somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সাহসী সাংবাদিক আতাউস সামাদের প্রয়াণে শ্রদ্ধাঞ্জলি

২৭ শে সেপ্টেম্বর, ২০১২ রাত ১০:০০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



চিন্তাকে সুসংহত করতে পারছি না। মাঝে মাঝে আমার এমন হয়। বিশেষত, কোন প্রিয় ব্যক্তির মৃত্যুতে আমি ঠিক মতো প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে পারি না। মাথার মধ্যে কেমন যেন একটা জ্যাম লেগে যায়। একটি মানুষের কোন বিশেষ দিক নিয়ে হয়তো যখন-তখন কথা বলা যায়, কিন্তু মানুষটির মৃত্যুর পরপরই তাকে নিয়ে আলোচনা করাটা আমার কাছে খুব দুঃসাধ্য একটি প্রক্রিয়া মনে হয়। যারা এই কাজটি অবলীলায় করতে পারেন, তারা আমার ঈর্ষার পাত্র। আমি পারি না, এই কাজটাতে আমি একেবারেই দুর্বল।

মৃত্যুকালে মানুষটার বয়স কতো হয়েছিল? ৭৫ বছর। অনেক সময়। আমাদের গড় আয়ুর চেয়ে বেশি। কিন্তু আমার কাছে ওনার চলে যাওয়াটা 'তাড়াতাড়ি' মনে হচ্ছে কেন? আপনি যদি কাউকে সত্যিকার অর্থে ভালবেসে থাকেন, মানুষটি যদি আপনার খুব প্রিয় হয় - তিনি নব্বই বছর বয়সে মারা গেলেও আপনার কাছে মনে হবে অনেক জলদি চলে গেলেন! সাংবাদিকদের গুরু আতাউস সামাদের মৃত্যুতে আমার এমনই অনুভূতি হচ্ছে।

সাংবাদিকতায় সাহসিকতা কেমন হতে পারে তা সাংবাদিক সমাজ অবলোকন করেছিল আশির দশকে আতাউস সামাদের কর্মে। সাহস আর হিউমারের সংমিশ্রণে সংবাদ ভাষ্যের জন্য তিনি কারাবরণ করেছিলেন স্বৈরাচারী হো.মো এরশাদের নির্দেশে। সেসময় বিবিসি বাংলায় তার পরিবেশিত সংবাদ শোনার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতেন দেশবাসী। সাংবাদিক/ব্লগার মাহবুব মোর্শেদের ভাষায়, "তীব্র গণআন্দোলনে রাজধানী অচল, পুলিশের গুলিতে একজন নিহত। অথচ পরের দিনের প্রধান পত্রিকার শিরোনাম হলো- কঙ্গোতে শান্তি আলোচনা চলছে বা সেনার গুলিতে তিন তামিল টাইগার নিহত। আন্দোলনের প্রতি সফট সংবাদপত্রগুলোর পরিস্থিতি প্রায় একই রকম। কেননা সেন্সরশিপ প্রবল। টিভি বলতে, সেই একমাত্র সরকারি বাংলাদেশ টেলিভিশন। মোবাইল ফোন নেই, ইন্টারনেট থাকার প্রশ্নই নেই। দেশের মানুষের জন্য খবরের একমাত্র উৎস বিবিসি, ভয়েস অব আমেরিকা। সকাল বেলা একবার আর সন্ধ্যা বেলা আরেকবার তাদের সম্প্রচার টিউন করতে হতো। বিবিসির সম্পাদকীয় নীতি ছিল অপেক্ষাকৃত উদার। খবর প্রচারিত হতো লন্ডন স্টেশন থেকে। ঢাকা থেকে খবর পাঠাতেন আতাউস সামাদ। গ্রামের বাজারে, বাড়িতে বাড়িতে বেজে ওঠা রেডিওতে বহুবার শুনেছি সেই কণ্ঠ। সাহসী, দৃঢ়, প্রত্যয়ী। টেলিফোনে পাঠানো তার খবর বিবিসি প্রচার করতো। সবাই জেনে যেত প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ।" আতাউস সামাদ ছিলেন সময়ের এমনই এক সাহসী সাংবাদিক।

মি. সামাদের সে সময়কার ভূমিকা যে আসলে কতোটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল বুঝা যাবে একটি বেসরকারী টিভি চ্যানেলের কমকর্তা অঞ্জন রায়ের কথায়, "৮০ দশকের কথা বলছি, তখন অনেক বোকা ছিলাম। ইস্কুল পড়ুয়া আমিও অনেকের মতোন বিশ্বাস করতাম- এরশাদের পতন হলেই গণতন্ত্র আসবে। তখন রাজধানী ঢাকা আমাদের পাবনা শহর থেকে আরো অনেক বেশি দুরে ছিলো। হাতে হাতে মোবাইল ফোন ছিলো না, ঢাকার খবরের কাগজ পাওয়া যেতো সন্ধ্যাবেলা। বাংলাদেশ টেলিভিশন তখনো ছিলো এখনের মতোই মিথ্যাবাদী। ঠিক সেই সময়ে অদ্ভুত কয়েকজন মানুষ ছিলেন- যারা আমাদের কানে পৌছে দিতেন আন্দোলনের খবর, আমরা স্যাটেলাইট টেলিভিশনের টিকার দেখে না- হরতালের মিছিল করতাম বিবিসি, ভয়েস অব আমেরিকা শুনে। সেখানে যার নামটি শোনার জন্য প্রতি সন্ধ্যার অপেক্ষা ছিলো তার নাম- আতাউস সামাদ। আমাদের এক সময়ের সাহসের ডাক হরকরা।"

আতাউস সামাদ শুধু একজন সাহসী সাংবাদিক ছিলেন না, তিনি ছিলেন সাংবাদিকদের গুরু। তার একসময়ের ছাত্রী, বর্তমানে ঢাবির শিক্ষক কাবেরি গায়েন বলেন, "স্যার-এর সাথে শেষ দেখা হয়েছিল কয়েক মাস আগে, সাংবাদিক ফয়েজ আহমেদ-এর মৃত্যুতে বিভাগ আয়োজিত স্মরণসভায়। স্যার অনেক প্রস্তুতি নিয়ে এসেছিলেন, বিশেষ করে জোর দিয়েছিলেন তথ্যসূত্র বার বার পরীক্ষার ব্যাপারে। কাকতালীয় কী না জানিনা, ফয়েজ আহমেদ-এর 'মধ্যরাতের অশ্বারোহী' থেকে যে অংশটি পাঠ করেছিলাম, সেই অংশটিও ছিলো তথ্যসূত্র পরীক্ষণ বিষয়েই। ফয়েজ আহমেদ বা আতাউস সামাদ-রা কেনো যে তৈরী হচ্ছেন না আর! কিন্তু হচ্ছেন না যে, সেটা দেখতেই পাচ্ছি। দলীয় রাজনীতির উপরে উঠে যেনো সবাই স্যারকে দেখতে পারি, সেই-ই একমাত্র চাওয়া। স্যার যেভাবে বিবিসির রিপোর্ট করেছেন, কীভাবে তথ্য সংগ্রহ করতে হয়, কীভাবে প্রভাব-বিস্তারী রিপোর্ট লিখতে হয় এ'ব্যাপারে যা শিখিয়েছেন- সেটাই যেনো শুধু সত্য হয়ে বিরাজ করে আমাদের ভেতরে। স্মরণ করছি স্যারের সেই ক্লাশগুলোকে, যেখানে নিজের সাংবাদিকতা জীবনের অভিজ্ঞতাকে বলতেন, কোন বই-এর সাধ্য নেই সংবাদ করার সেই বাস্তব উদাহরণগুলোর মতো সত্য আর বাস্তব উদাহরণ তৈরীর।"

আতাউস সামাদ ছিলেন একজন সত্যনিষ্ঠ কলামিস্ট। তার লিখিত কলামগুলো সাহসী তো ছিলই, অবমুক্ত করতো চিন্তার জড়তা। কিভাবে কোন নির্দিষ্ট দলকে দাসখত লিখে না দিয়েও রাজনৈতিক কলাম লেখা যায় তা আমরা শিখতে পারি আতাউস সামাদের কলাম পড়ে। আতাউস সামাদের কলম ছিল আপোষহীন, নির্ভার, আন্তরিক ও আলোকিত। সেই কলম আজ থেমে গেছে, থেমে গেছে বহুল প্রচারিত, আত্মদৃপ্ত, নির্ভরযোগ্য এক কণ্ঠস্বর!

গুরু, আপনাকে ভুলবো না। আপনার দেয়া শিক্ষা লালন করব আজীবন! লও সালাম!

২৭.০৯.১২

উদ্ধৃতি সূত্র: ফেবুতে বন্ধু হওয়ার সুবাদে সংশ্লিষ্টদের ফেসবুক পাবলিক স্ট্যাটাস থেকে প্রাপ্ত।
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা অক্টোবর, ২০১২ দুপুর ১২:৩৪
২টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মিল্টন সমাদ্দারের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত যেসব বিশ্বাসযোগ্য অভিযোগ পাওয়া গেছে…

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ২:০৭




মিল্টন সমাদ্দারের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত যেসব বিশ্বাসযোগ্য অভিযোগ পাওয়া গেছে…
১. প্রথমে বলেছেন মৃতদের পেটে কাটাছেড়ার ডাহা মিথ্যা। পরে স্বীকার করেছেন দাগ থাকে।
২. আশ্রমে বৃদ্ধদের চিকিৎসা দেয়া হয় না। কিন্তু... ...বাকিটুকু পড়ুন

আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের (সা.) পক্ষ নিলে আল্লাহ হেদায়াত প্রদান করেন

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৬:৪২



সূরা: ৩৯ যুমার, ২৩ নং আয়াতের অনুবাদ-
২৩। আল্লাহ নাযিল করেছেন উত্তম হাদিস, যা সুসমঞ্জস্য, পুন: পুন: আবৃত। এতে যারা তাদের রবকে ভয় করে তাদের শরির রোমাঞ্চিত হয়।অত:পর তাদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্লগটা তো ছ্যাড়াব্যাড়া হয়ে গেলো :(

লিখেছেন সাখাওয়াত হোসেন বাবন, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:৫৭



আমি আমার ব্লগিং শুরু করি প্রথম আলো ব্লগে লেখালেখির মাধ্যমে। ব্লগটির প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। কারণ প্রথম আলো ব্লগ আমায় লেখালেখিতে মনোযোগী হতে শিখিয়েছে । সে এক যুগ আগের কথা... ...বাকিটুকু পড়ুন

লুঙ্গিসুট

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:২৪



ছোটবেলায় হরেক রঙের খেলা খেলেছি। লাটিম,চেঙ্গু পান্টি, ঘুড়ি,মার্বেল,আরো কত কি। আমার মতো আপনারাও খেলেছেন এগুলো।রোদ ঝড় বৃষ্টি কোনো বাধাই মানতাম না। আগে খেলা তারপর সব কিছু।
ছোটবেলায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্বর্ণাক্ষরে লিখে রাখার মত মুফতি তাকি উসমানী সাহেবের কিছু কথা

লিখেছেন নতুন নকিব, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:২৫

স্বর্ণাক্ষরে লিখে রাখার মত মুফতি তাকি উসমানী সাহেবের কিছু কথা

ছবি কৃতজ্ঞতা: অন্তর্জাল।

একবার শাইখুল হাদিস মুফতি তাকি উসমানী দামাত বারাকাতুহুম সাহেবকে জিজ্ঞেস করা হল, জীবনের সারকথা কী? উত্তরে তিনি এমন... ...বাকিটুকু পড়ুন

×