এটা মেনে নেয়া যায় না
গার্মেন্ট সেক্টরে ইতহাসের সর্ববৃহৎ দুর্ঘটনা, ভয়াবহ সাভার ট্র্যাজেডি স্মরণে
আমি নির্বাক, নিস্তব্ধ; আমি বিক্ষুব্ধ, প্রতিবাদী। এটা মেনে নেয়া যায় না। আর কত কান্না হে যুবক, নওজোয়ান! বিপ্লবী কাঁদে না! কার কাছে এই কান্না, কার কাছে ফরিয়াদ! এখনও বোধ জাগেনি আমাদের? শাসকগোষ্ঠীর শ্রবণযন্ত্র অকেজো, অন্তঃকরণ তালাবদ্ধ। দুর্বলের কান্না সেখানে পৌঁছে না। অসহায়, দুঃস্থ নারী-শিশুর আর্তনাদ জালেমের অন্তর কাঁপায় না। তাই এবার ভাঙ ওদের ক্ষমতার মসনদ! শুধু একটাই আজ মন্ত্র, বিপ্লব অনিবার্য!!
আজকের এই কান্নার পেছনে রয়েছে আমাদেরই হাত। এই সমাজ, এই রাষ্ট্র আমরাই গড়েছি। যাদের শিক্ষা হয় না, কখনও হয় না। যাদের হয়, একবারই যথেষ্ট। বারবার একই ঘটনার পুনরাবৃত্তির প্রয়োজন নেই। হে বিপ্লবী, হে নও জোয়ান! আজকের সাভার ট্র্যাডেজির জন্য তুমিই দায়ি! হ্যাঁ তুমিই; আর কেউ না। সরকার না। সমাজ না। রাষ্ট্র না। কেননা রাষ্টব্যবস্থার ও সমাজ-দর্শনের মূলভিত্তি আমরাই, এই যুবসমাজ।
এখনও কি আমাদের হৃদয় তালাবদ্ধ থাকবে! ভোগের উন্মাদনা এতটুকু কাটেনি? হিংসা, দ্বেষ, বিভক্তি, নিজেরা নিজেরা মারামারি, কাটাকাটি আর কত? এবার সময় এসেছে এক হওয়ার, হাতে হাত মেলাবার। অন্তত সেই গরীব-অসহায়দের দিকে তাকিয়ে আসুন নিজেদের শত্র“তা ভুলে যাই। আলোচনার টেবিলে বসি। কি ভাবছেন, আমি যুদ্ধাপরাধের বিচার বন্ধের কথা বলছি? আপনি ভুল ভাবছেন। যুদ্ধাপরাধের বিচার চলবেই। যেহেতু শুরু হয়েছে আর থামবে না। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন।
আজ বিভেদ করার সময় না। ‘ধর্মীয় স্বাধীনতা’ অবশ্যই সবার থাকবে। কারণ এটা মানবিক অধিকার। মানুষের জন্যই তো ধর্ম, তাহলে মানুষের ধর্মীয় অধিকার থাকবে না থাকবে কার? এটা নিয়ে যদি সংগ্রাম করতে হয়, তবে এবার বুঝুন আমরা কত মূর্খ। ধর্মীয় অধিকার মানে হল- ধর্ম মানার অথবা না মানার অধিকার, এই ধর্ম অথবা সেই ধর্ম যে ধর্মই হোক। মানুষ হিসেবে সবার অধিকার সমান। সুতরাং যারা মানুষ, বিশেষ করে আজকে যারা অসহায়-অবহেলিত, রাজনীতিক ও বড়লোকদের লোভের শিকার, বিল্ডিংয়ের নিচে চাপা পড়েছে, হাসপাতালের বিছানায় কাতরাচ্ছে, পরপারে চলে গিয়েছে, নওজোয়ান ও বিপ্লবীদের তারা ডাকছে! তুমি শুনতে কি পাও!!
বিঃ দ্রঃ সাভার ট্র্যাজেডির পরদিন সকালে "আমারব্লগে" লেখা এই পোস্টের সঙ্গে মখা আলমগীরের "হাত সংক্রান্ত নাড়া-চাড়া ও ধাক্কাধাক্কি তত্ত্বের কোনো সম্পর্ক নেই।
নতুন জীবনবোধ ও চেতনার বিকাশ জরুরি
সাভার ট্র্যাজেডি স্বরণে
মানবসৃষ্ট, প্রাকৃতিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয়, ইচ্ছাকৃত, ভুলবশত বিভিন্ন কারণে একের পর এক ঘটে চলেছে অসংখ্য মর্মান্তিক দুর্ঘটনা। থেমে থেমে আহাজারি, বুকফাটা আর্তনাদ, দুঃখিনী মায়ের শোকের মাতম, সন্তানহারা পিতার বুক চাপড়ানো, বিধবার হৃদয়ের রক্তক্ষরণ, এতিম সন্তানের ভাষাহীন ফ্যালফ্যাল চাহনি আর কত দেখতে হবে আমাদের, এই দুর্ভাগা জাতির? এটাই কি জীবন, এই কি আমাদের পাওনা, অথবা ভাগ্য?
তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ, বিক্ষোভ, বক্তব্য-বিবৃতি; তারপর শেষ। আবার ভুলে যাওয়া। আবার সেই আগের মতোই হাসিখুশি, বিনোদন, আনন্দ-উৎসব। কিন্তু ইদানিং এ সুযোগটা কম। মাঝখানে বিরতি নেই বললেই চলে। ইস্যুর নিচে চাপা পড়ছে ইস্যু। ইস্যুর যেন মা-বাপ নেই। গত ছ’মাসে ক’হাজার ইস্যু চাপা পড়েছে হিসেব আছে কারও? এর ব্যাখ্যা কী? আজ পৃথিবীর কোনো আইন, দর্শন, থিওরি আমাদের মারামারি-হানাহানি-কাটাকাটি থেকে বিরত রাখতে পারছে না। সা¤প্রতিককালে যে রাজনৈতিক সংকট, সামাজিক অস্থিরতা, অর্থনৈতিক ব্যর্থতা ও মতাদর্শিক সংঘাত সৃষ্টি হয়েছে, এর আশু সমাধান কেউ দেখছেন না। তাহলে কি সহিংসতাই আমরা মেনে নেব, গৃহযুদ্ধই আমাদের শেষ পরিণতি! আর একের পর এক ট্র্যাজেডি?
না, এটা হতে পারে না। হতে দেয়া যায় না। আমাদের সমস্যাটা কোথায়? কিছু সংখ্যক লোকের ব্যক্তিগত ও গোষ্ঠীগত হিংসা চরিতার্থ করতে একটি জাতিকে ধ্বংসের মুখে নিক্ষেপ করতে হবে? কিন্তু সমাধানটা কি? কোনো পক্ষের (রাজনৈতিক পক্ষ-প্রতিপক্ষ) জনসমর্থন ও যুক্তিই তো দুর্বল নয়? এখানেও আমি প্রশ্নবিদ্ধ উভয় পক্ষের দ্বারা। আপনি নিরপেক্ষও হতে পারবেন না। যেকোনো একদিকে আপনাকে ঠেলে দেয়া হবে। আজ নিরপেক্ষতার বড় অভাব। অথচ নিরপেক্ষতা ছাড়া একটি দেশ, জাতি ও সমাজের শিক্ষাব্যবস্থা, বিচারব্যবস্থা, রাজনীতি প্রশ্নবিদ্ধ। আজকের সাভার দুর্ঘটনার ‘পেছনের কারণ’ অনেক দূরে। সুতরাং অতীত খুঁজে ফিরতে হবে প্রত্যেক দায়িত্বশীল নাগরিককে। সম্প্রতি বিভিন্ন ক্ষেত্রে একদল তরুণ প্রজন্মের সাফল্য ঈর্ষণীয়। অন্যদিকে অগ্নিসংযোগ, ভাংচুর, পারস্পরিক দোষারোপ সমস্যার পথ উন্মুক্ত করে। মুখ খারাপ করা, বিক্ষোভে ফেটে পড়া এগুলো দীর্ঘমেয়াদি সমাধান নয়। সুতরাং খুব সতর্কতার সঙ্গে যুবসমাজকে দায়িত্ব নির্ণয় করতে হবে।
শুনেছিলাম পাকিস্তান আমলে দেশের কোনো এক জেলায় এক সড়ক দুর্ঘটনায় একজন সাধারণ পথচারির হাত ভেঙ্গে ছিল। এ নিয়ে বিক্ষোভ-প্রতিবাদে শোষকদের মসনদ কেঁপে ওঠেছিল। আর আজ...। হায়রে স্বাধীন বাংলাদেশ! আমরা সরকারের মন্ত্রী-এমপিকে নিয়ে ঠাট্টা করি, গালি দেয়, আর ওরা মজা পায়। বোধ-বুদ্ধির অবশিষ্টাংশও হারিয়ে গেছে। মিডিয়ায় এসব দুর্নীতি-দুর্ঘটনার খবর প্রকাশও আজকাল নতুন সমস্যা সৃষ্টি করছে। মনস্তাত্ত্বিকভাবে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে যাচ্ছে। পর্যবেক্ষকরা বলছেন, নির্বাচনের আগে ‘এমনই’ হয়ে থাকে। কিন্তু দশ/পাঁচ বছর আগের ঘটনার পুনরাবৃত্তি স্বাভাবিক হয় কীভাবে। তাহলে কি এ সময়ে দেশ-জাতি একটুও এগুয়নি? যদি সত্যিই এগিয়ে না থাকে, নিশ্চয়ই অনেকদূর পিছিয়েছে। বাস্তবেও আমরা দেখছি তাই। সমস্যাগুলো আর আগের মতো নেই, আরও জটিল ও বিস্তৃত হয়েছে। তাহলে সমাজের এতসব সৃষ্টিশীল কাজের সার্থকতা কোথায়, যদি তা সম্মুখের বিপদ-মুসিবত দূর করতে সামান্যও ভূমিকা রাখতে না পারে?
মানবজীবনের এই সীমাহীন দুঃখ-দুর্দশা, আহাজারি-কান্না; অপরদিকে প্রেম-ভালোবাসা, আর্তমানবতার সেবায় নিজেকে বিলিয়ে দেওয়া, এতে সীমাহীন আনন্দ অনুভব করা এ কীসের প্রমাণ? মানুষ ছাড়া অন্য কোনো প্রাণীজগতে এমন কল্পনা করা যায়? তাহলে মানবজীবনকে অনন্য ও শ্রেষ্ঠ হিসেবে আজও আমরা বিচার করতে ও স্বীকৃতি দিতে পারি না কেন? পারি না এ জন্য যে, মানবমস্তিষ্ক ‘সন্দেহপ্রবণ’। সন্দেহ করা তার স্বভাব। সে ‘নিজের’ ওপরও সন্দেহ করে। সুতরাং স্রষ্টা ও অদৃশ্য জগতের ওপর তো করবেই। এ সন্দেহ থেকে মুক্তির সরাসরি কোনো পথ নেই। পথ যেটা আছে তা হল, যুক্তি, বুদ্ধি, বিচার-বিবেচনাবোধ প্রয়োগ ও প্রকৃতির সাক্ষ্য বা সৃষ্টিগত নিদর্শন প্রত্যক্ষকরণ। প্রকৃতি ও সৃষ্টির ভাষা আছে। সেই ভাষা আমাদের বুঝতে হবে। তারা কি বলছে? তারা বলছে তোমরা আমাদের মাঝে যে সৌন্দর্য দেখছ, যে স্বাদ ও উপকার দেখছ তা স্থির বা অপরিবর্তনীয় নয়, প্রতিনিয়ত বদলে যাচ্ছে। জগতের সবই ‘পরিবর্তনশীল’ স্বত্ত্বা। একক কোনো শক্তি সৃষ্টিতে নেই। মানবসমাজ ছাড়া অন্যকোনো সমাজে বিশৃঙ্খলা নেই ইত্যাদি।
অনেকে মনে করতে পারেন আমি এখানে ধর্ম প্রচার করছি। না, আমি কিছু মৌলিক প্রশ্নের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করছি মাত্র। সঙ্গে সামান্য দু’একটি ধারণা। যেহেতু এখানের সবাই শিক্ষিত, দুর্বল ধারণা তাদের প্রভাবিত করবে না। তাই নিঃসংশয়ে বলা। একদলের নিকট আরেকদলের জীবন যেন আজ খেলা; বিনোদন ও উৎসবের পণ্য। ইচ্ছায় অথবা অনিচ্ছায়, সবাইকে একক সত্ত্বার কাছেই ফিরে যেতে হবে। তাই পুরাতন বোধ-বিশ্বাস, ভ্রান্ত ধারণা আঁকড়ে না থেকে জীবনকে নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে। নতুন চেতনায় বলীয়ান হয়ে আত্মসমালোচনায় প্রবৃত্ত হতে হবে। কথাগুলো আমি নিজেকেও বলছি।
সাভার ট্র্যাজেডির দ্বিতীয় দিন লেখা