somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সাতটি তারার তিমির

২২ শে মে, ২০১৮ বিকাল ৪:৩৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ঘুটঘুটে অন্ধকার ঘরটায় চুপচাপ শুয়ে আছে অনিমেষ। এই ঘরটায় দিনের বেলাও আলোর উপস্থিতি নিষিদ্ধ, ভারি পর্দায় চব্বিশ ঘণ্টা ঢাকা থাকে উত্তরের জানালা। পৃথিবীতে এমন কিছু জিনিস আছে, যেগুলোকে যুক্তিযুক্ত কারণ ছাড়াই একসাথে পাবার নির্দোষ প্রত্যাশা করা হয়। অন্ধকারের সাথে নৈশব্দের উপস্থিতি ঠিক তেমনই একটা ব্যাপার। অবশ্য প্রত্যাশার সাথে সবসময় বাস্তবের মিল থাকে না, সে কথাটাও সত্য। পাশের রান্নাঘরের সিঙ্ক থেকে ভেসে আসা টুপটাপ পানির শব্দে অদ্ভুত এক ছন্দ, ঘড়ির কাটার সাথে সমান তালে বেজে যাচ্ছে। উঠে গিয়ে কলটা বন্ধ করতে পারলে ভালো লাগতো। ঘড়ির ব্যাটারিও খুলে রাখা দরকার। একমাত্র বিশুদ্ধ অন্ধকারের উপস্থিতিতে মুক্ত চিন্তা করা যায়, অনাকাঙ্ক্ষিত শব্দের কারণে তাতে বাধা সৃষ্টি হচ্ছে। একবার পাশ ফিরল অনিমেষ। বিছানা থেকে উঠতে ইচ্ছা করছে না এখন।
সূর্য থেকে যেমন গোলাপ গাছ আলো শুঁষে নেয়, ঠিক তেমনিভাবে শুঁষে নেয় অচ্ছুৎ কাঁটাগাছও। একই মাটিতে প্রোথিত অবস্থায় কোন এক জঙ্গলে তারা এক সাথেই বাস করে। কেউ কারও অস্তিত্ব না জেনেই। মস্তিষ্কের ধূসর কোষগুলোকে সেই জঙ্গলের সাথে তুলনা করা যাক, সুখের স্মৃতিগুলোকে গোলাপ আর দুঃখকে কাঁটাগাছ। নির্দিষ্ট প্রভাবকের উপস্থিতিতে দু’জনই আত্মপ্রকাশ করে অপ্রত্যাশিতভাবে।
হয়তো সে কারণেই, হঠাৎ এই অন্ধকার ওকে সাত বছর আগের এক আঁধারঘেরা সকালের কথা মনে করিয়ে দেয়। বৈশাখের শুরুর দিকের কথা, যখন তখন আকাশ কালো করে ঝড় শুরু হওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। এমন এক সকালে অনিমেষ ওর ভার্সিটির বারান্দায় অস্থিরভাবে পায়চারি করছিল। ক্লাস বাতিল হয়ে যাবার তীব্র সম্ভাবনা তখন, আশেপাশে কারো ছায়াও দেখা যাচ্ছে না। ঝড়ের ভেতর বাড়ি ফিরবে কী করে এই ভাবনায় যখন দোমনামনি চলছে, তখনই চোখে পড়েছিল দৃশ্যটা।
বারান্দার আরেক মাথায় রেলিং ধরে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে শ্রাবণী। মুখের বাম পাশটা চুলের আড়ালে ঢেকে ঢাকা। কানে হেডফোন, মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আকাশের দিকে। ধূসর অন্ধকারে এমন একটা দৃশ্যকে অনিমেষ থমকে দাঁড়াল। শ্রাবণীকে এই ছয় মাসে প্রতিদিন দেখেছে; ভার্সিটিতে ওর সবচেয়ে কাছের বন্ধু বলতে তো এই মেয়েটাই। কিন্তু এই ধূসর অন্ধকারে মিশে থাকা শ্রাবণী ওর পরিচিত নয়, যেন অন্য জগতের কেউ। যাকে শুধু দূর থেকে দাঁড়িয়ে দেখতে ইচ্ছে করে, নির্বাক, নির্নিমেষ।
পায়ের শব্দ শুনে পেছনে ঘুরে তাকালো শ্রাবণী।
“এই অনিমেষ, শুনে দেখতো, এটা কী গান। রেডিও স্টেশনে হঠাৎ করে বাজছে। শুনে বল, কার গান, কী গান। বাসায় গিয়ে আমাকে ডাউনলোড করে পাঠাবি।”
একটানা বলে গেলো মেয়েটা। অনিমেষ সম্মোহিতের মতো ওর পাশে গিয়ে দাঁড়াল, যেন কথা বলতে ভুলে গিয়েছে। শ্রাবণী হেডফোনের একটা তার খুলে ওর কানে লাগিয়ে দিলোঃ

And I’m never gonna leave your side,
I’m never gonna leave your side...”

অখ্যাত কোন এক গায়কের গান, আগে কখনও শুনেছে বলে মনে পড়ে না। তবে গানের সুর অনিমেষের মাথায় ঢুকছে না তখন। পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে ওরা, একই হেডফোনের দুই প্রান্ত দিয়ে গান শুনছে। বৃষ্টির পূর্বাভাস হিসেবে ভেসে আসা মাটির সোঁদা গন্ধের সাথে মিশে গিয়েছে শ্রাবণীর শরীরের মিষ্টি সুঘ্রাণ।
এ তো সেই শ্রাবণী, ভার্সিটির সব বন্ধুরা যাকে জোর করে ওর প্রেমিকা বানাতে চায়। এই নিয়ে দুই বন্ধুর মাঝে কতোই না হাসাহাসি! কী আশ্চর্য, ছেলে মেয়ে কি ভালো বন্ধু হতে পারে না? সারাদিন একসাথে ঘুরলেই কী প্রেম হয়ে গেলো নাকি?
কিন্তু সত্যিই কী তাই? কয়েক মিনিট আগেও অনিমেষ কথাটা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতো। কিন্তু বৃষ্টিস্নাত এই রহস্যময় সকালে যেন সেই বিশ্বাসে ফাটল ধরাতে সিদ্ধহস্ত। এমন কিছু তো হওয়ার কথা ছিল না কখনও!
কড়কড় শব্দ করে বাজ পড়ল দূরে কোথাও। একই সাথে তুমুল বেগে বৃষ্টি নেমে ওর চিন্তায় ছেদ ঘটালো।
পানির জোর ঝাঁপটা এসে লাগছে দু’জনের চোখে-মুখে।
শ্রাবণী এক লাফে রেলিং থেকে পিছে সরে দাঁড়াল, বৃষ্টিতে ভিজলে মাথা ব্যথা করবে। ঠিক তখনই চোখাচোখি হলো অনিমেষের সাথে। পাথরের মূর্তির মতো তাকিয়ে আছে ছেলেটা, ওর চোখের দিকে।
হ্যাঁ, অনিমেষ তাকিয়ে আছে। অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর চোখজোড়ার দিকে। ঝাউয়ের শাখার মতো দীর্ঘ কালো পাঁপড়ির আড়ালে সযত্নে আশ্রয় করে নেয়া সেই চোখ। বিড়ালের চোখের মতো স্বর্ণালি স্বচ্ছ মণি। শ্রাবণীর এই ‘ক্যাট’স আইয়ের’ প্রশংসা সবাই করে, কিন্তু এতদিন যেন সেই সৌন্দর্য অনিমেষের কাছে পুরোপুরি অদৃশ্য হয়ে ছিল!
শ্রাবণী মায়াভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। বিশুদ্ধ, পবিত্র, আত্মায় ঝড় তুলে দেয়া সেই দৃষ্টি।
অনিমেষ আবারও পাশ ফিরল। অন্ধকারে শুয়ে সাত বছর আগের সেই অন্ধকার সকালের কথা এতো স্পষ্টভাবে মনে পড়বে, তা কল্পনাও করতে পারেনি। সেদিন সকালেই ও প্রথমবার উপলব্ধি করেছিল, বন্ধুত্বের সীমারেখায় আর নিজেকে বেঁধে রাখা সম্ভব নয়। শ্রাবণীকে ভালোবাসে অনিমেষ, ভীষণ রকমের।
তবে কথাটা সে শ্রাবণীকে বলতে চায়নি শুরুতে। ও জানতো, মেয়েটার পরিবার কিছুটা প্রাচীনপন্থী। ইচ্ছে করলেও, কারো সাথে সম্পর্কে জড়াতে পারবে না। জোর করে নিজের আবেগকে গলা টিপে মারবে শ্রাবণী। ভালোবাসার কথা প্রকাশ পেলে বরং দু’জনের বন্ধুত্বে চিড় ধরবে। অন্তত সেটা টিকিয়ে রাখতে হলেও নিজের অনুভূতিকে মাটি চাপা দিতে হবে।
কিন্তু, তাই কী আর হয়? অনেক চেষ্টা করেও নিজেকে ধরে রাখতে পারলো না। দুই-এক সপ্তাহ নাহয় অভিনয় করা যায়। কিন্তু মানুষ কি নিজের সাথে অভিনয় করে টিকে থাকতে পারে কখনও?
ভালোবাসা ব্যাপারটাকে মেয়েরা খুব সহজেই আঁচ করতে পারে। সৃষ্টিকর্তা এই বোধশক্তিকে উপহার হিসেবে দিয়েছেন ওদের।
তার ওপর ওরা আবার ঘনিষ্ঠ বন্ধু।
বন্ধুত্বটাই শেষ করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল অনিমেষ, ভেবেছিল দূরে দূরে থাকবে। তবে জোর করে দূরে থাকতে গিয়ে, কদিনের ভেতর অনিমেষের পাগল হওয়ার অবস্থা হয়ে গেলো। ভার্সিটিতে গিয়ে শ্রাবণীর কাছ থেকে দূরে সরে থাকা, রাতে ফোন না ধরা, এগুলো নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়ালো। বিছানায় শুয়ে শুয়ে কষ্টে কাঁদতো ও। এভাবেই কেটে গিয়েছিল মাস দুয়েক।
অবশেষে সেই বিশেষ দিন ঘনিয়ে এলো। শ্রাবণী সবকিছুই জানে, তবুও সরাসরি কথাগুলো ওকে বলার সিদ্ধান্ত নিলো অনিমেষ। নাহলে নিজেকে কাপুরুষ ভেবে একটা আফসোস থেকে যাবে। কিছু হোক আর না হোক, শ্রাবণীকে নিজের কথাগুলো জানাতেই হবে। অন্তত বুকের ওপর থেকে একটা বোঝা নেমে যাক!
ভার্সিটিতে ছুটি চলছে তখন, নভেম্বরের বিকালে একটা আইসক্রিম পার্লারে মেয়েটাকে ডাকলো অনিমেষ। ঘণ্টা দুয়েক চুপচাপ কেটে গেলো, কারও মুখে কোন কথা নেই। অবশেষে শ্রাবণীই নীরবতা ভাঙলঃ
“আমার যেতে হবে, অনিমেষ। সন্ধ্যার আগে বাড়ি ফিরতে হবে।”
শ্রাবণীর পেছন পেছন নেমে গিয়েছিল অনিমেষ। রাস্তায় নেমে অনুরোধ করে আরেকটা রেস্টুরেন্টে ঢুকেছিল তারপর। সেখানেও আধ ঘণ্টা কেটে গেলো চুপচাপ। শ্রাবণী উঠে দাঁড়াবে, ঠিক এমন সময় খপ করে ওর হাত চেপে ধরেছিল অনিমেষ। চোখের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বলেছিল নিজের অনুভুতির কথা। শ্রাবণীর হাত দুটো থরথর করে কাঁপছিল তখন। ওদিকে অনিমেষ হৃদয় নিংড়ে বের করে দিচ্ছল জমে থাকা সব কথা।
সেদিন রাতে বাড়িতে ফিরেই ওকে টেক্সট করেছিল শ্রাবণী। জানিয়ে দিয়েছিল, সে-ও অনিমেষকে ভালোবাসে। স্বপ্নের মতো শুরু হয়েছিল ওদের সম্পর্কটা।
দিনগুলোও কেটে যাচ্ছিল স্বপ্নে স্বপ্নেই। সাত সাতটা বছর, প্রতিটা মূহুর্ত আনন্দের, প্রাপ্তির, সুখের। শ্রাবণীর হাতে হাত রেখে অনিমেষের মনে হতো, পৃথিবীতে ওর কিছু চাওয়ার নেই আর। ওই হাসিমুখের দিকে তাকিয়েই নির্দ্বিধায় কাটিয়ে দেয়া যায় গোটা জীবন।
সে যেন আরেক জীবনের স্মৃতি। শ্রাবণীর মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠলো আবারও। ঝাপসা, কুয়াশাচ্ছন্ন এক জগতে দাঁড়িয়ে আছে সে। আবছা আবছা দেখা যাচ্ছে। মুখে হাসি নেই, চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে মুক্তোর মতো অশ্রুকণা। অনিমেষের কল্পনায় সেই কান্নাভেজা চেহারাটাই ভেসে ওঠে বারবার। অদৃশ্য প্রেতাত্মার মতো ওকে আতঙ্কিত করে তোলে, পাথরের মতো চেপে বসে বুকের ওপর।
টিকটিকটিক...
ঘরের অন্ধকার কোণা থেকে সশব্দে নিজের অস্তিত্বের কথা জানালো একটা টিকটিকি। অনিমেষের ঘোর কেটে গেলো তাতে। মাথার ভেতর স্মৃতিগুলো ঘূর্ণিঝড়ের মতো ঘুরপাক খাচ্ছে। আঁধারেই ফিরে আসে আঁধারের স্মৃতি, কতো অজস্র রকমের। শ্রাবণীর জন্মদিনগুলোতে ঠিক রাত বারোটায় ওর অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিংয়ের নিচে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতো অনিমেষ, কখনও বেলুন আবার কখনও এক গোছা ফুল হাতে। প্রথমবারের পর প্রতি বছর শ্রাবণী ষোক্টভাবে নিষেধ করতো এই পাগলামি করতে। তবুও পরের বছর রাস্তার ধারে দেখা যেতো অনিমেষকে, একই ভাবে দাঁড়িয়ে আছে। একবার তো আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নেমেছিল। চৌদ্দো তলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে শ্রাবণী দেখেছিল অনিমেষ হাসিমুখে মাঝরাতের বৃষ্টিতে ভিজছে, আর ঠকঠক করে কাঁপছে। ওপর থেকে ওর মুখ ঠিকমতো দেখতে পায়নি শ্রাবণী, তবুও ভালোবাসার অশ্রু গড়িয়ে পড়েছিল নিজের অজান্তেই। সেই অন্ধকার রাতের স্মৃতিগুলো কি ভোলা সম্ভব?
চৌদ্দ তলা সেই বাড়িটা এখনও দাঁড়িয়ে থাকে সদম্ভে। গতকাল বিকালেও একটা কাজে ওই এলাকায় গিয়েছিল অনিমেষ। রাস্তা পার হবার সময় ওদিকে চোখ পড়তেই ধক করে উঠেছিল বুকের ভেতর। অট্টহাসি হেসে যেন তাচ্ছিল্য করছিল ওকে, দুমড়ে মুচড়ে দিতে চাইছিল নিজের ইট-সিমেন্টের কাঠামোর নিচে। শ্রাবণী ওখানেই আছে, বারান্দা সংলগ্ন ঘরের ভেতর। পার্থক্য একটাই, এই শ্রাবণী আর অনিমেষের শ্রাবণী নেই। আর বাড়িটা দাঁড়িয়ে আছে ঘাতক স্মৃতিসৌধ হয়ে।
ভালোবাসা এক অদৃশ্য সুতো, দু’জন মানুষ তাতে বাঁধা পড়ে গেলে সবকিছু বদলে যায়। একা বলতে তখন আর কিছুর অস্তিত্ব থাকে না। চিন্তাগুলো পাল্টে যায়, বদলে যায় জীবনের সমস্ত পরিকল্পনা। অপরিণত দৃষ্টিভঙ্গির ছেলেটা জীবন নিয়ে ভাবতে শুরু করে। বাড়ির আহ্লাদী মেয়েটা চুপিচুপি রান্নাঘরে ঢুকে প্রেমিকের পছন্দের খাবার রাঁধতে গিয়ে হাত পুড়িয়ে ফেলে। একসাথে বাঁচার আকাঙ্ক্ষায় স্বপ্নের তুলিতে চড়ানো হয় হরেক রকমের রঙ, বাস্তবতার ক্যানভাসে তা যতো স্পষ্টভাবে ফুটিয়ে তোলা যায়, ততোই সুখের হয় জীবন।
শ্রাবণী আসার পর অনিমেষের জীবনের সবকিছু বদলে গিয়েছিল আক্ষরিক অর্থেই। ও একটা জিনিসই বিশ্বাস করতো, শ্রাবণীকে খুশি রাখতে হবে, যা কিছু সব ওর জন্যেই। তবে নিজের প্রতি উদাসীন ভাবটা সে কাটিয়ে উঠতে পারেনি কখনো।
সেই দায়িত্বটা অবশ্য শ্রাবণী নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিল। অনিমেষ নাস্তা না খেয়ে তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে পড়তো প্রতিদিন সকালে। ভার্সিটিতে আসার আগে শ্রাবণী তাই ভোরে উঠেই বানাতো কিছু না কিছু, জোর করে খাইয়ে দিতো ওকে। অসুখ হলে অনিমেষ কষ্ট পেতো, কিন্তু ওষুধ খাওয়ার কথা মাথায় আনতো না। শ্রাবণীই জোর করে ওষুধ খাইয়ে দিতো ওকে, পাশে না থাকলে ফোনে মনে করিয়ে দিতো দুইবেলা।
আজ তিনদিন ধরে খুব জ্বর অনিমেষের, সাথে প্রচণ্ড মাথাব্যথা। কোথায় শ্রাবণী? কোথায়? মোবাইল ফোনটা নিতান্তই এক অপ্রয়োজনীয় বস্তুতে পাল্টে গিয়েছে এখন। মরা ইঁদুরের মতো এক কোণায় নিশ্চুপ নিথর হয়ে পড়ে থাকে। আর ইঁদুরপচা দুর্গন্ধের মতো প্রতিমুহূর্তে মনে করিয়ে দেয়, ক’দিন আগেও তাতে জীবনের স্পন্দন ছিল।
শ্রাবণীকে নিয়ে কিছু অস্বাভাবিক ভয় কাজ করতো অনিমেষের মনের ভেতর। বাড়ি পৌঁছে ফোন না করলে অথবা অনেকক্ষণ ফোন না ধরলে, ওর দম আটকে আসতো। একটানা ফোন করতো পাগলের মতো। একশবারের বেশি রিং বাজার নজিরও আছে! শ্রাবণী হয়তো ঘরের বাইরে থাকতে পারে, এই কথাটা ওর মাথায় আসতে চাইতো না। মনে হতো, এই বুঝি হারিয়ে ফেলেছে ওকে।
সেই যুক্তিহীন ভয়টা আজ নির্মম বাস্তব, বিশ্বাস করতে ইচ্ছা করে না অনিমেষের।
সাত বছরের সাত লক্ষ স্মৃতি, কোনটাকে আলাদা করে মুছবে অনিমেষ? ছোট-বড় প্রতিটা সাফল্যের সময় শ্রাবণী পাশে ছিল, ব্যর্থতার সময়গুলোতেও আঁকড়ে ধরেছিল পরম মমতায়। জীবন থেকে হারিয়ে গেছে সত্যি, কিন্তু সবকিছুতে ওর অদৃশ্য ছোঁয়া লেগে আছে। টেবিলের কোণায় যে চিরুনিটা পড়ে আছে, সেটাও শ্রাবণীর। শরতের কোন এক বিকেলে কাশবনে বেড়াতে গিয়েছিল ওরা। শ্বেতশুভ্র কাশফুলের আড়ালে লাল পোশাকের মেয়েটা খুশিমনে হেঁটে বেড়াচ্ছিল। ব্যাগ থেকে চিরুনিটা মাটিতে পড়ে গিয়েছিল হঠাৎ। অনিমেষ তুলে নিয়েছিল, নিজের কাছে রাখবে বলে। ওর পাগলামি দেখে খুব হেসেছিল মেয়েটা।
ভালোবাসার মানুষ কি সত্যিই হারায়? হারাতে পারে? নাকি তারা বেঁচে থাকে সঙ্গীর রক্তে মিশে? প্রতিটা রঙে, প্রতিটা সুরে, সুগন্ধে তারা ফিরে আসে; ফিরে আসে নতুন করে, পুরনো কথা মনে করিয়ে দিতে!
ঘরের বাতাসে মিশে আছে শ্রাবণী, অনিমেষ অনুভব করতে পারে। বাতি জ্বালালেই প্রতিটা কোণায় দেখা যাবে ওকে। হাসছে, কাঁদছে, অথবা হতবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। বিড়ালচোখী সেই দৃষ্টিতে পৃথিবীর সব রহস্য একসাথে জমাট বাধা।
রাতের অন্ধকারে পাবলো নেরুদার কবিতার কয়েকটা লাইন অনিমেষের মাথার ভেতর তোলপাড় করে দিচ্ছে। ছিয়ানব্বই বছর আগে হয়তো এমনই কোন রাতে তিনি লিখেছিলেন-

Tonight I can write the saddest lines...
.....................................................
I no longer love her, that’s certain, but maybe I love her.
Love is so short, forgetting is so long.
Because through nights like this one I held her in my arms
My soul is not satisfied that it has lost her.
Though this be the last pain that she makes me suffer
and these the last verses that I write for her.

উঠে বসলো অনিমেষ। অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে পানিভর্তি গ্লাসটা খুঁজে বের করলো। এক ঢোকে পানি শেষ করার সময় টের পেলো, বুকের ভেতরটা কেমন যেন ব্যথা করছে।
পানি! এই পানিকে নিয়েও ভয় ছিল অনিমেষের। অন্ধকারে বসে আরেকটা স্মৃতি রোমন্থন করা যাক!
এক বছর আগের কথা, ওদের সম্পর্কটা ছয় বছর পেরিয়ে সাতে পা রাখতে যাচ্ছে তখন। ভার্সিটির গণ্ডি পেরিয়েছে, একই প্রতিষ্ঠানে শিক্ষানবিশ হিসেবে কর্মরত দু’জন।
বন্ধুদের সাথে সমুদ্র ভ্রমণের একটা প্ল্যান হলো। অনিমেষ আগে কখনও সমুদ্র দেখেনি জেনে ওর বন্ধুরা খুব অবাক হয়েছিল সেবার। শুরুতে ছেলেরা মিলে জোট পাকালেও তিন বান্ধবী মিলে জেদ ধরে বসলো, ওদেরকে নিতে হবে। অগত্যা বাধ্য হয়েই রাজি হতে হলো। শ্রাবণীর হাত ধরে প্রথমবার সমুদ্র দেখবে, তাতে কী অনিমেষ রাজি না হয়ে পারে?
প্রথম সমুদ্র দেখার অভিজ্ঞতার সাথে বোধহয় আর কিছুর তুলনা হয় না। বিস্তৃত জলরাশি, ফোঁস ফোঁস শব্দে ঢেউ ভাঙছে, কোন কুল-কিনারা নেই; বাতাসের তোড়ে উড়ে যাওয়ার উপক্রম। সূর্য ডুবে গেছে কিছুক্ষণ আগে, আকাশে গাঢ় নীলচে মন খারাপ করা রঙ। অনিমেষ পানি ভয় পায়; একে তো সাঁতার জানে না, তার ওপর এমন দৃশ্য দেখে সে অভ্যস্ত নয়। একরকম টানাটানি করেই ওকে সমুদ্রের কাছাকাছি নিয়ে গেলো শ্রাবণী। কিনারা ঘেঁষে দাঁড়াতেই ফেনিল জলরাশি স্পর্শ করে গেলো ওদের পা। অনিমেষ হঠাৎ আবিষ্কার করলো, নিচ থেকে বালি সরে যাচ্ছে। আতঙ্কে চোখ বন্ধ করে ফেললো সে, শক্ত করে চেপে ধরল শ্রাবণীর হাতটা।
“চোখ খোল, অনিমেষ। আমি আছি তো। কিচ্ছু হবে না। দেখো, সমুদ্র কত সুন্দর!”
বেশ কিছুক্ষণ পর, সমুদ্রের ধার ঘেষে নির্জন এক কোণায় বসে আছে দু’জন। শ্রাবণীর মাথাটা আলতো করে অনিমেষের কাঁধে রাখা। অন্ধকারে কিছু দেখা যাচ্ছে না, শুধু সমুদ্রের সো-সো শব্দ। অনিমেষের মাথার ভেতরটা কেমন যেন ফাঁকা হয়ে আছে। শ্রাবণীকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো ও, যেন হাত ছাড়লেই হারিয়ে যাবে। চোখ থেকে এক ফোঁটা পানি গড়িয়ে শ্রাবণীর কপাল স্পর্শ করে গেলো।
ব্যস্ত হাতে অনিমেষের চোখের পানি মুছে দিলো শ্রাবণী। আরও কাছে টেনে নিলো ওকে। জনশূন্য এই পৃথিবীতে যেন ওরা একমাত্র মানব-মানবী, আর কোন কিছুর অস্তিত্ব নেই।
“আমি আছি, অনিমেষ। তোমাকে ছাড়া কি আমিও থাকতে পারব, বলো? আমি আছি, এই যে দেখো। তোমার পাশে, আমি আছি তো...”
আমি আছি তো...
আমি আছি তো...
ঘরের দেয়ালে তীব্র থেকে তীব্রতর সুরে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে শ্রাবণীর কণ্ঠস্বর। অনিমেষের কানের পর্দা ফেটে যেন রক্ত বেরিয়ে আসবে এখনই। পাশে থাকার আশ্বাস দিয়ে কেউ দূরে সরে যেতে পারে? নাকি নিজেই তাকে দূরে ঠেলে দিয়েছে ও? চেষ্টা করেনি ফিরিয়ে আনতে, ধরে রাখতে নিজের কাছে!
মৃত্যুর আগ পর্যন্ত একসাথে থাকার যে প্রতিশ্রুতি নিয়ে সম্পর্কের সূত্রপাত ঘটেছিল, সাত বছরের সীমানায় থমকে দাঁড়ালো তা। অন্ধকার রাতগুলোতে এই সহজ সত্যকে মেনে নিতে পারে না অনিমেষ।
নরকের সংখ্যা সাত, মহাপাপের সংখ্যাও সাত। রঙধনুর রঙ অথবা রুবারের তারের সংখ্যা সাত। প্রাণদায়ী বাতাসে মিশে থাকা যবক্ষারজানের পারমাণবিক সংখ্যা, গ্রীবাদেশের কশেরুকা, সৌরমণ্ডলের জ্যোতিষ্ক, কাল্পনিক অথবা বাস্তবিক আটলান্টিস নগরীর দ্বীপ- সবকিছুই সাত। দিনের সংখ্যা সাত, মহাদেশের সংখ্যা সাত। মহাপ্রলয়ের কালে নূহের নৌকায় জোড়ায় জোড়ায় ঠাই পাওয়া প্রত্যেক প্রজাতির সংখ্যা সাত।
সৌভাগ্যের প্রতীক সাত।
আবার দুমড়ে-মুচড়ে, ভেঙ্গে-চুরে ধ্বংসের ইতিহাস হয়ে টিকে থাকা সাত বছর।
সাতটি তারার তিমির।।

সর্বশেষ এডিট : ২২ শে মে, ২০১৮ বিকাল ৪:৩৫
৫টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতীয় পণ্য বয়কটের কেন এই ডাক। একটি সমীক্ষা-অভিমত।।

লিখেছেন সাইয়িদ রফিকুল হক, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৩:১৫



ভারতীয় পণ্য বয়কটের কেন এই ডাক। একটি সমীক্ষা-অভিমত।।
সাইয়িদ রফিকুল হক

বিএনপি ২০২৪ খ্রিস্টাব্দে দেশে অনুষ্ঠিত “দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে”-এ অংশগ্রহণ করেনি। তারা এই নির্বাচনের বহু আগে থেকেই নির্বাচনে অংশগ্রহণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৩৮


এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।

ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×