। এক।
আতর আলীর মেজাজ আজকে ফুরফুরা। সকালবেলার বউনিটাই আজকে সারাদিনের কামাই উশুল করে দিয়েছে। গতরাতটা সে কাটিয়েছে হারান মিয়ার দিশি মদের ঠেক এ। কুড়িলের মোড় থেকে শখানেক গজ সামনে গেলেই পেট্রল পাম্পের পিছনে হারানের এই ঠেক। গতকাল সন্ধ্যাতে প্রায় ধরাই খেতে যাচ্ছিলো সে আর হারুন। হারুন এই লাইনে নতুন। এক পাবলিকের চোখে যেইমাত্র "জিনিষ" ডলতে গেলো, কোথা থেকে যে টহল পুলিশের দলটা উদয় হলো টা চিন্তা করলেও আতরের এই ভর দুপুরেও গা শিরশির করে উঠে। আতর এই পেশায় কামেল লোক । সঠিক সময়ে সঠিক শিকার ধরা..চোখের কোথায় মলম দিতে হবে..মেয়েমানুষের পার্স ছাড়াও আর কোথায় দামী জিনিষের জন্য হাতাপিতা করা লাগবে এই বিষয়গুলো আতর সন্তানের মমতা নিয়ে দেশের বাড়ি থেকে আসা গ্যাতি গুস্ঠির সবাইকেই হাতে কলমে শেখায়। মলম পার্টির কাজ এত্ত সহজ হলে দুনিয়া চলতোনা। একথা ঠিক যে আতরকে হাতেধরে কেউ এই জিনিস শেখায়নি। রশীদ ওষ্তাদের দলে পেটে ভাতে কাজ করে, আধপেটা খেয়ে না খেয়ে অনেক ঠেকে আর কাঠখড় পুড়িয়ে আতর আজ নিজেই আজ একটা নিজস্ব মলমবাহিনীর লীডার। তার মতো অনেকে এই লাইনে থাকলেও এই মলম মারাকে আতর প্রায় শিল্পের পর্যায়ে উন্নীত করেছে। আতরের শিকার রা মলম খাওয়ার পরে কেউ আজ পর্যন্ত পৃথিবীর আলো দেখতে পায়নি।
তবে আতরের আজকের দিনটাই যেন ভিন্ন। কার মুখ দেখে যে আজ ঘুম থেকে উঠলো। সাত সকালে মোবাইলে ইদ্রিসের কল। ইদ্রিস সিএনজি চালক হলেও নিরীহ যাত্রীদেরকে অনাকাংখিত যায়গায় সিএনজি থামিয়ে আতরদের মত মলম পার্টির কাজ সহজ করে দেয়। এয়ারপোর্ট থেকে মধ্যপ্রাচ্য ফেরত সরল সোজা মজুর শ্রেনীর এক "মক্কেল" কে গাড়িতে তুলেই আজকে সকালে মোবাইলে পর পর ২ বার মিসকল দিয়েছে আতরকে। আতরও এই কলের মানে বুঝে হোটেল র্যাডিসনের কাছে নিরিবিলি একটা ঝোপের কাছে পোজিশন নেয়। বাকিটা সহজ সরল অংকের মত। জায়গামত এসেই হটাৎ সিএনজির স্টার্ট বন্ধ করে দিয়ে চোখের পলকে পেছনের গৃলের হুড়কো খুলে দেয় ইদ্রিস, দুপাশ থেকে অপারেশন চালায় আতর আর হারুন। তবে আজকের শিকারের কাছ থেকে যে এতগুলা ডলারের একটা বান্ডিল পাবে কল্পনাও করেনি আতর। কড়কড়ে ২২ টা ১০০ ডলারের নোট। ভর সকালেই জুম্মন ভাইকে ধরে কাফরুলের এক মানি এক্সচেন্জ থেকে ডলারগুলি ভাংগিয়ে টাকা করেছে আতর। নাহ, এরকম দিনে আর দ্বিতীয় কোন অপারেশন না। হারুনকে ছুটি দিয়েই আতর আজকে ঠিক করলো ফুলির কাছে যাবে। এই মেয়েছেলেটার কথা ভাবলেই আতরের মধ্যে কেমন কেমন জানি চিরিক দেয়া সুখানুভুতি আসে। আজকের দিনটা খাস। আতরের কেমন জানি দার্শনিক টাইপের চিন্তাভাবনা আসতে থাকে।
।দুই।
সকাল থেকেই কানিজের মেজাজটা বিগড়ে আছে। এত দামী একটা শখের ড্রেস ...কাজের মেয়েটাকে আয়রন করতে দেয়াই ভূল ছিলো। বেহায়া মেয়েটা কাপড়টা তো পুড়েছেই তার উপর হিহি করে তাকে এসে বলছে.."আফা....আইজ অন্য একটা কাপর পিন্দেন...এইডা শ্যাশ"। রাগে দু:খে চুল ছেড়া বাকি রেখেছে কানিজ। এই ড্রেসটা শুধু দামী বলেই না, তার প্রিয় অন্য একটা কারনে। ড্রেসটা গিফট করেছিলো ফারুক। আজকে ফারুকের জন্মদিনের যে পার্টি ওখানে এটা পড়েই যাবার প্ল্যান ছিলো ওর। গজগজ করতে করতে কাবার্ড থেকে কালো একটা ফতুয়া আর স্কাই ব্লু জীন্স বের করলো কানিজ। মেয়েটার সাথে বোঝাপড়া পরে করা যাবে, তিনটে প্রায় বেজে যাচ্ছে। আজকে কপালটা এতই খারাপ অফিস থেকে ম্যানেজ করা গাড়িটাও এক সিনিয়র কলিগের অন্যায় হস্তক্ষেপের জন্য হাতছাড়া হয়ে গেছে। বাসা থেকে এতটা দূর গাড়ী ছাড়া, ভাবতে ভাবতে মেজাজ আরো চিড়বিড় করে ওঠে।শাহীনবাগ থেকে উত্তরা যাওয়া আসা কি মুখের কথা ! সাজসজ্জার পর কোমরের পাশের বেঢপ ভাবে ফুলে থাকা অংশটার দিকে তাকিয়ে কেমন জানি অন্যমনস্ক হয়ে যায় কানিজ, উঁচু হয়ে থাকা যায়গাটাতে মনের অজান্তেই হাত চলে যায় ওর।
।তিন।
ফুলির সাথে সারাটা বিকেল কাটিয়ে মাগরিবের আজানের কিছুটা পরেই শাহীনবাগের নিজের ডেরাতে ফিরছিলো আতর। ঠিক তখনই রিকশাতে বসা কালো ফতুয়া আর নীল জীন্স পরা আদুরে মেয়েটাকে দেখতে পায় সে। ভারী সুন্দর উচা লম্বা মেয়েটা। কি সুন্দর ভংগিমায় একটা অহংকারী রাজ হাসের মতো বসে আছে রিকশাটায়। হাতে ঝা চকচকে একটা ভ্যানিটি ব্যাগ, অনেক সুন্দর জড়িবুটির কাজ করা। ব্যাগটা দেখেই ডেরায় ফিরে জাবার প্ল্যান বাতিল করে নতুন কর্ম পদ্ধতি ঠিক করে ফেললো আতর।ঠিক এরকম একটা ব্যাগ ফুলির হাতে তুলে দেয়ার শখ তার অনেক দিনের। বড়লোকের এই আদুরে বখা মেয়ে গুলিকে দুই চক্ষে দেখতে পারেনা আতর। এগুলির শরীরের বিভিন্ন স্পর্শকাতর স্থানেঅতিরিক্ত চর্বি জমে। আর সেই চর্বি কমানোর পবিত্র দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে এদেরকে মলমটা একটু বেশীই মারে আতর।এর পরে সুযোগ বুঝে অসহায় "বখা" মেয়েগুলিকে ইচ্ছেমত লান্ছিত করে । আজকের এই মেয়েটাকে দেখে তার সেইরকম "পবিত্র" একটা দায়িত্ব পালনে এ্যকশন প্ল্যান ঠিক করে নেয় সে। এরে ধরা লাগবে সামনে থেকে, হুড়মুড় করে রিকশার সামনে পড়ে রিকশাওয়ালার সাথে আগে একটা কাইজজা বাধানো লাগবে। বাকিটা সোজা। চকচকে চোখ নিয়ে পকেটে রাখা "ইস্পিশাল" টাইগার বামের কৌটো টা ডানহাতের মুঠোতে চেপে ধরে এগিয়ে যায় আতর....রিকশাটা অনেক কাছে চলে এসেছে....মেয়েটা আতরকে দেখে কেন যেন কোমরের কাছে হাত নিয়ে কিছু একটা হাতড়ে বের করার চেষ্টা করে...আতরও প্রায় লাফ দিয়ে রিকশাটায় চড়ে বস, চোখের পলকে ডান আংগুলে চলে এসেছে মলম।কিন্তু আতরের কেন যেন
কয়েকটা হার্টবিট মিস হয়,
কিছু একটা অস্বাভাবিকতা রয়েছে এই মেয়ের চাহনীতে....
কিছু একটা যেন ঠিক নেই,
মনের গহীনে কে যেন বলে ওঠে....সরে আয় আতর ...সরে আয়.....
।চার।
কিছু বুঝে ওঠার আগেই পয়েন্ট ব্ল্যংক রেন্জে চোয়ালের বাঁ দিকটায় গুলি খেয়ে ঝাকি খেয়ে থেমে যায় আতর...প্রায় সাথে সাথেই প্রান হারায়। গুলিটা চোয়ালের সাইড দিয়ে ঢুকে কোনাকুনি হয়ে অপরপাশের মাড়ির কয়েকটা দাঁত আর এক খাবলা জুলপির চুল উড়িয়ে নিয়ে টং করে বাড়ি খায় পাশের কোন একটা ল্যাম্প পোস্টে। ডাংগায় তোলা ইলিশের মত ঘোলা চোখ খুলে রেখে আতর পড়ে থাকে রাস্তার মাঝে। স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্সের অ্যাসিসট্যান্ট ডিরেক্টর ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট কানিজের হাতে ধরে থাকা প্লাস্টিক আর স্পেস এজ এ্যলুমিনিয়াম এলয়ের মিশ্রনে তৈরী .৪৫ ক্যলিবারের জার্মান গ্লক তখনো ধোয়া ছড়াচ্ছে। সেফটি ক্যাচ অন করে আবার যন্ত্রটি যথাস্থানে চালান করে দিয়ে কপালের উপর ছড়িয়ে থাকা অবাধ্য একগুচ্ছ চুলকে শাসনের আওতায় নিয়ে এলো কানিজ। লোকটার রিকশার দিকে এগিয়ে আসা দেখেই অভ্যস্ত চোখে অস্বাভাবিক কিছু একটা ধরা পড়েছিলো।গুলির শব্দে লোকজন জড়ো হওয়ার আগেই থানাপুলিশের সাথে ঝামেলা গুলো মিটিয়ে ফেলতে হবে। ক্লান্ত চোখে কানিজ মোবাইলটা বের করে.....
।পাঁচ।
ওস্তাদের জন্য অপেক্ষা করতে থাকা হারুন একসময় একাই খেয়ে নেয় রাতের খাবার। আতর ওস্তাদের আজকে দিলখুস। সকালেই কড়কড়ে দশটা পাঁচশো টাকার নোট নজরানা পেয়েছে হারুন। আতর আসার আগেই "ইস্পিশাল" মলম রেডি করতে চায় সে। বাইরে যদিও একটা বিকট শব্দ কিছুক্ষন আগে শুনতে পেয়েছে হারুন। এই ব্যাপারে তার বিন্দু মাত্র আগ্রহ নেই। মলম বানানি শেষ, আজকে এটা দেখিয়েই ওস্তাদের কাছ থেকে কয়টা দিন ছুটি নিবে সে। আতর ওস্তাদের মনটা আজকে বেজায় রকম ভালো। স্বপ্নাতুর চোখ নিয়ে মরিচমাখা মলম গুলো কৌটাবন্দী করতে থাকে হারুন....এই সময়টাতে তার বড়ই ভালো লাগতে থাকে।
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে নভেম্বর, ২০১০ রাত ১২:২৭