জেনারেল মইনের ছয় ঘোড়ার অশ্বমেধ যজ্ঞের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশকে গলাধঃকরণের যে প্রক্রিয়া দিল্লিতে আরম্ভ করা হয়েছিল সেই একই শহরে শেখ হাসিনাকে ইন্দিরা পদক প্রদান করে তার সফল সমাপ্তি টানা হলো। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তার ব্যক্তিগত কৃতজ্ঞতার ঋণ চুকাতে বাংলাদেশের মাটি ও মানুষকে ভারতের কাছে জিম্মি করে দিয়ে এসেছেন।
যে চেতনা নিয়ে বাংলাদেশে এক-এগারোর সৃষ্টি তারই ধারাবাহিকতা রক্ষা করেছেন এ দেশের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী। উপমহাদেশে ১৯৭৫ সালের সিকিম ট্র্যাজেডির পর স্বেচ্ছায় স্বাধীনতা বিকিয়ে দেয়ার ?্বিতীয় উদাহরণ সৃষ্টি করল মহাজোট সরকার। পার্থক্য শুধু এটুকু যে সিকিম আনুষ্ঠানিকভাবে ভারতের রাজ্যে পরিণত হয়েছে আর বাংলাদেশ তার পতাকাটি এখনো ধরে রেখেছে। বাংলাদেশের স্বার্থ বিবেচনায় প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর সফল না হলেও এক-এগারোর চেতনা বাস্তবায়নে এ সফর অবশ্যই শতভাগ সফল হয়েছে। গত তিন বছরে এক-এগারোর পক্ষে-বিপক্ষে কলম চালাননি এমন কলামিস্ট এ দেশে সম্ভবত খুঁজে পাওয়া যাবে না। এই কলামিস্টদের মধ্যে সুশীল (?) সমাজভুক্ত শতভাগ, আওয়ামী লীগ সমর্থক বেশির ভাগ এবং বিএনপি সমর্থকদের উল্লেখযোগ্য অংশ এক-এগারোর প্রাথমিক অবস্থায় জেনারেল মইন নিয়ন্ত্রিত সরকারকে জোর সমর্থন জানিয়েছিলেন। বাঙালি মুসলমানের ভোল পাল্টানোতে জুড়ি নেই। এদের মধ্যে অনেকেই এখন ভোল পাল্টে বিপ্লবী সেজেছেন। মইনের সাথে সুসম্পর্ক ছিল এমন একজন দেশের প্রখ্যাত কলামিস্টকে সে দিন টেলিভিশনে দাবি করতে শুনলাম, কেবল তিনিই নাকি জরুরি সরকারের অবৈধ কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করার হিম্মত দেখিয়েছিলেন। হতেও পারে । সব সংবাদপত্রের সব লেখা তো আর পড়া হয়ে ওঠে না। তবে টেলিভিশনের টকশোতে যে এই বর্ষীয়ান সাংবাদিককে মইন-ফখরুদ্দীন সরকারের পক্ষাবলম্বন করতে শুনেছি সেটি বিলক্ষণ স্মরণে আছে। মোদ্দা কথা, এক-এগারো নিয়ে অনেক বিশ্লেষণ হয়েছে যার মধ্যে আমারও লেখালেখি ছিল। বলতে গেলে সংবাদপত্র জগতে আমার আগমনই এক-এগারোকে কেন্দ্র করে। এ কারণেই বরেণ্য আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক-উল হক কৌতুক করে প্রায়ই বলে থাকেন, এক-এগারো একজন সিরামিক ব্যবসায়ীকে কলামিস্ট বানিয়েছে। যা হোক, মইন-মাসুদের অ্যাডভেঞ্চারের সাথে ইঙ্গ-মার্কিন-ভারতীয় সংযোগের কথা সাক্ষ্যপ্রমাণসহকারে বহুবার লিখেছি। সেই পুরনো প্রসঙ্গ বাদ দিয়ে আজকের লেখায় এক-এগারোর উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যের পরিপ্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর নিয়ে নিজের অভিমত প্রকাশ করাটা জরুরি বিবেচনা করছি। জরুরি সরকারের দুই বছর এবং মহাজোট সরকারের এক বছরের শাসন পদ্ধতি পর্যালোচনা করে আমার কাছে মনে হচ্ছে, ওই ঘটনার উদ্দেশ্যই ছিল বাংলাদেশকে একটি ভঙ্গুর রাষ্ট্রে পরিণত করে ক্রমান্বয়ে সীমান্তবিহীন ভূখণ্ডের দিকে এগিয়ে যাওয়া। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকে ভারতের শাসকশ্রেণীর অবিভক্ত ভারত পুনর্নির্মাণের যে স্বপ্ন সেটি বাস্তবায়নে এক-এগারো নিঃসন্দেহে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারত সফরকালে যে যৌথ বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেছেন তার মাধ্যমে এক-এগারোর ‘অর্জন’কে প্রসারিত করে বাংলাদেশকে প্রকৃতপক্ষে ভারতের একটি আশ্রিত রাষ্ট্রে পরিণত করা হয়েছে। ২০০৮ সালের নির্বাচনী প্রচারণায় এ দেশের নবীন প্রজন্মকে দিন বদল আর ডিজিটাল বাংলাদেশের ্লোগানে বিমোহিত করা হয়েছিল। এক বছরের মধ্যে বাংলাদেশকে একটি পতাকাসর্বস্ব স্বাধীন দেশে রূপান্তরিত করার আসল এজেন্ডাটি লুকিয়ে রাখা হয়েছিল চাকচিক্যময় কথার মোড়কে। এ বিষয়ে পরে আসছি। আগে তিন বছরে রাষ্ট্রের স্তম্ভগুলোকে কেমন করে ভেঙে ফেলা হয়েছে সেই আলোচনা শেষ করি।
এক-এগারোর পয়লা শিকার অবশ্যই দেশের প্রতিরক্ষাব্যবস্থা। আমরা সংবাদমাধ্যমের সাথে জড়িতরা নানা দিক থেকে এখন যেসব খবর পাচ্ছি তাতে ধারণা করছি সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে রাজনীতিবিদবিরোধী একপ্রকার মগজ ধোলাই প্রক্রিয়া দীর্ঘদিন ধরে চলমান ছিল। এর ফলেই মইন-মাসুদ চক্র ক্ষমতা দখল করার পর দেশের রাজনীতিকে পরিশুদ্ধ করার ধুয়া তুললে সেটা সামরিক বাহিনীতে তাৎক্ষণিক গ্রহণযোগ্যতা লাভ করেছিল। রাজনীতি পরিশুদ্ধ করার নামে এক-এগারো জান্তার প্রকৃত লক্ষ্যই যে ছিল দেশের জাতীয়তাবাদী শক্তিকে নির্মূল করে বিদেশী তাঁবেদারদের ক্ষমতায় বসানো এটা ক্রমাগত মগজ ধোলাইয়ের শিকার সেনাবাহিনীর দেশপ্রেমিক অংশের পক্ষে বোঝা সম্ভব হয়নি। পরে টাস্কফোর্স গঠনের নামে অপেক্ষাকৃত নবীন সেনাকর্মকর্তাদের দুর্নীতিতে জড়িত হওয়ার সুযোগ করে দিয়ে তাদের নৈতিকতাকে নিঃশেষ করা হয়েছে। মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি অনুযায়ী নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকালীন সেনাবাহিনীর সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের কাছে তাই আত্মরক্ষার প্রবণতাই প্রবল হয়ে উঠেছিল। মার্কিন-ভারত লবির কাছে অধিকতর পছন্দনীয় শেখ হাসিনা এবং তার দল আওয়ামী লীগ এক-এগারোর ঊষালগ্ন থেকেই সামরিক জান্তার পক্ষাবলম্বন করে তাদের সব অপকর্মের বৈধতা দানের আগাম প্রতিশ্রুতি প্রদান করে। অপর দিকে দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে বেগম খালেদা জিয়ার আদর্শিক অবস্থান গ্রহণের কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী গোষ্ঠী তার প্রতি ক্রমশ বিরূপ মনোভাবাপন্ন হয়ে উঠেছিল। ভারতীয় সম্প্রসারণবাদী শক্তির কাছে বাংলাদেশকে করায়ত্ত করার এর চেয়ে মোক্ষম সুযোগ স্বাধীনতার পর থেকে আর উপস্থিত হয়নি। সে দেশের শাসকগোষ্ঠী কোনো রকম রাখঢাক না করে প্রকাশ্যে জেনারেল মইনকে তাদের নিজস্ব লোক হিসেবে ঘোষণা দেয়। ভারতে আমন্ত্রণ জানিয়ে তাকে রীতিমতো রাষ্ট্র্রপ্রধানের সমতুল্য মর্যাদা দেয়া হয়। উপহারস্বরূপ ছয় ঘোড়া প্রদানের মাধ্যমে আধুনিককালের অশ্বমেধ যজ্ঞের আয়োজনও করা হয়েছিল যথেষ্ট জাঁকজমক করেই। সেনাবাহিনীর দেশপ্রেমিক অংশ এক সময় তাদের পর্বতসমান ভুল বুঝতে পারলেও তত দিনে বড়ই বিলম্ব ঘটে গেছে। এক দিকে মহাপ্রতাপশালী, আণবিক শক্তিধর ভারতভীতি, অন্য দিকে জাতিসঙ্ঘের শান্তি মিশনে চাকরি করে বিশাল অঙ্কের ডলার আয়ের লোভনীয় হাতছানি। এরপর মহাজোটের নেতৃত্বে একদলীয় সংসদ নির্মাণের মহৎ মিশন বাস্তবায়নকল্পে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ঝাঁপিয়ে পড়তে সেনাবাহিনীকে সম্ভবত আর কোনো ?্বিধা-দ্বন্দ্বে ভুগতে হয়নি। সৈনিকতা ও পেশাদারিত্বের যতটুকু অবশিষ্ট ছিল তার সমাপ্তি ঘটেছিল সে দিনই। তারপর ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি, ২০০৯ অপারেশন পিলখানা। মাত্র চব্বিশ ঘণ্টার ব্যবধানে সরকারের চোখের সামনে ৫৭ জন সেনাকর্মকর্তাকে হত্যা করা হলো। একসাথে ধ্বংস হলো আমাদের প্রতিরক্ষার প্রথম ও ?্বিতীয় বূøহ। বিডিআর হত্যাকাণ্ডের ফল হলো, সেনাবাহিনী হীনবল এবং বিডিআর আক্ষরিক অর্থেই নিশ্চিহ্ন। শত্রু দেশের একজন সৈন্যক্ষয় ব্যতিরেকেই ১৫ কোটি জনসংখ্যার একটি রাষ্ট্রের প্রতিরক্ষাব্যবস্থার মূলোৎপাটনের এই কাহিনী ভবিষ্যতে হয়তো বিভিন্ন দেশের রণকৌশল নির্ধারণে সহায়তা করবে। দুর্নীতির মূলোৎপাটনের গল্প ফেঁদে সেনাপতি মইন বাংলাদেশের নিরাপত্তা ব্যবস্থার সফল মূলোৎপাটন সম্পন্ন করেছেন। এমন সেবাদানের পর ইসলামবিরোধী সাম্রাজ্যবাদী ও আধিপত্যবাদী গোষ্ঠী জেনারেল মইনকে কি আর পুরস্কৃত না করে পারে?
জরুরি সরকারের পরবর্তী লক্ষ্য ছিল সমগ্র বিচারব্যবস্থাকে ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর আজ্ঞাবহে পরিণত করা। তারা কেবল যে বিশেষ আদালতের নামে সংসদ ভবনে ক্যাঙ্গারু কোর্ট বসিয়েছিল তাই নয়, উচ্চ আদালতেও প্রভাব বিস্তার করা থেকে বিরত থাকেনি। উচ্চ আদালতে জামিন স্থগিত করার যে বিস্ময়কর রেওয়াজ সাম্প্রতিক সময়ে এ দেশে চালু হয়েছে তার জন্য বেসামরিক লেবাসের সামরিক সরকার শতভাগ দায়ী। হাইকোর্ট জামিন দেয়ার পর চেম্বার জজ কর্তৃক সেই জামিন স্থগিত করার যে পদ্ধতি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে জুলুমকে বৈধতা দেয়ায় প্রসিদ্ধি লাভ করেছিল, দুর্ভাগ্যজনকভাবে নির্বাচিত সরকার সেটা আরো পাকাপোক্ত করেছে। ক’দিন আগেই চেম্বার জজ কার্যক্রমের অসহায় শিকারে পরিণত হয়ে শ্রমিকনেতা বাকির হোসেনকে প্রায় বিনা চিকিৎসায়, অমানবিক পরিস্থিতিতে পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে হয়েছে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০০৮ সালের ১২ মার্চ হাইকোর্ট বিভাগ বি এম বাকির হোসেন, পঙ্কজ দেবনাথ ও চৌধুরী আলমের বিরুদ্ধে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের দায়ের করা মামলাকে অবৈধ ও বেআইনি ঘোষণা করে রায় প্রদান করে। ওই রায় ঘোষণার পর সরকার আপিল করলে চেম্বার জজ হাইকোর্টের রায়কে স্থগিত করে দেন। পরে ২০০৮ সালের ২ ডিসেম্বর আপিল বিভাগ পঙ্কজ দেবনাথের জামিনের ওপর স্থগিতাদেশকে বাতিল করলে তিনি মুক্তি পান। চৌধুরী আলমের বিরুদ্ধে মামলা চালাতে সরকার উচ্চ আদালতের কাছে অনীহা প্রকাশ করলে তিনিও মুক্ত জীবনে ফিরে আসেন। আটক থাকেন কেবল বাকির হোসেন যাকে শেষ পর্যন্ত বন্দী অবস্থাতেই মৃত্যুবরণ করতে হয়। বাংলাদেশের সব নাগরিকের আইনের আশ্রয় সমভাবে লাভ করার অধিকার সংবিধান প্রদত্ত হলেও বাস্তব ক্ষেত্রে আইনের ভিন্ন প্রয়োগের জ্বলন্ত উদাহরণ হয়ে থাকবেন মরহুম বাকির হোসেন। এ দিকে হাইকোর্টের বেঞ্চ গঠন নিয়েও নানা বিতর্ক রয়েছে। এ প্রসঙ্গে প্রখ্যাত আইনজীবী ড. জহির মন্তব্য করতে গিয়ে বলেছেন, বেঞ্চ গঠনের নামে হাইকোর্টে সুনামি চালানো হয়েছে। বেঞ্চ গঠন করা নিয়ে সিনিয়র আইনজীবীদের প্রতিবাদের পরিপ্রেক্ষিতে প্রধান বিচারপতি স্বয়ং বেঞ্চ গঠনে ত্রুটির কথা বলেছেন। আর নিু আদালতের কথা যত কম বলা যায় ততই ভালো। আমার দেশ পত্রিকায় একটি সংবাদ ছাপানোকে কেন্দ্র করে একুশটি জেলায় এ কলামের লেখকের বিরুদ্ধেই ২৫টি মামলা হয়েছে। এক অভিযোগে একাধিক ফৌজদারি মামলা দায়ের সংবিধানে নিষিদ্ধ হলেও কক্সবাজার জেলা ছাড়া সব জেলায় নিু আদালতের ম্যাজিস্ট্রেটরা সব মামলা আমলে নিয়ে সমন জারি করেছেন। মাগুরা জেলা ম্যাজিস্ট্রেট সমনের পরিবর্তে গ্রেফতারি পরোয়ানা এবং কুমিল্লা জেলা ম্যাজিস্ট্রেট একাই তিনটি মামলা গ্রহণ করে বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থায় রীতিমতো ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন। বলাই বাহুল্য, ২৫টি মামলার কোনোটিতেই প্রকৃত সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি মামলা দায়ের করেননি। দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী যেকোনো বিবেচনায় প্রতিটি মামলাই খারিজযোগ্য হলেও একমাত্র কক্সবাজার জেলার ম্যাজিস্ট্রেট ছাড়া অন্য কেউ ইনসাফ করার সাহসটুকু সঞ্চয় করে উঠতে পারেননি।
বাংলাদেশের সার্বিক চিত্রটি একবার দেখার চেষ্টা করা যাক। আমাদের প্রতিরক্ষাব্যবস্থা বলতে আর কিছু অবশিষ্ট নেই সেটি লেখার প্রারম্ভেই বলেছি। রাষ্ট্রের তিনটি স্তম্ভের কথা রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা প্রায়ই বলে থাকেন। সংসদ বর্তমানে একদলীয় সংসদ সদস্যদের খোশগল্প এবং বিরোধীদের গাল-মন্দ করার স্থানে পরিণত হওয়ায় চূড়ান্ত অকার্যকর রূপ পরিগ্রহ করেছে। বিচারব্যবস্থাকে স্বাধীনতা প্রদানের অন্তরালে প্রকৃতপক্ষে পাকাপোক্তভাবে ক্ষমতাসীনদের আজ্ঞাবহে পরিণত করা হয়েছে। আদালতকে কুক্ষিগত করার মাধ্যমে ফ্যাসিবাদী শাসনব্যবস্থা চাপিয়ে দেয়ার যে নজির জেনারেল মইন সাফল্যের সাথে স্থাপন করেছিলেন, নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাকেই সোৎসাহে অনুসরণ করছেন। সর্বশেষ স্তম্ভ অর্থাৎ প্রশাসনে দলীয়করণ সর্বকালের রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। সচিবালয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্থানে পদায়ন অথবা পদোন্নতি বর্তমানে দলীয় অথবা ধর্মীয় পরিচয়ের ওপর সর্বতোভাবে নির্ভরশীল। রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ হিসেবে পরিচিত সংবাদমাধ্যমের প্রতি বর্তমান সরকারের অসহিষষ্ণুতা জরুরি সরকারকে অতিক্রম করেছে। নির্বাচনী ইশতেহারে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি দানকারী মহাজোট এখন বিভিন্ন উপায়ে ইলেকট্রনিক এবং প্রিন্ট মিডিয়া নিয়ন্ত্রণের অপচেষ্টায় রত। সব মিলে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটি একেবারেই নড়বড়ে প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। এক-এগারো আয়োজনের সাম্রাজ্যবাদী এবং আঞ্চলিক পরাশক্তির লক্ষ্য শতভাগ অর্জিত হওয়ার পর শেখ হাসিনা যে তাদের ঋণ শোধের জন্য ব্যগ্র হয়ে উঠবেন এমন আশঙ্কার কথা গত এক বছরে বিভিন্ন লেখায় অন্তত ডজনখানেক বার জানান দিয়েছি। তাতে এ দেশের জনগণের সুখনিদ্রায় কোনো ব্যাঘাত ঘটেছে এমনটি ধারণা করার কোনো কারণ নেই। ষাট, সত্তর ও আশির দশকে বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে যে স্বাধীনতার স্পৃহা এবং আত্মসম্মানবোধ জাগরূক ছিল বিশ্বায়নের হাতছানিতে তা এখন অনেকাংশেই হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার ১৯৯৬ সালে ভারতের কাছে দাসখত লিখে দেয়ার সমতুল্য পঞ্চাশ দফা সংবলিত কোনো সমঝোতা স্মারক সই করার সাহস করে উঠতে পারেনি। এবার প্রধানমন্ত্রী কেবল যৌথ ইশতেহারে সই করেই নিবৃত্ত থাকেননি, ভারতকে ট্রানজিট দেয়ার বিষয়টি দিল্লিতে বসেই জোর গলায় ঘোষণা দিয়ে এসেছেন এবং ঢাকায় ফিরে দলীয় নেতাকর্মীদের প্রদত্ত সংবর্ধনা হাসিমুখে গ্রহণও করেছেন। ১৯৯৬ সালে তিনি এভাবে দেশের স্বার্থ বিকিয়ে দিয়ে ফিরলে নিশ্চিতভাবে ওই দিনই বিরোধী দল হরতালের ঘোষণা দিত এবং ফুলের পাপড়ির পরিবর্তে তাকে রক্তে রঞ্জিত রাজপথ পেরিয়ে বিমানবন্দর থেকে সরকারি বাসভবন যমুনায় ফিরতে হতো। এক-এগারোতে আমাদের সার্বভৌমত্ব লুণ্ঠিত হয়েছে। আর প্রধানমন্ত্রীর ঢাকঢোল পেটানো সাম্প্রতিক ভারত সফর বাংলাদেশের স্বাধীন অস্তিত্বকেই প্রশ্নের মুখে ঠেলে দিয়েছে।
বর্তমান সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকেই বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে একপ্রকার রহস্য দানা বেঁধে উঠেছে। এ সময়ের মধ্যে আমাদের জনশক্তির বৃহত্তম বাজার ইসলামিক রাষ্ট্রগুলোর সাথে সম্পর্কে এক শীতল আবহ তৈরি হয়েছে। তার ফলও হাতেনাতে পাওয়া গেছে। গত এক বছরে আমাদের জনশক্তি রফতানিতে যে ধস নেমেছে তা আগে কখনো দেখা যায়নি। প্রতীয়মান হচ্ছে, বর্তমান নীতিনির্ধারকরা সম্পূর্ণভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ভারতের দয়া-দাক্ষিণ্যের ওপর নির্ভরশীল হতেই অধিকতর স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছেন। এ সময়ের মধ্যে পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি একাধিকবার ভারত সফরকালে দেশবাসীকে সম্পূর্ণ অন্ধকারে রেখে আঞ্চলিক বৃহৎ শক্তির সাথে যেসব অস্বচ্ছ গোপন চুক্তি সম্পাদন করে এসেছেন তারই অবধারিত পরিণতি শেখ হাসিনা-মনমোহন সিং যৌথ ইশতেহার।
বাংলাদেশের জনগণ যদি তাদের স্বাধীন সত্তা পরিত্যাগ করে আঞ্চলিক পরাশক্তির আশ্রিত রাজ্যের অধিবাসীতে পরিণত হতে না চান তাহলে এই ইশতেহারকে প্রত্যাখ্যান করে গণ আন্দোলন গড়ে তোলার কোনো বিকল্প নেই। দীর্ঘ দিনব্যাপী সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের ফলে এ দেশের জনগণের উল্লেখযোগ্য অংশ ভারতের প্রতি নতজানু মনোভাব পোষণ করলেও সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী এখনো স্বাধীন থাকতে চান বলেই আমার বিশ্বাস। জাতীয় নেতৃত্বের দেশপ্রেমিক অংশ একতাবদ্ধ হয়ে দেশ রক্ষার ডাক দিলে দিন বদলের ছদ্মবেশে বর্তমান সরকারের সীমানা ও পতাকা বদলের এ অপচেষ্টা ইনশাআল্লাহ রুখে দেয়া সম্ভব হবে। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সশস্ত্র মুক্তিসংগ্রাম পরিচালনা এবং অযুত প্রাণের বিনিময়ে প্রাপ্ত স্বাধীনতা আজ বিনা প্রতিরোধে ভারতের পায়ে বিসর্জন দিলে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের অগণিত শহীদের আত্মা আমাদের ক্ষমা করবে না।
লেখকঃ সাবেক জ্বালানি ও খনিজসম্পদ উপদেষ্টা এবং বিনিয়োগ বোর্ডের সাবেক নির্বাহী চেয়ারম্যান ।
Click This Link
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে জানুয়ারি, ২০১০ বিকাল ৪:৩৪