সস্তা শ্লোগাননির্ভর জনপ্রিয়তা ফ্যাসিবাদের লক্ষণ
ফরহাদ মজহার
আমাদের এখনকার কর্তব্য শিরোনামে গত কিস্তির লেখায় (নয়া দিগন্ত ১৩ মে ২০০৯) রাজনীতিতে লড়াইয়ের ময়দান শত্রুপক্ষ কিভাবে সাজায় সেই দিকে জনগণের নজরদারি তীক্ষ্ন করবার দিকে জোর দিয়েছি। বাংলাদেশে যাঁরা ইসলাম কায়েম করতে চান তাদের একটি অংশ এখনকার লড়াইকে ইসলাম বনাম ধর্মনিরপেক্ষতার লড়াই হিশাবে বোঝেন। বিস্ময়কর মনে হলেও আমরা দেখি ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী বা স্যেকুলারবাদীদের একটি অংশও বাংলাদেশের লড়াইকে ধর্মনিরপেক্ষতা বনাম ইসলামের লড়াই হিশাবে দেখেন। রাজনীতির ছক সাজানোর মধ্যে এদের এই আশ্চর্য মিল থাকা সত্ত্বেও আমরা ভাবি এরা বুঝি বাংলাদেশে রাজনীতির দুই প্রতিপক্ষ। মোটেও তা নয়। জনগণকে আমরা হুঁশিয়ার করে দেবার চেষ্টা করেছি যে বিভাজনের এই পদ্ধতিটাই আসলে সাম্রাজ্যবাদী পরাশক্তি এবং তাদের এই-দেশীয় বরকন্দাজদের সাজানো ছক। সেই ছক অনুযায়ী যারাই সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের লড়াইকে ইসলাম বনাম ধর্মনিরপেক্ষতার লড়াই হিশাবে সাজাবে তাদের বর্তমান বিশ্বপরিস্থিতির বাস্তবতায় আমাদের শত্রু হিশাবে চিহ্নিত করতে শিখতে হবে। যেখানে জনগণের লড়াই ফ্যাসিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে তখন তারা সাম্রাজ্যবাদ ও ফ্যাসিবাদকে আড়াল করার জন্যই এখনকার লড়াইকে ইসলাম বনাম ধর্মনিরপেক্ষতার লড়াই হিশাবে হাজির করে। এই ক্ষেত্রে এই বিভাজন ধর্মনিরপেক্ষতার পক্ষে দাঁড়িয়ে ইসলামের বিরুদ্ধে করা হোল, নাকি ইসলামের পক্ষে থেকে ধর্মনিরপেক্ষতার বিরুদ্ধে সাজানো হোল তাতে কিছু্ই আসে যায় না। ফ্যাসিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের এই প্রবল যুগে এই বিভাজন মারাত্মক বিভ্রান্তি তৈরি করে। জনগণকে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী ও ইসলামপন্থি হিশাবে বিভক্ত করে এবং মূল শত্রুর পরিবর্তে জনগণের নিজেদের মধ্যেই দূরত্ব, বিভেদ ও হানাহানি তৈরি করে। ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির বিশেষ বিশেষ ধারা যেমন ফ্যাসিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতার কথা বলে, ঠিক তেমনি ইসলামি রাজনীতির বিশেষ বিশেষ ধারাও ফ্যাসিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী। কথা হচ্ছে তারা কোন অর্থে কিভাবে এই বিরোধিতা করে কিম্বা ফ্যাসিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদকে কিভাবে বোঝে ও বিশ্লেষণ করে সেটা জানা ও বোঝা আমাদের কাজ। আমাদের উদ্দেশ্য হবে যতো বেশি সংখ্যায় মানুষকে ফ্যাসিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে একই কাতারে দাঁড় করানো।
ফ্যাসিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদই হচ্ছে আমাদের প্রত্যক্ষ শত্রু। দুনিয়াব্যাপী নির্যাতিত-নিপীড়িত জনগণের প্রধান শত্রু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তাদের দোসর পাশ্চাত্য পরাশক্তি। আঞ্চলিক দিক থেকে ভারত ও ইসরাইল সাম্রাজ্যবাদী শক্তির সঙ্গে অভিন্ন। সেই দিক থেকে এই লড়াই শুধুমাত্র জাতীয় লড়াই নয়, এই লড়াই একই সঙ্গে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক। শত্রুর বিরুদ্ধে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করাই আমাদের এখনকার কাজ, বিভক্ত বা বিভেদ তৈরি নয়। আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক লড়াই-সংগ্রামের জন্যই গণশক্তিকে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রশক্তিতে পরিণত করতে হবে। কিভাবে সেই রাষ্ট্র গঠন করা যায়, নতুন রাষ্ট্রের জন্য কিভাবে নতুন গঠনতন্ত্র কায়েম করতে পারি তার প্রক্রিয়ার কথাও আমরা গত লেখায় খানিক তুলেছি। এগুলো নতুন কোন কথা নয়। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পুরানা কথাই।
বলাবাহুল্য, ফ্যাসিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ চায় আমরা আমাদের লড়াইয়ের অভিমুখ ফ্যাসিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে পরিচালিত না করে পরস্পরের মধ্যে হানাহানি বাদবিসংবাদে অপচয় করি। যেন জনগণ রাজনৈতিক শক্তি হিশাবে সংঘবদ্ধ হতে না পারে এবং বাংলাদেশকে পরাধীন রাখা সহজ হয়। আর ইতোমধ্যে সাম্রাজ্যবাদ আমাদের দেয়ালে পোস্টারে বিলবোর্ডে লিখে দিয়ে দিচ্ছে যেখানেই আছে দিনবদলের চেষ্টা সেখানেই আছে অমুক। দিনবদল কথাটির যে মাধুর্য সেই অবস্থান থেকে তার অধঃপতন ঘটেছে, একটি কুৎসিত শব্দ হয়ে উঠেছে। ফ্যাসিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের ধারক ও বাহক একটি পত্রিকা সব কিছুই নাকি বদলে দিচ্ছে!। এখন দেখছি আরো বদলে যাওয়া ও বদলে দেবার শপথ নিচ্ছে তারা। অথচ এই পত্রিকার প্রায় প্রতিটি পাতায় পাতায় বহুজাতিক কোম্পানির বিজ্ঞাপন ও প্রচার, প্রতিটি খবর সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থ রক্ষার অধিক আর কিছুই হয়ে ওঠে না। ফ্যাসিবাদী ও সাম্রাজ্যবাদী প্রচার-প্রপাগন্ডায়, বিজ্ঞাপনে তারা আমাদের পুঁজির গোলামে পরিণত করবার জন্য বলে বদলে দাও, হারিয়ে যাও ইত্যাদি চিৎকার করে বেড়াচ্ছে। অথচ আমাদের কাজ হচ্ছে বিদ্যমান ব্যবস্থার খোলনলচে বদলে দেওয়া, বাংলাদেশে ফ্যাসিবাদ ও পুঁজিবাদের কবর রচনা করা।
নির্বাচন মানেই গণতন্ত্র নয়। আমরা বলেছি, গণতন্ত্র বলতে শাসক ও শোষক শ্রেণী যেভাবে বোঝে আমরা সেভাবে বুঝি না। প্রশ্ন উঠতে পারে, তাহলে গণতন্ত্র কথাটিও বা আমরা তাহলে রাখতে চাই কেন? এটা কি নিছকই কৌশলগত প্রশ্ন? মোটেও নয়। বরং যে প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে জনগণের ইচ্ছা ও সংকল্প বাস্তবায়িত হয়, সেই জায়গাটি রাজনীতির দিক থেকে বিশেষত গণশক্তি নির্মাণের প্রক্রিয়া হিশাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। একই সঙ্গে নীতিগত এবং ব্যবহারিক। অতএব গণতন্ত্র আমরা অবশ্যই চাইব কারণ গণতন্ত্র আমাদের দরকার। আমরা দেখিয়ে দেব যে শোষক শ্রেণী মুখে গণতন্ত্রের কথা বলে, কিন্তু তারা গণতন্ত্রবিরোধী। বড় বড় দলগুলোর কাণ্ডকারখানার দিকে তাকালেই এটা পরিষ্কার হবে। তাদের কপটতা ও গণতন্ত্রের মুখোশ খুলে দেওয়া আমাদের কাজ। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে মেনে নিতে আমাদের কোনো বাধা থাকার কথা নয়। কিন্তু গণতন্ত্র আমাদের কাছে শুধু ব্যক্তির মুক্তি নয়, বরং সমষ্টির হয়ে ওঠার প্রক্রিয়াও বটে। জনগণের ইচ্ছা ও সংকল্পের ওপর দাঁড়িয়ে সমষ্টির রাজনৈতিক, নৈতিক, আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বয়ান নির্মাণ ও তা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে নিপীড়িত শ্রেণী আন্তরিক। কিন্তু শোষক শ্রেণী নয়। অতএব ফ্যাসিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক লড়াই-সংগ্রাম করার অর্থ জনগণের ইচ্ছা ও সংকল্প যেন মূর্ত হয়ে উঠতে পারে সেই প্রক্রিয়াকে জোরদার করা। জনগণের ইচ্ছা ও সংকল্প প্রকাশ ও তা বাস্তবায়নের বহু পথ ও পদ্ধতি রয়েছে। শোষক শ্রেণীর ক্ষমতার বিরুদ্ধে গণ-অভ্যুত্থান জনগণের গণতান্ত্রিক ইচ্ছা ও সংকল্পের সবচেয়ে মূর্ত ও বাস্তব ও চরম বিকশিত মুহূর্ত। রাষ্ট্রবিজ্ঞান এই সত্য মানে, মানতে বাধ্য।
কার্ল মার্কসও গণতন্ত্র কায়েম করাকে নীতিগত প্রশ্ন আকারে গণ্য করেছিলেন। গণতন্ত্র কায়েম ও সমাজতান্ত্রিক রূপান্তরের মধ্যে ধারাবাহিকতার প্রশ্ন হচ্ছে শোষিত শ্রেণী অর্থাৎ শ্রমিক, কৃষক খেটে খাওয়া মানুষ ও গরিব জনগণ নিজেরা কতোটুকু রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত হতে সক্ষম হয়েছে এবং গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সমাজের সামষ্টিক স্বার্থ রক্ষা কারবার ক্ষেত্রে তারা কতোটা সংঘবদ্ধ ও সচেতন- সেই মাত্রায় ধারাবাহিকতা। তিনি সতর্ক করে দিতে ভোলেননি যে জনগণের ইচ্ছা সংকল্পের ওপর দাঁড়িয়ে যে গণতন্ত্র গড়ে ওঠে তার প্রাথমিক চরিত্র রাজনৈতিক। কিন্তু মানুষ বা ব্যক্তি মাত্রই একই সঙ্গে সমাজের সঙ্গে উৎপাদন সম্পর্কসহ নানান সম্পর্কে জড়িত, অতএব জনগণকে গণতান্ত্রিক শক্তিতে রূপান্তর করার অর্থ হচ্ছে জনগণ শুধু রাজনৈতিক ভাবে গণতন্ত্র পেয়ে খুশি থাকবে না, বরং সমাজের ধনি-গরিবের ব্যবধান, সম্পদের মালিকানা ও বণ্টন ব্যবস্থা, জীবন ও জীবিকার নানাবিধ প্রশ্ন ইত্যাদি সকল কিছুকেই গণতান্ত্রিক অধিকারের আওতায় আনবে। জনগণ কী মাত্রায় এই গণতান্ত্রিক অধিকারকে সম্প্রসারণ ও বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হবে তা নির্ভর করবে গণতান্ত্রিক আন্দোলন- সংগ্রামের মাত্রা বা তীব্রতার ওপর।
এই কিস্তিতে আমি ফ্যাসিবাদ নিয়ে কথা বলার প্রতিশ্রুতি দিয়েছি। সাধারণত শব্দটি গালি হিশাবে ব্যবহার করা হয়। ফলে এর রাজনৈতিক তাৎপর্য সাধারণ মানুষ ধরতে পারে না। বাংলাদেশে সাধারণত এই গালিটি আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে দেওয়া হয়। আওয়ামী বাকশালী আমল এবং ১৮৭৫ সাল শেখ মুজিবুর রহমানের নিহত হওয়া পর্যন্ত আমলকে অনেকে ফ্যাসিবাদী আমল বলে নিন্দা করে থাকেন। এই আমলে একদলীয় বাকশালী শাসন প্রতিষ্ঠা, নাগরিকদের বাক ও ব্যক্তিস্বাধীনতা হরণ, প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের নিমর্ম ভাবে হত্যা বিশেষত সিরাজ সিকদারকে হত্যা করার পর শেখ মুজিবুর রহমানের বজ্রকণ্ঠে আওয়াজ যে কোথায় সিরাজ সিকদার ইত্যাদি বাংলাদেশে ফ্যাসিবাদের মূর্ত রূপ হিশাবে এখনও প্রতিষ্ঠিত রয়েছে। শেখ মুজিবুর রহমান ও বাকশালী ব্যবস্থাকে ফ্যাসিবাদী বলার যথেষ্ট যুক্তি থাকতে পারে। বিশেষত এর মধ্যে বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও সমাজতন্ত্রের মিশাল হিটলারের নাৎসি পার্টির কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। এটাও সত্যি যে এই আমল জনগণের জন্য দুর্বিষহ হয়ে উঠেছিল এবং এই আমলের কারো দাগ আওয়ামী লীগ এখনো কাটিয়ে উঠতে পারে নি। তাছাড়া নৃতাত্ত্বিক জাতিগোষ্ঠির (ড়থধপ) সূত্র ধরে জাতীয়তাবাদী আত্মপরিচয় নির্মাণ ফ্যাসিবাদের একটি চরিত্র লক্ষণ। নৃতত্ত্ব-নির্ভর বাঙালি জাতীয়তাবাদী ধারণার সঙ্গে এখানেই ফ্যাসিবাদের ঘনিষ্ঠ মিল খুঁজে পাওয়া যায়।
কিন্তু আমরা এখনকার ফ্যাসিবাদকে শুধু আওয়ামী-বাকশালী চেহারা দিয়ে বুঝব না। নৃতাত্ত্বিক জাতিগোষ্ঠির ধারণা, জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র ইত্যাদি মিশাল দিয়ে যে ফ্যাসিবাদের বয়ান বাংলাদেশে জারি রয়েছে তার মর্ম মোটামুটি আমাদের জানা। কিন্তু আওয়ামী লীগের পতনের পর পরই ফ্যাসিবাদের পতন ঘটেছে এটা ঠিক নয়। তাছাড়া আমাদের ব্যাখ্যা করে বলতে হবে কেন ফ্যাসিবাদকে আমরা সাম্রাজ্যবাদের আগে বসাচ্ছি। অর্থাৎ বলছি ফ্যাসিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ। এখনকার ফ্যাসিবাদকে সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে আলাদা করে বিচার করা যায় না।
ফ্যাসিবাদ শব্দটির উৎপত্তি ইটালিতে। ফ্যাসিস্ট শাসক বেনিতো মুসোলিনির নাম এর সঙ্গে যুক্ত। এবং তার সঙ্গে যুক্ত এডল্ফ হিটলারের নাম। ফ্যাসিবাদ নিয়ে বিস্তর লেখালেখি হয়েছে। ফ্যাসিবাদী রাজনীতির চেহারাও নানান রকম। আমরা ইতিহাসের দিকে এখানে যাব না। বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে দুই একটি কথা বলব। বাংলাদেশে ফ্যাসিবাদের চেহারা শনাক্ত করতে পারা আমাদের জন্য বেশি জরুরি। ফ্যাসিবাদের চেহারা ইতিহাসে নানান ধরনের তার কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্যসূচক দিক আছে। ফ্যাসিজম নিয়ে ইন্টারনেটে খুঁজতে গিয়ে দেখতে পাচ্ছি যে বলা হচ্ছেঃ
One element shared by all fascist movements, racialist or not, is the apparent lack of consistent political principle behind the ideology- political opportunism in the most basic sense. One virtually unique aspect of fascism is its ruthless drive to attain and hold state power. On that road to power, fascists are willing to abandon any principle to adopt an issue more in vogue and more likely to gain converts.
যে কোন ফ্যাসিবাদী রাজনীতির মধ্যে, তারা নৃতাত্ত্বিক জাতিগোষ্ঠির কল্পনা করুক বা না করুক, একটা সাধারণ দিক আছে। সেটা হোল, কোন প্রকার সুসঙ্গত রাজনৈতিক নীতির অভাব। অর্থাৎ রাজনৈতিক সুবিধাবাদই এখানে প্রকট থাকে। ফ্যাসিবাদের বৈশিষ্ট্যপূর্ণ দিকগুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে, ক্ষমতায় যাওয়া ও ক্ষমতায় থাকার জন্য বেপরোয়া প্রবৃত্তি। ক্ষমতায় যাবার জন্য ফ্যাসিস্টরা যে কোন সময় তাদের রাজনৈতিক নীতি বিসর্জন দিতে পারে, এবং জনগণ যে সকল কথা শুনতে পছন্দ করে বা যে সব গণতুষ্টিকর কথাবার্তা জনগণের মধ্যে চালু থাকে তাকে ব্যবহার করে ফ্যাসিস্টরা তাদের পক্ষে জনমত তৈরি করে।
উদ্ধৃতিটি দুটো কারণে দিয়েছি। প্রথমে ক্ষমতায় যাওয়া ও থাকার জন্য বেপরোয়া মনোবৃত্তি। দ্বিতীয়ত কোন সুচিন্তিত রাজনীতি নয়, বরং সস্তা জনপ্রিয় শ্লোগানগুলোর ওপর আশ্রয় করে ফ্যাসিজম তার ক্ষমতার ভিত্তি তৈরি করে। এই কাজ শুধু আওয়ামী লীগ একা করে, সেটা মনে করার কোন কারণ নাই।
একনায়কতন্ত্রের সঙ্গে ফ্যাসিজমের চরিত্রগত পার্থক্য হচ্ছে একনায়কতন্ত্রের কোন জনপ্রিয় ভিত্তি থাকে না, এই ক্ষেত্রে বল প্রয়োগই যে ক্ষমতার ভিত্তি সেটা খুব নগ্নভাবেই জনগণ বোঝে। কিন্তু ফ্যাসিজম ভয়াবহ এই কারণে যে, ফ্যাসিবাদী রাজনীতি বা ফ্যাসিবাদী শাসক জনপ্রিয় হতে পারে। মুসোলিনি বা হিটলারের পক্ষে জনগণের বিপুল গণসমর্থন ছিল। সেই কারণে সস্তা ও চটুল রাজনৈতিক শ্লোগান দিয়ে বিপুল ভোটে নির্বাচিত হয়ে আসা গণতন্ত্রের লক্ষণ নয়, বরং ফ্যাসিবাদেরই বৈশিষ্ট্য।
সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে বাংলাদেশে ফ্যাসিবাদের যে চেহারা আমরা দেখছি তার প্রধান চরিত্র লক্ষণ হচ্ছে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের বয়ানের পক্ষে জনমত তৈরি করা, ইসলাম যে আসলেই একটি বর্বর, পশ্চাতপদ ও সন্ত্রাসবাদী ধর্ম সেটা সরবে বলা, বা নীরবে মেনে নেওয়া। এক সময় টুপি-দাড়িওয়ালা ছেলেবুড়ো মাত্রই যে সন্ত্রাসী এই ধারণার ব্যাপক চল হয়েছিল। এখন ইংরেজি শিক্ষিত ছেলে মেয়েরা মার্কিন জিন্স আর হাওয়াই শার্ট গায়ে দিয়ে যখন ইসলামি রাজনীতির পক্ষে দাঁড়াচ্ছে তখন টুপি-দাড়ি ও লম্বা কোর্তাওয়ালারা খানিক রেহাই পেয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কওমি মাদ্রাসাকে সন্ত্রাসের ঘাঁটি হিশেবে চিহ্নিত করে কওমি মাদ্রাসাকে ধ্বংস বা তাকে আমূল সংস্কার করবার যে পদক্ষেপ নিয়েছে সেই তাপে বাংলাদেশেও কওমি মাদ্রাসার বিরুদ্ধে প্রচারণা চলছে। এই প্রচারণা এখন ফ্যাসিবাদী রূপ পরিগ্রহণ করেছে। ওয়ার এগেইনস্ট টেররিজমের কাঠামোর মধ্যে সাম্রাজ্যবাদ বাংলাদেশে ফ্যাসিবাদের একটা বয়ান তৈরি করতে গিয়েই এই ফ্যাসিবাদ নির্মাণ করেছে। গণতান্ত্রিক লড়াই সংগ্রামের অর্থ হচ্ছে এই ফ্যাসিবাদী বয়ানের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো। যে সকল শ্রেণী, গোষ্ঠি, সুশীল সমাজ প্রতিষ্ঠান ও গণমাধ্যম চালাচ্ছে তাদের ফ্যাসিবাদী চরিত্রকে জনগণের সামনে উদাম করে দেওয়া।
যেভাবে আমরা ফ্যাসিবাদকে শনাক্ত করছি সেটা ফ্যাসিবাদের বয়ান ও প্রচার-প্রপাগান্ডার দিক। কিন্তু ফ্যাসিবাদকে আমরা সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে যুক্ত করার কারণ হচ্ছে বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থার সঙ্গে তার যোগ। সেই বিষয়টা খানিক ব্যাখ্যা করে বলতে হবে আগামী কিস্তিতে।
(চলবে)।
৭ জ্যৈষ্ঠ ১৪১৬, ২১ মে ২০০৯। শ্যামলী
ইমেইলঃ [email protected]
সূত্র: নয়া দিগন্ত, ২২-০৫-২০০৯