somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

তদন্তের নামে বিডিআর নির্যাতন ও হত্যা বন্ধ করুন : ফরহাদ মজহার

১৯ শে এপ্রিল, ২০০৯ রাত ১:৫৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

তদন্তের নামে বিডিআর নির্যাতন ও হত্যা বন্ধ করুন
ফরহাদ মজহার


পিলখানা কি মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়েছে? হাবিলদার সাইদুর রহমানের লাশ বেরোলো এবার পিলখানা থেকে। এবার হার্ট অ্যাটাক বা আত্মহত্যা নয়, বলা হয়েছে হাবিলদার কাজী সাইদুর রহমান বুকের ব্যথায় মারা গিয়েছেন। এ নিয়ে ১২ জন বিডিআরের রহস্যজনক মৃত্যু ঘটল। অনেকে এই ধরনের মৃত্যু সম্পর্কে সংশয় প্রকাশ করবার কোন সঙ্গত ভাষা না পেয়ে বলছেন, এগুলো প্রশ্নবিদ্ধ মৃত্যু। সাংবাদিকরা দায় এড়াবার জন্য বিভিন্ন ভাষা ব্যবহার করলেও কোন অভিযুক্ত যদি জিজ্ঞাসাবাদে থাকার সময় কর্তৃপক্ষের হাতে নির্যাতনে মৃত্যুবরণ করেন, তাহলে মানবাধিকারের দিক থেকে তা গুরুতর অপরাধ হিশাবে গণ্য। যার কারণে মানবাধিকার কর্মীরা এই ধরনের প্রশ্নবিদ্ধ, রহস্যজনক বা অস্বাভাবিক মৃত্যুকে হত্যাকাণ্ড ছাড়া অন্য কিছু গণ্য করেন না। তবে তাঁরা কথাটা আইনের ভাষায় বলে থাকেন। যেমন আইনবহিভূত হত্যাকাণ্ড, কিম্বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে থাকার সময় মৃত্যু ইত্যাদি। এই সকল হত্যাকাণ্ড আন্তর্জাতিকভাবে গুরুতর অপরাধ হিশাবেই শুধু গণ্য করা হয় না, এর বিরুদ্ধে দুনিয়াব্যাপী প্রবল প্রতিরোধ তৈরি হয়েছে। কোন অভিযুক্তকে জিজ্ঞাসাবাদের সময় অতিরিক্ত নির্যাতনে হত্যা করবার মতো নৃশংস ও পৈশাচিক কাজ আর কিছুই হতে পারে না। পাঠক, ভেবে দেখুন বিডিআরদের অধিকাংশই বয়েস বেশি হলেও হাবিলদার সাইদুর রহমানের চেয়ে বেশি হবে না। সাইদুরের বয়স ৪৩ বছর। এই বয়সে বিশেষত যারা সৈনিক অর্থাৎ শরীর ও স্বাস্থ্যে অটুট তাদের নির্যাতন করে হত্যা করার সময় কী পরিমাণ পৈশাচিক নির্যাতন করতে হয়েছে খানিক ভাবলে শিউরে উঠতে হবে।

ফলে আজ আমাদের প্রথম কাজ হচ্ছে এই ধরণের পৈশাচিক হত্যার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানো। এটা অন্যায়। ভয়াবহ। বাংলাদেশের নিরাপত্তার জন্য মারাত্মক হুমকি। সর্বোপরি সেনাবাহিনী ও সৈনিকদের প্রতি জনগণের যে সংবেদনশীলতা তৈরি হয়েছে তাকে পরিকল্পিতভাবে নস্যাৎ করার জন্য বিডিআরদের হত্যার পরিকল্পনা কোন একটি মহলের থাকতে পারে বলে ক্রমশ সন্দেহ দানা বাঁধছে। পিলখানা থেকে একে একে বিডিআরদের মৃতদেহ বেরিয়ে আসাকে ঘটনার তদন্ত বা অভিযুক্তের বিচার বলে জনগণ মনে করবে না। জনগণকে এই ধারণাই বরং দেওয়া হচ্ছে একটা প্রতিহিংসা বা প্রতিশোধের কাণ্ড ঘটছে। বিডিআর হেডকোয়ার্টারকে কারা আজ মৃত্যুপুরি বানাতে চাইছে? সেনাকর্মকর্তাদের রক্তের দাগে ইতিমধ্যেই যে পিলখানা ভারী হয়ে আছে, আজ সেই পিলখানাকে গুয়ানতানামো কারাগার বানাবার পরিকল্পনা কাদের হতে পারে? জিজ্ঞাসাবাদের নামে অভিযুক্তদের হত্যার এই প্যাটার্ন মানবাধিকার কর্মীদের চেনা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো শক্তিশালী দেশের বিরুদ্ধে আজ সারা দুনিয়ার মানুষ নিন্দায় কঠোর হয়েছে। সমাজ বা রাষ্ট্রের চোখে কেউ যদি অপরাধী হয় তবে অবশ্যই অপরাধীর বিচার হবে। কিন্তু তথ্য বের করবার জন্য নির্যাতন করে হত্যার লাইসেন্স রাষ্ট্র কাউকেই দিতে পারে না। কারণ তাহলে খোদ রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক ও সাংবিধানিক ভিত্তিই নড়বড়ে হয়ে পড়ে। রাষ্ট্র টেকে না। রাষ্ট্রকে ভাঙা, সমাজে অস্থিরতা তৈরি করা এবং বিদেশি স্বার্থের হস্তক্ষেপের জন্য অনুকূল পরিস্থিতি তৈরি করবার পরিকল্পনা ছাড়া ১২ জন বিডিআরের মৃত্যুর আর কোন অর্থ করা যায় না। যারা এই ধরণের নির্যাতন ও হত্যাকে ক্রমাগত প্রশ্রয় দিয়ে চলেছেন, তারা আর যা-ই হোক বাংলাদেশের মিত্র নয়।

নিষ্ঠুর, অমানবিক অথবা মর্যাদাহানিকর আচরণ বা শাস্তির বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক কনভেনশান রয়েছে। সেই কনভেনশানে বাংলাদেশ স্বাক্ষর করেছে ৫ অক্টোবর ১৯৯৮ সালে। এর অর্থ হচ্ছে যদি কেউ এই ধরণের নির্যাতনমূলক অপরাধের সঙ্গে জড়িত থাকেন, তাহলে তাঁরা যত বড় শক্তিধরই হয়ে থাকেন না কেন, আন্তর্জাতিক আদালতে তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা হতে পারে। হয়তো হবেও। রাষ্ট্র হিশাবে বাংলাদেশকে এই ধরণের মামলায় সহযোগিতা করতে হবে। বেশ কিছু মানবাধিকার লঙ্ঘনকারীর যেমন আন্তর্জাতিক আদালতে শাস্তি হয়েছে এই ক্ষেত্রেও তার অন্যথা না হবার সম্ভাবনাই বেশি। মনে রাখা দরকার, বাংলাদেশ শক্তিশালী দেশ নয় যে আন্তর্জাতিক বিধিবিধান অগ্রাহ্য করতে পারে। বিশেষত মানবাধিকার-সংক্রান্ত আইন, সনদ বা নীতি লঙ্ঘন করা এই কালে অনেক কঠিন হয়ে উঠেছে। বলা বাহুল্য, বিডিআরের বিরুদ্ধে অভিযোগ মারাত্মক। অবশ্যই। পিলখানার সেনাকর্মকর্তাদের যারা নৃশংসভাবে হত্যা করেছে তাদের শাস্তি হোক। বিডিআর বিদ্রোহ সম্পর্কে নয়া দিগন্তের এই কলামেই লিখতে গিয়ে আমি এই ঘটনাকে কিলিং-মিশন আখ্যা দিয়েছিলাম। কারণ হিশাবে বলেছি, আকস্মিক সংঘর্ষে মৃত্যু আর বেছে বেছে ধরে সেনাকর্মকর্তাদের হত্যা সমার্থক নয়। বিডিআর জওয়ানদের ক্ষোভ, দাবিদাওয়া, আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণের প্রতিবাদ যদি কিছু থাকেও তাহলে এই হত্যা-মিশনের রক্তে-লাশে নৃশংসতায় সেই সব চাপা পড়ে গিয়েছে। আফসোস! আজ আমরা শুধু নিহত সেনাকর্মকর্তা ও তাঁদের পরিবার-পরিজনদেরই হারাইনি, আমরা হারিয়েছি সীমান্তের অকুতোভয় সেই সব জওয়ানদের, যারা দিনের পর দিন বাংলাদেশকে শত্রুর হাত থেকে জীবন বাজি রেখে আমাদের রক্ষা করেছেন। তাঁরা নিহত হননি ঠিক; কিন্তু যাঁরা সত্যি সত্যিই জাতির বীর হিশাবে পদুয়া-রৌমারীতে ভূমিকা রেখেছেন, আজ তাদের আমরা ঘৃণায় ও লজ্জায় প্রত্যাখ্যান করছি। এই সব শুরুর দিকে লেখা। কিন্তু এখন বুড়িগঙ্গার জল নানা দিকে গড়াতে শুরু করেছে।

আরেকটি লেখায় বলেছিলাম, এই ঘটনা এক ঢিলে দুই পাখি মারার মতো ঘটনা। এক দিকে সেনাবাহিনীকে দুর্বল করা অন্য দিকে বিডিআরকেও ধ্বংস করা। কিন্তু বিস্মিত হয়েছি যখন সেনাবাহিনীর যোগ্য কর্মকর্তাদের নেতৃত্বে তাঁদেরই প্রশিক্ষণে ও যত্নে যে বিডিআর দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য অকুতোভয় লড়বার দুর্ধর্ষ সাহস দেখিয়েছে সেই বিডিআরের নাম পরিবর্তনের প্রস্তাব এসেছে সেই সেনাবাহিনীর কাছ থেকেই। আমি লজ্জিত হয়ে লক্ষ করেছি বিডিআরের দায়িত্বপ্রাপ্ত সেনাকর্মকর্তা বলছেন, তিনি এখন আর ব্যাজ পরবেন না, বিডিআরের পোশাক পরবেন না। প্রথমত, তাঁর ঘোষণা একটি সুশৃঙ্খল বাহিনীর জন্য মারাত্মক হুমকি। তিনি শৃঙ্খলা ভঙ্গ করেছেন কি না সেটা অবশ্যই সেনাবাহিনীর নিয়মনীতি-বিধিবিধানের অধীনে দেখতে হবে। এটা ব্যক্তিগত ইচ্ছা-অনিচ্ছা বা আবেগ-ঘৃণার ব্যাপার নয়। যিনি এই বাহিনীর প্রধান হবেন তাঁকে অবশ্যই ব্যাজ পরতে হবে এবং পোশাক পরতে হবে। এই ধরণের আচরণের কারণে সুশৃঙ্খল বাহিনীর মধ্যে যে স্বেচ্ছাচার ও নৈরাজ্যের নজির তৈরি হয় তার কুফল হতে পারে মারাত্মক।

ফলে সেনাবাহিনী ও প্রতিরক্ষার স্বার্থে আমাদের বলতে হয়েছে যদি রক্তের দাগ নিয়েই কথা ওঠে তাহলে বাংলাদেশের উচ্চপদস্থ সেনাকর্মকর্তাদের অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের জন্য মধুর নয়। আমরা প্রতিষ্ঠান হিশাবে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও সাধারণ সৈনিকদেরও এই ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ আলাদাভাবে বিচার করবার পক্ষপাতী। সেনাবাহিনী একটি শৃঙ্খলাবদ্ধ বাহিনী। সেই ক্ষেত্রে উচ্চাভিলাষী সেনাকর্মকর্তাদের কমান্ড বা হুকুম সাধারণ সৈনিকরা তাদের প্রশিক্ষণ ও সাংগঠনিক নিয়মের অধীনস্থতার কারণেই মানতে বাধ্য হয়। অল্প কয়জন স্বার্থান্বেষী ও উচ্চাভিলাষী অফিসারের দোষে আমরা সেনাবাহিনী, অন্যান্য সেনাকর্মকর্তা ও সাধারণ সৈনিকদের দোষী সাব্যস্ত করতে পারি না। শেখ মুজিবুর রহমান ও জিয়াউর রহমান সেনাকর্মকর্তাদের হাতেই নিহত হয়েছেন। রাজনৈতিক নেতাকে হত্যা করার অর্থ দেশের মানুষের বুকে গুলি চালানো। এই অপরাধের পরও এই দেশের মানুষ অল্প কয়জন সেনাকর্মকর্তার দোষে সেনাবাহিনীকে কখনোই দোষী করেনি। সেনাবাহিনীকে ক্ষমার চোখেই দেখে।

অল্প কয়জন সেনাকর্মকর্তা তাদের ব্যক্তি ও গোষ্ঠিস্বার্থে যদি সামরিক অভ্যুত্থান করে থাকে তাহলে তো সৈনিকের পোশাকে ও ব্যাজেও রক্তের দাগ লেগে রয়েছে। সেনাকর্মকর্তাদের পরিষ্কার বুঝতে হবে তাদের কোন সহকর্মী যখন নৃশংসভাবে নিহত হয় তাঁরা যেভাবে ব্যথা পান ও আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন, জনগণের নেতাদের যখন হত্যা করা হয় তখন কোটি কোটি মানুষ তাঁদের প্রিয় নেতার এই নৃশংস মৃত্যুতে দিশাহারা হয়ে পড়ে। কোটি কোটি মানুষের বুকের ব্যথা প্রশমন অত সহজ কাজ নয়। যে ক্ষত একবার তৈরি হয় তার ঘা শুকানোর জন্য দেশের মানুষকে বহু কাঠখড় পোড়াতে হয়। জনগণের ইচ্ছা, সঙ্কল্প, আশা-ভরসা ও ভবিষ্যতের দিশা হয়ে যে রাজনৈতিক নেতার উত্থান, তিনি ঐতিহাসিক ব্যক্তি। ইতিহাস তাঁকে তৈরি করে। আফসোস, কোন প্রকার প্রশিক্ষণ, শিক্ষা বা বিধিবিধানের নিয়মে ফেলে নেতা তৈরি করা যায় না। নেতৃত্বশূন্যতা দেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতি। এই শূন্যতা সৃষ্টির জন্য পুরো সেনাবাহিনীকে দায়ী করে নাম বদলানো বা পোশাক বা ব্যাজ না পরার দাবি জনগণ কখনোই তোলেনি। কিন্তু যে বিডিআর পদুয়া-রৌমারীতে শত্রুর আক্রমণ থেকে দেশকে রক্ষা করে জনগণনন্দিত হয়েছে, সেই বাহিনীর নাম পরিবর্তন ও বিডিআর ব্যাজ ও পোশাকে রক্তের দাগ লেগে থাকার দাবি তুলে তা না পরবার দাবি প্রতিটি দেশপ্রেমিক নাগরিককে মারাত্মকভাবে আহত করেছে।

তাহলে আমাদের এখনকার কাজ কী? প্রথম কাজ হচ্ছে নির্যাতন, প্রতিহিংসা, একের পর এক বিডিআরের লাশ বেরোনোর নৃশংসতা অবিলম্বে বন্ধ করা। পিটিয়ে মানুষের কাছ থেকে ঘটনায় তাদের যুক্ত থাকার স্বীকারোক্তি বা জবানবন্দী আদায় আইনের চোখে যেমন টেকে না, তেমনি মানবাধিকারও একে খুবই গর্হিত কাজ বলে মনে করে। এই ধরনের প্রক্রিয়া এটাই প্রমাণ করে যে, তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণের জন্য আমাদের কোন প্রশিক্ষিত সংস্থা নাই। পিটিয়ে তথ্য সংগ্রহ বা টর্চার এই কারণেই অপরাধীদের শনাক্ত করার জন্য একমাত্র মাধ্যম হয়ে উঠেছে। জাতীয় নিরাপত্তার জন্য এটা খুবই চিন্তার বিষয়। নিরাপত্তার চিন্তাও এখন রীতিমতো দুশ্চিন্তা হয়ে উঠেছে। এই ধরনের মৃত্যু কি মূলত খোদ তথ্যকেই বা সাক্ষী-কেই চিরদিনের জন্য গরহাজির করে দেবার ইঙ্গিত? এই আশঙ্কা সমাজে সৃষ্টি হবার ফলে সেনাবাহিনীর প্রতি যে সংবেদনশীলতা জনগণের তৈরি হয়েছিল, সেখানে দ্রুত ক্ষয় ঘটছে। জনগণের সঙ্গে সেনাবাহিনীর দূরত্ব তৈরি হচ্ছে। আগেও ছিল, সেনাসমর্থিত সরকারের আমলে সেটা বেড়েছে। সেনাবাহিনী বেসামরিক লেবাসে সামরিক সরকার পরিচালনার কারণে দেশের যে বিপর্যয় ঘটেছে এখনো তা উপলব্ধি করছে না বলেই জনগণ মনে করে। বিডিআরের ঘটনায় সেনাবাহিনীর প্রতি যে সহমর্মিতা গড়ে উঠেছিল তার ক্ষয় ঘটছে। প্রশ্ন উঠেছে, যেখানে সেনাবাহিনী দেশের ভেতরে নিজেকে নিজে রক্ষা করতে অক্ষম, তাহলে কী করে তারা বাইরের শত্রুর হাত থেকে নাগরিকদের রক্ষা করবে? অন্য দিকে, দেশের সার্বভৌমত্ব ও প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে এই ভয়াবহ বিপর্যয়ের কোন প্রকার মূল্যায়ন ছাড়া অত্যাচার ও প্রতিহিংসার পথেই সেনাবাহিনী যাচ্ছে বলে জনগণের মধ্যে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। এই পরিস্থিতি বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর জন্য শুভ নয়।

দ্বিতীয়ত, সম্পূর্ণ অরক্ষিত বাংলাদেশকে শত্রুর সম্ভাব্য হামলা থেকে কিভাবে আমরা রক্ষা করতে পারি সেই বিষয়ে অবিলম্বে ভাবনাচিন্তা শুরু করা। এই ক্ষেত্রে আমি বারবারই বলেছি, একটি জনগোষ্ঠি নিজেদের রাষ্ট্র হিশাবে পরিগঠিত করবার অর্থই হচ্ছে আর সকল রাষ্ট্র বা রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত অন্য সকল রাষ্ট্রই সেই রাষ্ট্রের সম্ভাব্য শত্রু। যদি তা না হবে তাহলে নিজেদের আলাদা রাজনৈতিক জনগোষ্ঠি ভেবে আমাদের আলাদা একটি রাষ্ট্র হয়ে টিকে থাকার কী দরকার? এই দিক থেকে কোন রাষ্ট্রকে বিশেষ ঐতিহাসিক সময়ে মিত্র বলা একটা আপেক্ষিক বা সাময়িক ব্যাপার মাত্র। একাত্তরে ভারত যদি আমাদের (সাময়িক) মিত্র হয়ে থাকে তাহলে ২০০৯ সালে ভারত আমাদের মিত্র কি? কোন দেশই আমাদের মিত্র দেশ নয়। আমাদের অবশ্যই নিজেদের প্রতিরক্ষা নিজেদেরই নিশ্চিত করতে হবে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে ভারতীয় সেনাবাহিনীর অধীনে একটি রক্ষীবাহিনীতে পরিণত করবার প্রক্রিয়া কোন কোন মহলের থাকতেই পারে। আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির টানাপড়েনে সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন এখন খুবই সহজ। বিডিআরের ঘটনার আগে এই ধরনের প্রস্তাব অবাস্তব মনে হোত। এখন হয় না। বলা হচ্ছে, ভারত আমাদের সীমান্ত রক্ষার ক্ষেত্রে এতই ইতিবাচক ভূমিকা রেখেছে যে বিডিআর-প্রধান স্বয়ং গিয়ে ভারতকে ধন্যবাদ জানিয়ে এসেছেন। যদি ভারতই বাংলাদেশের সীমান্ত রক্ষা করতে পারে তাহলে বিডিআর রাখারই বা দরকার কী? একই যুক্তিতে এই প্রশ্ন তো উঠতে বাধ্য যে তাহলে একটা স্থায়ী সেনাবাহিনীই বা বাংলাদেশকে পুষতে হবে কেন? এই প্রচারণাই কি বাংলাদেশের শত্রুরা সেই একাত্তর সাল থেকে করছে না? আমার আশঙ্কা বিডিআর সম্পর্কে যে সকল বক্তব্য আমরা শুনছি তা রাষ্ট্র হিশাবে বাংলাদেশকে বিলুপ্ত করবার খায়েশ থেকে বলা। এই ধরনের খায়েশের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া ও সেনাবাহিনী, বিডিআর ও জনগণের মধ্যে এই বিষয়ে ঐক্য ও মৈত্রীর স্থানগুলো শনাক্ত করা ও তা বিকশিত করাই আমাদের এখনকার কাজ। যদি আমরা তা করতে চাই তাহলে ঘটনার নৈর্বক্তিক পর্যালোচনার প্রয়োজন রয়েছে। সেনাবাহিনীকে অবশ্যই তিক্ত ও সমালোচনামূলক কথা আন্তরিকতার সঙ্গে শুনতে প্রস্তুত থাকতে হবে। সেই লক্ষ্যে অবিলম্বে সেনাবাহিনীকে অবশ্যই সেই সকল কাজ থেকে বিরত থাকতে হবে যে সকল কর্মকাণ্ড তাদেরকে জনগণের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে নেয় এবং জনগণের বিরুদ্ধে দাঁড় করায়।

সম্প্রতি ইত্তেফাকে প্রকাশিত (১৬ এপ্রিল ২০০৯) একজন সামরিক অফিসারের অনুভূতি শিরোনামে লে. কর্নেল কাজী কবিরুল ইসলামের লেখাটি খুবই আগ্রহ নিয়ে পড়েছি। তিনি ঢাকা সেনানিবাসে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ বিভাগের পরিচালক। খুবই গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। একজন নাগরিক হিশাবে আমি তার অনুভূতিকে অত্যন্ত সম্মান জানাই। কর্মরত অবস্থায় পদাধিকারের পরিচয় নিয়েই তিনি লেখাটি লিখেছেন। হয়তো বোঝাতে চেয়েছেন তার অনুভূতিই সেনাবাহিনীর বিশেষত সেনাকর্মকর্তাদের অনুভূতি। কিন্তু তার লেখা পড়ে আমি বিচলিত হয়েছি। কারণ বাংলাদেশের বর্তমান ভয়াবহ প্রতিরক্ষা দুর্যোগে তিনি একজন সেনাকর্মকর্তার অধিক কিছু হয়ে উঠতে পারলেন না। সহকর্মীর নৃশংস মৃত্যুর জন্য ব্যথা আছে তার, সেই ব্যথা আমার বুকেও এসে বিঁধেছে। অথচ এখন তো একই সঙ্গে দেশের সকল মানুষের ব্যথা-বেদনার কথা বলবার সময়, দেশের প্রতিরক্ষা নিয়ে জনগণের আশঙ্কা ও আতঙ্ক প্রশমন করবার ক্ষেত্রে সৈনিককেই তো এখন জাতীয় ভূমিকা রাখতে হবে। আমাদের সকলকেই এখন নাগরিক হতে হবে। প্রতিটি সৈনিককে যেমন বুঝতে হবে যে তিনি সৈনিক মাত্র নন, এই দেশের নাগরিক অবশ্যই, ঠিক তেমনি প্রতিটি নাগরিককেও ভাবতে হবে সৈনিকতা তার পেশা না হোক, কিন্তু দেশের প্রতিরক্ষা নিশ্চিত করবার ক্ষেত্রে তিনি একজন সৈনিকও বটে। সৈনিকের চোখে পানি ও কান্নার আবেগ ও কষ্ট আমরা বুঝি, কিন্তু তার মধ্যে সৈনিকতার দৃঢ়তা প্রকাশ পায় না, আবেগের আতিশয্য সৈনিকতার মর্যাদাকে বাড়ায় কি না আমি লে. কর্নেল কাজী কবিরুল ইসলামকে বিনয়ের সঙ্গে ভেবে দেখতে বলি। তাঁকে এটাও বুঝতে হবে যেখানে দেশের অধিকাংশ মানুষ গরিব ও হতভাগ্য সেখানে এই রাষ্ট্রের পক্ষে অধিক আর্থিক সুবিধা ও প্রয়োজন মেটানো কিভাবে সম্ভব? সেটা সম্ভব যদি আমরা সঠিক অর্থনৈতিক পরিকল্পনা করতে পারি। যদি সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের শাসন কায়েম করতে পারি, যদি দুর্নীতিবাজ ও দুবৃত্তদের বিরুদ্ধে সৈনিক ও জনগণের মৈত্রী গড়ে তুলতে পারি। তাই না?

তিনি প্রশ্ন তুলেছেন, দেশের বিবেককে যারা ধারণ করে আছেন তাদের প্রতিনিয়ত ক্ষুরধার কথায় আমরা রক্তাক্ত হয়ে উঠি। আমরা যেন ঘৃণ্য এক অপরাধী গোষ্ঠী। মনকে প্রবোধ দেই, দেশকে ভালোবাসা যদি অপরাধ হয়ে থাকে তাহলে আমরা অপরাধী। ক্ষমতাবানদের রক্তচক্ষু ভ্রূকুটি উপেক্ষা করে দেশের জন্য কাজ করাটা যদি অপরাধ হয়ে থাকে তাহলে আমরা অপরাধী।
আবেগের মূল্য আছে অবশ্যই। কিন্তু বাংলাদেশে গত জরুরি অবস্থা জারির পেছনে সেনাবাহিনীর ভূমিকা আবেগহীনভাবে আমি তাঁকে পর্যালোচনা করতে অনুরোধ করি। সেনাবাহিনী কি দেশের স্বার্থ রক্ষা করেছিল নাকি পরাশক্তির স্বার্থ? তারা কি জনগণের পক্ষে দাঁড়িয়েছিল নাকি জনগণের বিপক্ষে? দেশকে ভালোবাসে বলেই কি সেনাবাহিনী জরুরি অবস্থা সমর্থন করেছিল ও প্রেসিডন্টেকে দিয়ে জরুরি অবস্থা জারি করেছিল? নাকি যখন বলা হয়েছিল ২০০৭-এর নির্বাচনে সেনাবাহিনী সহায়তা দিলে সেনাবাহিনীর শান্তি-মিশন-এ অংশগ্রহণ করা অনিশ্চিত হয়ে যেতে পারে, তখন সেনাবাহিনী সংবিধানবিরোধী ভূমিকায় নামতে পিছপা হয়নি। সেনাবাহিনীর জন্য এর চেয়ে লজ্জার তার কী হতে পারে! দেশের বর্তমান বিপর্যয়ের জন্য কে কিভাবে দায়ী সেই পর্যালোচনা খোলামনে করা দরকার। আমরা কি এখন ব্যক্তির একনায়কতন্ত্র ও বিকট ফ্যাসিজম কায়েম করি নি? সেই ক্ষেত্রে সেনাবাহিনীর অবদান কি জনগণ ভুলে যাবে? বাংলাদেশকে পরাশক্তির লুণ্ঠনক্ষেত্রে পরিণত করবার এই বর্তমান পরিস্থিতির জন্য দায়ী কে?

লে. কর্নেল কাজী কবিরুল ইসলাম যখন পত্রিকায় লিখতে শুরু করেছেন, আমি তাকে আহ্বান করি এই প্রশ্নগুলো আলোচনা হোক। সেনাবাহিনীকে অবশ্যই গণমুখী হতে হবে। সেনাবাহিনীকে আমরা জনগণের মিত্র হিশাবে চাই, শত্রু হিশাবে নয়। জনগণের বিপক্ষে দাঁড়ালে সেনাবাহিনী ধনী, দুর্বৃত্ত, শোষক, লুণ্ঠনবাজদের ব্যক্তিগত পাহারাদারে পরিণত হবে। শান্তি-মিশন আমাদের সুনাম এনেছে ঠিক, সেনাকর্মকর্তাদের আর্থিক আয়-উন্নতিও হয়েছে কিন্তু একই সঙ্গে সেনাবাহিনীর বিজাতীয়করণও ঘটেছে। এই সেনাবাহিনী কি এখন আমাদের সেনাবাহিনী? জনগণের? জনগণের মধ্যে এই প্রশ্ন ও সাধারণ বিচারবোধটুকু আছে? আমি তাকে নিশ্চিত করে বলতে পারি জনগণ কখনোই বাংলাদেশের সেনাবাহিনীকে ঘৃণ্য অপরাধী গোষ্ঠি মনে করে না, যদি তারা নিজেরা নিজেদের এইভাবে না ভাবেন। যে ধনী শ্রেণীর পাহারাদারি সেনাবাহিনী করে সেই শ্রেণীর মধ্যে এই ধরনের বিকৃত চিন্তা থাকতে পারে। তা ছাড়া দেশ কথাটার অর্থ শ্রেণিভেদে বিভিন্ন রকম। গরিব, শোষিত, নির্যাতিত, সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের পক্ষে দাঁড়ানোর মধ্য দিয়েই দেশকে ভালোবাসার দিকে কদম বাড়াতে হয়। একাত্তরে যাঁরা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন তাঁদের খুব কমই পেশায় সৈনিক ছিলেন। দেশ রক্ষা কারো একচেটিয়া নয়। দেশের প্রতি ভালোবাসার কথা শুধু কথা দিয়ে বলতে হয় না, কাজে প্রমাণ করতে হয়। বিডিআরের জওয়ানরা সেটা প্রমাণ করেছেন পদুয়া-রৌমারীতে। একাত্তরের পরের সেনাবাহিনী এখনো সেই পরীক্ষা দেয়নি। আগামি দিনে দেবে কি না আমরা নিশ্চিত নই। যদি পিলখানার মৃত্যুপুরি থেকে বিডিআরদের লাশ একের পর এক বেরোতে থাকে তখন দেশপ্রেমের কথা যে গরিব শ্রেণী থেকে বিডিআর জওয়ানরা এসেছে তাদের বোঝানো যাবে কি?
আমাদের আবেগহীন হয়ে দেশের সকলের কোথায় মঙ্গল সেই দিকটি ভাবতে হবে। এই কাতর আহ্বানটুকু জানিয়ে শেষ করি।

ইমেইলঃ [email protected] (সুত্র, নয়া দিগন্ত, ১৮/০৪/২০০৯)
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

গরমান্ত দুপুরের আলাপ

লিখেছেন কালো যাদুকর, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৫৯




মাঝে মাঝে মনে হয় ব্লগে কেন আসি? সোজা উত্তর- আড্ডা দেয়ার জন্য। এই যে ২০/২৫ জন ব্লগারদের নাম দেখা যাচ্ছে, অথচ একজন আরেক জনের সাথে সরাসরি কথা... ...বাকিটুকু পড়ুন

রাজীব নূর কোথায়?

লিখেছেন অধীতি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:২৪

আমি ব্লগে আসার পর প্রথম যাদের মন্তব্য পাই এবং যাদেরকে ব্লগে নিয়মিত দেখি তাদের মধ্যে রাজীব নূর অন্যতম। ব্যস্ততার মধ্যে ব্লগে কম আসা হয় তাই খোঁজ-খবর জানিনা। হঠাৎ দু'একদিন ধরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বৃষ্টির জন্য নামাজ পড়তে চায়।

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৩৮



ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে বৃষ্টি নামানোর জন্য ইসতিসকার নামাজ পড়বে তার অনুমতি নিতে গিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এটির অনুমতি দেয়নি, যার জন্য তারা সোশ্যাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

=তুমি সুলতান সুলেমান-আমি হুররাম=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৩৬



©কাজী ফাতেমা ছবি

মন প্রাসাদের রাজা তুমি, রাণী তোমার আমি
সোনার প্রাসাদ নাই বা গড়লে, প্রেমের প্রাসাদ দামী।

হও সুলেমান তুমি আমার , হুররাম আমি হবো
মন হেরেমে সংগোপনে, তুমি আমি রবো।

ছোট্ট প্রাসাদ দেবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

মৃত্যুর আগে ইবলিশ ঈমান নিয়ে টানাটানি করে

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:০২



ইউটিউব হুজুর বললেন, মৃত্যুর আগে ইবলিশ ঈমান নিয়ে টানাটানি করে। তখন নাকি নিজ যোগ্যতায় ঈমান রক্ষা করতে হয়। আল্লাহ নাকি তখন মুমিনের সহায়তায় এগিয়ে আসেন না। তাই শুনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×