উপন্যাসঃ জোরবা দ্য গ্রীক
লেখকঃ নিকোস কাজানজাকিস
অনুবাদঃখালেকুজ্জামান ইলিয়াস
প্রকাশনীঃ কথাপ্রকাশ।
জোরবা দ্য গ্রীক দুজন মানুষের বন্ধুত্বের গল্প।জোরবার বয়স পয়ষট্টি বছর,জন্ম মেসোডোনিয়ায়।জোরবা জীবনের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পেশা অবলম্বন করেছে।কখনো সে খনি শ্রমিক,কখনো সে ফেরিওয়ালা,কখনো সে সান্তুরি বাজিয়ে।কাজের সন্ধানে ঘুরেছে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে।জোরবা শিক্ষা লাভ করেছে প্রকৃতির কাছ থেকে, অভিজ্ঞতা থেকে।জীবন ও জগৎ সম্পর্কে তার রয়েছে গভীর ধারনা।যে কোন বিষয়ে তার রয়েছে অন্তদৃষ্টি,নিজস্ব মতামত।আর সে অন্তদৃষ্টি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নির্ভুল।তার মতামত অনেক সময় রুঢ় শোনালেও তা যুক্তির মানদন্ডে উত্তীর্ণ।জোরবা চিন্তাভাবনা লেখককে এতই প্রভাবিত করে যে লেখক তাকে দার্শনিক বার্গশঃ,গৌতম বুদ্ধ'র পাশে তার গুরু হিসাবে স্থান দেয়।
লেখকের সাথে জোরবার পরিচয় গ্রীসের একটি ক্যাফেতে।প্রথম সাক্ষাতেই জোরবাকে লেখকের ভাল লেগে যায়।লেখক জোরবাকে ক্রীটে লিগনাইট খনিতে ফোরম্যানের চাকুরি দেয়।শুরু হয় লেখক আর জোরবার একসাথে পথ চলা।তারা ক্রীটে লিগনাইট খনির পাশে ছাপড়া তুলে থাকা শুরু করে।জোরবা খনিতে কাজ করে আর খানা পাকায় তার ও লেখকের জন্য।জোরবা খনির সুড়ঙ্গ ধ্বস ঠেকিয়ে লেখক ও অসংখ্য শ্রমিকের প্রান বাচায়। তাদের সম্পর্ক মালিক- কর্মচারীর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না।জোরবা লেখকের বন্ধুতে পরিনত হয়।
জোরবা চরিত্রটি রক্তমাংসে তৈরি এক চরিত্র।জোরবা দোষে গুনে মিলিয়ে এক জীবন্ত সত্ত্বা।জোরবা অবাধ যৌনাচারে অভ্যস্থ।ক্রীট দ্বীপে তার সঙ্গীনি হোটেল মালিক,এক সময়ের ক্যাবারে গায়িকা আর্তেনসে।ইরাকলিওতে ক্যাবল কারের জন্য তার, যন্ত্রপাতি কেনার জন্য গেলে সে তরুনী লিউবার পেছনে লেখকের সাত হাজার ড্রাকমা খরচ করে।তবে জোরবা অবিবেচক নয়।লেখককে অর্ধেক দামে আশ্রমের বন ইজারা এনে দিয়ে তার ঋন শোধ করে।এ আশ্রমে এক সমকামী ভিক্ষুর হাতে আরেক ভিক্ষু নিহত হয়।জোরবার নির্দেশে পাগলাটে ও বিতাড়িত ভিক্ষু জাখারিয়াস আশ্রম জ্বালিয়ে দেয়। সাইবেরিয়া,স্পেন যেখানেই সে গিয়েছে সেখানেই সে বৈধ-অবৈধ নারী সঙ্গ খুজে নিয়েছে।
যৌবন বয়সে জোরবা রুমানিয়া-বুল্গেরিয়া জাতীগত দাঙ্গায় মানুষ খুন করেছে।সর্বপ্রকার সদগুনে গুনান্বিত তথাকথিত নায়ক সে নয়।জোরবার পাশে অন্য সব নায়ককে অজীর্ন রোগে ভোগা মানুষ বলে মনে হয়।
গ্রামের বিধবা মহিলার করুন পরিণতি,ভিক্ষু জাখারিয়াসের পাগলামী, মোড়ল আনাগনস্তিস ইত্যাদি বিভিন্ন ঘটনা ও চরিত্রের মাধ্যমে কাহিনি এগিয়ে গিয়েছে।
খনির সুড়ঙ্গ ধ্বসে লিগনাইট কয়লা উত্তলনের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয় লেখকের।ব্যর্থ হয় কেবল কারের মাধ্যমে কাটা গাছ পাহাড়ি বন থেকে সমতলে নামানোর প্রচেষ্টা।জোরবার সব কলাকৌশল বিফলে গেলেও লেখকের সাথে তার বন্ধুত্বে ফাটল ধরে না।
অবশেষে বিদায়ের ক্ষন এসে পড়ে।পরদিন ভোরে লেখক জাহাজ ধরবে বাড়ি ফেরার।গভীর রাত পর্যন্ত জোরবা ও লেখক গল্প করে।তারপর জোরবা রাতের অন্ধকারে সমুদ্রের দিকে হারিয়ে যায়।ওটিই লেখকের সাথে জোরবার শেষ দেখা।পরদিন সকালে লেখক অনুভব করে জোরবা আশেপাশে কোথাও থেকে তাকে তাকিতে দেখছে।
জোরবার কাছ থেকে লেখকের গ্রীসের ঠিকানায় হটাৎ হটাৎ চিঠি আসে।জোরবা কখনো সাইবেরিয়ায়,কখনো রুমানিয়ায়,কখনো আথোস পর্বতে।এরকমই সার্বিয়া থেকে একটি চিঠি আসে জোরবার মৃত্যু সংবাদ নিয়ে।মৃত্যুর আগে জোরবা সজ্ঞানে ছিল,জীবন নিয়ে তার কোন আফসোস ছিল না—একথা লেখকে জানাতে বলে যায় সে।মৃত্যুর আগে জোরবা প্রায়ই তার লেখক বন্ধুর কথা তার স্ত্রী লিউবাকে বলতো।তার স্মৃতী চিহ্ন হিসাবে লেখককে তার প্রিয় সান্তুরিটি উপহার দিয়ে যায়।জোরবার স্ত্রী লেখককে তাদের বাসায় আতিথ্য গ্রহন করার এবং সান্তুরিটি উপহার হিসাবে নেওয়ার অনুরোধ জানায়।
নিছক কল্পনা নয়ঃ
নিকোস কাজানজাকিসের পয়তাল্লিশ দিনের প্রচেষ্টায় লেখা জোরবা দ্য গ্রীকের সবটাই কল্পনা নয়।উপন্যাসের আলেক্সিস জোরবা বাস্তবের ইয়োর্গিস জোরবা যার সাথে মিলে লেখক মানি প্রদেশের প্রাসতোভা অঞ্চলে লিগনাইট খনি পরিচালনা করেন ১৯১৬-১৭ সালে। পুরো উপন্যাস ক্রীট দ্বীপের পটভূমিতে রচিত হলেও,বাস্তবের জোরবা কখনো ক্রীট দ্বীপে যায়নি।বাস্তবের জোরবা কি কখনো ভেবেছিল কাজানজাকিসের কলমে সে অমরত্ব লাভ করবে?
জোরবার সঙ্গিনী ক্যাবারে গায়িকা ম্যাডাম আর্তেনসেও কাল্পনিক চরিত্র নয়।তিনি বাস্তবের ফরাসী মহিলা আডেলাইন গুট। ইয়েরাপেত্রা মিউনিসিপালে অনেকের সাথে তার ছবি আজও দেয়ালে ঝুলে।অর্তেনসে ছদ্মনামটি তার এক প্রাক্তন প্রেমিকের দেওয়া।তবে বাস্তবের আর্তেনসের সাথে জোরবার কখনো দেখা হয়নি।দেখা হলে তাদের সম্পর্ক কেমন হতো তা কেবলই অনুমানের বিষয়।
কিছু জোরবা বচনঃ
পুরো উপন্যাসে লেখক ও জোরবার আলাপচারিতায় জোরবার গভীর জীবনবোধের পরিচয় পাওয়া যায়--
চতুর মানুষ আর মুদি দুজনেই এক।তারা খালি মাপে,সবকিছু মাপে।
আমি তো দুনিয়ায় অশ্ব কি বৃষ হয়ে জন্মিনি যে কেবল খাওয়ার উদ্দেশ্যেই বাচবো।
বিশ্ব প্রকৃতীতে সব কিছুই সরল,গায়ে পড়ে একে জটিল করে তুলো না।
মানুষ আসলেই এক জানোয়ার;আপনি যদি নিষ্ঠুর হন তো সে আপনাকে পুজা করবে।আর যদি দয়া দেখালেন তো চোখ উপড়ে ফেলবে।
মানুষের মাথায় একটু পাগলামি থাকা ভালো,নইলে তার যে বন্ধন সেটা কাটতে সে সাহস পায় না;ফলে মুক্তিও পায় না।
চলচিত্রে জোরবা দ্য গ্রীকঃ
জোরবা দ্য গ্রীক নিয়ে হলিউডে চলচিত্র নির্মিত হয়েছে ১৯৬৪ সালে ।এতে জোরবা চরিত্রে রুপদান করেন ম্যাক্সিকান অভিনেতা এন্থনি কুইন।ছবিটি একাডেমি পুরষ্কার লাভ করে।পুরষ্কার জিতেন এন্থনি কুইনও।
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে মে, ২০২২ সন্ধ্যা ৬:০২