আশ্বিনের কোন এক রাতে আমরা দেখতে পাই, দিনভর কেরোসিন কাঠস্বরূপ খটখটে শুকনো আকাশটা হঠাৎ চেহারা বদলে ফেলেছে। কোনরকম পূর্বাভাস ছাড়াই মাঝরাতের মিনিট পনেরো আগে বিদ্যুৎ চমকে ওঠে, ভীষণ বাতাসে উপড়ে পড়তে চায় শহরের অবহেলিত দীর্ঘাঙ্গী নারিকেল আর ইউক্যালিপ্টাস গাছ। ভারী বর্ষণ, সুঁই ঝরে পড়ে আকাশ থেকে। তীক্ষ্ম ডগা, সূক্ষ্ম দেহ; লক্ষ লক্ষ সুঁই ঝরে বায়ুস্তর ভেদ করে, ক্ষ্যাপা মহিষের মতো ওরা ছুটে আসে মাটি বরারর। বৃষ্টি হয়ে আমাদের চোখে ধরা দেয় বহুরূপী সু্ঁই, অথচ গায়ে বিধলেই চামড়া ফুটো হবে। সাত আসমান ফুঁড়ে ছুটে আসা ধারালো সূচ চামড়ার সাতটি স্তর ভেদ করে প্রথিত হবে গভীর থেকে গভীরে
আকাশ থেকে বিষাক্ত সুঁই ঝরে পড়ছে। তীক্ষ্ম ডগা, সূক্ষ্ম দেহ; লক্ষ লক্ষ সুঁই।
আমাদের সম্মিলিতি দৃষ্টিশক্তি একীভূত হয়ে যায়। ছায়ার মতো অদৃশ্য হয়ে ভাসতে ভাসতে আমরা দেখি, সড়কের একপাশে বিশালাকৃতি দালানের নিচে গুটিসুটি মেরে দাঁড়ানো এক কুকুর। সূচবিদ্ধ, রক্তাক্ত সেই কুকুরের যন্ত্রণায় কাতর হবার কথা, তবুও কোন এক অজানা কারণে ওর ঘোলাটে চোখে আমরা মায়া দেখতে পাই। নেশায় বিভোর, মন্ত্রমুগ্ধ কুকুরটাকে কেউ জানায়নি কেন? আকাশ থেকে সুঁই নেমে আসছে। মুহূর্তের ব্যবধানে পিঠ-পাজর ভেদ করে ঢুকে যাবে ওরা।
মাঝরাতের কালো পর্দায় ঢাকা চারদিক, লক্ষ লক্ষ ধারালো ধাতব সু্ঁই ঝলমলিয়ে ধেয়ে আসছে মাটির দিকে। হঠাৎ এই রুপালী-কালো কন্ট্রাস্টের বাইরে আমাদের দৃশ্যপটে হাজির হয় গাদাখানেক বেলুন। বেগুনি, নীল, আসমানী, সবুজ, হলুদ, কমলা, লাল- হাইড্রোজেন গ্যাসভরা হরেক রঙের বেলুন। মহাকর্ষকে তুচ্ছজ্ঞান করে, মাটির পৃথিবীকে ধিক্কার জানিয়ে ওরা উঠছে, তীব্র বেগে উঠে যাচ্ছে আকাশের দিকে। অথবা হয়তো আকাশ নয়, বিশালাকৃতি দালানের চৌদ্দতলা বরাবর ওরা আশ্রয় নিতে চায়।
আকাশ থেকে বিষাক্ত সুঁই ঝরে পড়ছে। তীক্ষ্ম ডগা, সূক্ষ্ম দেহ; লক্ষ লক্ষ সুঁই।
প্রথমে চুপসে যায় বেগুনি বেলুন। তারপর নীল, আসমানী, সবুজ, হলুদ। অসুরের মতো ছুটে আসা সুঁইয়ের নির্মম খোঁচায়, ওদের দর্পচূর্ণ হয়। মরে যাওয়া তারার মতো ওরা ছিটকে পড়ে কক্ষপথ থেকে।
কমলা আর লাল এখনও চুপসে যায়নি। তবে আসন্ন পরিণতির কাছে হার মানতে বাধ্য হয় ওরা। আমরা চুপচাপ চেয়ে দেখি, হাইড্রোজেন গ্যাসের ঊর্ধ্বগামী ক্ষমতাকে অগ্রাহ্য করে উল্টোপথে ওরা ধেয়ে আসে পিচঢালা কালচে রাস্তার দিকে। সময় থমকে যায়, অনন্তকাল ধরে নেমে আসতে থাকে দুই বেলুন। তারপর হঠাত, একটা দোতলা বাসের চাকার নিচে আত্মাহুতি দেয়। নৈ:শব্দে জর্জরিত পৃথিবীতে ওদের আর্তনাদ সশব্দে ধ্বনিত হয় না। তবে আমরা বুঝতে পারি, সময় চলতে শুরু করেছে আবার।
আকাশ থেকে বিষাক্ত সুঁই ঝরে পড়ছে। তীক্ষ্ম ডগা, সূক্ষ্ম দেহ; লক্ষ লক্ষ সুঁই।
দালানের ওপরতলায় পর্দার আড়ালে কারও ছায়া জমাট বাধতে শুরু করে, একটু একটু করে রূপ নেয় মানবদেহের আকৃতি। সেখানকার পরিস্থিতি জানার জন্য মন ব্যকুল হয়ে উঠলেও, আমাদের সম্মিলিত দৃষ্টি আবারও ক্যামেরার ফোকাল পয়েণ্টের মতো নিচের দিকে আটকে যায়।
নেড়ি কুকুরটা কখন যেন অন্য পথে হাঁটা দিয়েছে!
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে ডিসেম্বর, ২০১৮ ভোর ৪:১৯