এ দু’মাস হোটেলগুলোতে জায়গা পাওয়া যায় না। হোটেলগুলো এসময়ে যে ব্যবসা করে বাকী ১০ মাস ভাড়া না দিলেও চলে যায়। মধ্যমসারির হোটেলে ২৫০-৩০০ রিয়ালে প্রতি রাতের জন্য সিংগেল রুম ভাড়া নিতে হয়। বস্তুতঃ বাকী ১০ মাস হোটেলগুলোর রুম তালাবদ্ধ হয়েই থাকে।
আমি যখন প্রথম আবহা আসলাম, অবাকই হলাম। কারন বাংলাদেশি প্রায় সব শিক্ষকরা হোটেলে থাকে। আমিও কয়েকদিনের মাঝে অভ্যস্ত হয়ে গেলাম। বাসাবাড়ির চেয়ে বেশী সুবিধা পাওয়া যায়। রুমভেদে ১০০০-১২০০ রিয়ালে সারা মাসের জন্য ভাড়া দিয়ে দেয়। এটা ওদের জন্য অতিরিক্ত প্রাপ্তি, নাহলে এ রুমগুলো খালিই পড়ে থাকতো। কর্মচারীরা সব বাংলাদেশি। সাথে আছে ফ্রি রুম সার্ভিস, সপ্তাহে ১ দিন পুরো ফ্ল্যাট পরিস্কার করে দেয়। ইন্টারনেট, ডিশ লাইন, ফার্নিচারেরও কোন চিন্তা নেই।এখানে ফ্যামিলি হোটেলগুলতে কিচেন থাকে, রান্না নিয়ে ঝামেলা নেই।মোট কথা কোন চিন্তাই নেই, বললেই কাজ হাজির। আর এভাবে আমরা বাংলাদেশি কিছু ফ্যামিলি একসাথে আছি। সাফিয়া’র সময় আমারা আমদের নিজস্ব মালপত্র গোডাউনে রেখে দেশ হতে বেড়িয়ে আসি।
আমরা এখানে থাকি ...
এখানে “খামিস” হচ্ছে আরেকটি বড় শহর। ছুটি দিনে এখানকার রাস্তাঘাটে চারিদিকে শুধু বাংলাদেশিদের দেখতে পাওয়া যায়। এখানে বেশ বড় বাংলাদেশি কমিউনিটি গড়ে উঠেছে। এখানে অনেক ফ্যমিলি বাসা ভাড়া নিয়ে থাকে। ৬/৭ শত রিয়ালে বাসা পাওয়া যায়। আমরা একবার একজনের বাসায় গিয়েছিলাম, ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা, তেমন ভালো লাগেনি।
খামিসের বাংলাদেশি পাড়ায় কৃষ্ণচূড়ার সমারোহ
আগের একটি লেখায় বলেছি প্রাইভেট গাড়ী ছাড়া এখানে চলাচল বেশ কষ্টসাধ্য। গাড়ির দাম এখানে খুব সস্তা, সবারই গাড়ী আছে। ৮/৯ বছরের সৌদি বাচ্চারাও বিরাট মার্সিডিজ গাড়ী চালায়। পুলিশ তাদের ধরেনা, একধরনের সম্মতি আছে। কারন সৌদিতে মহিলাদের গাড়ী চালনা নিষেধ, তাই বাড়ী’র পুরুষেরা সময় দিতে না পারলে বাচ্চারা মহিলাদের আনা নেওয়া করে। তবে সৌদি মহিলারা তাদের এই অধিকার আদায়ে এখন যথেষ্ট সোচ্চার। তারা এখন নিজ বাড়ীতে গাড়ী চালনা শিখছে, মাঝে মাঝে সকাল বেলা রাস্তায় বের হয়ে আসে। বেশ কয়েকজন পুলিশের হাতে ধরাও পড়েছে, জেল হয়েছে। কিছুদিন আগে মহিলারা আন্দোলনের ডাক পর্যন্ত দিয়েছিল।
কিন্তু আমাদের টিমে কারো কোন গাড়ী নেই। ফলে যেখানে সেখানে ঘুরতে মনে চাইলেও সবসময় তা হয়ে উঠে না। ৩/৪ বছর আগে মক্কা থেকে ফেরার পথে আমাদের ইউনি’র দুজন বাংলাদেশি শিক্ষক ড্রাইভ করতে গিয়ে নিহত হন। সেই ভয় সবার মাঝে জেকে বসেছে। আদিল ভাই আর মিলন ড্রাইভিং শিখলেও এখানে লাইসেন্স নেননি। কিছুদিন আগে মিলন ড্রাইভিং লাইসেন্স পেয়েছে, শীঘ্রই গাড়ী কিনে ফেলবে। আমি ও আদিল ভাই সম্মত হয়েছি ড্রাইভিং শিখে লাইসেন্স নিয়ে নেব। আমি ঢাকায় ড্রাইভিং শিখে এসেছি, কিন্তু এখানে ভরষা পাচ্ছিনা। সবার যখন গাড়ী হবে, প্রতি উইকেন্ডে নিশ্চিতভাবেই ব্যাপক ঘুরোঘুরি হবে।
প্রথম প্রথম ভাবতাম সৌদি মহিলারা কিভাবে সারাদিন বাড়িতে কাটায়? বাড়িগুলো এমন- জানালা সবসময় বন্ধ থাকে, সীমানা প্রাচীর ১০ ফিট উচু, তারা সদর দরজা দিয়ে বের হতে পারেনা, তাদের জন্য আলাদা ছোট দরজা থাকে। সব সময় নেকাব, হাতে ও পায়ে মোজা থাকে। মেয়ে জামাই শাশুড়িকে/ শালীকে জীবনেও দেখতে পারেনা। এটা কি জীবন?
এখন বুঝতে পারি তারা ভালোই আছে। তারা সৌদিতে অনেক স্বাধীনতা ভোগ করে। সৌদিতে কোন পুরুষের সাহস নেই কোন মহিলাকে টিজ করে। রিয়াদ ও দাম্মামে অনেক নেকাব ছাড়া সৌদি মেয়ে চোখে পড়েছে। শিক্ষার প্রতি তাদের আগ্রহ বাড়ছে। হয়তো একদিন গাড়ীও চালাবে। কয়েকদিন আগে তারা পৌর নির্বাচনে ভোটাধিকার পেয়েছে। এশা’র পর এখানকার মার্কেটগুলো জমজমাট হয়ে যায়। সৌদি মহিলারা দেদারসে শপিং করতে আসে। দোকানের ডিসপ্লেতে যে ধরনে জামা কাপড় দেখি, বলতেই হয় তারা অনেক এগিয়ে আছে। সে তুলনায় সৌদি ছেলেদের আমার কাছে অনেক উগ্র, অথর্ব আর চরম অলস মনে হয়।
সন্ধ্যায় সৌদি ফ্যমিলিরা পার্কে/সবুজ রাস্তার পাশে চাদর বিছিয়ে বসে, খাওয়া দাওয়া করে। উইকেন্ডে তারা গাড়ী, তাবু নিয়ে দূরে পাহাড়ের পাদদেশে অথবা সমুদ্রতীরে চলে যায়। সারা রাত থাকে। আস্ত ঝলসানো খাসী অথবা বারবিকিউ হয়, অলস সময় কাটায়। এটাই তাদের আনন্দ, এটাই তাদের জীবন।
একা একাই ফ্যামিলি নিয়ে নিরিবিলি কোথাও বেড়িয়ে আসে ...
পার্কে ...
মাঝে মাঝে ভাবি আমরা ক’জন বাংলাদেশী উইকেন্ডে ফ্যামিলি নিয়ে একাকী বেড়িয়ে যেতে পারি, অলস সময় কাটাতে পারি? বেঁচে থাকার সংগ্রামেইতো জীবনটা চলে যাচ্ছে।
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে সেপ্টেম্বর, ২০১১ সকাল ১০:৪৩