somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কল্পনার জগৎ বইনির্ভর : আল মাহমুদ

০৩ রা মে, ২০০৯ রাত ৮:০৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

কল্পনার জগৎ বইনির্ভর
- আল মাহমুদ


প্রচণ্ড গরমে কোনো কিছুতে স্বস্তি পাই না। উত্তাপে অস্বস্তিতে প্রাণ ওষ্ঠাগত। তবু লেখার কর্তব্য যাদের ভাগ্যে জুটেছে তাদের তো আর না লিখে উপায় নেই। আমিও লিখছি আমার ভেতরের তাগিদে। লিখছি পাঠকদের তাগাদায়। তারা যে যেখানেই আছেন, আমার জন্য অপেক্ষা করে থাকেন। তাদের জন্য যথার্থ সহানুভূতির সম্পর্ক বজায় রেখে সব আবহাওয়ায় লিখে যাই। তাপে লিখি উত্তাপেও লিখি। আমার কোনো শীত-গ্রীষ্ম থাকতে নেই, কারণ আমি প্রতিশ্রুত লেখক। আমার কর্তব্য কেবল লিখে যাওয়া।

মাঝে মাঝে শরীর বিশ্রাম কামনা করে। কিছুক্ষণ চোখ বুজে থাকি� এতেই বিশ্রামের স্বাদ গ্রহণ করা হয়। কী লিখব সেটা আর বড় কথা নয়। বড় কথা হলো পৃষ্ঠা ভরিয়ে তোলা। যারা আমাকে চেনে তারা জানে, আমি দায়িত্বজ্ঞানহীন নিবন্ধ লেখক নই। যা-ই লিখি, এর একটা অর্থ থাকে, প্রতিক্রিয়াও যে থাকে না এমন নয়। কিন্তু প্রতিক্রিয়াটা লিখে কেউ জানায় না। বাতাসে ছড়িয়ে দেয়। ওই বাতাস আমার বিপক্ষে যতটা পারে বিরূপতাই সৃষ্টি করে। চুপ করে থাকি, কথা বলি কম। কিন্তু কথা তো না লিখে পারি না। ফলে শত্রু ও মিত্র উভয় পক্ষই আমার লেখার জন্য অপেক্ষা করে। আমি কী করে বুঝাই যে, আমার যথেষ্ট বয়স হয়েছে। আমার স্নায়ুগুলো এখন বিশ্রাম কামনা করে। আমি তো নিজের শরীরের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারি না। একটা সময় ছিল, যখন সব কিছু অস্বীকার করে লেখাটাকে বড় করে তুলেছিলাম। এখন ভাবি, লেখার চেয়ে জীবন অনেক বড়। বাঁচার সাধ মেটেনি। কিন্তু শুধু বাঁচলেই তো চলবে না। বাঁচার সাথে সাথে কর্মের পরিধি বিস্তৃত করতে হবে। বাঁচতে হলে আমার মতো লোকের অর্থাৎ কবির লিখেই বাঁচতে হয়। লেখার মধ্যেই আছে নানা রহস্যের উদঘাটন। আমি সব উন্মোচন করতে পারিনি, লেখাও ছাড়িনি। এই সাহসিকতার জন্য আমাকে কেউ পুরস্কৃত করবে না। তবে লেখালেখির জগতে একদা আমি ছিলাম� এ কথা অবশ্যই স্বীকার করবে।

গত কয়েক বছর ধরে আমার চোখের দৃষ্টি ক্ষীণ হয়ে এসেছে। এক হাত দূরের মানুষের মুখ দেখেও চিনতে পারি না। হাত ধরতে পারি। স্পর্শ করে শনাক্ত করতে পারি, কিন্তু স্পর্শও যথার্থভাবে আমাকে জানান দেয় না। এ অবস্থায় লেখক মাত্রই লেখা বন্ধ করে দেন। আমিও কি লেখালেখি ছেড়ে দেবো? আমার পাঠকরা �না, না� করে উঠবেন; আমার ভেতর থেকেও একটা �না, না� বেরিয়ে আসবে। এসব উপেক্ষা করে লিখে যেতেই মনস্থির করেছি।

এখন কথা হলো, বহুদিন ধরে এই কলামটি আমি লিখছি। হয়তো এতে কিছু বিষয় ছিল যা আমার ভক্তদের টেনেছে, আমিও খুশি। এখন ভাবছি আরো গভীরে গিয়ে চিন্তাভাবনা করে লেখাটা চালিয়ে নেয়া যায় কি না। দেখা যাক, কতটুকু কী করা যায়।

এই শহরে স্বপ্নদ্রষ্টা কবির কর্তব্য যথাসাধ্য পালন করে গেছি। বিশ্বাসী মানুষ হিসেবে অনেক বিষয় আমি উত্থাপন করার প্রয়াস পেয়েছি। অর্থাৎ বেঁচে থাকার জন্য হাতের কাছে যত বিষয় পেয়েছি, সব কিছুই ভাঙিয়ে চলেছি। আমাকে কেউ লেখার ব্যাপারে বারণ করেননি। কিন্তু আমার নিজেরই মন হা হা করে বাধা দিয়েছে অর্থহীন কথা না বলে জীবনের কোনো ঘনিষ্ঠ বিষয় উত্থাপন করার জন্য।

আমি পারিনি; চেষ্টাও ছাড়িনি। কিন্তু মাঝে মধ্যে স্মৃতিভ্রষ্ট মানুষের মতো হয়ে যাই। তখন মনে হয়, আর কিছু লেখার নেই। কয়েক দিন ভেতরটা বোবা হয়ে থাকে। আবার সময় এলে আমার মধ্যে কাণ্ডজ্ঞান ফিরে আসে। আবার লিখতে শুরু করি। ভাবি, লিখতে লিখতে নিশ্চয় কোথাও পৌঁছাব। যেখানে পৌঁছাব সে ব্যাপারে আমার সংশয় ও শঙ্কা আছে। অন্য দিকে আছে কর্তব্য, দায়িত্ববোধ ও কবিত্ব।

আমি মাঝে মধ্যে আমার রক্তের সম্পর্কের আত্মীয়দের খোঁজখবর নিতে চেয়েছি। কিন্তু কেউ আপনজন হিসেবে এগিয়ে আসেনি। অন্য দিকে এ সময়টায় আমার পারিবারিক অবস্থা রোগে-শোকে মুহ্যমান। সুখ কাকে বলে, তা আমরা কখনো বুঝতে পারিনি। হয়তো সুখ এসেছিল আমাদের ঘরে। কিন্তু আমরা সুখের মুখ শনাক্ত করতে পারিনি। এখন ভাবছি, আমাদের সুখ-দুঃখ ও কান্না-হাসি সমান্তরাল। বোঝারও দরকার নেই, খোঁজারও দরকার নেই। কেবল দিনযাপন আর কাল হরণ� এই যে আমি লিখছি� আমার মনে হয়, আমার আগে কোনো কবি এমন আত্মবিবরণ উদঘাটন করে কিছু লেখেননি। লেখাটা দুঃসাধ্য ব্যাপারও বটে। অনেকে বলেন, এমন বিষয় নেই যা লেখা যায় না। কারণ, তা স্বীকার করি না। এমন অনেক বিষয় আছে যা লেখা যায় না। লেখা যায় কিন্তু হজম করা যায় না। আমি তো সব বিষয় বাজিয়ে দেখেছি। কিন্তু এমন বহু বিষয় আছে যা লিখতে গেলেই দুঃখে অশ্রুজলে সব ভেসে যায়। লেখা সম্ভব হয় না। লেখাটা তো একটা বিষয়েরই বর্ণনামাত্র। আমি কি আমার সব বিষয়েরই বর্ণনা দিতে পারি? তাহলে যে রক্ত সম্পর্কের আত্মীয়রাই আত্মীয়তা অস্বীকার করে বসবে। দূর হোক সম্পর্কের ঘনঘটা, আমি সবারই আত্মীয়; সব পরিবারের মধ্যেই জন্মেছি। কিন্তু শিশুকালটা আমার মনে নেই, যেন শৈশবটা আপনা থেকেই মুছে গেছে; যেন আমি কোনো কালেই বালক ছিলাম না, সব সময় ছিলাম প্রাজ্ঞ যুবক। এখন তো বয়স হিসাব করলে আমাকে কেউ আর যুবকও বলবে না। বৃদ্ধও বলবে না বটে, তবে যুবক তো কিছুতেই নয়। শুধু বলা যায় প্রাজ্ঞ এক রহস্যময় অস্তিত্ব, যে কিনা সব জানে, সব দেখেছে, কিন্তু বলে না কিছুই; হাসে না, ভালোবাসে না কাউকে, আবার শত্রুতাও করে না। তার একজন মিত্র আছে, যার নাম হলো �মহাকাল�।

যদি কেউ জিজ্ঞেস করে, আপনি কেমন আছেন, তাহলে সে শুধু হাসে। নিঃশব্দ হাসি। এই হাসি মানুষের অন্তরকে শীতল করে দেয় বটে; তবে মনে হয় হাসিটা এক টুকরো বরফের মতো জমাট বেঁধে আছে।
মানুষের শ্রেষ্ঠ কাজ হলো গ্রন্থ প্রকাশ। নিজের লেখা মুদ্রিত অবস্থায় দেখা এক রোমাঞ্চকর ঘটনা। আমার এখন এসব ঘটনায় এমন অভ্যেস হয়ে গেছে যে, আর অকস্মাৎ পুলকে আটখান হয়ে যাই না। তা ছাড়া আছে প্রকাশনার নানা কারসাজি, সব যে আমাকে জিজ্ঞেস করে কিংবা মূল্য পরিশোধ করে প্রকাশিত হয় এমন নয়। আমাকে না বলে আমার বই ছাপা হয়ে বাজারে চলে যাচ্ছে। আমি নিরূপায়, ইচ্ছা করলে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারি। আইন আমার পক্ষে আছে, কিন্তু আমি করি না। মনে হয়, কোনো ঝামেলায় যেতে আমার আর ইচ্ছে হয় না। কে, কিভাবে আমার বই ছাপছে তা অনুসন্ধান করার জন্য আমার কোনো প্রতিনিধি নেই। এখন আমার ছেলেদের মধ্যে থেকে দুয়েকজন আমাকে প্রশ্ন করে; আমি জবাব দিতে পারি না। এই অবস্থা সৃষ্টি করা লেখক-প্রকাশকের জন্য অমঙ্গলজনক। যা হোক, আমি কোনো স্বার্থপর একঘেয়ে লেখক নই। মিলমহব্বতের মধ্যেই এত দিন জীবন চলে গেছে। কোনো জটিলতা সৃষ্টি হোক, ভবিষ্যতেও তা আমার কাম্য নয়। আমার প্রকাশকদের প্রতি আমার বিশ্বাস আছে যে, তারা আমাকে আমার প্রাপ্যটা যথারীতি পরিশোধ করবেন এবং আমি না থাকলে আমার পরিবার-পরিজনদের অনুসন্ধান করে বের করে তাদের হাতে আমার প্রাপ্যটা তুলে দেবেন। এর বেশি কী আর বলতে পারি? লেখক-প্রকাশকের সম্পর্কে আন্তরিক হওয়া আমার একান্ত কাম্য। উভয়কেই সাহিত্যের স্বার্থে কাজ করে বাঁচতে হয়, কে কাকে ঠকাবে?

তবে এখনকার প্রকাশকদের মধ্যে আগের মতো বইকে আকর্ষণীয় করে তোলার প্রতিযোগিতা দেখতে পাই না। ফলে তিন কালার বা চার কালার যা-ই হোক একটা প্রচ্ছদ দিয়ে বইটা বাজারে ছেড়ে দেয়া হয়, বই চলতে থাকে, সমাজে গলতে থাকে; কিন্তু কোনো প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে না। এই অবস্থার অবসান হওয়া দরকার। এত রঙচঙ না করে একটি আকর্ষণীয় প্রচ্ছদ নিয়ে বইটি বাজারে গেলে কোনো অসুবিধা নেই। বই চলে এর ভেতরকার গুণে। প্রচ্ছদচিত্রটি বইটিকে সাহায্য করে। কিন্তু এর কোনো গুণ প্রচ্ছদচিত্রে প্রভাবিত হয় না। আমরা আশা করছি, বহুবর্ণের অর্থ ব্যয়ের বদলে একটি পরিচ্ছন্ন বই বাজারে এসে আকর্ষণ সৃষ্টি করবে। এতে পাঠকরা কম দামে বই সংগ্রহ করতে পারবেন। বই যত সস্তা থাকে ততই বিক্রি বাড়ে। অযথা রঙ মাখিয়ে সঙ সাজিয়ে বাজারে বই ছাড়লে তাতে সাধারণ পাঠকদেরই পকেট কাটা যায়। এতে বইয়ের জগৎ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সবারই উচিত একটি বই প্রিয়জনকে উপহার দেয়া। বই ছাড়া জগৎ চলে না। বর্তমান দুনিয়া প্রযুক্তিতে অনেক অগ্রসর হলেও কল্পনার জগত বইনির্ভর।

(সুত্র, নয়া দিগন্ত, ৩০/০৪/২০০৯)

Click This Link
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা মে, ২০০৯ রাত ৮:০৭
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

স্মৃতিপুড়া ঘরে

লিখেছেন আলমগীর সরকার লিটন, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৩০



বাড়ির সামনে লম্বা বাঁধ
তবু চোখের কান্না থামেনি
বালিশ ভেজা নীরব রাত;
ওরা বুঝতেই পারেনি-
মা গো তোমার কথা, মনে পরেছে
এই কাঠফাটা বৈশাখে।

দাবদাহে পুড়ে যাচ্ছে
মা গো এই সময়ের ঘরে
তালপাতার পাখাটাও আজ ভিন্নসুর
খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে... ...বাকিটুকু পড়ুন

গরমান্ত দুপুরের আলাপ

লিখেছেন কালো যাদুকর, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৫৯




মাঝে মাঝে মনে হয় ব্লগে কেন আসি? সোজা উত্তর- আড্ডা দেয়ার জন্য। এই যে ২০/২৫ জন ব্লগারদের নাম দেখা যাচ্ছে, অথচ একজন আরেক জনের সাথে সরাসরি কথা... ...বাকিটুকু পড়ুন

রাজীব নূর কোথায়?

লিখেছেন অধীতি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:২৪

আমি ব্লগে আসার পর প্রথম যাদের মন্তব্য পাই এবং যাদেরকে ব্লগে নিয়মিত দেখি তাদের মধ্যে রাজীব নূর অন্যতম। ব্যস্ততার মধ্যে ব্লগে কম আসা হয় তাই খোঁজ-খবর জানিনা। হঠাৎ দু'একদিন ধরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বৃষ্টির জন্য নামাজ পড়তে চায়।

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৩৮



ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে বৃষ্টি নামানোর জন্য ইসতিসকার নামাজ পড়বে তার অনুমতি নিতে গিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এটির অনুমতি দেয়নি, যার জন্য তারা সোশ্যাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

=তুমি সুলতান সুলেমান-আমি হুররাম=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৩৬



©কাজী ফাতেমা ছবি

মন প্রাসাদের রাজা তুমি, রাণী তোমার আমি
সোনার প্রাসাদ নাই বা গড়লে, প্রেমের প্রাসাদ দামী।

হও সুলেমান তুমি আমার , হুররাম আমি হবো
মন হেরেমে সংগোপনে, তুমি আমি রবো।

ছোট্ট প্রাসাদ দেবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×