১২ই ডিসেম্বর, ১৯৭১।
ঢাকার মিরপুর এলাকায় পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর অস্থায়ী ক্যাম্প।
টেবিলের উপর পা তুলে দিয়ে রিল্যাক্স মুডে বসে আছে মেজর সোয়েব আলী। প্রায় আধা ঘণ্টা যাবত সে এভাবেই আছে। ব্যাগ গুছিয়ে রেখেছে। একটা ফোনের অপেক্ষায় আছে। কিছুক্ষনের মধ্যে একটা হেলিকপ্টার আসবে। তুলে নিয়ে যাবে তাকে নিরাপদ স্থানে।
পালাচ্ছে সোয়েব আলী। পালানো ছাড়া উপায় নেই। মুক্তিযোদ্ধারা দেশের বেশিরভাগ অঞ্চল মুক্ত করে ফেলেছে। চারিদিক থেকে এগিয়ে আসছে তারা ঢাকার দিকে। বসে থাকলে আত্মসমর্পণ করতে হবে। আর আত্মসমর্পণ মানেই মৃত্যু। ৯ মাস ব্যাপী এই যুদ্ধে পাকিস্তানী বাহিনীর সবচেয়ে হিংস্র, বর্বর আর নৃশংস অত্যাচারীদের মধ্যে একজন ছিল এই সোয়েব আলী। তার বাহিনীর সৈন্যরা ২৫শে মার্চ রাতে তুমুল হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল। সমস্ত যুদ্ধের সময়টাতে তার লোকেরা খুন, লুটতরাজ আর ধর্ষণের ব্যাপক মহরা দেখিয়েছে। মুক্তিযোদ্ধারা তাকে হাতে পেলে কিছুতেই প্রানে বাঁচতে দেবেনা। তাই পালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সোয়েব আলী। আর কিছুক্ষনের মধ্যে একটা কপ্টার আসবে। তাকে সহ আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ ব্যাক্তিদের নিয়ে চলে যাবে নিরাপদ স্থানে। সেখান থেকে পাকিস্তান ফিরে যেতে আর কোনও সমস্যা হবেনা।
ফোন এলো। ব্যাস্ত হয়ে রিসিভার তুলল সোয়েব আলী। ওপাশ থেকে নির্দেশ এলো ১০ মিনিটের মধ্যে শাহ্ আলীর মাজারে পৌছাতে হবে। সেখানে কপ্টার অপেক্ষা করছে তার জন্য! সব কিছু গোছানোই আছে। জিপ রেডি আছে। এখান থেকে মাজারে যেতে বড়জোর ২ মিনিট লাগবে। তাহলে হাতে আছে ৮ মিনিট। ছোট একটা কাজ বাকি আছে তার। কাজটা সাড়তে ১ মিনিটও লাগবে না। ছোট হলেও কাজটা গুরুত্বপূর্ণ।
***
ঘণ্টা খানেক যাবত একই ভঙ্গিতে বসে আছে মেজর নজরুল। একটা ঝিমুনিভাব চলে এসেছে। সেলের দরজা খোলার আওয়াজে চমকে উঠল সে। মুখ তুলে দেখল দাড়িয়ে আছে সোয়েব আলী। তার এক হাতে একটা ব্যাগ, অন্য হাতে ধরা উদ্যত পিস্তল।
মৃদু হাসল নজরুল, “পালাচ্ছ নাকি সোয়েব?”
“হ্যাঁ...পালাচ্ছি। তোমার কথাই ঠিক হল নজরুল। শেষ পর্যন্ত তোমরাই জিতে গেলে এই যুদ্ধে”।
আবার হাসির রেখা ফুটে উঠল নজরুলের ঠোঁটে, “আমি জানতাম আমরা জিতবই। সত্য আর ন্যায়ের জয় সব সময়ই হয়ে এসেছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা কেউ আটকাতে পারবেনা”।
হঠাৎ অট্টহাসিতে ফেটে পরল সোয়েব।
“হাসছ কেন? পাগল হয়ে গেলে নাকি?”
হাসতে হাসতেই সোয়েব বলল, “হাসছি এই ভেবে যে তুমি কত বোকা!”
“তার মানে?”
“দেশ স্বাধীন হয়ে যাচ্ছে, তাতে তোমার কি লাভ হল? মনে করেছ তোমাকে আমি সেই স্বাধীনতা দেখার সুযোগ দিব? এখনই তোমাকে খুন করব আমি। স্বাধীনতা তো তোমার কোনও কাজে এলনা!”
“আমি বেঁচে থাকি না থাকি তাতে কিছু যায় আসে না। দেশ স্বাধীন হচ্ছে এটাই বড় কথা। আমার এই আত্মত্যাগের বিনিময়ে আমার দেশের মানুষ স্বাধীন জাতি হিসেবে মাথা উচু করে দাঁড়াবে ভাবতেই গর্বে আমার বুকটা ভরে যাচ্ছে”।
“তুমি লোকটা আসলেই খুব শক্ত, নজরুল!” আফসোসের ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল সোয়েব। “ধরা পরার পর থেকে প্রায় এক মাস যাবত তোমাকে আটকে রেখেছি এখানে। দিনের পর দিনে না খাইয়ে রেখেছি, কত নির্মম টর্চার করেছি, কিন্তু তুমি মুখ খোলনি! তোমার সঙ্গি সাথি কোথায় আছে, কোথায় ঘাঁটি গেড়েছে, কোথায় অস্ত্র লুকিয়ে রেখেছে সে সম্পর্কে একটা তথ্যও দেওনি! আশ্চর্য!”
“যেদিন যুদ্ধে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, সেদিনই শপথ করেছিলাম মৃত্যু এলে বুক পেতে দাঁড়াব। যে মরতে ভয় পায়না, সে টর্চারের ভয়ে মুখ খুলবে একথা ভাবলে কি করে?”
“মরতে ভয় পাওনা?” হাসল সোয়েব, পিস্তলটা উচু করে নজরুলের দিকে ধরল। “এখনই প্রমান হয়ে যাবে”।
একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল নজরুল, প্রস্তুত হল সকল সম্ভাবনায়।
সোয়েব অস্থির গলায় বলল, “কেন জানি তোমাকে মারতে পারছিনা নজরুল। মিলিটারি ক্যাম্পে একসাথে ট্রেনিং নিয়েছি আমারা, একসাথে অনেক দিন কাজ করেছি। তাই হয়ত গুলি করতে পারছিনা তোমাকে। প্লিজ এমন কিছু বল যাতে তোমাকে গুলি করতে আমার হাত না কাঁপে”।
“একসাথে কাজ করেছি একসময়। কিন্তু আমার আদর্শ ভিন্ন। আজ আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা, আর তুমি পাকিস্তানী কুকুর”।
“নাহ, এতেও হচ্ছেনা। আরও কঠিন কিছু বল”।
নজরুল চুপ করে থাকল।
“চুপ করে থেকনা নজরুল”।
ঘড়ি দেখল সোয়েব “আমার হাতে সময় নেই। হেলিকপ্টার অপেক্ষা করছে আমার জন্য। তোমাকে না মেরে আমিতো যেতে পারছিনা!”
“তুমি যদি এই মুহূর্তে আমাকে না মেরে মুক্ত করে দাও, তাহলে প্রথম সুযোগেই তোমাকে আমি খুন করব সোয়েব। আমার দেশের মানুষকে যে নির্বিচারে মেরেছে তাকে আমি ক্ষমা করব না”।
“এইবার আসল কথা বলেছ, নজরুল”। হাসিতে উদ্ভাসিত হল সোয়েবের মুখ। ট্রিগার ধরা আঙ্গুলটা চেপে বসল। মেরুদণ্ড বেয়ে একটা সুখের শিহরণ বয়ে গেল। এই কাজ সে বহুবার করেছে। বাঙ্গালীগুলোকে কাছ থেকে গুলি করে মারতে তার খুব আনন্দ হয়। তাদের ছট ফট করে মরার দৃশ্যটা সে বেশ উপভোগ করে।
গুলি করল সোয়েব। নিখুঁত লক্ষ্যভেদ। নজরুলের বুকের বাম পাশ রক্তে ভেসে যাচ্ছে। ঠিক হার্টে গুলি লেগেছে। এখানে গুলি লাগলে ৫ সেকেন্ডের মধ্যেই মৃত্যু হয়। একটার বেশি বুলেট খরচা করার কোনও প্রয়োজন নেই। পিস্তলটা নজরুলের দিকে ছুড়ে দিল সোয়েব। “এই নাও, যে পিস্তল দিয়ে তোমাকে মারলাম সেটাই তোমাকে উপহার দিলাম”।
***
সেল থেকে বেড়িয়ে এলো সোয়েব। ডেস্ক থেকে জিপের চাবিটা নিল। নজরুলকে খুন করতে গিয়ে ৫ মিনিট সময় ব্যায় হয়েছে। তারাতারি করতে হবে। তবে খুনটা করে তৃপ্তি পেয়েছে সোয়েব। হয়ত এটাই ছিল তার হাতে শেষ কোনও বাঙ্গালীর মৃত্যু।
দরজা খুলে বেড়িয়ে যাবে, দরজার নবে হাত রাখতেই বুকে প্রচণ্ড ব্যাথা অনুভব করল সে। যেন কিছু একটা তার হার্ট ছিদ্র করে দিয়েছে! আওয়াজটা এলো কয়েক মিলি সেকেন্ড পর। গুলির শব্দ! কেউ একজন গুলি করেছে তাকে! বুকের ভেতর বুলেটের অস্তিত্ব টের পেল সোয়েব। ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকাল । যা দেখল তা দেখার জন্য সে প্রস্তুত ছিলনা সে! নজরুল বসে আছে চেয়ারে। ডেস্কের উপর তুলে দিয়েছে ২ পা। হাতে ধরা সোয়েবের পিস্তলটা!
হাঁটু ভেঙে বসে পরল সোয়েব। কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে। তবুও শরীরের শেষ শক্তিটুকু এক করে বলল, “এটা হতে পারেনা.....আমি তোমাকে হা..হার্টে গুলি করেছি। বেঁচে যাওয়া অ...অসম্ভব!”
নজরুলের ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটল। হাতের পিস্তলটা দোলাতে দোলাতে বলল, “সোয়েব! অনেক টর্চারের পরও আমি কোনও তথ্য দেইনি বলে তুমি খুব আক্ষেপ করছিলে! একটা তথ্য নাহয় দেই তোমাকে। তথ্যটা হল, আমি ডেক্সট্রোকার্ডিয়াক*!”
তথ্যটা সোয়েবের কানে গিয়ে পৌছালো না। কারন ৫ সেকেন্ড পেরিয়ে গেছে অনেক আগেই! দূর থেকে মিছিলের শব্দ ভেসে আসছে, জয় বাংলা, বাংলার জয়!
----------------------------------------
*জন্মগতভাবে কিছু মানুষের হার্ট থাকে বুকের ডান পাশে। এদেরকে ডেক্সট্রোকার্ডিয়াক বলা হয়।
আলোচিত ব্লগ
ইন্দিরা গান্ধীর চোখে মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক: ওরিয়ানা ফলাচির সাক্ষাৎকার

১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ইতালীয় সাংবাদিক ওরিয়ানা ফলাচি ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাক্ষাৎকার নেন। এই সাক্ষাৎকারে মুক্তিযুদ্ধ, শরনার্থী সমস্যা, ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক, আমেরিকার সাম্রাজ্যবাদী পররাষ্ট্রনীতি এবং পাকিস্তানে তাদের সামরিক... ...বাকিটুকু পড়ুন
=যাচ্ছি হেঁটে, সঙ্গে যাবি?=

যাচ্ছি হেঁটে দূরের বনে
তুই কি আমার সঙ্গি হবি?
পাশাপাশি হেঁটে কি তুই
দুঃখ সুখের কথা ক'বি?
যাচ্ছি একা অন্য কোথাও,
যেখানটাতে সবুজ আলো
এই শহরে পেরেশানি
আর লাগে না আমার ভালো!
যাবি কি তুই সঙ্গে আমার
যেথায়... ...বাকিটুকু পড়ুন
আগামী নির্বাচন কি জাতিকে সাহায্য করবে, নাকি আরো বিপদের দিকে ঠেলে দিবে?

আগামী নির্বচন জাতিকে আরো কমপ্লেক্স সমস্যার মাঝে ঠেলে দিবে; জাতির সমস্যাগুলো কঠিন থেকে কঠিনতর হবে। এই নির্বাচনটা মুলত করা হচ্ছে আমেরিকান দুতাবাসের প্রয়োজনে, আমাদের দেশের কি হবে, সেটা... ...বাকিটুকু পড়ুন
বাঙ্গু এনালিস্ট কাম ইন্টারন্যাশনাল সাংবাদিক জুলকার নায়েরের মাস্টারক্লাস অবজারবেশন !

ক্ষমতাচ্যুত ফ্যাসিবাদ: দিল্লির ছায়া থেকে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র
একটা সত্য আজ স্পষ্ট করে বলা দরকার—
শেখ হাসিনার আর কোনো ক্ষমতা নেই।
বাংলাদেশের মাটিতে সে রাজনৈতিকভাবে পরাজিত।
কিন্তু বিপদ এখানেই শেষ হয়নি।
ক্ষমতা হারিয়ে শেখ হাসিনা এখন ভারতে আশ্রয় নিয়ে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র... ...বাকিটুকু পড়ুন

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।