সরকার যেন কোনো কিছু লুকোনোর চেষ্টা করছে
সিরাজুর রহমান
বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে ৩৮ বছর হলো। এ সময়ে দেশে কোনো প্রতিরক্ষা নীতি ছিল বলে শুনেছেন কেউ? ভারতে বা পাকিস্তানেও কি আছে তেমন কোনো নীতি? আমি বিলেতে আছি ৪৯ বছর ধরে। যদ্দুর জানি, এ দেশে প্রতিরক্ষা নীতি বলে কিছু নেই। যুক্তরাষ্ট্রেও আছে বলে শুনিনি। তবে তাদের অত্যন্ত শক্তিশালী প্রতিরক্ষা বাহিনী আছে এবং তাদের কর্তব্য সম্পর্কে কারো অজানা থাকার কথা নয়। দেশের সীমানার ওপর যদি কখনো কোনো হুমকি আসে, তাহলে সে হুমকি প্রতিহত করা প্রতিরক্ষা বাহিনীর কর্তব্য যেমন অভ্যন্তরীণ শান্তিশৃঙ্খলার প্রতি হুমকির মোকাবেলা করার জন্য আছে বিভিন্ন বাহিনী। সীমান্তে অবৈধ আনাগোনা, অনুপ্রবেশ, চোরাচালানি ইত্যাদি প্রতিরোধের জন্য যুক্তরাষ্ট্রে আছে হোমল্যান্ড সিকিউরিটি বিভাগ। অনুরূপ সংস্থা মোটামুটি সব দেশেই আছে।
আওয়ামী লীগ সরকারের পরিকল্পনামন্ত্রী এয়ার ভাইস মার্শাল এ কে খোন্দকারের একটা উক্তিতে তাই চমকে উঠেছিলাম। প্রতিরক্ষা নীতি সম্বন্ধে শিগগিরই সংসদে একটা বিল আসছে। তাহলে কি শেখ হাসিনার সরকার বিশ্বের জন্য দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করতে যাচ্ছে?
পথপ্রদর্শকের ভূমিকা নিতে যাচ্ছে?
সেনাবাহিনী সম্বন্ধে আওয়ামী লীগের মনোভাব বরাবরই ছিল দ্বিধাপূর্ণ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সেনাবাহিনীকে সন্দেহের চোখে দেখতেন। সে সময় দেশের বেশির ভাগ মানুষেরও ভয়ভীতি ছিল সেনাবাহিনী সম্পর্কে। তার কারণ অবশ্যই এই যে, দীর্ঘ সামরিক স্বৈরশাসনের যুগে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী মুজিবসহ দেশের বহু মানুষের বিরুদ্ধে নানা নিপীড়ন চালিয়েছে, একাত্তরে তাদের অমানুষিক নির্যাতন দেশের মানুষ প্রাণ দিয়ে এবং মান দিয়ে সয়েছে। তবু পরবর্তী সময়ে সাধারণ মানুষের ভয়ভীতি অনেকটা কেটেছে স্বাধীনতার যুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পূর্ব পাকিস্তানে নিযুক্ত বাঙালি অফিসাররা স্বাধীনতার সংগ্রামে জনগণের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন বলে। বাংলাদেশের জাতীয় সেনাবাহিনী গড়ে উঠেছে সে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর ভিত্তি করে।
আওয়ামী লীগের কয়েকজন কলকাতা-ফেরত নেতা তখন দেশের নিরাপত্তার জন্য ভারতের সমরশক্তির ওপর নির্ভর করার পক্ষপাতী ছিলেন। তাদের যুক্তি ছিল, সুইজারল্যান্ডের যেমন নিজস্ব বৈদেশিক প্রতিরক্ষা বাহিনী নেই বাংলাদেশেরও সে পথেই যাওয়া উচিত। স্বাধীনতার পর তাদের চাপে শেখ মুজিব সেনাবাহিনীর পাল্টা একটা রক্ষী বাহিনী গঠন করেছিলেন। এ বাহিনীর অত্যাচার আর তাদের নির্যাতনে ৪০ হাজার মানুষের মৃত্যুর ফলে গোটা জাতি রক্ষী বাহিনীর ওপর ভয়ানক ক্রুদ্ধ হয়।
জাসদ (জাতীয়তাবাদী সমাজতান্ত্রিক দল) সে সময়ে সক্রিয়ভাবে আরেকটা মতবাদ প্রচার করে। তারা চীনের গণবাহিনীর (তখনকার) মতো একটা স্বেচ্ছাসেবী খণ্ডকালীন বাহিনী রাখার পক্ষপাতী ছিল। এ লক্ষে তারা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মধ্যেও সিপাই সিপাই ভাই ভাই, অফিসারের কল্লা (মুণ্ডু) চাই বলে প্রচারপত্র ছড়াচ্ছিল, এমন কি ্লোগানও দিচ্ছিল। সেনাবাহিনীর ভেতরে এদের নেতা ছিলেন কর্নেল তাহের।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের মর্মান্তিক হত্যার (১৯৭৫) পেছনে রক্ষী বাহিনী ও জাতীয় সেনাবাহিনীর মধ্যকার টানাপড়েন একটা বড় ফ্যাক্টর ছিল। খালেদ মোশাররফ তার অভ্যুত্থানের সময় জেনারেল জিয়াউর রহমানকে গৃহবন্দী করেছিলেন। জাসদপন্থী সিপাইদের অভ্যুত্থানের ফলেই খালেদ মোশাররফের অভ্যুত্থান ব্যর্থ হয়। তারা জিয়াকে মুক্ত করেন এবং ক্ষমতায় বসান। তার পরও সেনাবাহিনীর ভেতরে অবাধ্যতা বেশ কিছু দিন চলেছিল।
ছিয়াত্তরে প্রেসিডেন্ট জিয়া আমার সাথে একটা নির্ধারিত সাক্ষাৎকার হঠাৎ করে এক দিন পিছিয়ে দেন। ভেতরে ভেতরে খোঁজ নিয়ে জেনেছিলাম যে চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টে এক সিপাহি এক মেজরকে স্যালুট করতে অস্বীকার করা থেকে উদ্ভূত পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে জিয়াকে হঠাৎ করে সেখানে যেতে হয়েছিল। সেনাবাহিনীর ভেতরের এসব টানাপড়েনের অবসান করতে চেয়েছিলেন। তার জের হিসেবেই প্রেসিডেন্ট জিয়াকে প্রাণ দিতে হয়েছে। তবে তার পরে মোটামুটি শৃঙ্খলা ফিরে এসেছিল এবং চেন অব কম্যান্ড পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সেনাবাহিনীতে।
কৃষ্ণ সন্দেহ
হঠাৎ করে প্রতিরক্ষা নীতি নিয়ে বিল প্রণয়নের উদ্যোগ মানুষের মনে সন্দেহের উদ্রেক করবে বিশেষ একটা কারণে। মাত্র পাঁচ সপ্তাহ আগে বিরাট একটা ট্র্যাজেডি ঘটে গেছে সেনাবাহিনীতে। শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ একজন মন্ত্রী, একজন প্রতিমন্ত্রী, একজন হুইপ এবং আরো তিনজন সংসদ সদস্যের সাথে ঘাতকদের একাত্মতা, সন্দেহজনক টেলিফোন যোগাযোগ, হত্যাকাণ্ডের মাঝামাঝি সময়ে প্রধানমন্ত্রীর সাথে ঘাতকদের বৈঠক, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর উপস্থিতিতেও হত্যা ইত্যাদি ব্যাপারে ব্লগ গুলোতে নিত্যনতুন তথ্য প্রকাশিত হচ্ছে এবং তাতে কিছু কৃষ্ণ সন্দেহ গোটা জাতির মনে ছায়া ফেলে আছে।
সেসব সন্দেহ নিরসনের জন্য যা যা করা প্রয়োজন ছিল সরকার করছে তার সম্পূর্ণ বিপরীত কাজ। সন্দেহের অঙ্গুলি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দিকেও নির্দেশিত হয়েছে, অথচ গোড়ায় তার নেতৃত্বেই সরকার একটা তদন্ত কমিটি গঠন করেছিল। এ ব্যাপারে ব্যাপক আপত্তির কারণে অন্য একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হলেও সরকার সে কমিটির রিপোর্ট দাখিলের মেয়াদ দফায় দফায় বাড়িয়ে দিচ্ছে। অতীতের অভিজ্ঞতায় দেশের মানুষ জানে, প্রকৃত পরিস্থিতি চাপা দেয়ার কিম্বা প্রকৃত সত্যকে জোলো করে দেখানোর জন্যই তদন্তের মেয়াদ প্রায় অনন্ত কাল পর্যন্ত বাড়িয়ে দেয়া হয়।
সেনাবাহিনী নিজস্ব একটা তদন্ত চালাচ্ছে, তার ফলাফলও এখনো প্রকাশিত হয়নি। ইতোমধ্যে গোয়েন্দা পুলিশ স্বভাবতই তদন্ত চালাবে, কিন্তু সে তদন্ত পরিচালনার জন্যে কবর থেকে তুলে আনা লাশের মতো কয়েক বছর আগে অবসরপ্রাপ্ত অপেক্ষাকৃত নিুপদস্থ এবং কট্টর আওয়ামী লীগপন্থী বলে পরিচিত একজন অফিসারকে ডেকে এনেছে সরকার।
তিনটি তদন্তের সবগুলোই এখনো চলমান। সব ন্যায়নিষ্ঠ ও সত্যানুরাগী মানুষের উচিৎ এ রকম পরিস্থিতিতে কথা ও কাজে সংযম অবলম্বন করা, যাতে কোনো তদন্তেই অপপ্রভাব পড়তে না পারে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী এবং তার কোনো কোনো মন্ত্রীর কার্যকলাপ থেকে বরং মনে হতে পারে যে তদন্তগুলো সঠিক পথে পরিচালিত হওয়া তাদের কাম্য নয়। বিভিন্ন তদন্তের মধ্যে সংযোগ রক্ষা একটা লোক-দেখানো দায়িত্ব দেয়া হয়েছে বাণিজ্যমন্ত্রী ফারুক খানকে। তিনি দিনের পর দিন সংবাদ সম্মেলন করে ঘোড়ার আগে গাড়ি জুড়ে দিয়েছেন, তদন্ত শেষ না হতেই রায় দিয়ে দিয়েছেন। শুধু কি তাই? তার রায়ে একেক দিন একেক জোট বা গোষ্ঠীকে দোষী ঘোষণা করা হয়েছে।
এ বাবদ দেশের ভেতরে এবং বিদেশে ফারুক খানের বিস্তর নিন্দা হয়েছে। আপাতত তিনি রায় দান একটু সংযত করেছেন বলেই মনে হয়। কিন্তু তাতে কী আসে যায়? এবারে ময়দানে নেমেছেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী। তিনি আবিষ্কার করেছেন যে মাফিয়া গোষ্ঠী (মূলত ইতালিতে উদ্ভব, যুক্তরাষ্ট্রেও কিছু পরিমাণে সক্রিয় অর্থনৈতিক সন্ত্রাসী ও দুষ্কৃতকারী) বিডিআরর হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকতে পারে।
শেখ হাসিনা ও ফারুক খানের উপরিউক্ত কথাবার্তাকে ইংরেজিতে বলে পারভার্টিং দ্য কোর্স অব জাস্টিস (বিচারের প্রক্রিয়াকে বিপথগামী করা) এবং সেটা দণ্ডনীয় অপরাধ। প্রধানমন্ত্রী নিজে না জানলেও তার আইন উপদেষ্টার উচিত ছিল সে কথা তাকে বুঝিয়ে বলা।
নতুন প্রতিরক্ষা নীতি নিয়ে যে উদ্যোগ দেখানো হচ্ছে সেটাও একই রকম সন্দেহজনক। সেনাবাহিনীর ৭০ জনের কাছাকাছি শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তার পদ বিগত পাঁচ সপ্তাহের মধ্যে আকস্মিক এবং মর্মান্তিকভাবে শূন্য হয়েছে। সুশৃঙ্খলভাবে সে পদগুলো পূরণ করে চেন অব কমান্ড সম্পূর্ণ পুনর্গঠন ও মুহূর্তের বড় প্রয়োজন। তা ছাড়া সেনাবাহিনী তাদের দৃষ্টিকোণ থেকে প্রকৃত সত্য আবিষ্কার করতে চায়। এ সময় নতুন প্রতিরক্ষা নীতির ধুয়া তুলে কি সে তদন্তকে প্রভাবিত করার চেষ্টা হচ্ছে? সেনাবাহিনীর মনে কি এ সন্দেহ ঢুকিয়ে দেয়ার চেষ্টা হচ্ছে যে তাদের বাহিনীর অস্তিত্বও নিরাপদ নয়? এ সন্দেহ এখন দেশের মানুষের মনে দেখা দেয়া স্বাভাবিক যে শেখ হাসিনা ও তার সরকার কোনো কিছু লুকোনোর চেষ্টা করছেন।
শেখ হাসিনার কাজকর্মে শোরগোল করো পূর্বে আর আক্রমণ করো পশ্চিমে মাও সেতুংয়ের এ উক্তিটির প্রতি অনুরাগ বিশেষ লক্ষ করা যায়। হতে পারে যে তার সরকারের নানামুখী ব্যর্থতা থেকে জাতির মনোযোগ ভিন্নমুখী করার জন্যই তিনি একের পর এক বিতর্ক সৃষ্টি করে চলেছেন।
দুই নেতা দুই প্রতিশ্রুতি
শেখ হাসিনা যেন কাটা জিহ্বা দিয়ে কথা বলেন। তার কথায় ও কাজে মিল থাকে না। দিন বদলের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি প্রথমে দিয়েছিলেন বারাক হোসেন ওবামা। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হয়েছেন। ত্রিশ দশক পরে ইরানের সাথে আবার ওয়ায়াশিংটনের সংলাপ শুরু হয়েছে, ৫০ বছর পরে কিউবার বিরুদ্ধে অবরোধ প্রত্যাহারের উদ্যোগ শুরু হয়েছে। ইউরোপ সফরে এসে ওবামা ইঙ্গিত দিয়েছেন, তিনি পারমাণবিক অস্ত্র নিষিদ্ধ করার কথা চিন্তা করছেন। মোট কথা, বিশ্বের ওপর থেকে একটা হিংসা আর উত্তেজনার কালো মেঘ ওবামার ৭০ দিনের কার্যক্রমের মধ্যেই সরে যেতে শুরু করেছে।
হাসিনা ক্ষমতায় এসেছেন ৮৫ দিন আগে। তার পর থেকে প্রতিহিংসা আর উত্তেজনার কালো মেঘ বাংলাদেশের ভাগ্যাকাশে পরতে পরতে জমা হচ্ছে। নির্বাচনে বিজয়ের সময় থেকেই তিনি সহযোগিতার কথা বলে আসছেন। গত ২ এপ্রিল তিনি সংসদে বলেছেন, বিরোধী দলের সহযোগিতা চান তিনি। কিন্তু তার পরের মুহূর্তেই বিরোধী দলের নেত্রী খালেদা জিয়াকে গৃহহারা করার ন্যক্কারজনক প্রস্তাব দিয়েছেন। শহীদ সেনা সদস্যদের ফ্ল্যাট দেয়া যদি সত্যি তার আন্তরিক উদ্দেশ্য হয় তাহলে বাংলাদেশে, এমনকি ঢাকা শহরেও ছয় বিঘা জমির অভাব ছিল না। সে জন্য খালেদা জিয়াকে কৃতজ্ঞ জাতির উপহার হিসেবে দেয়া বাড়িটি ভাঙা যদি শেখ শেখ হাসিনার আন্তরিক কামনা হয় তাহলে ধানমন্ডি লেকের কিছু অংশ ভরাট করে পাঁচ নম্বর রোডে যে প্রাসাদটি নির্মিত হয়েছে সেটি শহীদদের পরিবারের জন্য বরাদ্দ করে তিনি দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করুন। শেখ হাসিনা শহীদদের পরিবারদের নিয়ে রাজনীতি করছেন। তাদের নিয়ে টেলিভিশনে বাহবা পেতে চাইছেন। কিন্তু খালেদা জিয়াকে গৃহহীন করার উদ্যোগে শোকাহত পরিবারগুলো ভীষণ বিব্রত বোধ করবেন।
এমনও হতে পারে যে এই হাস্যকর প্রস্তাবটিও জাতীয় প্রতিরক্ষা নীতি বিলের মতো জনমতকে তার সরকারের ব্যর্থতাগুলো থেকে ভিন্নমুখী করার উদ্দেশ্যে করা হয়েছে। কিন্তু হাসিনার পৃষ্ঠপোষকদের মতিগতিদৃষ্টে তার ভবিষ্যৎ ক্রিয়াকলাপ সম্বন্ধে নিশ্চিত হওয়া কঠিন। তার গদি বাঁচানোর জন্য সীমান্তের ওপারে পৃষ্ঠপোষকরা বাংলাদেশে ছত্রীসেনা নামানোর হুমকি সৃষ্টি করেছিলেন, কিন্তু সেনাবাহিনীর ওপর কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ করার আগে শেখ হাসিনাকে গভীর চিন্তা করতে হবে, সৎ পরামর্শ নিতে হবে।
জাতির গৌরব
আগেই বলেছি, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী জাতির গৌরবের অংশবিশেষ। তাদের অস্তিত্ব পবিত্র সংবিধানে সংরক্ষিত। এ কথা অবশ্যই সত্যি যে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী তাদের ক্ষুদ্র ইতিহাসেও অনেক ভুলভ্রান্তি করেছে। দু-দুজন রাষ্ট্রপতিকে হত্যা করেছে সেনাবাহিনীর কিছু সদস্য।
সেনাবাহিনীর সমর্থনের জোরে জেনারেল এরশাদ নয় বছর স্বৈরশাসন ও নির্যাতন চালিয়েছেন। ২০০৬ সালের ২৮ ডিসেম্বর যখন প্রকাশ্য দিবালোকে এবং রাজধানীর সড়কে পিটিয়ে মানুষ খুন করা হচ্ছিল, দেশকে অবরোধ করে রাখা হয়েছিল এবং চলাচল ও পরিবহন ব্যবস্থা সাবোটাজ করা হচ্ছিল তখন সেনাবাহিনী সিভিল প্রশাসনের সাহায্যের আবেদন উপেক্ষা করে সাংবিধানিক কর্তব্যে হানি করেছিল। দেশের ঘাড়ের ওপর দুবছর ধরে একটা অসাংবিধানিক ও স্বৈরতন্ত্রী সরকার চাপিয়ে রাখাও সেনাকর্মকর্তাদের জন্য অন্যায় হয়েছিল। দেশে বর্তমানে যে সন্দেহ-অবিশ্বাস, বিশৃঙ্খলা ও হানাহানি চলছে তার জন্যও দায়ী সেসব হঠকারি কাজকর্ম।
তা সত্ত্বেও শেখ হাসিনা যদি সেনাবাহিনীকে অবলুপ্ত করতে অথবা সেনাবাহিনীর ভূমিকার ওপর হস্তক্ষেপ করতে চান তাহলে ইতিহাসের কাছে তিনি ধিকৃত হবেন। দেশের প্রতিরক্ষা দায়িত্ব তিনি যদি ভারতের ওপর ন্যস্ত করতে চান তাহলে তাকে স্মরণ করিয়ে দেয়া প্রয়োজন যে এ ভুলটা সিকিমও করেছিল। এমন দৃষ্টান্ত ইতিহাসে ভূরি ভূরি যে এক দিনের বন্ধু পরদিনের শত্রুতে পরিণত হতে পারে। গত ডিসেম্বরে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমার ভেতরে ভারতের যুদ্ধজাহাজ ও তেল সন্ধানী জাহাজ পাঠানো থেকেও প্রমাণ হয় যে দুদেশের সম্পর্ক এখনো সমস্যামুক্ত নয়। দুই দেশের মধ্যে এখনো বহু অমীমাংসিত বিষয় আছে। গত বছরের শেষ ভাগে মিয়ানমারও বাংলাদেশের সমুদ্রসীমার ভেতরে যুদ্ধজাহাজ পাঠিয়েছিল, গ্যাস ও তেল অনুসন্ধান শুরু করেছিল।
সুইজারল্যান্ডে গণভোট
বাংলাদেশের সেনাবাহিনী আকারে ক্ষুদ্র, অবশ্যই ভারতের বিশাল বাহিনীর মোকাবেলার জন্য যথেষ্ট নয়। কিন্তু তারা যদি কোনো সম্ভাব্য আক্রমণের প্রথম চোট সামলাতে পারে তাহলে নিরাপত্তা পরিষদ বা অন্য কোনো দিকের হস্তক্ষেপ পর্যন্ত কিছু সময় পাওয়া সম্ভব। তা ছাড়া এক সাগর রক্তের বিনিময়ে যারা স্বাধীনতা এনেছিল তারাও প্রতিরোধ সংগ্রামে একটা নেতৃত্ব পাবে, যেমন পেয়েছিল একাত্তরে।
বাংলাদেশকে যারা সুইজারল্যান্ড বানাতে চান তাদের অবগতির জন্য আরেকটা কথা এখানে মনে করিয়ে দেয়া অত্যাবশ্যক। সুইজারল্যান্ডে কোনো আইন পাসের আগে, এমনকি স্থানীয় কোনো ব্যাপারেও, গণভোট নিতে হয়, সে জন্য তিন-চার এমনকি ছয় মাস পর্যন্ত আলাপ-আলোচনার সময় দেয়া হয়। জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে গণভোটের আগে আলোচনার জন্য এক কিম্বা দুবছর পর্যন্ত সময় দেয়া হতে পারে। বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা নিয়ে হেরফের করতে হলে অন্তত দুবছর সময় দিয়ে গণভোট করতেই হবে।
লেখকঃ সাংবাদিক, সাহিত্যিক, কলামিস্ট
(লন্ডন, ০৪.০৪.০৯)
[email protected] (সুত্র, নয়া দিগন্ত, ০৭/০৪/২০০৯)