১৭.২
রানুর অবশ্য এই ভাড়া বাসায় আর থাকার ইচ্ছে নেই, সে নিজস্ব বাড়ি চায়। আমেরিকান ড্রীম। এ দেশে আসার পর পরই বিজু আমেরিকান ড্রীম কথাটা শুনেছিলো। বেশ অনেকদিন লেগে গিয়েছিলো ব্যাপারটা জানতে - নিজস্ব একটি বাড়ির মালিক হওয়া নাকি আমেরিকান ড্রীম, অন্তত সেই কথিত স্বপ্নের একটা বড়ো অংশ। ঠিক বোঝা যায়নি।
একটি বাড়ি, আশ্রয় তো মানুষের প্রয়োজনের মধ্যে পড়ে, এ দেশে তা অর্জন করাও কঠিন কিছু নয়। সেটা স্বপ্ন হবে কেন? স্বপ্নের উচ্চতা কি আরো বেশি, আরো দুরধিগম্য হওয়ার কথা নয়? মানুষ এতো স্বপ্নহীনও হয়! স্বপ্ন-কল্পনা এমন সীমাবদ্ধ!
এই প্রাচুর্যের দেশে এতো ছোটো স্বপ্ন দেখা হয় কেন, কে জানে। অবশ্য যে দেশে জর্জ বুশের পুত্রের নামও হয় জর্জ বুশ, তাদের কল্পনাশক্তি আর কোন উচ্চতায় যাবে! এর মধ্যে হয়তো এক ধরনের তীব্র আত্মকেন্দ্রিক অহংবোধও প্রকাশ পায়, অথচ স্বপ্ন দেখতে জানলে ভূমিহীন চাষী আতর আলীও তার ছেলের নাম আকাশ রাখতে পারে, মেয়ে হলে ফুলের নামে নাম দেয়।
রানু বেশ কিছুদিন আগে বাড়ি কেনার ইচ্ছে জানিয়েছে, সেই বাবদে নিজের রোজগারের প্রায় পুরোটা সে জমাতেও শুরু করেছে। অবশ্য ঠিক তৈরি বাড়ি কেনা তার ইচ্ছে নয়, শহরের একটু বাইরে কোথাও এক একরের মতো জমি কিনে নিজের পছন্দমতো তৈরি করে নেওয়ার বাসনা তার।
অফিসে বসে কাজের ফাঁকে ফাঁকে নিজের বাড়ির ফ্লোর প্ল্যান কমপিউটারে এঁকে ফেলেছে সে। প্লটারে প্রিন্ট করিয়ে এনে বিজুকে দেখিয়েছিলো। সত্যি চমৎকার প্ল্যান, পেশাদার আর্কিটেক্টের কাজ আর কি। আর্কিটেক্ট বউ থাকলে এরকম সুবিধা পাওয়া যাবে, কখনো ভাবেইনি সে। ক’জনের এমন ভাগ্য হয়!
বিজু নিজে বাড়িঘরের মালিকানায় একেবারে উৎসাহী নয়। টাকাপয়সার সমস্যা নেই, এ দেশে কেউ নগদে পুরো টাকা দিয়ে বাড়ি কেনে না। ব্যাংক বা মর্টগেজ কোম্পানি বাড়ির দাম দিয়ে দেয়, তারপর মাসিক কিস্তিতে সুদে-আসলে পনেরো বা তিরিশ বছরে শোধ করে বাড়ির মালিকানা নিজের হয়। কেনার সময় নিজের পকেট থেকে যতো বেশি টাকা দেওয়া যায়, মাসিক কিস্তি সেই অনুপাতে কমে আসে।
রানুর ইচ্ছে, যতোটা বেশি সম্ভব টাকা আগাম দিয়ে ফেলা এবং তিরিশ বছরের বদলে পনেরো বছরের মেয়াদে যাওয়া। এসব বিষয়ে খোঁজখবর বিজু খুব জানে এমন নয়, তবে এটুকু জানে, বিল্ডাররা তাদের নিজেদের ফ্লোর প্ল্যান অনুযায়ী যেসব বাড়ি তৈরি করে, সেখানে নিজেদের তদারকির তেমন কিছু নেই। ওরাই সব করে দেবে।
জায়গা কিনে নিজেদের প্ল্যানে বাড়ি তুলতে যে কী ঝকমারি হবে, রানু বুঝতে পারছে? প্রত্যেকটি জিনিস নিজে পছন্দ করে কিনতে হবে, কাজের দেখাশোনা করতে হবে। এতো সময় কোথায় পাওয়া যাবে? এ তো কুঁজোর চিৎ হয়ে শোয়ার ইচ্ছের মতো ব্যাপার।
দু’জনের চাকরি-বাকরি, বাচ্চার দেখাশোনা, হাটবাজার, রান্নাবান্না, লন্ড্রি, ঘরবাড়ি পরিষ্কার, কিঞ্চিৎ সামাজিকতা করতেই জিভ বেরিয়ে যাচ্ছে। রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে মাঝেমধ্যে দু’কাপ চা নিয়ে কিছুক্ষণ বসা ছাড়া দু’জনের তো তেমন করে দেখাও হয় না। আর এ দেশে থাকা না-থাকার মীমাংসা এখনো হয়নি। যদি না-ই থাকবে তাহলে বাড়ি বানানোর ঝামেলায় গিয়ে কাজ কী!
বিজু জানে, রানুর আগ্রহের মূলেও ওই থাকা-না-থাকা। বাড়ি বানানো হয়ে গেলে দেশে ফেরার কথা উঠলে অনায়াসে বলতে পারবে, নিজেদের বাড়িঘর ছেড়ে কোথায় যাবো! কেন যাবো! বিজু আমেরিকান ড্রীম-এর ফাঁদে পড়তে অনিচ্ছুক।
রানুর বাড়ির প্ল্যান দেখে বিজু বলেছিলো, খুব চমৎকার। এই প্ল্যানে একটা বাড়ি কি আমরা দেশে ফিরেও বানাতে পারি না?
হ্যাঁ, পারি। কিন্তু আমি চাই না।
কেন, জানতে পারি?
রানু গলায় সামান্য উষ্মার ফোড়ন যোগ করে সিদ্ধান্ত জানায়, তোমাকে তো বলেইছি, আমরা এখানে থেকে যাচ্ছি। দেশে বছরে বছরে যাবো বেড়াতে, থাকতে নয়।
কিন্তু রানু, আমরা এখানে থাকবো বলে আসিনি, এসেছিলাম তোমার লেখাপড়ার জন্যে। সেটা হয়ে গেছে আগেই, মাঝখানে আমার পড়াশোনার জন্যে খানিকটা দেরি হয়ে গেলো। এখন আরো শেকড়বাকড় না ছড়িয়ে আমাদের গুটিয়ে নিয়ে চলে যাওয়ার কথা ভাবা উচিত।
তুমি উচিত মনে করতে পারো, আমি করি না। আমাদের মতো অন্য দেশ থেকে লক্ষ লক্ষ মানুষ এ দেশে এসে বসবাস করছে। করছে না?
বিজু বলে, তোমাকে আগেও বলেছি, সবাই যা করবে আমাদেরও তা করতে হবে বলে আমি মনে করি না। আমাদের জীবন আমাদেরই, অন্য কারো সঙ্গে মিলিয়ে ফেললে ভুল হবে। অনেকে এসেছে যারা দেশে কিছু করতে পারেনি বা পারবে না বলে বুঝে গেছে। আমাদের পরিস্থিতি তা নয়। আমরা এসেছিলাম একটা প্রয়োজনে, কর্মজীবনে নিজেদের আরো সাফল্যের জন্যে যোগ্য হতে। সে প্রয়োজন মিটে গেছে। বন্ধু-পরিজন ছেড়ে পরের দেশে মাটি কামড়ে পড়ে থাকা কেন উচিত আমি বুঝতে পারি না, রানু।
দেশে ফিরে কী হবে? বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়-স্বজন আমার কী কাজে লাগবে?
আমরা আমেরিকা আসার আগে পর্যন্ত যেভাবে লেগেছে সেভাবে লাগবে।
আমি চাই না, তবু যদি যাওয়ার কথা বলো, আরো কয়েক বছর থেকে কিছু টাকাপয়সা গুছিয়ে নিয়ে যেতে চাই যাতে দেশে গিয়ে মাথা গোঁজার একটা নিজস্ব ব্যবস্থা করতে পারি, কিছু একটা করতে পারি নিজে থেকে।