পৃথিবীর বয়স মানুষের জন্মের থেকে অনেক বেশি। পৃথিবীতে মানুষের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে প্রায় বিশ লাখ বছর আগে।
যেভাবেই মানুষ পৃথিবীতে আসুক না কেন, প্লাইস্টোসিন, হলোসিন, হেমোসেপিয়ান, নিয়ানডারথাল, রামোপিথেকাস, অস্টালোপিথেকাসÑযে নামেই চিহ্নিত করা হোক না কেন, মানুষ নিরন্তর চেষ্টা করছে মানুষ হওয়ার জন্য। অর্থাৎ মনুষ্যত্বের উন্নতি। মানুষ হয়ে ওঠা অত সহজ নয়। যত সহজে মানুষ অমানুষ হয়ে উঠতে পারে।
মানুষ যখন বন্যাবস্থায় ছিল তখন ভাব বিনিময়ের জন্য ভাষার উদ্ভাবন করেছে, মনুষ্যত্বের নতুন মাত্রা খুঁজে নেওয়ার জন্য আগুনের আবিষ্কার শিখল। মহান দার্শনিক কার্ল মার্কস তার ‘আউট লাইনে অব ইকোনমিতে’ বলেছেন, ‘Ideas do not exist separatily from language’। ধীরে ধীরে মানুষ গোষ্ঠী থেকে সমষ্টিগত জীবনের দিকে যাত্রা শুরু করল, একাকিত্ব ও বিচ্ছিন্নতা মানুষের পছন্দ নয়, মানুষের জীবনের দ্বিতীয় পর্ব হলো বর্বর যুগ। সেই যুগে মানুষ এগিয়ে গেল আরও এক ধাপ। মানুষ আর বনে বাদাড়ে থাকতে চাইল না গৃহ নির্মাণ করা জরুরি হয়ে পড়ল, সৌন্দর্য এবং নান্দনিক জীবনচর্চার দিকে এগিয়ে চলল মানুষ। বেঁচে থাকার উপকরণের জন্য সৌন্দর্যবোধের প্রয়োজন হলো, সে সময় মানুষ যেকোনো মাত্রায় কিংবা শিকারের সময় বাইসন দেখে বের হতো। সেই আলতামিরার গুহাচিত্রের বাইসন আজ জগদ্বিখ্যাত।
এরপর ধীরে ধীরে মানুষ সভ্যতার প্রয়োজন অনুভব করল। আবিষ্কার করল বর্ণলিপি এবং লিখনশিল্পের সভ্য যুগে উত্তরিত হলো মানুষ। প্রাকৃতিক সম্পদের ব্যবহার মানুষকে করল আরও উন্নততর। মহামতি এঙ্গেলসের মতে, ‘প্রাকৃতিক সম্পদ নিয়ে আরও উন্নততর প্রক্রিয়া এবং যথার্থ শ্রমশিল্প এবং কলার জ্ঞান অর্জিত হয়েছে।’
মানুষ লক্ষ লক্ষ বছর ধরে মানবতার পথে এগিয়ে গেছে সামাজিক বিভিন্ন স্তরের ভেতর দিয়ে। অথচ তৃতীয় সহস্রাব্দে অর্থাৎ একবিংশ শতাব্দীতে এসে আমরা ঠিক এর উল্টো প্রতিফলন দেখতে পাচ্ছি। বিভিন্ন উপচারের মাধ্যমে দেখানো হচ্ছে মনুষ্যত্ব বিন্যাস, বিশ্বায়নের কল্যাণ এবং হাইটেকের চূড়ান্ত উন্নতির কারণে বিশ্বের ৩০ শতাংশ মানুষ একই সঙ্গে একই জিনিস দেখতে পারে টেলিভিশনের পর্দায়।
অথচ বর্তমানে দেখা যাচ্ছে, মানুষ উত্তরাধুনিকতার নাম করে নিজেকে পৃথিবী থেকে বিভিন্ন করে ফেলছে আমরা এদেরকে বলছি (Yupper) Young upwardly mobile people । এরা বর্তমানকেই সত্য বলে জানে। এটা যে একটা রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক অবস্থার শিকার, এটা তারা মনে করে না। ওয়াল্টার বেঞ্জামিনের ভাষায়, ‘হোমারীয় যুগে মানুষ দেবতাদের ধ্যান করত’। আর সেই মানুষ এখন নিজেদের ধ্যান নিজেরাই করে। নান্দনিক সুখভোগের জন্য মানুষ নিজেকে নিজে বিচ্ছিন্ন করে ফেলছে।
বিশ্বায়নের মাধ্যমে তৈরি করা হচ্ছে সাংস্কৃতিক সমসত্ব বোধ। বিশ্বায়নে দেখানো হয় পুরো বিশ্বই এক, কোথাও নেই কোনো শ্রেণীবিরোধ। Cultural Homogeneity সৃষ্টির চেষ্টা করে ঠিক তাকে উল্টো পথে পরিচালনা করা হয়।
বিশ্বায়ন মানুষকে শ্রেণীনির্বিশেষে ক্ষুদ্র সত্তায় ভাগ করে দিচ্ছে, যার নাম দিয়েছে Social imginary বা সামাজিক বিভাজন। এরা ক্ষুদ্র সংস্কৃতিকে মদদ দিচ্ছে। এরা প্রতিটি নৃগোষ্ঠীকেই স্বতন্ত্র দাবি করছে। সাম্রাজ্যবাদী বহুজাতিক শক্তিগুলো মধ্যস্থতার কথা বলে মানুষকে আরও বেশি বিচ্ছিন্ন করে ফেলছে।
তাদের মতে, মানুষ শ্রেণীচেতনায় সংঘবদ্ধ হতে পারে না। পারে না সংগ্রাম করতে। এ জন্য মানুষকে বিভিন্ন সম্প্রদায়ে বিভক্ত করা হয়েছে। সম্প্রদায়-অসম্প্রদায়, দেশীয় বহিরাগত, নারী-পুরুষ, উচ্চ বর্ণ-নিু বর্ণ, পর্বতবাসী সমতলবাসী, আদিবাসী অ-আদিবাসী। এ সকল বিভক্তিকরণের জন্য সমাজ আজ বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়ে দগদগে ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছে। মানুষের ইতিহাস আজ উল্টো পথে চলেছে। মানুষকে তার আদিম সত্তায় নিয়ে যাওয়ার জন্য বিশ্বায়ন আজ অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক উদ্যোগ গ্রহণ করছে। চরমভাবে নিজেদের বিভিন্ন করে ফেলছে। একে বলা যেতে পারে সাধারণীকৃত বিচ্ছিন্নতা (Generatised separations)।
চূড়ান্ত ভোগবাদ মানুষকে নরকের দরজায় পৌঁছে দিচ্ছে। মানুষ পারস্পরিক ভালোবাসা থেকে ছিটকে পড়ছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, গ্রেট ব্রিটেন, জার্মানি, হাইতি, ফিলিপিনস ইত্যাদি নানান দেশে কার্যকরী গণ-আন্দোলন গড়ে উঠেছে।
আমরা কেন আমাদের এই ষোলো কোটি দেশের মানুষ বসে থাকব। সুতরাং আমাদের আর বসে থাকার সময় নেই। শিয়রেই আমাদের শমন, সুতরাং সাধু সাবধান!
সংগ্রহ
http://shaptahikkagoj.com/?p=747
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ রাত ১১:৩১