somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

নারী দিবসের শতবর্ষ : আন্দোলনের উদ্ভব, বিকাশ এবং বর্তমান পরিস্থিতি-২য় খণ্ড

০৮ ই মার্চ, ২০১০ দুপুর ২:৩২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

লিখাটির প্রথম খণ্ড পড়তে চাইলে ক্লিক করুন এ লিঙ্কে- ( Click This Link )
বাংলাদেশের নারীরা কেমন আছে?

আন্তর্জাতিক নারী দিবস একশ’ বছরে পা দিলেও বাংলাদেশে নারীদের আর্থ-সামাজিক অবস্থা আদৌ ভাল নয়। এখানকার নারীদের উন্নয়নে সুদূরপ্রসারী কোন পরিকল্পনা দেখা যাচ্ছে না। বেশ কিছু এনজিও এ ব্যাপারে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করলেও তার দীর্ঘমেয়াদি কোন ফলাফল নেই। বিভিন্ন পেশায় নারীদের আগমনের হার অতীতের তুলনায় বেড়েছে। কিন্তু, পেশাগত স্বীকৃতি হিসেবে প্রাপ্য মজুরি থেকে তারা বঞ্চিত। অন্যদিকে, নারী নির্যাতনের চিত্র কোনভাবেই হ্রাস করা যাচ্ছে না। অনেক ক্ষেত্রে এসব নির্যাতন নারীরা নীরবে সহ্য করে যাচ্ছে। প্রতিবছর হাজার হাজার নারী এবং শিশু ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। ধর্ষণের পর তাদের হত্যার উদাহরণের সংখ্যা নিতান্ত কম নয়। প্রতিমাসে শত শত নারী ও শিশু বহির্বিশ্বে পাচার হচ্ছে। নারী নির্যাতন বন্ধে দেশে আইন থাকলেও তার প্রয়োগ যথাযথ নয়।

পেশাগত স্বীকৃতি থেকে নারীরা বঞ্চিত

বিগত বছরগুলোতে নারীরা উল্লেখযোগ্য মাত্রায় বিভিন্ন পেশায় যুক্ত হয়েছে। শ্রমশক্তি প্রতিবেদনের সা¤প্রতিক এক জরিপে জানা যায়, দেশে ১৯৮৫-৮৬ সালে শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণের হার উৎপাদনমুখী কর্মক্ষেত্রে ছিল ৯.৯ ভাগ। পরিস্থিতি উন্নতি হয়ে, ১৯৯০-৯১-এ এসে দাঁড়ায় ১৪.১ ভাগে। ২০০০ সাল নাগাদ সে হারে বেড়েছে তিন গুণ। বর্তমানে বৃদ্ধির হার ৫ ভাগের বেশি। তথ্য সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশের মোট ৮ কোটি নারীর শতকরা ৪০ জন গ্রামে বাস করে। যাদের অধিকাংশই নিজ সংসার ছাড়া বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক কাজে যুক্ত রয়েছে। শ্রমশক্তির অন্য এক জরিপে দেখা যায়, বর্তমানে শ্রমজীবী নারীর শতকরা ৭৮.৮ ভাগ কৃষি ও মাছ ধরার কাজ করে। শতকরা ৪০ জন বিনা পারিশ্রমিকে পারিবারিক শ্রমে নিয়োজিত। সমীক্ষায় দেখা যায়, শিশু লালন-পালনসহ একজন নারী পারিবারিক কাজে ১৪ থেকে ১৮ ঘন্টা কাজ করে। কিন্তু, এদের উৎপাদিত মূল্য অর্থনীতিতে অদৃশ্য থাকে। চাকরিতে বেশির ভাগ নারী শিক্ষা, চিকিৎসা এবং নার্সিং পেশায় নিয়োজিত। ব্যবস্থাপনা এবং নীতি-নির্ধারণী কর্মকর্তা হিসেবে নারীর সংখ্যা শতকরা মাত্র সাত জন। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০০৯ সালে পোশাক প্রস্তুতকারী কারখানায় ৩ লাখের বেশি নারী শ্রমিক কাজ করছে। যা মোট নারী শ্রমিকের ৯০ ভাগ। পোশাক, নির্মাণ ও অন্যান্য উৎপাদন কারখানায় মজুরি দেয়ার ক্ষেত্রে পুরুষের তুলনায় নারী বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। অথচ, শ্রম দেয়ার ক্ষেত্রে নারীরা কোন ক্ষেত্রেই পুরুষের চেয়ে পিছিয়ে নেই। অধিকাংশ বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও কারখানায় প্রসূতিকালীন ছুটি দেয়া হয় না। অথচ নারীর কর্ম জীবনে ৪ মাস প্রসূতিকালীন ছুটি বিভিন্ন আনুষ্ঠানিক ক্ষেত্রগুলোতে অনুমোদিত। পোশাক শিল্প-কারখানায় বেশিরভাগ শিপমেন্ট হয় রাতে। কিন্তু, এক্ষেত্রে নারী শ্রমিকদের নিরাপত্তা যথাযথ নয়।

সহিংসতা বেড়েই চলছে
বাংলাদেশে নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা ক্রমশ বাড়ছে। অথচ রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে নারীর অংশগ্রহণ আগের চেয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে। দেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী এবং বিরোধী দলের চীফ দু’জনই নারী। উপমহাদেশ এবং দেশের প্রথম স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে বর্তমানে ভূমিকা পালন করছেন এডভোকেট সাহারা খাতুন। কিন্তু, এতকিছুর পরও নারী নির্যাতন বেড়েই চলছে। শুধুমাত্র প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে নয়, তথাকথিত শিক্ষিত সমাজেও এ হার বেড়েছে। ২০০৯-এর কিছু ঘটনা উল্লেখ করা যেতে পারে। ওই বছরের ৩০ মে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রের হাতে নির্যাতনের শিকার হয় মাস্টার্স পড়–য়া এক ছাত্রী। ঘটনার প্রতিবাদে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র আন্দোলন গড়ে উঠে। আন্দোলনের চাপে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন অভিযুক্ত ছাত্র শামসুল হককে বহিষ্কার করতে বাধ্য হয়। ১০ জুন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী মিশমা খুন হয় স্বামীর হাতে। স্বামী চায়নি মিশমা উচ্চ শিক্ষিত হোক। এর বিরুদ্ধাচরণ করায় মিশমাকে অকালে প্রাণ দিতে হয়। ২১ জুলাই প্রেমিক উজ্জ্বলের সাথে সম্পর্ক টিকিয়ে না রাখায় সালমা নামক একজন চিকিৎসক খুন হয়। ২১ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের ছাত্রী সুতপা স্বামীর হাতে খুন হয়। একই মাসে যৌতুকের কারণে অপমৃত্যু ঘটে ইন্টার্নি ডাক্তার তামান্নার। ‘নারীর প্রতি সহিংসতা এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থার ভূমিকা’ শীর্ষক এক সংবাদ সম্মেলনে জাতীয় নারী নির্যাতন প্রতিরোধ ফোরামের নেতৃবৃন্দ দেশে নারী নির্যাতনের ঘটনা আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধির কথা বলেন। তাদের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৯ সালে ৫৬৮টি সুনির্দিষ্ট নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে মাত্র ২৭০টি। ২০০৯-এর ৭ অক্টোবর দৈনিক আমার দেশ-এ নারী নির্যাতনের একটি চিত্র প্রকাশিত হয়েছে। এতে বলা হচ্ছে, বেসরকারি হিসাব অনুযায়ী জানুয়ারি থেকে ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৯ মাসে ৩৩৮ জন নারী ও শিশু ধর্ষণের শিকার হয়। তন্মধ্যে, ১৫৮ জন নারী ও ১৮০ জন মেয়ে শিশু। ১৫৮ জন নারীর মধ্যে ৫০ জনকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়। ৬৮ জন গণধর্ষণের শিকার হয়। ১৮০ জন মেয়েশিশুর মধ্যে ২২ জনকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়। মহিলা পরিষদের তথ্যমতে, জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ৩ হাজার ২৩৩টি নারী নির্যাতন হয়েছে।

মা ও শিশু মৃত্যুর হার কমানো যাচ্ছে না
২০০৯-এর ৪ মার্চ পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে নারী ও শিশুর অপুষ্টিজনিত দুর্ভোগ এবং মা-শিশুর মৃত্যু হার ক্রমশ বেড়ে চলছে। “স্বাস্থ্যবান বাংলাদেশের সন্ধানে : একুশ শতকের প্রত্যাশা” শীর্ষক বিশ্বব্যাংকের সা¤প্রতিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অপুষ্টি ও শিশু মৃত্যুর দিক দিয়ে বাংলাদেশের স্থান তালিকার শীর্ষে। অপুষ্টির কারণে, দেশে প্রতিদিন ৬ শ’ শিশুর মৃত্যু ঘটছে। গর্ভধারণ সংক্রান্ত রোগ জটিলতায় প্রতিবছর ২৮ হাজার মায়ের মৃত্যু হচ্ছে। বছরে ৩৩ লাখ ৩০ হাজার শিশুর জন্ম হয়। তন্মধ্যে, এক-তৃতীয়াংশ অর্থাৎ ১১ লাখ ১০ হাজার শিশুর জন্মকালীন দৈহিক ওজন স্বাভাবিকের চেয়ে কম হয়। পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুর দুই-তৃতীয়াংশ অপুষ্টিতে ভুগছে। প্রতি নয়জনের মধ্যে একজন শিশু ৫ বছরের আগেই মারা যায়। জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের হিসাব অনুযায়ী, দেশে নারীদের গড় বিয়ের বয়স ১৬ দশমিক ৯ বছর। ‘জাতীয় ক্যান্সার ইনস্টিটিউট ও গবেষণা হাসপাতাল’-এর তথ্যমতে, বাল্যবিয়ে আইন নিরোধ সত্ত্বেও দেশের ৭৫ শতাংশ মেয়ের কৈশোরে বিয়ে হয়। এদের মধ্যে ২৬ ভাগ নারী প্রসবজনিত জটিলতায় মারা যায়। ইউনিসেফের ২০০৯-এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বে মোট বাল্য বিয়ের অর্ধেকই হয় ভারতে। এর ফল হিসেবে ভারতে সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে প্রতিবছর ৭৮ হাজার নারীর মৃত্যু হয়। অন্যদিকে শিশু মৃত্যুর সংখ্যা ১০ লাখ। পাশাপাশি, বাংলাদেশের বাল্য বিয়ের হার প্রায় ৬০ শতাংশ।

বছরে ৩০ হাজার নারী ও শিশু পাচার

প্রতি বছর বাংলাদেশ থেকে ৩০ হাজার নারী ও শিশু দালালের মাধ্যমে বহির্দেশে পাচার হচ্ছে। তথ্য সূত্রে জানা যায়, বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনের মতে, গত ২০ বছরে শুধু মধ্যপ্রাচ্যে নারী ও শিশু পাচারের সংখ্যা দুই লাখের বেশি। প্রতিমাসে দেশ হতে ৭শ’ থেকে ১ হাজার নারী ও শিশু পাচার হচ্ছে। এদের মধ্যে বেশির ভাগ পাচার হয় ভারত ও পাকিস্তানে। পাচারকৃত নারীদের অধিকাংশকে ওই দেশগুলোর পতিতালয়ে বিক্রি করে দেয়া হয়। ভারতের নয়াদিল্লী ও পাকিস্তানের করাচিতে ১০ হাজার বাংলাদেশি নারী বাধ্যতামূলক পতিতাবৃত্তি পেশায় নিয়োজিত রয়েছে। একটি আইনজীবী সংস্থার সমীক্ষায় দেখা গেছে, পাকিস্তানেই প্রতি বছর নারী ও শিশু পাচারের গড় সংখ্যা ৫ থেকে ৬ হাজার। গত দশ বছরে শুধু পাকিস্তানে পাচার হয়েছে ২ লাখের বেশি নারী। ভারতের সমাজকল্যাণ বোর্ডের সূত্র মতে, ওই দেশে মোট ৫ লাখ বিদেশি পতিতা রয়েছে। যার অধিকাংশই বাংলাদেশি। মধ্যপ্রাচ্য, ভারত, পাকিস্তান ছাড়াও এ দেশের নারী মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, কম্বোডিয়া, থাইল্যান্ড, হংকং প্রভৃতি দেশে পাচার হচ্ছে।

নারী আন্দোলন বিভক্ত
বর্তমানে নারী আন্দোলন বহুধা বিভক্ত। তাদের বিরুদ্ধে সহিংসতা তীব্র গতিতে চললেও নারীদের ঐক্যবদ্ধ কণ্ঠস্বর অনেকাংশে দুর্বল। বিভিন্ন মত ও পথকে কেন্দ্র করে নারী আন্দোলন বিভিন্ন ধারায় পরিচালিত হচ্ছে। তন্মধ্যে কোন কোন ধারার বক্তব্য বিভ্রান্তিকরও বটে। ফলে, নারী আন্দোলন কোন কোন সময় প্রশ্নের সম্মুখীন হতেও দেখা গেছে। সংক্ষিপ্তভাবে ধারাগুলো আলোচনা করা হল।

উদারনৈতিক নারীবাদ
নারীবাদী আন্দোলনের সবচেয়ে প্রাচীন ধারা হল উদারনৈতিক নারীবাদ বা লিবারেল ফেমিনিজম। আন্দোলনের এ ধারা ষষ্ঠদশ শতাব্দী থেকে শুরু হয়ে বিংশ শতাব্দীতে শক্তিশালী আকার ধারণ করে। ফরাসি বিপ্লবের আগে পর্যন্ত নারীর অধিকার কাল্পনিক রূপে ছিল। সামন্তীয় প্রথা ভেঙে বুর্জোয়া বিপ্লবের মাধ্যমে মানুষের অবাধ স্বাধীনতা প্রথম বাস্তবে রূপ পায়। মানব স্বাধীনতার ধারাবাহিকতায় সমাজসহ সর্বপ্রকার পুরুষতান্ত্রিক শোষণ থেকে মুক্তির উপায় হিসেবে নারী আন্দোলন বিকশিত হয়। এ ধারার প্রধান কর্মসূচি হচ্ছে পুরুষের সমান নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা করা। উদারনৈতিক নারীবাদীদের মূল দাবি হচ্ছে ভোটাধিকার, বাক স্বাধীনতা, নির্বাচন ও রাজনীতিতে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় পুরুষের মত সমান সুযোগ অর্জন করা। পাশাপাশি তারা সাংবিধানিকভাবে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে নারীর অধিকার সমতার ভিত্তিতে নির্ধারণের দাবিতে সোচ্চার। নারীবাদের অন্যান্য ধারার আন্দোলনকারীরা তাদের কয়েকটি বিষয় নিয়ে তীব্র সমালোচনা করে থাকে। প্রথমত, তারা জেন্ডার বৈষম্যের বিরুদ্ধে কখনো অবস্থান গ্রহণ করেনি। দ্বিতীয়ত, উদারনৈতিক নারীবাদ বিদ্যমান সমাজ কাঠামো অুণœ রাখার পক্ষে। অর্থাৎ, বর্তমান সমাজ ব্যবস্থার বিভিন্ন অনিয়মকে চ্যালেঞ্জ না করেই তারা আন্দোলন পরিচালনার নীতিকে যথার্থ মনে করে। এসব সীমাবদ্ধতা সত্ত্ব্ওে আন্দোলনের এ ধারা নারী অধিকারে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। কেননা, এর মাধ্যমে বিশ্বে নারীবাদী আন্দোলনের সূচনা হয়। মেরি ওলস্ট্যানক্র্যাফট, জন স্টুয়ার্ট মিল, বেটি ফ্রাইডান, রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর প্রমুখ উদারনৈতিক নারীবাদের প্রবক্তা।

মার্কসীয় নারীবাদ
বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের প্রবক্তা কার্ল মার্কসের মতাদর্শকে ভিত্তি করে এ ধারার উদ্ভব। তবে এখানে শুধুমাত্র মার্কসের অবদান বললে ভুল হবে। নারী অধিকার প্রশ্নে তার সহযোদ্ধা ফ্রেডরিক এঙ্গেলসের অবদান ইতিহাসে অনস্বীকার্য। সাধারণত, মার্কস এবং এঙ্গেলসের যৌথ চিন্তা পদ্ধতিকে মার্কসবাদ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। মার্কসীয় চিন্তার আলোকে নারী অধিকার আন্দোলনের ধারাকে মার্কসীয় নারীবাদ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। এ ক্ষেত্রে ফ্রেডরিক এঙ্গেলসের একটি বই যথেষ্ট আলোচনার দাবি রাখে। বইটি হচ্ছে ‘পরিবার, ব্যক্তিগত সম্পত্তি ও রাষ্ট্রের উৎপত্তি’। বর্তমান সময়ে নারী বিষয়ে যে কোন গবেষণা কর্মে বইটি ব্যবহৃত হচ্ছে। ঐতিহাসিকভাবে নারী কোন প্রক্রিয়ায় পুরুষের পদানত হয়েছে, সে ব্যাপারে এখানে বিস্তারিত আলোচনা রয়েছে। এঙ্গেলসের বইটি ১৮৮৪ সালে প্রকাশিত হয়।
মার্কসীয় নারীবাদে শ্রেণী বিভক্ত সমাজকে নারীর পরাধীনতার মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এ ধারা অনুসারে, নারীর পরাধীনতা শুরু হয়েছে দাস প্রথারও অনেক পূর্বে। নারীর ঐতিহাসিক পরাজয়ের ক্ষেত্রে তার শরীর কোন ভূমিকা পালন করেনি। এঙ্গেলস বলছেন, মাতৃপ্রধান সমাজ অবসানের পর যাবতীয় সম্পত্তি ও নারীর উপর ব্যক্তিগত মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হয়। সমাজের অন্যান্য উৎপাদনের মত নারী সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র হিসেবে পুরুষের ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে পরিণত হয়। ফলে এ ধারার নারীবাদীদের মতে, ব্যক্তিগত সম্পত্তি ও মালিকানা বিলুপ্তির পর সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে নারী মুক্তি সম্ভব। এর কারণ হিসেবে তাদের বক্তব্য হচ্ছে, নিছক কতকগুলো অর্থনৈতিক দাবি-দাওয়ার মাধ্যমে নারী অধিকার প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। তাদের যুক্তি হচ্ছে, কর্মসংস্থানের সমান অধিকার কখনো নারীর চাকরি ও সমান বেতনের নিশ্চয়তা দেয় না। মার্কসীয় নারীবাদের আন্দোলন পুরুষদের বিরুদ্ধে নয়। এ ধারার প্রধান কর্মসূচি হচ্ছে, পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক কাঠামো এবং পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা উচ্ছেদ করা। তাদের মতে, এ প্রক্রিয়ায় নারীর অধিকার আদায় সম্ভব। কার্ল মার্কস, ফ্রেডরিক এঙ্গেলস, কারা জেটকিন, ভøাদিমির লেনিন, আলেকজান্ডার কোলনতাই প্রমুখ মার্কসীয় নারীবাদকে শক্তিশালী অবয়ব দেন।

আমূল বা র‌্যাডিক্যাল নারীবাদ
বিংশ শতাব্দীর ৬০-এর দশকে পাশ্চাত্যে র‌্যাডিকাল ফেমিনিজমের উদ্ভব। র‌্যাডিক্যাল ধারার কর্মীরা নারীর পুনরুৎপাদন বা প্রজনন ক্ষমতাকে অস্বীকার করে থাকে। তাদের মতে, সন্তান লালন ও সাংসারিক কর্মকাণ্ড নারীকে পুরুষের অধীনস্থ রাখে। এ নারীবাদের মূল কথা হল, পুরুষ নারীকে লৈঙ্গিক পীড়নের মাধ্যমে শোষণ করে। পুরুষের শারীরিক ক্ষমতা, আগ্রাসী মনোভাব ও নির্যাতনের ক্ষমতা নারী নিপীড়নে মদদ দেয়। তারা নারী নিপীড়নকারী পুরুষকে শ্রেণী শত্রু হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। ফলে, র‌্যাডিক্যাল ফেমিনিজম পুরুষদের সাথে সমস্ত সম্পর্ক বিচ্ছিন্নেœ বিশ্বাসী। এ ধারার মতে, পিতৃতন্ত্রের পাশাপাশি বিয়েসহ পুরুষের সাথে সমস্ত সম্পর্ক বিলোপের মাধ্যমেই নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা সম্ভব। নারীরা কেবল নারীদের সাথে একত্রিত হয়ে নতুন নারীকেন্দ্রিক দুনিয়া গড়ে তোলার মাধ্যমে শোষণের অবসান করতে হবে। র‌্যাডিক্যাল প্রবক্তাদের মতে, মাতৃত্বের দায় গ্রহণ করায় নারীরা পুরুষের বশ্যতা স্বীকারে বাধ্য হয়েছে। তাই তারা উন্নত প্রযুক্তি দ্বারা কৃত্রিম উপায়ে মাতৃগর্ভের বাইরে সন্তান জন্মদানের পক্ষে। জৈবিক চাহিদা মেটানোর ব্যাপারে এরা সমকামে বিশ্বাসী। বর্তমান পরিবার প্রথা বিলুপ্তির মাধ্যমে র‌্যাডিক্যাল ফেমিনিস্টরা মাতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার স্বপ্ন লালন করে থাকে।

সমাজতান্ত্রিক নারীবাদ
র‌্যাডিক্যাল এবং মার্কসীয় নারীবাদের এক ধরনের মিলিত রূপ হচ্ছে সমাজতান্ত্রিক নারীবাদ। সমাজ ও ইতিহাস ব্যাখ্যায় মার্কসবাদী পদ্ধতি এরা গ্রহণ করলেও নারী মুক্তি প্রশ্নে তার সাথে দ্বিমত পোষণ করে। তাদের মতে, নারী অধিকার আদায় শুধুমাত্র সর্বহারা বিপ্লবে সম্ভব নয়। অর্থাৎ লিঙ্গ বৈষম্যের ব্যাপারে তারা মার্কসীয় ধারণাকে বর্জন করে থাকে। সমাজতান্ত্রিক নারীবাদ সামাজিক ও ঐতিহাসিক কাঠামোকে নারী নিপীড়নের মূল কারণ হিসেবে শনাক্ত করেছে। তাদের মতে জৈবিক পার্থক্য নয়, নারী-পুরুষের মধ্যে গড়ে উঠা সামাজিক সম্পর্কই নারীর মর্যাদাহীনতায় দায়ী। আর তাকে পিতৃতন্ত্র পাকাপোক্ত করেছে। এ ধারার যুক্তি অনুযায়ী, যৌন শোষণ পুঁজিবাদের আগে যেমন ছিল তেমনি সমাজতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায়ও থাকতে পারে। কারণ, সম্পদে সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর সর্বহারা শ্র্রেণীর মধ্যে পিতৃতান্ত্রিক মনোভাব প্রবল মাত্রায় থাকতে পারে। তাদের মতে, একমাত্র পিতৃতন্ত্রের বিলুপ্তির মাধ্যমে নারীর অর্থনৈতিক মুক্তি সম্ভব।

সাংস্কৃতিক নারীবাদ
সাংস্কৃতিক নারীবাদের মতে, জেন্ডার সম্পর্কিত ধারণা সামাজিক এবং ঐতিহাসিকভাবে সৃষ্টি হয়েছে। ফলে তা নিশ্চিতভাবে পরিবর্তনযোগ্য। নারী-পুরুষের শারীরিক বৈশিষ্ট্যজনিত কারণ নয়, মনস্তাত্ত্বিক গড়নই নারী অধীনস্থতার মূল নিয়ামক। একজন নারী ও পুরুষকে লৈঙ্গিক পরিচয় অনুযায়ী সমাজ নির্দিষ্ট কাঠামোর মধ্যে আচার-আচরণ ও ব্যবহার পদ্ধতি শেখায়। অর্থাৎ, ছোটবেলা থেকে প্রত্যেককে সামাজিক বিষয়ে কিছু নির্দিষ্ট আচরণে অভ্যস্ত করানো হয়। আর তা থেকে নারী-পুরুষের বৈষম্য সহজাতভাবে তৈরি হয়। তাই সংস্কৃতিবাদীরা নারী মুক্তি প্রশ্নে সংস্কৃতি ও ভাবাদর্শের উপর জোর দেয়। সাংস্কৃতিক নারীবাদীরা অনেকাংশে র‌্যাডিক্যালদের বিপরীতে অবস্থান করে। তাদের মতে, শারীরিক বাস্তবতা নারীকে কতকগুলো নারীবাদী বৈশিষ্ট্য বা সংস্কৃতিতে সমৃদ্ধ করেছে। যেমন অপরের জন্য ভাবনা, মমতা, সহনশীলতা, নমনীয়তা, মাতৃত্ব ইত্যাদি। তাদের মতে, এসব সংস্কৃতি কাক্সিত এবং তা সমাজের প্রয়োজনে ঊর্ধ্বে তুলে ধরতে হবে। এ নারীবাদ কখনো মাতৃত্বকে অবমূল্যায়ন ও ধ্বংস করার পক্ষপাতী নয়।

পরিবেশ নারীবাদ
পরিবেশ নারীবাদের মূল বক্তব্য হল নারী ও পরিবেশ উভয়ে পিতৃতান্ত্রিক আগ্রাসনের শিকার। পুরুষতন্ত্র এই দুই গোষ্ঠীকে হাজারো বছর ধরে শোষণ করে আসছে। সভ্যতার শুরু থেকে পুরুষরা জীবনের স্রষ্টা ও রক্ষকরূপে প্রকৃতি এবং নারীর উপর ভূমিকা রেখে চলছে। বর্তমান প্রচলিত উন্নয়ন ধারা এ আগ্রাসনকে আরো বিস্তৃত করেছে। তাই এই নারীবাদ নারী ও প্রকৃতির উপর বিদ্যমান পুরুষ প্রাধান্যের অবসানের দাবি করে। পরিবেশ নারীবাদের প্রবক্তা হিসেবে ভারতের বন্দনা শিবা, মারিয়া মিজদের নাম উল্লেখযোগ্য।

বৈশ্বিক নারীবাদ
এই ধারা নারীর অবস্থানকে বৈশ্বিকভাবে দেখার দিক-নির্দেশনা দিয়ে থাকে। কেননা, কেবল নির্দিষ্ট এক দেশে নয়, নারীরা দুনিয়ার সর্বত্রই দরিদ্র ও নিপীড়িত। বিভিন্ন পিতৃতান্ত্রিক সমাজে পুরুষরা বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় নারীর অর্থনৈতিক ও পুনরুৎপাদন শ্রমকে আত্মসাৎ করে। সে জন্য তারা মনে করে, ওই সমস্যা দূর করতে একটি বৈশ্বিক সাপোর্ট নেটওয়ার্ক গড়ে তুলতে হবে। যেখানে প্রতিটি সমাজের নারীরা তাদের সমস্যা যথাযথ চিহ্নিত করার ক্ষমতা অর্জন করবে। এই প্রক্রিয়ায় নারী সহজে সমস্যা সমাধান করতে পারবে।

প্রয়োজন সঠিক দৃষ্টিভঙ্গির
আলোচনা থেকে স্পষ্ট হয়, নারী আন্দোলনের বয়স নিছক কম নয়। আত্মত্যাগ ও সংগ্রামের দীর্ঘ স্মারক বেয়ে নারী দিবস আজ একশ’ বছরে উপনীত হয়েছে। কিন্তু, তারপরও যথাযথ সাফল্য আসেনি। এক্ষেত্রে নারীবাদী আন্দোলনের দৃষ্টিভঙ্গির সমস্যা যথেষ্ট আলোচনার অবকাশ রাখে। কোন কোন নারীবাদী আন্দোলন পুরুষদের বিরুদ্ধে পরিচালিত হতে দেখা যায়। র‌্যাডিক্যাল ফেমিনিজম সরাসরি পুরুষদের শ্রেণী শত্রু হিসেবেও আখ্যায়িত করেছে। এভাবে চিন্তার পদ্ধতি বিভ্রান্তিকর। নারীবাদী মানে যদি পুরুষ বিরোধিতা হয়, তাহলে সে আন্দোলন কখনো সাফল্য পাবে না। কারণ, এ সংগ্রামে পুরুষদের বাদ দিয়ে পরিপূর্ণ অধিকার আদায় সম্ভব নয়। কেননা, নারী-পুরুষের যৌথ প্রয়াসে সমাজ এগিয়ে গেছে। আগামীতেও ওই প্রক্রিয়ায় নারী মুক্তি সম্ভব।




৫টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

তোমাকে লিখলাম প্রিয়

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ০২ রা মে, ২০২৪ বিকাল ৫:০১


ছবি : নেট

আবার ফিরে আসি তোমাতে
আমার প্রকৃতি তুমি,
যার ভাঁজে আমার বসবাস,
প্রতিটি খাঁজে আমার নিশ্বাস,
আমার কবিতা তুমি,
যাকে বারবার পড়ি,
বারবার লিখি,
বারবার সাজাই নতুন ছন্দে,
অমিল গদ্যে, হাজার... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছাঁদ কুঠরির কাব্যঃ মিসড কল

লিখেছেন রানার ব্লগ, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ৯:৫৫



নতুন নতুন শহরে এলে মনে হয় প্রতি টি ছেলেরি এক টা প্রেম করতে ইচ্ছে হয় । এর পেছনের কারন যা আমার মনে হয় তা হলো, বাড়িতে মা, বোনের আদরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

হিটস্ট্রোক - লক্ষণ ও তাৎক্ষণিক করণীয়

লিখেছেন ঢাকার লোক, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:০৭

সাধারণত গরমে পরিশ্রম করার ফলে হিটস্ট্রোক হতে পারে। এতে দেহের তাপমাত্রা অতি দ্রুত বেড়ে ১০৪ ডিগ্রী ফারেনহাইট বা তারও বেশি হয়ে যেতে পারে।

হিটস্ট্রোক জরুরি চিকিৎসা প্রয়োজন। চিকিৎসা... ...বাকিটুকু পড়ুন

আল্লাহকে অবিশ্বাস করার সংগত কোন কারণ নাই

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৩



সব কিছু এমনি এমনি হতে পারলে আল্লাহ এমনি এমনি হতে সমস্যা নাই। বীগ ব্যাং এ সব কিছু হতে পারলে আল্লাহও হতে পারেন। সব কিছুর প্রথম ঈশ্বর কণা হতে পারলে আল্লাহও... ...বাকিটুকু পড়ুন

যুক্তরাষ্ট্রে ইসরাইল বিরোধী প্রতিবাদ বিক্ষোভ

লিখেছেন হাসান কালবৈশাখী, ০৩ রা মে, ২০২৪ সকাল ৮:০২

গাজায় হামাস উচ্ছেদ অতি সন্নিকটে হওয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিউইয়র্ক ও লসএঞ্জেলসে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পরেছিল। আস্তে আস্তে নিউ ইয়র্ক ও অন্যান্ন ইউনিভার্সিটিতে বিক্ষোভকারীরা রীতিমত তাঁবু টানিয়ে সেখানে অবস্থান নিয়েছিল।


... ...বাকিটুকু পড়ুন

×