রহিঙ্গা সমস্যা ও তাদের ইতিহাস নিয়ে কয়েকজন ব্লগার পক্ষে ও বিপক্ষে বেশ কিছু বিচিত্র তথ্য উপাস্থাপন করেছেন। এখানে দু’জন সম্মানিত ব্লগারের তথ্যপূর্ণ লেখা দু’টি পোষ্ট তুলে ধরলাম। আমরা সঠিক তথ্য জানতে আগ্রহী। কারো কাছে অধিকতর সঠিক তথ্য থাকলে তিনি তার মূল্যবান তথ্য দিয়ে পাঠকদের সচেতন করতে সহযোগিতা করবেন বলে আশা করছি।
জনাব ব্লগার রাসেল সরকার বেশ কিছু বিচিত্র তথ্য তুলে ধরেছেন। তার লেখাটি নিম্নরুপ:
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সংখ্যালঘু মুসলমান রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন এখন বিশ্ব সংবাদ মাধ্যমগুলোর শিরোনাম। কিন্তু রোহিঙ্গাদের ইতিহাস সম্পর্কে আমরা কতটুকু জানি? এখানে রোহিঙ্গা জাতির প্রায় ভুলে যাওয়া ইতিহাসের কিছু তুথ্য তুলে ধরা হলো:
১. রোহিঙ্গাদের আবাসভূমি আরাকান ছিল স্বাধীন রাজ্য। ১৭৮৪ সালে বার্মার রাজা বোডপায়া এটি দখল করে বার্মার অধীন করদ রাজ্যে পরিণত করেন।
২. আরাকান রাজ্যের রাজা বৌদ্ধ হলেও তিনি মুসলমান উপাধি গ্রহণ করতেন। তার মুদ্রাতে ফার্সি ভাষায় লেখা থাকতো কালেমা।
৩. আরাকান রাজ দরবারে কাজ করতেন অনেক বাঙালি মুসলমান। বাংলার সাথে আরাকানের ছিল গভীর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক।
৪. ধারণা করা হয় রোহিঙ্গা নামটি এসেছে আরাকানের রাজধানীর নাম ম্রোহং থেকে: ম্রোহং>রোয়াং>রোয়াইঙ্গিয়া>রোহিঙ্গা। তবে মধ্য যুগের বাংলা সাহিত্যে আরাকানকে ডাকা হতো রোসাং নামে।
৫. ১৪০৬ সালে আরাকানের ম্রাউক-উ রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা নরমিখলা ক্ষমতাচ্যুত হয়ে বাংলার তৎকালীন রাজধানী গৌড়ে পলায়ন করেন। গৌড়ের শাসক জালালুদ্দিন শাহ্ নরমিখলার সাহায্যে ৩০ হাজার সৈন্য পাঠিয়ে বর্মী রাজাকে উৎখাতে সহায়তা করেন। নরমিখলা মোহাম্মদ সোলায়মান শাহ্ নাম নিয়ে আরাকানের সিংহাসনে বসেন। ম্রাউক-উ রাজবংশ ১০০ বছর আরাকান শাসন করেছে।
৬. মধ্যযুগে বাংলা সাহিত্যচর্চ্চার একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র ছিল রোসাং রাজ দরবার। মহাকবি আলাওল রোসাং দরবারের রাজ কবি ছিলেন। তিনি লিখেছিলেন মহাকাব্য পদ্মাবতী। এছাড়া সতী ময়না ও লোর-চন্দ্রানী, সয়ফুল মুল্ক, জঙ্গনামা প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থ রচিত হয়েছিল রোসাং রাজদরবারের আনুকূল্যে।
৭. ভাই আওরঙ্গজেবের সাথে ক্ষমতার দ্বন্দ্বে পরাজিত হয়ে মোগল যুবরাজ শাহ্ সুজা ১৬৬০ সালে সড়ক পথে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার হয়ে আরাকানে পলায়ন করেন। তৎকালীন রোসাং রাজা চন্দ্র সুধর্মা বিশ্বাসঘাতকতা করে শাহ্ সুজা এবং তার পরিবারকে নির্মমভাবে হত্যা করেন। এর পর আরাকানে যে দীর্ঘমেয়াদী অরাজকতা সৃষ্টি হয় তার অবসান ঘটে বার্মার হাতে আরাকানের স্বাধীনতা হরণের মধ্য দিয়ে।
সূত্র: রোহিঙ্গা জাতির ইতিহাস, এন. এম. হাবিব উল্লাহ্, এপ্রিল-১৯৯৫
: বিবিসি আর্কাব থেকে নেওয়া ।
জনবা ব্লগার আহা রুবন উক্ত লেখার মন্তব্যে আরো কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য তুলে ধরেছেন তা নিম্নরুপ :
"শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের 'শ্রীকান্ত' উপন্যাস পড়লে দেখবেন, রেঙ্গুনে (আজকের ইয়াঙ্গুন) কিছু মানুষের ভাষার সঙ্গে আমাদের চট্টগ্রামের ভাষার বেশ মিল। শরৎচন্দ্র যখন বার্মায় (আজকের মায়ানমার) যান তখন উনিশ শতক চলছে। উইকিপিডিয়া ও এনসাইক্লোপিডিয়া থেকে জানা যায়, ষোল শতক থেকে মজুর হিসেবে বাংলা থেকে কিছু গরীর মানুষ (যারা ধর্মীয় পরিচয়ে মুসলিম) বার্মায় পাড়ি জমানো শুরু করে। সে সময় রেঙ্গুন যাওয়ার বিষয়টা যে চট্টগ্রামের মানুষের কাছে আজকের দুবাই যাওয়ার মতো ছিল, তার প্রমাণ পাওয়া যায় চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানে। 'ও শ্যাম রেঙ্গুন ন যাইও/ কনে খাইব রেঙ্গুনের কামাই/ রেঙ্গুন যাইবা ডিংগাত করি/ কাঁইনতে কাঁইনতে আঁই যাইউম গই মরি...' এমন গানের কথা চট্টগ্রামের বয়োজ্যেষ্ঠদের মুখে এখনও জনপ্রিয়।
এই বাঙালি রোহিঙ্গারা পরে আরাকান রাজ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে দাঁড়ায়। পনেরো শতকের শেষ দিকেই আরাকান রাজ্যের মুদ্রায় রোহিঙ্গাদের ক্ষমতায়নের পরিচয় মেলে। নিজেদের রোহিঙ্গা (অর্থ স্থানীয়) নামে পরিচয় দিলেও দেশটিতে তাদের বঙ্গাল বলেই ডাকা হয় এখনও। ব্রিটিশ শাসিত (১৮২৪-১৯৪৮) বার্মার আরাকান রাজ্যে রাখাইন ও রোহিঙ্গাদের মধ্যে জাতিগত দাঙ্গার ইতিহাস আজকের না।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন ১৯৪২ সালের দাঙ্গার মধ্য দিয়ে বার্মায় জাতিগত বিভক্তির সুত্রপাত। ব্রিটিশ সরকারের কাছ থেকে অস্ত্র নিয়ে জাপানি সৈন্যদের মোকাবেলা করার বদলে রোহিঙ্গারা ২০,০০০ আরাকানিকে হত্যা করেছিল। অন্যদিকে রাখাইন ও রেড কারেনদের পাল্টা আক্রমণে মিনবিয়া ও মারুকুতে ৫,০০০ রোহিঙ্গা নিহত হয়েছিল।
ব্রিটিশ আমলে রোহিঙ্গারা অর্থনৈতিক পশ্চাৎপদতা ও ধর্মীয় গোড়ামীর কারণে শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত ছিল। ১৯৪৮ সালে বার্মা স্বাধীন হবার পরেও তাদের অবস্থার মৌলিক কোনও পরিবর্তন ঘটেনি। বার্মা স্বাধীন হবার আগেই রোহিঙ্গা নেতারা পাকিস্তানের কায়েদে আজম মোহম্মদ আলি জিন্নাহর সঙ্গে দেখা করে এবং আরাকান মুসলিম লিগ গঠন করে। পরবর্তিতে তারা পাকিস্তানের সঙ্গে একীভূত হওয়ার ঘোষণাও দেয়, কিন্তু জিন্নাহ বার্মার অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে মাথা ঘামাতে রাজি না হওয়ায় তারা সফল হয়নি। ১৯৫০ সালে তারা সশস্ত্র আন্দোলন শুরু করলে সেনাবাহিনী তা কঠোর হস্তে দমন করে। বার্মা থেকে আলাদা না হলেও এসব কারণে বার্মার রাজনৈতিক সঙ্কট ঘনিভূত হতে থাকে। ১৯৮২ সালে বার্মার নাগরিক আইন পাশ হয় রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব সরাসরি অস্বীকার করা হয়।
সুতরাং আবেগের বশে না যাচাই না করে কোনও ফেসবুক ছবিতে লাইক/ শেয়ার দেবেন না এবং রেডিও মুন্নার মতো লাইসেন্সবিহীন ভুঁইফোঁড় অনলাইন মাধ্যমের নিউজ দেখে বিচলিত হবেন না। আপনার লাইক/ শেয়ারের মাধ্যমে পেইজগূলোর টিএমপি বাড়ে, হাজার টাকা ইনকামের জন্য তারা হলুদ সাংবাদিকতায় লিপ্ত।
১৯৯০ সালের দিকে এসে রোহিঙ্গাদের নতুন আন্দোলন শুরু হয় সায়ত্বশাসিত পৃথক রাজ্যের দাবীতে। স্বাভাবিকভাবেই শিক্ষার অধিকার বঞ্চিত রোহিঙ্গাদের নেতারা যতটা না জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ, তার চেয়ে বেশি সাম্প্রদায়িক চেতনায় ঐক্যবদ্ধ। বিভিন্ন সময়ে তারা ওআইসি এবং প্রতিবেশী মুসলিম দেশগুলোর সহায়তা চেয়ে এসেছে।
রাজনৈতিক সঙ্কটের প্রেক্ষিতে ১৬ কোটি জনগণ অধ্যুষিত বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের পুশইন শুরু করে মায়ানমার সরকার। সামরিক জান্তাদের দমন-পীড়ন, রোহিঙ্গা নেতাদের জঙ্গিবাদী নীতি আর আন্তর্জাতিক মহলের নীরবতায় সাধারণ রোহিঙ্গা ও বার্মিজদের জীবন দুর্বিসহ হয়ে পড়ে। সমস্ত নাগরিক অধিকার বঞ্চিত রোহিঙ্গাদের বড় অংশ ইতোমধ্যেই অপরাধপ্রবণ জনগোষ্ঠীতে রূপান্তরিত হয়েছে। ২০১২ সালে কয়েকজন রোহিঙ্গার হাতে রাখাইন এক তরুণী ধর্ষণের জেরে ফের শুরু হয় রোহিঙ্গা বনাম রাখাইন জাতিগত দাঙ্গা। এক পর্যায়ে এর জাতিগতভাবে রাখাইন বৌদ্ধ ভিক্ষুদের একাংশ অস্ত্র হাতে তুলে নেয়। রাখাইনদের বড় অংশ ছাড়াও বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী কোকাং এবং পান্থায় জাতি দাঙ্গার বিরোধিতা করলেও সশস্ত্রদের থামাতে ব্যর্থ হয়েছে।
২০১৫ সালে এসে নতুন করে রোহিঙ্গা শরণার্থী সঙ্কটের শুরু হয়, যার দীর্ঘ মেয়াদি কুপরিণতিও ভোগ করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। বিভিন্ন সময়ে পুশইনের মাধ্যমে বাংলাদেশে প্রবেশ করে তারা ইতোমধ্যেই কক্সবাজার জেলায় ছড়িয়ে পড়েছে। এরকম খবর চট্টগ্রামের আঞ্চলিক পত্রিকাগুলোতে প্রায়ই দেখা যায়। রামুতে বৌদ্ধবিহারে হামলায় এই রোহিঙ্গাদের বৌদ্ধবিদ্বেষ কাজে লাগানো হয়েছিল বলেও প্রতিবেদন প্রকাশ হয়েছিল। এছাড়া অবৈধ রোহিঙ্গা অভিবাসী অপরাধীরা পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ সমুদ্র সৈকত কক্সবাজারের সমুহ সম্ভাবনা ধ্বংস করছে বলেও বিভিন্ন সময়ে অভিযোগ উঠে এসেছে। কক্সবাজার সৈকত নিয়ে আন্তর্জাতিক চক্রান্তে রোহিঙ্গাদের ব্যবহারের সম্ভাবনা নাকচ করা যায় না। এদিকে বাংলাদেশ সরকার হাতিয়ায় রোহিঙ্গাদের জন্য শরণার্থী শিবির খুলতে যাচ্ছে বলে খবরে প্রকাশ। কিন্তু ভাঙ্গন কবলিত হাতিয়ার স্থানীয় গৃহহীন মানুষের কী হবে, রোহিঙ্গাদের কর্মসংস্থানের কী ব্যবস্থা হবে তাও ভাবা দরকার। নতুবা 'গোঁদের ওপর বিষফোঁড়া' টাইপ আপদের সম্মুখীন হবে বাংলাদেশের নাগরিকরা। সাধারণ রোহিঙ্গাদের প্রতি আমাদের মানবিক সহানুভূতি অবশ্যই থাকবে। কিন্তু এই রাজনৈতিক সংকটের স্থায়ী সমাধানের জন্য মায়ানমারের সরকারের প্রতি আন্তর্জাতিক চাপ প্রয়োগের কোনও বিকল্প নেই। সমুদ্রে হাজারো মানুষ দিনের পর দিন ভাসতে থাকবে, আর মানবাধিকারের ধ্বজাধারী পশ্চিমারা উদ্যোগ না নিয়ে চুপ করে বসে থাকবে, এটা হতে পারে না।
এই কাজ যারা করছে, তারা অবশ্য অদূর ভবিষ্যতে রোহিঙ্গাদের (যখন তারা এখানে সেটেল্ড হয়ে যাবে) মারা শুরু করবেন, তালেবান আর আইএস যেভাবে শিয়াদেরকে মারে। এখন আপাতদৃষ্টিতে তারা বেশ ইসলাম দরদি মনে হলেও তারা আসলে বৌদ্ধবিদ্বেষ ছড়াচ্ছেন।
মূলত তাদের উদ্দ্যেশ্য আপনার আমার সেন্টিমেন্ট কাজে লাগিয়ে আরেকবার রামুর ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটানো। যারা সত্যিকার ইসলামে বিশ্বাস করেন, যারা ইসলামকে শান্তির ধর্ম হিসেবে সমুন্নত রাখতে চান, তারা এই ধরনের প্রচারে যোগ দিয়ে বাংলাদেশে দাঙ্গা লাগাবেন না। আখেরি জামানায় সিরাতুল মুস্তাকিমে থাকার চেষ্টা করবেন। শয়তানের ওয়াসওয়াসায় পা দেবেন না। হাশরে যদি নবীর (সা) শাফায়াত চান, তাহলে ইসলামকে কলঙ্কিত করবেন না।"
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই ডিসেম্বর, ২০১৬ রাত ১২:১৫