লিও টলস্টয়।
ঊনবিংশ শতাব্দীর একজন বিখ্যাত রাশিয়ান লেখক। তাকে সর্বকালের অন্যতম সেরা লেখকদের একজনও বলা হয়ে থাকে। যে লিস্টে তার সাথে রয়েছেন শেক্সপিয়ার ও রবীন্দনাথের মত অমর লেখকেরা।
এই লিও টলস্টয় একবার বলেছিলেন,
"নারী হল সমাজ জীবনের এক অনিবার্য নিরানন্দের উৎস।"
প্রাচীনকাল থেকেই সমাজে নারীর অবস্থান সম্পর্কে নানা নেতিবাচক ধারনা প্রচলিত। যেমন, মেয়েরা বুদ্ধিহীন, তাদের স্থান শুধুই ঘরে, তারা শুধু পরনিন্দা করে ইত্যাদি। সময়ের সাথে সাথে সমাজে নারীর অবস্থান অনেক শক্ত হয়েছে। এ ধরনের নেতিবাচক ধ্যান-ধারনা কমেছে। সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রেই নারীদের সফলতা চোখে পড়বার মত।
যদি শুধু বাংলাদেশের কথাই চিন্তা করি, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী ,দেশের ৫ কোটি ৪১ লাখ কর্মজীবীর মধ্যে ১ কোটি ৬২ লাখ নারী৷ ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প উদ্যোক্তাদের মধ্যে নারীর সংখ্যা ১৬ হাজার ৬৯৭ জন৷ বিদেশে বিভিন্ন পেশায় কর্মরত ৭৬ লাখ প্রবাসীর মধ্যে ৮২ হাজার ৫৫৮ জন নারী৷ এছাড়া বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের প্রধান খাত তৈরি পোশাক শিল্পের ৮০ ভাগ কর্মীই নারী৷ দেশের ৯০ শতাংশ ক্ষুদ্রঋণ ব্যবহারকারীও নারী৷ বর্তমানে সংসদে ৬৯ জন নারী সংসদ সদস্য রয়েছেন৷ মন্ত্রিসভায় নারী আছেন৷ প্রধানমন্ত্রী নারী৷ সাবেক প্রধানমন্ত্রীও নারী৷ নারী জাতীয় সংসদের স্পিকারও৷
সব মিলিয়ে দৃশ্যটা বেশ সুখকর বলেই আপাত দৃষ্টিতে মনে হয়৷
যাই হোক, প্রসঙ্গ থেকে কিছুটা সরে আসি। চলে যাই পলাশীর যুদ্ধ ও বক্সারের যুদ্ধের সময়কালে। যুদ্ধে জয়লাভ করে ব্রিটিশ ইস্টইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতবর্ষে তাদের শাসন প্রতিষ্ঠা করে। তবে কি জানেন তো, তারা এক অভিনব পদ্ধতিতে শাসন ও শোষণ করতে শুরু করে। তারা তৎকালীন সম্রাটকেই শাসনকার্য পরিচালনা করার ভার দেয়, কিন্তু তার সকল প্রকার অর্থনৈতিক স্বাধীনতা কেড়ে নেয়। অর্থাৎ সম্রাটের নামেই খাজনাদি আদায় হত, কিন্তু আদতে তা যেত ব্রিটিশদের পকেটে।
নারীদের ব্যাপারটাও অনেকটা সেরকম। যেসব উদাহরণ বা স্ট্যাটিস্টিকস দিলাম সেগুলো হল নারীর ক্ষমতায়ন। কিন্তু নারীমুক্তি আজও অধরা। আজ মেয়েদের শিক্ষার হার বেড়েছে। তারা স্কুলে যাচ্ছে, উচ্চশিক্ষায় যাচ্ছে ঠিকই, কিন্তু কাউকে কাউকে আবার তনু বা রিসার মত করুণ পরিণতির শিকার হতে হচ্ছে। আজ নারীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিকা হচ্ছেন আবার স্বামীর পাশবিক নির্যাতনের শিকার হয়ে চোখও হারাচ্ছেন।
আবার কিছু স্ট্যাটিস্টিকস দেই।
অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. আবুল বারকাত তার ‘‘নারীর ভূমি অধিকার ও বঞ্চনা'' শীর্ষক গবেষণায় বলেছেন, ‘‘মাত্র শতকরা চার ভাগ নারীর ভূমির উপর প্রকৃত মালিকানা রয়েছে৷ মুসলিম নারীরা উত্তরাধিকার সূত্রে সম্পত্তির মালিকানা লাভ করলেও শতকরা মাত্র দুই থেকে পাঁচ ভাগ মুসলিম নারীর ভূমিতে প্রকৃত মালিকানা রয়েছে৷''
সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে নারীর অবস্থান জানতে চাচ্ছেন? শুনুন ঢাকার কয়েকজন ওয়ার্ড কাউন্সিলরদের মুখে৷ তাঁদের কয়েকজন জানান, ‘‘নির্বাচিত হওয়ার তিন মাসের মধ্যে কোনো কাজই শুরু করতে পারিনি৷ কোনো সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে আমাদের গুরুত্বই দেয়া হয় না৷'' এক গবেষণায় নারীর ক্ষমতায়নে ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে ৬ ধরনের বাধার কথা বলা হয়েছে-
১. নারীর অংশগ্রহণ প্রক্রিয়ায় পরিবারের সমর্থনের অভাব এবং নিষেধ।
২. নারী নের্তৃত্ব মেনে নেয়ার জন্য সামাজিক অনীহা।
৩. পরিবারের পুরুষ সদস্যের ওপর নির্ভরতা বা নারীদের চলাচলের ওপর বাধা নিষেধ আরোপ।
৪. অর্থনৈতিক সম্পদের অভাব।
৫. শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের অভাব।
৬. রাজনৈতিক দলগুলোর ভেতরে গণতন্ত্রের চর্চার অভাব।
এবার কর্মপরিবেশ এবং মজুরির কথা ধরা যাক৷ জাতীয় শ্রম শক্তি জরিপ প্রতিবেদন অনুসারে, দেশে নারী শ্রমিকের সংখ্যা সাড়ে ৮ লাখ৷ তাঁরা সকলেই মজুরি বৈষম্যের শিকার৷ পুরুষের সমান কাজ করলেও তাঁরা মজুরি পান কম৷ উদাহরণস্বরূপ, গ্রামাঞ্চলে একই কাজ করে পুরুষ শ্রমিকরা গড়ে ১৮৪ টাকা পেলেও নারী শ্রমিকরা পান ১৭০ টাকা৷ ন্যায় বিচারের বিষয়টি স্পষ্ট করার জন্য এই একটি তথ্যই যথেষ্ঠ৷
যখন নারীরা সিদ্ধান্ত গ্রহণে বাঁধার শিকার হচ্ছেন, শহরের (ঢাকা) প্রায় ৮১% নারী কোন না কোনভাবে যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছেন, পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন, কর্মক্ষেত্রে নানামুখী বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন তখন স্পষ্টভাবেই বলা যায় যে, নারীমুক্তি আজও ধরাছোঁয়ার বাইরেই রয়ে গেছে।
অনেকেই এখন বলবেন এসব কথা তো বস্তাপচা কথা। এগুলো তো আমরা জানি। এর মধ্যে নতুন কি আছে? এভাবেই তো চলছে।
ঠিক তাই। নতুন কিচ্ছু নাই। এভাবেই চলছে। চলবে। এভাবেই তনুর মত মেয়েরা ধর্ষণের শিকার হবে, আমরা কিছুদিন ফেসবুক গরম করব, দুএকটা সভা সেমিনার করব। আর ওদিকে অপরাধীরা দাপিয়ে বেড়াবে। রিসার মত মেয়েরা বখাটেদের হাতে বলি হবে আর আমরা শুধু চেয়ে চেয়ে দেখব।
আর খুব বেশি হলে এই যে, এধরনের দু-তিনটে স্ট্যাটাস শেয়ার করব।
by the way, এই স্ট্যাটাসটা দেয়ার মাধ্যমে আমি কিন্তু আমার দায়বদ্ধতা থেকে মুক্ত। এখন রিসা বা তনুর হত্যাকারী ধরা পরল কি পরল না তা আমার দেখার বিষয় না। নারীমুক্তি মিলল কি অধরা রইল তা নিয়ে ভাবার কোন দরকার নেই।
কাল থেকে আমিও পথেঘাটে নারীদেরকে অবমূল্যায়ন করব।
আবার কোন ঘটনা ঘটলে? আবার একটা স্ট্যাটাস দেব। সব দায়বদ্ধতা খতম।
সিম্পল।
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে আগস্ট, ২০১৬ রাত ১২:০১