ি হবে।’
আধশোয়া অবস্থায় মুখের ওপর একটা বই গুঁজে রেখেছে ফরহাদ। আগাথা ক্রিস্টির কার্ডস অন দ্য টেবল। অনেকক্ষণ হলো কোন সাড়াশব্দ নেই, থেকে থেকে শুধু পা নাচাচ্ছে আর গোগ্রাসে গিলছে বইটা।
‘এইতো, আর দুই-চার পৃষ্ঠা। এই বই নামিয়ে রাখা সম্ভব না।’
‘কসাই ঠিক করেছিলে আজকে? সকাল সকাল কাজ সেরে না ফেললে ঝামেলা বেড়ে যায়।’
‘ওহহো, মনেই ছিল না একদম,’ উঠে বসলো ফরহাদ। ‘কুরবানির ঈদে এতো কাজ। ছুটির দিনটা একটু আরাম করে ঘুমানোও যায় না।’
‘আচ্ছা, নুসরাতকে ওভেনের অতো খুঁটিনাটি শেখানোর দরকার ছিল?’ প্রসঙ্গ পাল্টালাম আমি।
‘কেন, কী হয়েছে?’ ফরহাদ আমার দিকে অবাক চোখে তাকালো। বইটা বন্ধ করে ফেলেছে।
‘না, মানে, ছোট মানুষ। ইলেকট্রিক জিনিস দিয়ে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। আর তাছাড়া, হাত পুড়ে গেলে...’
‘কী যে বলো,’ হেসে আমাকে থামিয়ে দিলো ফরহাদ। ‘আমাদের মেয়ের মাথায় অনেক বুদ্ধি। ও ওসব ভালোই বোঝে।’
‘নুসরাত খুব চুপচাপ হয়ে গেছে কয়েক মাস হলো। ঘর থেকে তেমন বের হয় না। মেজাজও খিটমিটে হয়ে যাচ্ছে।’
‘ও কিছু না। বড় হচ্ছে তো, এখন একটু বদলাবেই। আবার ঠিক হয়ে যাবে সামনে।’
‘কতোই বা বড়। মাত্র সাত বছর বয়স।’
‘তা ঠিক। ওকে আরও সময় দেয়া উচিত আমাদের।’
‘একটা জিনিস খেয়াল করেছো? ছোট বোনকে নিয়ে ওর তেমন কোন আগ্রহ নেই। মাঝে মাঝে দেখি, নুহিনের দোলনার কাছে গিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। আজ সকালেও ঘুম ভাঙিয়েছে মেয়েটার।’
‘তাই নাকি?’
‘হুম। গত সপ্তাহে নীলু আন্টি কি সুন্দর একটা মেরি গো রাউন্ড নিয়ে এলো নুহিনের জন্য। ওর দোলনার ওপর টানিয়ে দিয়েছিলাম। পরদিন দুপুরে দেখি ভেঙে কয়েক টুকরো হয়ে মাটিতে পড়ে আছে। জামাটাও ছেঁড়া।’
পাশেই দোলনাতে শোয়া নুহিনের ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকালাম আমি। কী সুন্দরই না লাগছে! কাল সকালে উঠেই কপালের বামপাশে কাজলের টিপ পরিয়ে দিতে হবে ওকে।
‘নুসরাত ভেঙেছে নাকি? ভাঙতে দেখেছো?’
‘তা দেখিনি। তবে ও ছাড়া আর কে করবে, বলো? দেড় মাস হয়ে গেলো, একবারও বাচ্চাটাকে আদর করেনি নুসরাত। তুমি-আমি কোলে নিলেও আড়চোখে কেমন করে যেন তাকিয়ে থাকে। তোমার মনে আছে নাকি জানি না, ওকে যখন প্রথমবার বললাম, ওর একটা ছোট্ট বোন হতে যাচ্ছে, তখন থেকেই কেমন যেন চুপচাপ হয়ে গেছে ও।’
‘বাচ্চাদের সাইকোলজি বোঝা মুশকিল,’ গম্ভীর কণ্ঠে বললো ফরহাদ। ‘নীতু আপার কথা মনে আছে? উনি কিন্তু হাসতে হাসতে এমন একটা কথা বলেছিলেন।’
কথাগুলো আমার মাথার ভেতর বেজে উঠল আবারঃ
“হ্যাঁরে, তানিয়া। বড় মেয়েটার দিকে একটু খেয়াল রাখিস। নতুন বাবু দেখলে কিন্তু অভিমান হতে পারে। অনেকের হয় এরকম। হঠাৎ করে মনে হয়, বাবা-মা, আত্মীয়স্বজন আগের মতো আদর করছে না, নতুন বাবুকে নিয়ে ব্যস্ত সবাই; তখন সব রাগ গিয়ে পড়ে ছোট মানুষটার ওপর। আমার বড় ছেলেটা কী করতো জানিস? আবরার হওয়ার পর ওর হাতে-পায়ে খামচি দিতো! একদিন তো খাট থেকে টেনে ফেলেও দিয়েছিল। পরে আমি আর তোর ভাই মিলে অনেক বুঝিয়েছি। এসব ক্ষেত্রে বকা দিতে নেই, আদর করে বোঝাতে হয় যে ওর আদর কমে যায়নি। খেয়াল রাখিস আমার কথা।”
‘কালকের দিনটা যাক। আমরা নুসরাতকে ভালো করে বুঝিয়ে বলব।’ ফরহাদের কথা শুনে আবার বর্তমানে ফিরে এলাম।’
‘ঠিক আছে। নুহিনকে অবশ্য আঁচড়-টাচড় কাটেনি একবারও। কিন্তু চুপচাপ দূর থেকে তাকিয়ে থাকে। কেমন যেন অস্বাভাবিক মনে হয় ব্যাপারটা।’
‘ওই যে বললাম, চাইল্ড সাইকোলজি বেশ অদ্ভুত। প্রথম বাচ্চাগুলো হঠাৎ করে একটা অ্যাটেনশন সিকিং ক্রাইসিসে ভোগে। ভাবে, এই বুঝি আমাকে আর কেউ আদর করবে না, এই বুঝি সবকিছু নতুন বাবুটার হয়ে গেলো। চিন্তা করো না। আমাদের মেয়েটা অনেক লক্ষ্মী, ঠিকমতো বোঝালেই শান্ত হয়ে যাবে।’
ঘুমে চোখ ভারি হয়ে আসছে আমার। বেডল্যাম্পটা নিভিয়ে দিলাম। গাঢ় অন্ধকারে ঢেকে গেলো পুরো ঘর। রাত পেরোলেই ঐতিহ্যবাহী ধর্মীয় উৎসব।

***

বারোটা বেজে গেছে। এখনও গরু কেটেকুটে শেষ করতে পারেনি কসাইয়ের দল। ফরহাদ কোত্থেকে ধরে নিয়ে এসেছে কে জানে, এতো ঢিলেমি করলে কাজ হয়?
সকালে উঠে এখন পর্যন্ত এক মিনিট দম ফেলার সময় পাইনি। তা ভালো, নুসরাত খাওয়া-দাওয়া নিয়ে এখন আর যন্ত্রণা করে না। একটু পায়েস মুখে দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে ও। শরীরটা নাকি ভালো লাগছে না। নুহিনেরও এখন ঘুমানোর সময়। এমনিতেও আমার বাবুটা তেমন কান্নাকাটি করে না। গোলাপি জামা পরিয়ে দুধ খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছি। ঠিক যেন পরীর দেশের রাজকুমারীর মতো লাগছে ওকে।
‘কুরবানির ঈদ শুধু নামেই ঈদ, বুঝলে?’ কপালের ঘাম মুছতে মুছতে বুয়াকে বললাম আমি। পুরো রান্নাঘরের মেঝেতে কাঁচা মাংসের ছড়াছড়ি। গন্ধে গা গুলিয়ে আসছে রীতিমতো।
‘গরীব মাইনষের আবার ঈদ, আপা। কী যে কন! আমগো সারাবছর তো একই।’
দার্শনিক আলাপ শুনতে ইচ্ছে করছে না এখন। মাইগ্রেনের ব্যথাটা আজকে আবার উঠবে, টের পাচ্ছি। আরেকটা বিরক্তিকর কাজ এখনও বাকি। ফরহাদ গরুর ভুঁড়ি খেতে পছন্দ করে। সেটা আবার গ্যারেজে লোক দিয়ে ধোয়ালে চলবে না। বাড়ির ভেতর বুয়াকে দিয়ে পরিষ্কার করাতে হবে। একশো টাকার দুটো নোট হাতে ধরিয়ে দিলে বুয়া হাসিমুখে কাজটা করে ফেলে, কিন্তু ঘরের ভেতর যে গন্ধটা ছড়ায় তা কোনভাবেই সহ্য করা যায় না।
বালতিতে ফরহাদের ‘পরম আরাধ্য’ ভুঁড়ি নিয়ে বাথরুমে ঢুকে পড়লো বুয়া, কমসে কম আধা ঘণ্টার কাজ। এই ফাঁকে ফ্রিজে রাখার জন্য কয়েকটা ছোট ছোট প্যাকেটে মাংস ভরে ফেলতে হবে।
ক্লান্ত লাগছে ভীষণ। মোবাইলে জেরি রেফারটির বেকার স্ট্রিট গানটা ছেড়ে কানে হেডফোন গুঁজে দিলাম। গান শুনে যদি একটু চাঙ্গা হওয়া যায়!

***

প্লে-লিস্ট সেট করা ছিল আগে থেকেই। বিশ মিনিট হয়েছে বোধহয়, গান শুনতে শুনতে একমনে কাজ করে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ একটা কড়া গন্ধ পেয়ে মনোযোগ ছুটে গেলো। আশ্চর্য! ডাইনিং রুম থেকে এমন তীব্র পোড়া গন্ধ আসছে কীসের?
কান থেকে একটানে হেডফোন খুলে ফেললাম। পোড়া গন্ধটা তীব্র থেকে আরও তীব্রতর হয়ে উঠছে।
‘হাহাহাহাহা... হাহ হাহ হা...’
দূর থেকে হাসির আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। না, দূরে নয়। আমার ফ্ল্যাটের ভেতরেই। সেই হাসির সুরটা ঠিক স্বাভাবিক নয়। কেমন যেন অপ্রকৃতস্থ ভাব, অপার্থিব এক অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ।
নুসরাত! নুসরাত হাসছে এমন করে! কীসের এতো আনন্দ ওর?

***

মাংসের প্যাকেটগুলো এক পাশে ঠেলে সরিয়ে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলাম। ধোঁয়া দেখা যাচ্ছে এখান থেকে। নীলচে-ধূসর ধোঁয়ার আস্তরণ। পোড়া গন্ধে ভারী হয়ে আছে ঘরের বাতাস।
শিশুকন্ঠের হাসিতে তেমন তীব্রতা নেই। তবুও যেন ঘরের দেয়ালে চিড় ধরে যাচ্ছে সেই শব্দে। কেঁপে উঠছে ঘরের মেঝে।
এইতো নুসরাতকে দেখা যাচ্ছে, উল্টো ঘুরে দাঁড়িয়ে থাকায় মুখটা চোখে পড়ছে না। ডাইনিং রুমের ফ্রিজের ধার ঘেষে দাঁড়িয়ে আছে ও।
ওভেনের সামনে।
হাতে সেই ভাঙা লালরঙা মেরি গো রাউন্ডটা ধরে রাখা।
আড়চোখে একবার আমার ঘরের খোলা দরজা দিয়ে ভেতরে তাকালাম। গোলাপি রঙের ফিডার মেঝেতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। ড্রেসিং টেবিলের ওপর থেকে কাজলদানি যেন উপহাস করছে আমাকে।
দোলনাটা ফাঁকা।
নুসরাতের হাসি যেন আমার মস্তিষ্কের কোষের ভেতর ঢুকে ছিন্নভিন্ন করে ফেলছে সবকিছু।
আতঙ্ক মিশ্রিত বিস্ময় নিয়ে ওভেনটার দিকে তাকালাম। মিশেনহেম ব্র্যান্ডের ইন্ড্রাস্টিয়াল কনভেকশন ওভেন। বিরাট বড় স্টিলের বাক্সটার কাচের ঈষদচ্ছ দরজার ভেতর ঘুরপাক খাচ্ছে কিছু একটা। মিটমিট করে ভোতা একটা হলদে আলো জ্বলছে। ভেতর থেকে ধোঁয়া বেরিয়ে ছড়িয়ে আছে পুরো ঘর জুড়ে। মাংস পোড়া গন্ধে শ্বাস নেয়া দায়!
জ্ঞান হারানোর ঠিক আগ মুহূর্তে ফরহাদের কথাগুলো কানে বাজলো আমার।
‘মিডিয়াম রেয়ার বিফ স্টেক, গ্রিল, উমম... দারুণ একটা জিনিস কিনেছি...’

সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই এপ্রিল, ২০১৮ রাত ১০:০৪
৩টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কষ্ট থেকে আত্মরক্ষা করতে চাই

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৯



দেহটা মনের সাথে দৌড়ে পারে না
মন উড়ে চলে যায় বহু দূর স্থানে
ক্লান্ত দেহ পড়ে থাকে বিশ্রামে
একরাশ হতাশায় মন দেহে ফিরে।

সময়ের চাকা ঘুরতে থাকে অবিরত
কি অর্জন হলো হিসাব... ...বাকিটুকু পড়ুন

রম্য : মদ্যপান !

লিখেছেন গেছো দাদা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৫৩

প্রখ্যাত শায়র মীর্জা গালিব একদিন তাঁর বোতল নিয়ে মসজিদে বসে মদ্যপান করছিলেন। বেশ মৌতাতে রয়েছেন তিনি। এদিকে মুসল্লিদের নজরে পড়েছে এই ঘটনা। তখন মুসল্লীরা রে রে করে এসে তাকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

মেঘ ভাসে - বৃষ্টি নামে

লিখেছেন লাইলী আরজুমান খানম লায়লা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৩১

সেই ছোট বেলার কথা। চৈত্রের দাবানলে আমাদের বিরাট পুকুর প্রায় শুকিয়ে যায় যায় অবস্থা। আশেপাশের জমিজমা শুকিয়ে ফেটে চৌচির। গরমে আমাদের শীতল কুয়া হঠাৎই অশীতল হয়ে উঠলো। আম, জাম, কাঁঠাল,... ...বাকিটুকু পড়ুন

= নিরস জীবনের প্রতিচ্ছবি=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৪১



এখন সময় নেই আর ভালোবাসার
ব্যস্ততার ঘাড়ে পা ঝুলিয়ে নিথর বসেছি,
চাইলেও ফেরত আসা যাবে না এখানে
সময় অল্প, গুছাতে হবে জমে যাওয়া কাজ।

বাতাসে সময় কুঁড়িয়েছি মুঠো ভরে
অবসরের বুকে শুয়ে বসে... ...বাকিটুকু পড়ুন

Instrumentation & Control (INC) সাবজেক্ট বাংলাদেশে নেই

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৫




শিক্ষা ব্যবস্থার মান যে বাংলাদেশে এক্কেবারেই খারাপ তা বলার কোনো সুযোগ নেই। সারাদিন শিক্ষার মান নিয়ে চেঁচামেচি করলেও বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরাই বিশ্বের অনেক উন্নত দেশে সার্ভিস দিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×