somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

অন্ধবালক

০৮ ই জানুয়ারি, ২০১৩ রাত ৯:২৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


জাফর সাহেব হঠাৎ করেই আবিষ্কার করলেন তিনি মানুষের ভবিষ্যৎ বলতে পারছেন। আবার সেই ভবিষ্যৎ বলতে পারার ব্যাপারটাও অদ্ভুত। শুধুমাত্র অবিবাহিত ছেলে বা মেয়ের বিবাহ সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে তার ভবিষ্যৎ বানী মিলে যাচ্ছে। একটা উদাহারন দিলেই ব্যাপারটা পরিষ্কার হবে।

জাফর সাহেব একটা বেসরকারি ব্যাংকের গুলশান ব্রাঞ্চের HR কর্মকর্তা। তার ব্রাঞ্চে জুনিয়র একজিকিউটিভ পদে একটা নতুন ছেলে জয়েন করল। ছেলেটির নাম সোহেল। প্রানবন্ত এক যুবক। এসেই সবার মন জয় করে নিল। ছেলেটাকে দেখে একদিন হঠাৎ জাফর সাহেবের মনে হল এই ছেলেটি মাস দুয়েকের মধ্যে বিয়ের পিড়িতে বসতে যাচ্ছে। সে কিছুদিন বাদেই একটা বিয়ে বাড়িতে বেড়াতে যাবে। সেখানে কোন একটা বিষয় নিয়ে বড় ধরনের ঝামেলা হবে, তারপর বাধ্য হয়ে ছেলেটি নিজের থেকে দু বছরের বড় এক মেয়েকে বিয়ে করে বাড়িতে নিয়ে আসবে। ভাবনাটা মাথায় আসার পর জাফর সাহেবের বেশ হাসি পেল। এমন একটা চিন্তা তার মাথায় কেন এল? এই ছেলে নিজের থেকে দু বছরের মেয়ে বিয়ে করবে কেন? অদ্ভুৎ চিন্তা! জাফর সাহেব ব্যাপারটা হেসে উড়িয়ে দিলেন।

এর মাস দুয়েক পর হঠাৎ করে সোহেল অফিস আসা বন্ধ করে দিল। কোনও খোঁজ খবর নাই। ফোনও বন্ধ। সবাই ব্যাপারটা নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়ল। সপ্তাহ খানেক বাদে ছেলেটি অফিসে এল। সবাই অবাক হয়ে দেখল অমন প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর ছেলেটা হঠাৎ করে কেমন যেন চিমসে গেছে! খবর নিয়ে জানা গেল ছেলেটি একটি বিয়ে বাড়িতে গিয়ে কোনও একটা ঝামেলায় জড়িয়ে পড়ে। তার ফল স্বরূপ নিজের চেয়ে বয়সে ২ বছরের বড় একটা মেয়েকে বিয়ে করে বাড়িতে ফিরতে হয়েছে। এখন এই ঘটনা নিয়ে তার বাসায় ভীষণ ঝামেলা চলছে। খবরটা আক্ষরিক অর্থেই জাফর সাহেবের মাথা ঘুরিয়ে দিল। তিনি মিলাতে পারছেন না কেমন করে তার অদ্ভুত একটা ভবিষ্যৎ চিন্তা বাস্তবে সত্যি হয়ে গেল। তবে ডিকশনারিতে “কাকতালীয়” নামে একটা শব্দ আছে যা এই যাত্রায় জাফর সাহেব কে সাহায্য করল মনকে প্রবোধ দিতে ।

কিন্তু পরের ঘটনাটা আর “কাকতালীয়” ক্যাটাগরিতে ফেলা গেলনা। জাফর সাহেব তার বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া একমাত্র মেয়েকে নিয়ে মোহাম্মদপুর এলাকার একটা ফ্ল্যাটে থাকেন। একদিন তাদের পাশের ফ্ল্যাটে নতুন ভাড়াটিয়া এল। বাবা-মা আর তাদের দুই ছেলে। বাড়ির কর্তা ভদ্রলোক সরকারি চাকরি করেন। বড় ছেলেকে নিয়ে একদিন তার সাথে সৌজন্য সাক্ষাৎ করতে এলেন । নিজের ছেলেকে দেখিয়ে গর্ব করে অনেক কথা বললেন। ছেলে ভাল চাকরি করে, ভাল বেতন পায়, ব্রিলিয়ান্ট ছাত্র ছিল, আদব কায়দা জানে আরও নানান প্রশংসা। জাফর সাহেব মনে মনে হাসলেন। তার মাথায় চিন্তা এল ছেলেটা কদিন বাদেই এক মেজরের মেয়েকে নিয়ে ভাগবে আর ভদ্রলোকের জান খারাপ হয়ে যাবে। চিন্তাটা কেন মাথায় এল ভেবে জাফর সাহেব অবশ্য উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলেন। সপ্তাহ খানেক বাদে জাফর সাহেব অফিস শেষে বাড়ি ফিরে মেয়ের কাছে শুনলেন পাশের বাসার বড় ছেলেটা বাসায় ফেরেনি, তার মা বাবা চিন্তায় অস্থির হয়ে আছে। জাফর সাহেব নিজেও চিন্তায় অস্থির হলেন। তিনি মনে প্রানে চাইলেন যেন তার ধারনা মিথ্যে হয়। কিন্তু পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখলেন তাদের বাড়ি ঘিরে ধরেছে পুলিশ আর আর্মির লোকজন। পাশের বাড়ির ছেলেটা আসলেই একজন মেজরের মেয়েকে নিয়ে ভেগে গেছে। সেই মেজর এসে ছেলের বাবাকে টেনে হিঁচড়ে রাস্তায় নিয়ে গিয়ে সবার সামনে অপমান করছে।

ব্যাপারটা হজম করতে জাফর সাহেবের খুব কষ্ট হল। তিনি ঘামতে শুরু করলেন আর বড় বড় শ্বাস নিতে থাকলেন। মেয়েকে বললেন এক গ্লাস ঠাণ্ডা পানি দেয়ার জন্য। পানি খেয়ে জাফর সাহেব মেয়েকে বললেন, “মা তোকে এখন একটা কথা বলব, কথাটা কাউকে বলতে পারবিনা। কথাটা হল, আমি অবিবাহিত ছেলে মেয়ের ভবিষ্যৎ দেখতে পাই। বলে দিতে পারি কবে কখন কোথায় আর কার সাথে তার বিয়ে হবে”।

মেয়েটি প্রথমে ব্যাপারটা বুঝতে পারল না। জাফর সাহেব মেয়েকে পুরো বিষয়টা বুঝিয়ে বললেন। জাফর সাহেবের মেয়ে যুক্তিবাদী। সে বিশ্বাস করে জগতের প্রতিটি বিষয় একটা নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে চলে। এখানে কারও কোনও অলৌকিক ক্ষমতা পেয়ে যাওয়ার কোনও সম্ভাবনা নেই। বাবার কথা তাই তার বিশ্বাস হলনা। মেয়েকে বিশ্বাস করানোর জন্য এর পর জাফর সাহেব আরও বেশ কিছু ভবিষ্যৎ বানী করলেন যা কিছুদিন পরেই সত্যি প্রমানিত হল। মেয়েটি বুঝল জগতের স্বাভাবিক নিয়মের মাঝে কোথাও নিশ্চয়ই কোনও মারাত্মক অনিয়ম ঘটেছে। যার ফলে তার বাবা একটা এমন ক্ষমতা পেয়ে বসেছে যা সাধারন মানুষের মাঝে থাকেনা।

কিন্তু মেয়েটি একটা ব্যাপার খেয়াল করেনি যে প্রকৃতি আসলে অস্বাভাবিক কিছু পছন্দ করে না। তাই কোথাও অস্বাভাবিক কিছু দেখা দিলে তা যত দ্রুত সম্ভব ঠিক করে নেয়ার জন্য পদক্ষেপ নেয়। একদিন অফিস যাওয়ার পথে জাফর সাহেবের গাড়ি মারাত্মক দুর্ঘটনার শিকার হল। গুরুতর আহত অবস্থায় তাকে হাসপাতালে নেয়া হল। ডাক্তাররা বললেন আর বাঁচান যাবেনা। মৃত্যুশয্যায় একমাত্র মেয়েটি হাত ধরে পাশে বসে ছিল। জাফর সাহেব অতি কষ্টে বলতে লাগলেন, “মা...তোর ভবিষ্যৎ আমি দেখেছি.....তুই কি জানতে চাস?”

মেয়েটি কান্না জড়ানো কণ্ঠে বলল, “চুপ কর বাবা। তোমাকে কিছু বলতে হবেনা”।

“আমি তো চুপ করেই যাব.....তাই শেষ কয়েকটা কথা বলে যাই....তোর বিয়ে হবে একটা অন্ধ ছেলের সাথে....ছেলেটির সাথে কিভাবে তোর পরিচয় হবে জানিস?

মেয়েটি কিছু না বলে শুধু চোখ মুছল।

“তুই দাড়িয়ে থাকবি একটা বড় রাস্তার পাশে....রাস্তার ওপাশে অন্ধ সেই ছেলেটিকে দেখতে পাবি....ছেলেটি চোখে না দেখলে কি হবে....তার শ্রবণশক্তি প্রবল...সে গাড়ির আওয়াজ শুনে শুনে....রাস্তা পার হয়ে তোর দিকে....এগিয়ে আসবে...কবে ঘটবে এই ঘটনা জানিস?”

“থাক বাবা, চুপ থাক। তোমার কষ্ট হচ্ছে কথা বলতে”।

“সেই দিনটা হল একটা বাংলা মাসের প্রথম দিন। কোন মাস জানিস?”

“জানতে চাইনা বাবা। প্লিজ তুমি চুপ কর। মেয়েটি কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল এবার”।

জাফর সাহেব অনেক কষ্ট করেও মাসের নামটা আর উচ্চারন করতে পারলেন না। তার গলা দিয়ে ঘোঁত ঘোঁত জাতীয় কিছু শব্দ বেড়িয়ে এল। মেয়েটি তা দেখে ডাক্তার নার্স দের ডাকাডাকি শুরু করল। কিন্তু চিরায়ত সেই past perfect tense অনুযায়ী ডাক্তার আসার পূর্বেই রোগী মারা গেল।


দুই

শাহেদের মা আনোয়ারা বেগম পেশায় আইনজীবী। তিনি অত্যন্ত চিন্তিত হয়ে পড়েছেন নিজের ছেলেকে নিয়ে। সপ্তাহ খানেক যাবত দেখছেন তার হাসি খুশি ছেলেটি হঠাৎ করে আমুল বদলে গেছে। এমন মনমরা অবস্থায় তাকে আগে কখনই দেখেননি। সময়মত অফিস যাচ্ছে না। ঠিকমত খাওয়া দাওয়া করছে না। টিভিতে খেলা দেখার পাগল অথচ টিভির সামনেই আর বসে না। ছেলের অসংখ্য বন্ধুবান্ধব আছে, কারও সাথে দেখাও করেনা । যতক্ষণ বাসায় থাকে নিজের ঘরে দরজা আটকে বসে থাকে। কিছু জিজ্ঞেস করলে বলে কিছুই হয়নি। আনোয়ারা বেগম প্রথমে সন্দেহ করেছিলেন ছেলেটি হয়ত ড্রাগ ধরেছে। কিন্তু নিজের ছেলেকে তিনি ভাল করেই চেনেন। ছেলে নেশা জাতীয় বস্তু থেকে সব সময় দূরেই থাকে। এখন তিনি সন্দেহ করছেন মেয়ে ঘটিত কোনও জটিলতায় পড়েছে তার ছেলে। আজ তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ঘটনা যাই হোক আজ তাকে জানতেই হবে।

আনোয়ারা বেগম জোরে জোরে ছেলের রুমের দরজায় ধাক্কা দিলেন। “শাহেদ, দরজা খোল”।

“বিরক্ত করোনা মা, ভাল লাগছে না”।
ভেতর থেকে শাহেদের উত্তর।

“তুই দরজা খোল বলছি, কথা আছে তোর সাথে”।

নিতান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও শাহেদ দরজা খুলে দিল।

আনোয়ারা বেগম ঘরে ঢুকে ছেলের বিছানায় বসলেন, “আজ তোকে বলতেই হবে তোর কি হয়েছে। কোনও আপত্তি শুনছি না”।

“কিছু হয়নি মা। মনটা ভাল নেই”।

“শাহেদ! আমি তোর মা! তুই জানিস তুই আমার সাথে যেকোনো কথাই বলতে পারিস”।

শাহেদ কিছু না বলে মাথা নিচু করে থাকল।

আনোয়ারা বেগম একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, “মেয়েটির নাম কি”?

শাহেদ চুপ করে থাকল।

“আমি তোকে একটা কিছু জিজ্ঞেস করেছি শাহেদ!”

“অদিতি”।

“মেয়েটিকে তুই ভালবাসিস?”

“হ্যা”।

“মেয়েটি তোকে পছন্দ করেনা?”

“মনে হয় করে”।

“তাহলে সমস্যা কি? মেয়েটির পরিবার রাজি হবেনা? আমি নিজে কথা বলব তাদের সাথে গিয়ে। তুই আমার একমাত্র ছেলে। তোর সুখের জন্য সব কিছু করব আমি”।

“তেমন কিছু না মা!”

“তাহলে কি?”

“তুমি বিশ্বাস করবেনা”।

“বলেই দেখ, বিশ্বাস করি কিনা!”

“মেয়েটি বিশ্বাস করে তার বাবা ভবিষ্যৎবানী করতে পারতেন। মৃত্যুর আগে তিনি মেয়েকে বলে গেছে তার বিয়ে হবে একটা অন্ধ ছেলের সাথে। কোনও একমাসের প্রথম দিন ছেলেটির সাথে তার দেখা হবে। মেয়েটি সেই ছেলের অপেক্ষায় আছে!”

আনোয়ারা বেগম হাসলেন। “পুরো বিষয়টা একটু বিস্তারিত খুলে বল”।

শাহেদ বলল।

আনোয়ারা বেগম পুরো ব্যাপারটা শুনে বললেন, “এখন কি করবি ভাবছিস?”

শাহেদ খানিক ইতিতস্ত করে বলল, “আমি মেয়েটিকে খুব ভালবাসি মা! আমি অনেক আগেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি ওকে পাওয়ার জন্য প্রয়োজনে অন্ধ হয়ে যাব। কিন্তু তোমার কথা ভেবে তা করতে পারিনি”।

ভয়ঙ্কর কথাটা শুনে আনোয়ারা বেগমের পিলে চমকে উঠল। কিন্তু তিনি মুখে স্বাভাবিক হাসি ধরে রেখে বললেন, “তারচেয়ে ভাল উপায় আছে একটা। কিন্তু খুব রিস্কি হয়ে যায়! তুই কি পারবি এই রিস্ক নিতে?”

“বলেই দেখনা”।

আনোয়ারা বেগম এক নিঃশ্বাসে কিছু কথা বলে গেলেন। সেটা শুধু শাহেদই শুনল, আর তার সাক্ষি হয়ে রইল প্রকৃতি।


তিন

আষাঢ় মাসের ১ তারিখ। বর্ষার প্রথম দিন। বর্ষা চলে এল আর বৃষ্টি হবেনা তা তো হয়না। সকাল বেলাই হঠাৎ প্রচণ্ড শব্দে কেঁদে উঠল আকাশ। মুষলধারে নামল বৃষ্টি। অন্যান্য মাসের মত এই আষাঢ় মাসের প্রথমদিনও বাড়ির সামনের বড় রাস্তার কাছে দাড়িয়ে আছে অদিতি। বৃষ্টি দেখে ছাতা মেলল সে। খুব বাতাস বইছে, ঠাণ্ডা লাগছে তার। তবুও ঠায় দাড়িয়ে থাকল সে। আজ কি আসবে সেই অন্ধ ছেলেটা?

খানিকবাদেই রাস্তার ওপারে শাহেদকে দেখতে পেল অদিতি। এই বৃষ্টির মাঝে ভিজতে ভিজতে চলে এসেছে। ছেলেটিকে সব কিছু খুলে বলার পরও বিষয়টা বুঝতে চাইছে না! শাহেদ তার পকেট থেকে একটা কাল কাপড় বের করল। সেটা দিয়ে নিজের চোখ বাঁধল। কি করতে যাচ্ছে বুঝতে পেরে আঁতকে উঠল অদিতি। শাহেদ চোখ বাধা অবস্থায় গাড়ির আওয়াজ শুনে শুনে রাস্তা পার হওয়ার চেষ্টা করছে! রাস্তার এদিকটাতে কোনও ট্র্যাফিক সিগন্যাল না থাকার কারনে গাড়ি গুলো খুব স্পীডে চলে। চোখ-কান খোলা অবস্থায় রাস্তা পার হতে ভয় লাগে! আর চোখ বাঁধা অবস্থায় একাজ করার কথা তো ভুলেও ভাবা যায়না! শাহেদ কয়েক পা এগিয়ে এল। ভয়ঙ্কর ব্যাপারটা ঘটতে শুরু করতেই নিজেকে খুব অসহায় মনে হতে থাকল অদিতির। হাত থেকে ছাতা ফেলে দিল। চিৎকার করে শাহেদকে নিষেধ করতে মন চাইছে। কিন্তু কেউ যেন তার গলা চেপে ধরেছে! যেকোনো দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে এই মুহূর্তে। নিজের বাবার দুর্ঘটনার কথা মনে পড়ে গেল তার। বাবার রক্তমাখা ব্যান্ডেজ বাঁধা মুখটার কথা মনে পরতেই ভীষণ কান্না পেয়ে বসল। একটা বাস খুব দ্রুত ছুটে আসছে দেখে চিৎকার বলল, “শাহেদ!! বাস আসছে সরে দাঁড়াও”।
শাহেদ বাসের হর্ন শুনে দাড়িয়ে গেল। বাসটা একেবারে কাছ ঘেঁষে ছুটে গেল। অদিতি বড় করে শ্বাস নিয়ে নিয়ে মনে মনে বলল, “আল্লাহ আজ আমাকে যেন আর একটা এক্সিডেন্ট দেখতে না হয়”। আরও কয়েকটা গাড়ি একেবারে নাকের ডগা দিয়ে যাওয়ার পর অবশেষে শাহেদ রাস্তা পেরিয়ে এল।

শাহেদের দিকে দৌরে গেল অদিতি। কান্না জড়ানো কণ্ঠে বলল, “এই কাজটা কেন করলে তুমি?”

শাহেদ চোখ থেকে কাপড়টা খুলল। তাকিয়ে দেখল অদিতি দুচোখ বেয়ে জল গড়াচ্ছে। সে হাত বাড়িয়ে স্পর্শ করল। মৃদু হেসে বলল, “একি বৃষ্টির জল নাকি কান্নার জল?”

“আমার প্রশ্নের জবাব দাও! কেন এই কাজ করলে?”

শাহেদ হাসিমুখেই বলল, “তুমি মার জন্য কাঁদবে কেন? আমি ধরে নিচ্ছি এটা বৃষ্টির জল”।

নিজেকে সামলে রাখতে কষ্ট হচ্ছে অদিতির। তার মুখ দিয়ে ফোঁপানোর মত একটা আওয়াজ বেড়িয়ে এল। কথা বলছে না, জানে ঠোঁট নাড়লেই কান্না চলে আসবে।

এবার শাহেদের হাসিটা আরও প্রসস্থ হল, “বুঝতে পেরেছি! আর ঢেকে রাখতে পারবে না! এটা কান্নার জলই”।

অদিতি কান্না সামলে নিয়ে আবার জিজ্ঞেস করল, “কেন করলে এটা?”

“তোমাকে পাওয়ার জন্য" শাহেদের উত্তর। "আমি প্রমান করতে চেয়েছি, তোমাকে পাওয়ার জন্য আমি অন্ধকারকে আপন করে নিতে প্রস্তুত!”

“তুমি মরে যেতেও পারতে! জান সেটা?”

“তোমাকে না পাওয়ার কষ্ট থেকে ওটা বেটার হত”।

অদিতি শাহেদের হাত ধরে টান দিল। “বাসায় চল। বৃষ্টিতে একদম ভিজে গেছ। ঠাণ্ডা লেগে যাবে”।

“আগে বল আমার ভালবাসা গ্রহন করতে তোমার এখনও আপত্তি আছে কিনা! নইলে আমি আজ সারাদিন এই কাপড় বাঁধা অবস্থায় রাস্তা পার হতে থাকব”।

“তুমি আমার সাথে আসবে নাকি আমি কান্না কাটি করে মানুষ জড়ো করব?”

“আচ্ছা! বাসায় গিয়ে বলবে! চল”।

হাঁটতে হাঁটতে অদিতির একটা হাত নিজের হাতে তুলে নিল শাহেদ। অদিতি ছাড়িয়ে নিল। খানিকবাদে আবার অদিতিই হাত ধরল শাহেদের । শাহেদ একটু হেসে অন্য হাতে ধরে থাকা কাল কাপড়টা ফেলে দিল। মনে মনে বলল, যাক! সব কিছু ভালয় ভালয় হয়েছে! অদিতি টের পায়নি। বাইরে থেকে দেখতে যাই মনে হোক কাপড়টা আসলে স্বচ্ছ। দেখে দেখেই রাস্তা পার হয়ে এসেছে শাহেদ। রিস্ক ছিল, অদিতি হয়ত চালাকিটা ধরে ফেলতে পারত। কিন্তু ভাগ্য সহায় ছিল বলে পারেনি। অথবা অদিতি হয়ত বুঝতে পেরেছে বিষয়টা কিন্তু কিছুই বলেনি। হয়ত শাহেদকেই নিজের সেই কাঙ্খিত অন্ধ ছেলেটি বলে ধরে নিয়েছে। অন্ধ বলতে কি শুধুমাত্র দৃষ্টিশক্তিহীন মানুষকেই বোঝায়?


চার

বৃষ্টির প্রকোপ কমে এসেছে। এখন গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টি থেকে বাঁচার জন্য বিভিন্ন দোকানপাটের শেডের নিচে আশ্রয় নেওয়া মানুষ জন সব বেড়িয়ে এল। বড় রাস্তার ওপাড়ে ২৫-২৬ বছর বয়সী একজন যুবককে দেখা গেল। ছেলেটি চোখে একটা মোটা কাচের কাল সানগ্লাস পড়ে আছে। তার হাতে সাদা ছড়ি। ছেলেটির ভাব ভঙ্গী দেখে মনে হচ্ছে রাস্তা পার হবে। সে রাস্তার পাশে দাড়িয়ে গাড়ির আওয়াজ শোনার জন্য কান পেতে থাকল। যখন বুঝল গাড়িগুলো বেশ দূরে দূরে আছে, সে আস্তে আস্তে রাস্তা পার হতে লাগল। একটা গাড়ি খুব কাছে চলে আসায় সে একটু থামল। গাড়ি চলে যেতেই আবার এগিয়ে গেল।

রাস্তা পার হয়ে আসার পর তার কাছে মনে হল কিছু একটা ঠিক নেই। কেন যেন মনে হচ্ছে এইখানে তার জন্য কারও অপেক্ষা করার কথা। ছেলেটি দাড়িয়ে থাকল। তাকে দাড়িয়ে থাকতে দেখে একজন লোক এগিয়ে আসল। কাধে হাত রেখে বলল, “ভাই কি রাস্তা খুঁজে পাচ্ছেন না? সাহায্য দরকার?”

“না না ভাই। আমি একাই যেতে পারব”।

লোকটা “ওহ আচ্ছা” বলে চলে যেতে উদ্যত হল। ছেলেটি বলে উঠল “ভাই , একটু শুনুন”।

“বলুন”।

“একটু দেখুন তো আশে পাশে কেউ দাড়িয়ে কিনা!”

“না ভাই, এদিকটায় আপনি আর আমি ছাড়া কেউ নেই”।

“আচ্ছা ভাই, আপনি যান”।
বলে ছেলেটি তার ছড়ি দিয়ে পথ খুঁজে খুঁজে এগিয়ে যেতে লাগল। লোকটা আর কিছুক্ষন দাড়িয়ে থাকল। ভাল করে আশে পাশে লক্ষ করল কেউ দাড়িয়ে আছে কিনা বোঝার জন্য। নাহ! সবাই যার যার পথে চলেছে। কারো জন্য কেউ থেমে নেই। এই যান্ত্রিক জীবনে কেউ কারো জন্য অপেক্ষা করে থাকবেনা, সেটাই স্বাভাবিক। প্রকৃতি কোনও অস্বাভাবিকতা পছন্দ করেনা।
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে মে, ২০১৩ বিকাল ৪:৪১
৪৩টি মন্তব্য ৪৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমার প্রফেশনাল জীবনের ত্যাক্ত কথন :(

লিখেছেন সোহানী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সকাল ৯:৫৪



আমার প্রফেশনাল জীবন বরাবরেই ভয়াবহ চ্যালেন্জর ছিল। প্রায় প্রতিটা চাকরীতে আমি রীতিমত যুদ্ধ করে গেছি। আমার সেই প্রফেশনাল জীবন নিয়ে বেশ কিছু লিখাও লিখেছিলাম। অনেকদিন পর আবারো এমন কিছু নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৩৮


এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।

ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×