অটোমোবিল মন এবং প্রতিরোধ
১ম কিস্তি
চট্টগাম থেকে ঢাকায় এসেছি খুব বেশি দিন না। আগে মাঝে মাঝে যখন আসতাম, তখন এই শহরকে হয়তো কিঞ্চিত বুঝতে পারতাম। চট্গ্রামের তুলনায় ঢাকার গতি যে অনেক বেশি তা এখানকার যানবাহন এবং মানুষের কর্মব্যস্থতা দেখলেই বুঝা যেত। ইতোমধ্যে দেখতেই দেখতেই ৭/৮ মাস অতিক্রান্ত।
এই মেট্রোপলিটনে এসে প্রথম যখন তল্পিতল্পাসহ সায়েদাবাদ স্টেশনে বাস থেকে নামি, তখন সামনে অন্যরকম এক অনিশ্চয়তার পথচলা। ১ম মাসেই বুঝতে পেরেছিলাম বিচ্ছিন্নতা তত্ত্বের প্রায়োগিকতা। এতদিন মার্কসের এলিয়েনেশন থিওরী আড্ডায় বিভিন্নভাবে হয়তো বলতাম। কিন্তু তার ভয়াবহতা বুঝলাম, এই শহরের গতি দেখে। এ কয়দিন ঢাকায় অবস্থান করে বুঝলাম, এই শহর একজন মানুষকে কী পরিমাণ যান্ত্রিক করে ফেলতে পারে। মেট্রোপলিটন সিটি গড়ে উঠার ইতিহাস পড়তে গিয়ে গত শতাব্দীর প্রথমভাগে সৃষ্টি হওয়া নিউইয়র্ক সিটির ইতিহাস পড়েছিলাম। মানুষ কীভাবে পরিবার, বন্ধু, স্বজন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে শেষ পর্যন্ত নিজের আত্মিক জায়গা থেকেও হারিযে যায়-তা এখানে ভালভাবেই বিবৃত ছিল। মেট্রোপলিটন মন, মধ্যবিত্ত বিদ্রোহ বইয়ে, বিনয় ঘোষ বলেছিলেন, কোটি মানুষের মধ্যে থেকেও বিচ্ছিন্ন থাকতে থাকতে মানুষের মন তখন পরিণত হয় মেট্রোপলিটন মনে। এই মনকে তিনি বিশ্লেষণ করতে গিয়ে শেষ পর্যন্ত নাম দিয়েছিলেন অটোমোবিল মন। বিনয় ঘোষের প্রতি শ্রদ্ধা। কারণ আজ থেকে প্রায় ৫০ বছর আগে যে বিষয়টি তিনি বলেছিলেন, সে বিষয়টি কি অদ্ভুতভাবে ঢাকা শহরের জন্য এখন প্রযোজ্য!
চট্টগ্রাম শহরে কৈশোর এবং তারুণ্যের এক বিশাল সময় অতিক্রান্ত হয়েছিল। কোন কোন বিষন্ন বিকেলে স্রেফ মন ভাল করার জন্য ঘন্টার পর ঘন্টা পাহাড়ে অবলীলায় কাটিয়ে দিতাম। ঐ শহরের পাহাড়গুলো ছিল অনেক উঁচা। পাহাড়ে অবগাহনের মাধ্যমে সীমাহীন আকাশকে নিকটে পাওয়ার জন্যেই আমাদের এই প্রয়াস। পাহাড় এবং আকাশকে মাঝে রেখে এই কৌশলে অবলীলায় কতবার মনকে ভালো করেছি, তার কোন ইয়ত্তা নেই। কিন্তু এই ঢাকা শহরে লীলাকে আর কোনভাবেই অবলীলায় পরিণত করা সম্ভব হয়ে উঠেনা। তারপর কোন কোন জোৎসনার আগুন লাগা রাতে কর্ণফুলি নদীতে অর্থহীন নৌকায় চড়ে দ্বিগবিদিক সময় কাটানো। শুক্রবার বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধের অজুহাতে রাঙ্গুনিয়া-রাউজানের চা বাগানে মাঝখানে ডুব মারা। এমন আরো কত কী? কিন্তু এখন........... সবই নষ্টালজিক স্মৃতি। এমনি করে এই শহরে থাকতে থাকতে মানুষের শেষ আশ্রয়স্থল নষ্টালজিক মনটা হয়তো একদিন পরিণত হয় অটোমবিল মনে।
যাইহোক, এখানখার যান্ত্রিক ছন্দে রিপু করা মনকে সংহত করে আপাতত বিচ্ছিন্নতা থেকে মুক্তি পেলেও সাম্প্রতিক কিছু বিষয় থেকে কোনভাবেই বের হতে পারছি না। সভ্য সমাজে মানুষ কতটা বর্বর হতে পারে? একযোগে অধিকাংশ তথাকথিত শিক্ষিত মানুষ কিভাবে সমস্বরে মিথ্যাচার করে? কয়েকদিন আগে পেট্রোবাংলার চেয়্যারম্যানকে দেখলাম ইলেকট্রনিক চ্যানেলের সামনে প্রকাশ্যে দিব্যি মিথ্যা কথা বলতে। উনি বললেন, মডেল পিএসসি ২০০৮ এ বিদেশী কোম্পানি দুর্ঘটনা ঘটালে ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা আছে। তার এই ভাবকে সম্প্রসারণ করার জন্য আরো বললেন, অতীতে টেংরাটিলা এবং মাগুরছড়ায় যে দুর্ঘটনা তা থেকে শিক্ষা নিয়ে নাকি এই মডেল পিএসসি তৈরি করা হয়েছে। পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যানের হয়তো ধারণা ১০.৫ ফন্টের বর্ণমালার মাপ নিয়ে ৭২ পৃষ্টায় ইংরেজী ভাষায় তৈরি করা বিভিন্ন জটিল অর্থনৈতিক টার্মসের এই পিএসসি চুক্তি একমাত্র সরকার বাহাদুরের উচ্চপদস্থ কর্তাব্যাক্তি এবং পেট্রোবাংলার লোকজন ছাড়া দেশের আর কোন পাবলিকের পড়ার সাধ্যি নেই।
অদ্ভুত হলে সত্য, এই পিএসসির কোথাও লিখা নেই বিদেশি কোম্পানি কর্তৃক সংগঠিত দুর্ঘটনার দায়ভার নিজেরা নিয়ে দেশে ক্ষতিপূরণ প্রদান করবে। বেশ কয়েকদিন আগে, সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, সম্পদ রক্ষা কমিটি দেশে তেল-গ্যাস নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে। আর এই বিভ্রান্তি থেকে তাদের মুক্ত করার জন্য মুক্ত আলোচনার কথা বেশ বীরদর্পেই ঘোষণা করেছিলেন। কিন্তু ২৪ সেপ্টেম্বর কারওয়ান বাজারস্থ পেট্রোবাংলার সামনে কালো পতাকা মিছিলোত্তর সমাবেশে সম্পদ রক্ষা কমিটির আহ্বায়ক যখন চুক্তির বিষয়ে পাল্টা আলোচনার চ্যালেঞ্জ যখন ছুঁড়ে দেয়, তখন এই বিষয়ে তথাকথিত অতিশয় বিজ্ঞ সংসদীয় দলের প্রতিনিধিরা ঠিকই নিশ্চুপ ছিল। ইতোমধ্যে শুনেছি, গত ২৯ সেপ্টেম্বর চুক্তির বিষয়ে আইরিশ বহুজাতিক তাল্লো সাথে সরকারের কর্তাব্যাক্তিরা বৈঠক করেছেন। আলোচনার কথা বলে সরকারের এমন জালিয়াতি মাধ্যমে প্রমাণ হয়, তেল-গ্যাস-বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা কমিটির সাথে তারা আলোচনায় বসতে ভয় পায়। কথা হচ্ছে, দেশের ক্ষতির বিষয়টি কি তারা না জেনেই এহেন চুক্তির উদ্যোগ নিয়েছেন? প্রকৃতপক্ষে তারা সব কিছুই জানেন। স্বদেশ প্রেমের যে মন মানুষের থাকে, তাদের সেই মন এখন বিলুপ্ত। মুনাফাই তাদের মনের একমাত্র বিষয়বস্তু। কারণ ন্যায়-অন্যায়ের যে বোধ তা তাদের নিকট থেকে পুরোটাই বিলুপ্ত। বিনয় ঘোষের ভাষায় এই বস্তু হচ্ছে সেই অটোমোবিল মন।
পৃথিবীর তেল-গ্যাসের ইতিহাস হচ্ছে এক রক্তস্নাত অধ্যায়ের প্রতিচ্ছবি। এই তেল-গ্যাসকে করায়ত্ত করার জন্য মধ্যপ্রাচ্যে গঠন করা হয়েছে কৃত্রিম রাষ্ট্র ইসরায়েলের। ১৯১৭ সালে তৎকালীন ব্রিটেনের পররাষ্ট্র মন্ত্রী বেলফুর প্রথমবারের মত এই রাষ্ট্র গঠনের অফিসিয়াল ঘোষণা প্রদান করে। পরবর্তী সময়ে আমরা দেখি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ তাবৎ সাম্রাজ্যবাদী বিশ্ব একত্র হয়ে হাজারো বছরের সভ্যতা এবং সংস্কৃতিতে বলীয়ান প্যালেস্টাইন জাতিগোষ্ঠীকে উচ্ছেদ করতে। কিন্তু ১৯৪৮ সাল থেকে এই কৃত্রিম রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে প্যালেস্টাইনীদের সংগ্রাম অব্যাহত রয়েছে। চারটি আরব বনাম ইসরায়েল যুদ্ধে পরাজিত হওয়ার পরও প্যালেস্টাইনীরা হাল ছেড়ে দেয়নি। তারা ইতোমধ্যে দুইটি ইন্তিফাদার ডাক দিয়েছে। ফিলিস্থিনী কিশোরের পাথর হাতে অত্যাধুনিক ইসরায়েলী ট্র্যাংকের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আমরা বিভিন্ন সময় টেলিভেশনে দেখেছি। এই প্রতিরোধ মানসিকতাই সুস্পষ্ট হয়েছে আরব কবি মাহমুদ দারবীশের কবিতায়, তার কবিতার কয়েকটি লাইন এখানে তুলে ধরা
লেখো/এবং সবার উপরে/দয়া করে লিখে রাখো/আমি কাউকে ঘৃণা করি না/আমি কেড়ে নিইনি কারো সমূহ সম্পদ/কিন্তু আমি যখন অনাহারী/আমি নির্দ্ধিধায় ছিঁড়ে খাই/আমার সর্বস্ব-লুন্ঠনকারীর মাংস/অতএব সাবধান/আমার ক্ষুধাকে সাবধান/ আমার ক্রোধকে সাবধান/যারা ধ্বংস করে/মানুষ খুন করার নেশায় পাগল হয়ে যায়/সেই বর্বরদের বিরুদ্ধেই কেবল আমরা অস্ত্র ধরি/পৃথিবীটা বদলে গেছে/প্রবল ভূমিকম্পে উপত্যকার পুষ্প ঝরে যাক/তীক্ষ ছুড়ি সংক্ষিপ্ত করুক পাখির কলগীতি/বারুদের গুঁড়োয় পুড়ে যাক শিশুদের ভ্রুপল্লব।
কবিতাটি পড়েছিলাম অনেক আগে। কয়েকদিন আগে ব্লগে এক বন্ধুর (নাস্তিকের ধর্মকথা) সংযোজন থেকে আবার পড়লাম। মাহমুদ দারবীশের এই কবিতাটি রচনার সময়কাল ব্যাপক আগে । ১৯৮৭ সালে নিজস্ব বাসভূমকে উদ্ধার করার জন্য যে প্রথম ইন্তিফাদা প্যালেস্টাইনীরা ঘোষণা করেছিল, হয়তো দারবীশের এই কবিতা সমূহ তাদের উদ্দীপনা যোগাতো। সাম্প্রতিক সময়ে মধ্যপ্রাচ্য আরো উত্তপ্ত। ইরাকে নয়া উপনিবেশিক শোষণ তীব্র আকার ধারণ করেছে। যাই হোক শোষণের বিরুদ্ধে ইতিহাসের অভিজ্ঞতা হচ্ছে, নিরুপদ্রবে মানুষ কখনোই এই ব্যবস্থা
মেনে নেয়নি।
পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সাম্রাজ্যবাদ শোষণের এখন নতুন কৌশল আবিষ্কার করেছে। সম্পদ দখলের আগে এখন তারা সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের দিকে অনেক বেশি মাত্রায় মনযোগী। লক্ষ একটাই, মানুষের কোমল মনটাকে মেরে দিয়ে তার স্থলে অটোমোবিল মন স্থাপন করা। কিন্তু তা কি আদৌ সম্ভব? অটোমোবিল মনের বিরুদ্ধে আছে, মাহমুদ দারবীশ, নাইজেরিয়ার কবি উলে সোয়েঙ্কা অথবা চিলির পাবলো নেরুদা বা বেঞ্জামিন মোলয়সীর অমর সৃষ্টি। অটোমোবিল মনের বিরুদ্ধে তাদের এই সৃষ্টিই আগামী দিনে আমাদের পথ দেখাবে।