somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বেগম খালেদা জিয়ার সেনানিবাসের বাড়ি বাতিল এবং প্রাসঙ্গিক রাজনীতি : ড. মাহবুব উল্লাহ

১৩ ই এপ্রিল, ২০০৯ রাত ২:৪৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

বেগম খালেদা জিয়ার সেনানিবাসের বাড়ি বাতিল এবং প্রাসঙ্গিক রাজনীতি
ড. মাহবুব উল্লাহ


ইংরেজিতে একটি প্রবাদ আছে, Morning Shows the Day অর্থাৎ প্রত্যুষেই বোঝা যায় দিনটি কেমন যাবে। এই প্রবাদের আলোকেই হয়তো নতুন নির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতাসীন হওয়ার প্রথম ১০০ দিন নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করা হয়। এই ১০০ দিনের কর্মকান্ডে বোঝা যায়, সরকারের পুরো মেয়াদটি কেমন সুখের হবে। এই লেখাটি যখন আমি লিখছি, তখন আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের ৯৪তম দিবস অতিক্রান্ত হচ্ছে। এই ৯৪ দিনে সরকারের আমলনামায় সওয়াবের চাইতে গোনাহর পাল্লাটিই যেন অনেক বেশি ভারি হয়ে উঠেছে।

দিনবদলের প্রত্যাশা জাগিয়ে যারা নজিরবিহীন (!) ভোট পেয়ে সরকার গঠন করল, তারা ঠিকই দিনবদল করে ফেলেছে। পৃথিবীর কোনো দেশের ইতিহাসে যে ঘটনা ঘটেনি, বাংলাদেশে সেই ঘটনা ঘটেছে। ঘটনাটি হলো, মাত্র ৩৬ ঘণ্টার মধ্যে সর্বাধিক সংখ্যক সেনা কর্মকর্তা নিহত হয়েছেন এই দেশে, এই সরকারের আমলে। না, কোনো যুদ্ধ নয়, ষড়যন্ত্রমুলক এক বিদ্রোহে। যে বিদ্রোহ দমন করার আন্তরিক কোনো প্রয়াস ছিল না।

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উচ্চতর প্রশাসনে দলীয় অনুগতদের আসীন করা হয়েছে দ্রুততম সময়ে। সিভিল প্রশাসনে ওএসডি করার হিড়িক এবং তার সঙ্গে কেবল আমাদের লোকদের গুরুত্বপুর্ণ পদে নিয়োগদান সিভিল প্রশাসনকে স্হবির করে ফেলেছে। থানার ওসি ও সেকেন্ড অফিসারসহ পুলিশ প্রশাসনের সর্বত্র সমান গতিতে আমাদের লোকদের দায়িত্ব দেয়া হচ্ছে। সেনাবাহিনীও দলবাজ সরকারের তান্ডব থেকে রেহাই পায়নি। সেনাবাহিনীর বহু যোগ্য ও চৌকস অফিসার বিডিআর বিদ্রোহে নিহত হওয়ার ফলে মেধা ক্ষরণের মধ্যে পড়েছে। সে সময় চাকরির মেয়াদ থাকা সত্ত্বেও কোনো কোনো সামরিক কর্মকর্তাকে যেভাবে অসৌজন্যমুলকভাবে অবসরে পাঠানো হয়েছে, সেটা সামরিক বাহিনী, বিশেষ করে সেনাবাহিনীর জন্য নতুন বিপর্যয়ের সৃষ্টি করেছে। হল দখল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দখল, বাড়ি দখল, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে খুন-জখম করা এখন নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়সহ কলেজের ভর্তি পরীক্ষা প্রহসনে পরিণত হয়েছে। প্রায় সর্বত্র সরকারি ছাত্রসংগঠন ভর্তিতে কোটা দাবি করছে। কলেজগুলোর অধ্যক্ষরা চরম অসহায় অবস্হার মধ্যে পড়েছেন। কোনো দিক থেকে কেনো প্রতিকার নেই।

অপরদিকে কোনো কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানপ্রধান কৃতজ্ঞতার দায় শোধ করতে গিয়ে নির্লজ্জের মতো যে দোহাই পাড়ছেন, তাতে মনে হয় এ দেশ থেকে নীতি-নৈতিকতা চিরতরে বিদায় নিতে বসেছে। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যাসেলর মহোদয় অকপটে বলে ফেলেছেন, যারা আমাকে এই চেয়ারে বসিয়েছেন তাদের জন্য তো একটা কিছু করতে হবে। আসলে তার উপলব্ধি করার ক্ষমতা নেই যে, ওই চেয়ারটি আসলে তার নয়। তিনি নিছক সাক্ষীগোপাল মাত্র। সব মিলিয়ে যা ঘটেছে, তাকে দিনবদল না বলে আর কী বলা যায়? এভাবে আরো দিনবদল ঘটতে থাকবে।

আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার এ যাত্রায় তার শাসনের ৯৩তম দিবসে এমন একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যে সিদ্ধান্ত ন্যক্কারজনক, চরম নিন্দনীয় এবং প্রতিহিংসাপরায়ণতায় নজিরবিহীন। সিদ্ধান্তটি হলো, বিএনপি চেয়ারপারসন এবং সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়াকে ঢাকা সেনানিবাসে শহীদ মইনুল রোডে যে বাড়িটি দেয়া হয়েছিল লিজ ডকুমেন্ট সম্পাদন করে, সেই লিজ বাতিল। সিদ্ধান্তটি গৃহীত হয় ৮ এপ্রিলের মন্ত্রিসভার বৈঠকে। সভায় সভাপতিত্ব করেছেন নিয়মমাফিক মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সংবাদপত্র সুত্রে জানতে পারলাম, কেবিনেট মিটিংয়ের নির্ধারিত আলোচ্যসুচিতে বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত ছিল না। ৮ এপ্রিল মন্ত্রিসভার বিশেষ বৈঠকে সরকারি জলমহাল বরাদ্দ সংক্রান্ত নীতিমালার খসড়া পর্যালোচনাই ছিল একমাত্র এজেন্ডা। বিবিধ আলোচনার সময় প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোঃ আবদুল আজিজ খালেদা জিয়ার ক্যান্টনমেন্টের বাড়ির বরাদ্দ বাতিলের প্রস্তাব উত্থাপন করেন। সংবাদপত্র সংশ্লিষ্ট সুত্রের কাছ থেকে এ তথ্য জেনেছি। সংশ্লিষ্ট সুত্র থেকে আরো জানা গেছে, বেগম খালেদা জিয়ার ক্যান্টনমেন্টের বাড়ির বরাদ্দ বাতিলের পক্ষে মত ব্যক্ত করে শেখ হাসিনা বলেছেন, আমার ঢাকায় কোনো বাড়ি না থাকায় গণভবন বরাদ্দ নিয়েছিলাম। আমার ছোট বোনকেও একটি বাড়ি বরাদ্দ দিয়েছিলাম; কিন্তু পরবর্তী সরকার আমাদের নামে নেয়া বাড়ি দুটির বরাদ্দ বাতিল করে দেয়। আমার নামের বাড়ির বরাদ্দ বাতিল হবে আর ওনার নামে নেয়া বাড়ির বরাদ্দ থাকবে-এক দেশে দুই নিয়ম চলতে পারে না।

নিশ্চয়ই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, এক দেশে দুই নিয়ম চলতে পারে না, চলতে দেয়া উচিত নয়। আপনার এই নৈতিক ও আইনগত অবস্হানের সঙ্গে দ্বিমত পোষণের কোনো সুযোগ নেই; কিন্তু প্রশ্ন হলো, আসলেই কি দুই নিয়মের কোনো বিষয় এখানে আছে? বেগম খালেদা জিয়াকে যখন বাড়িটি বরাদ্দ দেয়া হয়, তখন তিনি ক্ষমতাসীন ছিলেন না। তিনি দরখাস্ত করে বরাদ্দও চাননি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যেভাবে নিজে সভাপতিত্ব করে মন্ত্রিসভার মিটিংয়ের মাধ্যমে নিজ নামে বাড়ি বরাদ্দ করিয়ে নিয়েছেন, সে রকম কোনো কাজও বেগম খালেদা জিয়া করেননি। তাহলে এক দেশে দুই নিয়ম হলো কী করে? সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া, যিনি কখনো কোনো নির্বাচনে পরাজিত হননি এবং নির্বাচনী আইন অনুযায়ী যে কটি আসন থেকে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা যায়, তার সবকটি আসনেই যিনি জয়লাভ করেছেন এবং যিনি বর্তমানে বিরোধীদলীয় নেতা, তার বাড়ি বরাদ্দের লিজ বাতিলের মতো রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপুর্ণ একটি সিদ্ধান্ত মন্ত্রিসভায় হবে অথচ আগে এ সম্পর্কে কোনো ঘোষিত এজেন্ডা নেই, এ থেকেই অনুমান করা যায় মন্দ কাজের অভিপ্রায় থেকেই এটি করা হয়েছে। মন্ত্রিসভায় সব মন্ত্রীর মতোই প্রধানমন্ত্রী একজন মন্ত্রী, তবে তিনি প্রধানমন্ত্রী-এটুকুই যা। মন্ত্রিসভার বৈঠকে তিনি সভাপতিত্ব করেন। বৈঠক করা হয় কেবিনেট মিটিংয়ে অংশগ্রহণকারী মন্ত্রীদের বিজ্ঞ মতামত শোনার জন্য। এজেন্ডায় যদি কোনো বিষয় উল্লেখ না থাকে এবং বিষয়টি যদি জনগুরুত্বপুর্ণ হয়, তাহলে প্রধানমন্ত্রীর সহকর্মীরা আগেই চিন্তা-ভাবনা করার সুযোগ পাবেন কী করে? এই সুযোগ না দেয়ার জন্যই সবাইকে ঙভভ এঁধৎফ অবস্হায় ফেলে প্রধানমন্ত্রী বিবিধ আলোচনা করতে গিয়ে খালেদা জিয়ার বাড়ির প্রসঙ্গটি উত্থাপন করেছেন। এ দেশে যা হওয়ার তা-ই হয়েছে। অনুমান করা যায়, রাজা কেনিউটের পারিষদের মতো বাকি মন্ত্রীরাও প্রধানমন্ত্রীকে জোর সমর্থন জানিয়েছেন। এসব সত্ত্বেও ডৎড়হম ফড়রহম-এর অভিযোগ উড়িয়ে দেয়া কঠিন।

গণভবন কি শহীদ মইনুল রোডের বাড়িটির সঙ্গে কোনোক্রমে তুলনীয় হতে পারে? গণভবন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের একটি অতি গুরুত্বপুর্ণ প্রতীক। বঙ্গভবন আরো অধিক মর্যাদাপুর্ণ প্রতীক। রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের পরিচয়বাহী এসব ভবন ও স্হাপনা বিনিময়যোগ্য নয়। নয় হস্তান্তরযোগ্য। আমেরিকার হোয়াইট হাউস কি দোর্দন্ড প্রতাপ প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ নিজ নামে লিখে নিতে পারতেন? দশ ডাউনিং ষ্ট্রিটের বাড়িটি কি কোনো ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী নিজ নামে লিখে নিতে পারেন? মস্কোর ক্রেমলিন প্রাসাদটি কি প্রেসিডেন্ট পুতিন তার নামে হস্তান্তর করাতে পারতেন? এই সামান্য বোধশক্তিও কি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী হারাতে বসেছেন? শহীদ মইনুল রোডের বাড়িটি পাকিস্তান আমলে একজন লে. কর্নেল পদমর্যাদার অফিসারের বাসভবন ছিল। শহীদ জিয়া সেনাবাহিনীর ডেপুটি চিফ অব ষ্টাফ নিযুক্ত হলে এই বাড়িটি তার বাসভবন হিসেবে বরাদ্দ পান। পরে তিনি চিফ অব ষ্টাফ হয়েছেন, রাষ্ট্রপতি হয়েছেন; কিন্তু এই বাড়িটি ছেড়ে আরো উন্নতমানের কোনো বাড়ি বা বঙ্গভবনে বসবাসের কথা তিনি ভাবেননি। এটা ছিল তার বিনম্র মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ।

৩০ মে ১৯৮১ চট্টগ্রামে এক সামরিক অভ্যুত্থানে তিনি যখন শহীদ হলেন, তখন দেখা গেল তার স্ত্রী এবং দুই সন্তানের মাথা গোঁজার মতো কোনো ঠাঁই নেই। নেই কোনো সহায়-সম্বল। রাষ্ট্রপ্রধান হয়েও জিয়া তার নির্ধারিত বেতন ও পারিতোষিকের মধ্যেই কৃচ্ছতার সঙ্গে দিনযাপন করেছেন। তার ব্যক্তিগত সততা ছিল প্রশ্নাতীত। তিনি ছিলেন সব ধরনের স্বজনপ্রীতি থেকে মুক্ত। তার অন্তিমযাত্রা ছিল স্মরণকালের বৃহত্তম এবং শোকবিহ্বল লাখো মানুষের কলেমা শাহাদাত ধ্বনিতে মুখর। বাংলাদেশের রাজনীতিতে উল্কার বেগে তার উত্থান ঘটেছিল। মাত্র সাড়ে পাঁচ বছরের রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব থেকে তিনি বাংলাদেশের মানুষকে স্বপ্ন দেখাতে সক্ষম হয়েছেন এবং সেসব স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য করেছেন কঠোর পরিশ্রম। বাংলাদেশের দুশমনরা তাকে বাঁচতে দিল না। এমন মানুষের স্ত্রী ও সন্তানরা চরম অসহায়ত্বের মধ্যে পড়বে-দেশবাসীর তা কাম্য ছিল না। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বিভিন্নজন জিয়া পরিবারকে জমি ও বাড়িঘর দানের প্রস্তাব দিল। সেসব প্রস্তাবে বেগম খালেদা জিয়া কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন; কিন্তু সেসব প্রস্তাব গ্রহণ করে বিষয়সম্পদের প্রতি মোহ প্রদর্শন করেননি।

১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ও সাবেক সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার পর সংসদে বিস্তারিত আলোচনার পর সর্বসম্মতিক্রমে বেগম খালেদা জিয়াকে ক্যান্টনমেন্টের ওই বাড়িটি দলিলমুলে রেজিষ্ট্রির মাধ্যমে বরাদ্দ দেয় ওই সময়ের সরকার। একজন মহান মুক্তিযোদ্ধা, যার স্বাধীনতার ঘোষণায় দিশেহারা জাতি পথচলার দিশা খুঁজে পায় এবং মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে, তার পরিবারকে যদি কৃতজ্ঞ জাতি একটি বাড়ি উপহার দেয় এবং প্রতিশোধপরায়ণ একটি সরকার যদি এক কলমের খোঁচায় সেই উপহারটি কেড়ে নেয়, তাহলে এর চাইতে হীনতা ও নিচতা আর কী হতে পারে!

১৯৯৬-২০০১ পর্বে একুশ বছর পর ক্ষমতায় আসা আওয়ামী লীগ সরকার চেষ্টা করেছিল বেগম খালেদা জিয়ার ক্যান্টনমেন্টের বাড়িটি কেড়ে নেয়ার; কিন্তু ক্যান্টনমেন্ট বোর্ড কাজটি বেআইনি হবে মত দেয়ার ফলে সে সময় আওয়ামী লীগ সরকার এই অসৎ উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করতে পারেনি। এবার সংসদে তিন-চতুর্থাংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে এবং প্রতিবেশী রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে যে কোনো মুল্যে এই সরকারকে রক্ষা করার রণহুঙ্কারে বলীয়ান হয়ে এই সরকার দিগ্বিদিক জ্ঞানশুন্য হয়ে পড়েছে। যা মনে আসছে, এরা তা-ই করছে। শেখ হাসিনাকে ভগ্নি দাবিকারী সাবেক রাষ্ট্রপতি এরশাদ, যিনি পদ-পদবি না পেয়ে এখন নিদারুণ হতাশায় ভুগছেন এবং বলছেন তার মনে অনেক দুঃখ, তিনি তার ভগ্নির মন ভেজানোর জন্য বলেছেন, তিনি যদি জানতেন এ বাড়িতে থেকে বেগম খালেদা জিয়া রাজনীতি করবেন তাহলে তিনি এ বাড়ি বরাদ্দ দিতেন না। তিনি বরাদ্দ দেয়ার কে? বরাদ্দের প্রস্তাব পাস করেছিল তৎকালীন সংসদ দলমত নির্বিশেষে। বেগম খালেদা জিয়া তো ওই বাড়ি রাজনীতির কাজে ব্যবহার করেননি। আবেগ আপ্লুত খালেদা জিয়া স্বামীর স্মৃতিকে বুকে ধারণ করে ওই বাড়িতে বসবাস করার ফলে বরং তার রাজনৈতিক কর্মকান্ড বাধাপ্রাপ্ত হয়েছে। এমনও সময় গেছে, যখন তার শুভানুধ্যায়ীরা ওই বাড়ির গা ঘেঁষতে পারেননি। তাহলে রাজনীতি হলো কীভাবে? বরং ওই বাড়ি বরাদ্দের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থেকে এরশাদ বর্তে গেছেন। সামরিক শাসক হিসেবে বৈধতা অর্জনে তিনি এই সিদ্ধান্তকে কাজে লাগিয়েছেন। বস্তুত জিয়াবিরোধী হওয়া সত্ত্বেও তার শাসনের প্রথম কটি মাস কেটেছে তার টেবিলে শহীদ জিয়াউর রহমানের একটি ফ্রেমে বাঁধানো ছবি স্হাপন করে। সংবাদপত্র ও টেলিভিশনের পর্দায় আমরা সেই ছবি দেখেছি।

বিএনপিকে ঘায়েল করে আওয়ামী লীগের সঙ্গে তিনি কৌশলগত মিত্রতা স্হাপন করে প্রতিবেশী রাষ্ট্রের নেকনজরে থাকতে চেয়েছেন। ৮৬-র নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অংশগ্রহণ দৈবক্রমে ঘটেনি। দুষ্ট লোকেরা বলে, এটি ছিল একটি পাতানো খেলা। ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় বাড়ি আছে অনেক বেসামরিক এবং সামরিক বাহিনী থেকে অবসর নেয়া ব্যক্তির। এদের মধ্যে দুজন বিশিষ্টজনের কথা বলা যায়, যাদের একজন সাবেক সেনাপ্রধান এবং অপরজন সাবেক সেনা কর্মকর্তা। এরা দুজনই আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে সার্বক্ষণিকভাবে জড়িত। এদের একজন তো বর্তমান মন্ত্রিসভারও সদস্য। দলীয় রাজনীতি সংশ্লিষ্টতার জন্য তাদেরও কি ক্যান্টনমেন্ট এলাকা থেকে বের করে দিতে হবে?

সংসদে শেখ হাসিনা বলেছেন, বেগম খালেদা জিয়ার ক্যান্টনমেন্টের বাসভবনের জমির ওপর বহুতল ভবন নির্মাণ করে বিডিআর বিদ্রোহে শহীদ সেনা অফিসারদের পরিবারবর্গকে ফ্ল্যাট বরাদ্দ দেয়া হবে। প্রতি পরিবার পাবে দুটি করে ফ্ল্যাট। একটি তাদের নিজেদের থাকার জন্য, অন্যটি ভাড়া দিয়ে সাংসারিক ব্যয় নির্বাহের জন্য। ভবিষ্যতে সেনা কর্মকর্তাদের পরিবারের সদস্যরা যদি রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন তাহলে কী হবে? একসঙ্গে এতগুলো ফ্ল্যাটে অনেকেরই রাজনীতিতে জড়িত হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যাচ্ছে। শহীদ পরিবারগুলোর জন্য ঢাকা শহর কিংবা ক্যান্টনমেন্টের ভেতরেই জায়গার কোনো অভাব থাকার কথা নয়। আসল কথা হলো, তাদের বসবাসের ব্যবস্হা নিশ্চিত করা। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, এসব পরিবারের সদস্যরা সেনা-সংস্কৃতিতে অভ্যস্ত। একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং শাহাদাত বরণকারী সাবেক সেনাপ্রধানের পরিবারের জন্য যে বাড়ি বরাদ্দ দেয়া হয়েছে, তার জায়গায় নির্মিত বহুতল ভবনে বসবাস করা তারা কিছুতেই ভালোভাবে নেবে না। কারোর প্রতিহিংসার দাবার ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহৃত হওয়া তাদের জন্য সম্মানজনক বলে তারা মনে করবেন-এমনটি বিশ্বাস করা কঠিন।

আবদুল গাফফার চৌধুরীসহ কেউ কেউ অভিযোগ করেছেন, বেগম খালেদা জিয়া যদি ক্যান্টনমেন্টের বাসভবনে থাকেন, তাহলে সেটা রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি হবে। এখন পর্যন্ত বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে এমন কোনো অভিযোগ এই মর্মে সরকারিভাবে উত্থাপিত হয়নি যে, তিনি রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি। অথচ বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্পর্কে বিগত জরুরি সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে তার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন বাধাগ্রস্ত করতে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রেসনোট জারি করে বলা হয়েছিল যে, তিনি বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি। প্রেসনোটের এই আপত্তিকর ভাষ্যের কোনো ফয়সালা আজ পর্যন্ত হয়নি।

আজ তিনি দেশের প্রধানমন্ত্রী এবং প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব তার হাতে। রাষ্ট্রের নিরাপত্তার গুরুভার তারই হাতে জনগণ অর্পণ করেছে। এ ধরনের নিরাপত্তা হুমকি আবিষ্কারের আজব ঘটনা বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশেই ঘটতে পারে। দেশবাসী জানতে চায়, কারা কী উদ্দেশ্যে সেদিন এ ধরনের একটি প্রেসনোট জারি করেছিল। কেননা ওই প্রেসনোট জারির মাত্র কবছর আগে তিনি বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। একইভাবে আমরা বুঝতে পারি না তিন তিনবার প্রধানমন্ত্রী থাকা বেগম খালেদা জিয়া যেখানেই বসবাস করুন না কেন, কীভাবে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি হতে পারেন। মনে হচ্ছে, কোনো একটি মহল বেগম খালেদা জিয়াকে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি প্রতিপন্ন করে তাকে আবারো দেশছাড়া করতে চাইছে। মাইনাস টু ফর্মুলার উদ্যোক্তাদের সব কার্যক্রমকে বৈধতা দানের প্রতিশ্রুতিকারী নেতৃত্বের আমলে আসল মাইনাস ফর্মুলা কার্যকর করার খেলায় ষড়যন্ত্রকারীরা এখন মেতে উঠেছে। এখন মনে হচ্ছে, মাইনাস টু আসলে ছিল মাইনাস ওয়ান। এটি না করতে পারলে তো বাংলাদেশকে করদরাজ্যে পরিণত করা যাবে না।

অনেকে আইনের দৃষ্টিতে বেগম খালেদা জিয়ার জন্য ক্যান্টনমেন্টের বাড়ি বরাদ্দ বাতিলের বিষয়টি দেখছেন। আমার দৃষ্টিতে বরাদ্দ বাতিল আইনগতভাবে ত্রুটিপুর্ণ হলেও বিষয়টি আসলে সম্পুর্ণভাবে রাজনৈতিক। এটাকে রাজনৈতিকভাবেই বিচার করতে হবে। দেশ আজ পর্বতপ্রমাণ সমস্যার বেড়াজালে আবদ্ধ। পানি নেই, বিদ্যুৎ নেই, কৃষক ফসলের ন্যায্য মুল্য পাচ্ছে না। বিশ্বমন্দার করাল গ্রাসের মুখে বাংলাদেশ। দখল ও সন্ত্রাসের তান্ডবে জনজীবন জর্জরিত। শিক্ষাব্যবস্হা ভেঙে পড়ার উপক্রম।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক নেতৃত্বের পদ থেকে ইস্তফা দেয়ার পরও সমস্যার কোনো সুরাহা হয়নি। এরপরও সিলেট শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে সংঘর্ষ ও ভাংচুরের ঘটনা ঘটেছে। সবচেয়ে বড় যে সমস্যা, সেটি হলো পিলখানার ঘটনায় নিহত সামরিক কর্মকর্তাদের হত্যা ও বিদ্রোহের বিচার। সরকার কতটা সফলভাবে এবং নিরপেক্ষতার সঙ্গে এই ঘটনার বিচার নিশ্চিত করতে পারবে, সেই সম্পর্কে ইতোমধ্যেই দারুণ সংশয় দেখা দিয়েছে। ঘটনা ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার উদ্দেশ্যে জঙ্গিতত্ত্ব থেকে শুরু করে বহু ধরনের তত্ত্ব সরকারি মহল থেকে জোর গলায় প্রচার করা হচ্ছে; কিন্তু এসব আষাঢ়ে গল্প ফেঁদে জনগণকে বিভ্রান্ত করা সম্ভব নয় জেনে এবং মিডিয়ায় এসব প্রয়াসের স্বরুপ উন্মোচিত হওয়ার পর সরকার এখন মোক্ষম কৌশলের আশ্রয় নিয়েছে। সরকার খুব ভালো করেই জানে, বেগম খালেদা জিয়ার কণ্ঠ স্তব্ধ করতে পারলে তাদের পক্ষে সহজে পার পাওয়া সম্ভব। সেজন্যই আঘাতটা এখন তার ওপর, উদ্দেশ্য তাকে মনের দিক থেকে দুর্বল করে দেয়া, যাতে সরকারের দায়িত্বহীনতার বিশাল কোনো প্রতিবাদ না হয়। সরকারের কৌশলটি এখন অনেকটা এরকমঃ কেউ যদি মেষের পাল দখল করতে চায় তাহলে তার উচিত হবে না একটি দুটি করে মেষ চুরি করার চেষ্টা করে সময় নষ্ট করা। এটাও ঠিক হবে না, মেষের পাল পাহারা দেয়া কুকুরগুলোর ওপর হামলে পড়া। এতে জীবন বিপন্ন হতে পারে অথবা অঙ্গপ্রত্যঙ্গ হারাতে হতে পারে। আসল লক্ষ্য হওয়া উচিত মেষপালককে টার্গেট করা। তাকে যদি কোনোক্রমে ভুল বুঝিয়ে অন্যপথে নেয়া যায়, তাহলে কুকুরগুলোও অনুসরণ করে চলবে। আর মেষপালককে আঘাত হেনে ফেলে দিতে পারলে মেষের পালটি ছত্রভঙ্গ হয়ে যাবে এবং তার পক্ষে সম্ভব হবে একটি একটি করে প্রতিটি মেষ আয়ত্তে নিয়ে আসা। অষ্টম শতাব্দীর তাং বংশের চৈনিক কবি দুফু বলেছেনঃ

আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য দুফুর নির্দেশিত পথেই এগুচ্ছে। তারা খুব ভালো করেই জানে, বেগম খালেদা জিয়াকে ঘায়েল করতে পারলে এদেশের ফ্যাসিবাদ নির্যাতিত মানুষ নেতৃত্বশুন্য হয়ে পড়বে। সেজন্যই তাদের কৌশল হলো বিচ্ছিন্ন বিক্ষিপ্তভাবে মেষগুলো করায়ত্ত না করে মেষপালককে ধরাশায়ী করা। আমি জানি না, শেখ হাসিনার পরামর্শকরা তাকে চৈনিক কবি দুফুর কথাগুলো পড়ে শুনিয়েছেন কিনা। তবে তাদের পদক্ষেপ অনেকটা সেরকমই। বেগম খালেদা জিয়াকে বলব, তারা আপনার ক্যান্টনমেন্টের বাড়িটি ছিনতাই করতে পারে; কিন্তু মনে রাখবেন-এদেশের প্রতিটি ঘর আপনার ঘর হয়ে যাবে, যদি এদেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব এবং সামরিক বাহিনীর ইজ্জত রক্ষায় আপনি আপনার ঐতিহ্যবাহী আপসহীন ভাবমুর্তি অক্ষুণ্ন রাখতে পারেন।

লেখকঃ অধ্যাপক, ডেভেলপমেন্ট ষ্টাডিজ বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়. (সুত্র, আমার দেশ, ১১/০৪/২০০৯)
১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

স্মৃতিপুড়া ঘরে

লিখেছেন আলমগীর সরকার লিটন, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৩০



বাড়ির সামনে লম্বা বাঁধ
তবু চোখের কান্না থামেনি
বালিশ ভেজা নীরব রাত;
ওরা বুঝতেই পারেনি-
মা গো তোমার কথা, মনে পরেছে
এই কাঠফাটা বৈশাখে।

দাবদাহে পুড়ে যাচ্ছে
মা গো এই সময়ের ঘরে
তালপাতার পাখাটাও আজ ভিন্নসুর
খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে... ...বাকিটুকু পড়ুন

গরমান্ত দুপুরের আলাপ

লিখেছেন কালো যাদুকর, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৫৯




মাঝে মাঝে মনে হয় ব্লগে কেন আসি? সোজা উত্তর- আড্ডা দেয়ার জন্য। এই যে ২০/২৫ জন ব্লগারদের নাম দেখা যাচ্ছে, অথচ একজন আরেক জনের সাথে সরাসরি কথা... ...বাকিটুকু পড়ুন

রাজীব নূর কোথায়?

লিখেছেন অধীতি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:২৪

আমি ব্লগে আসার পর প্রথম যাদের মন্তব্য পাই এবং যাদেরকে ব্লগে নিয়মিত দেখি তাদের মধ্যে রাজীব নূর অন্যতম। ব্যস্ততার মধ্যে ব্লগে কম আসা হয় তাই খোঁজ-খবর জানিনা। হঠাৎ দু'একদিন ধরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বৃষ্টির জন্য নামাজ পড়তে চায়।

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৩৮



ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে বৃষ্টি নামানোর জন্য ইসতিসকার নামাজ পড়বে তার অনুমতি নিতে গিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এটির অনুমতি দেয়নি, যার জন্য তারা সোশ্যাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

=তুমি সুলতান সুলেমান-আমি হুররাম=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৩৬



©কাজী ফাতেমা ছবি

মন প্রাসাদের রাজা তুমি, রাণী তোমার আমি
সোনার প্রাসাদ নাই বা গড়লে, প্রেমের প্রাসাদ দামী।

হও সুলেমান তুমি আমার , হুররাম আমি হবো
মন হেরেমে সংগোপনে, তুমি আমি রবো।

ছোট্ট প্রাসাদ দেবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×