কোথায় যাচ্ছি বা কোথায় যাবো জানিনা আমি। শুধু মনে পড়ে সেই মধ্য দুপুরে রৌদ্রতপ্ত রাস্তায় খুব দ্রুত হাঁটছিলাম হন হন। রাস্তা প্রায় জনশূন্যই ছিলো। দু'একজন হকার বা পান বিড়িওয়ালা ঝিমাচ্ছিলো গাছের ছায়ায়। রাস্তায় একটা দুটো গাড়ি দেখা যাচ্ছিলো। সেই উন্মাদনা বা অস্থির সময়ের স্মৃতিটুকু মনে করলেও আজও আমার পায়ের নীচে স্পর্শ পাই রৌদ্রতপ্ত রাজপথে আমার পায়ের নীচে ফুটতে থাকা ফুটপাতের ছোট ছোট ইটের টুকরো, বালি বা পাথরের। হয়তো খালি পায়ে হাঁটার অনভ্যাসে বা সেই সময় সকল সিদ্ধান্থীনতাময় অস্থিরতায় সেই কোমল কঠিন পায়ের তালু এবং রুক্ষ কঠোর রাজপথের ধুলোবালিময় ফুটতে থাকা স্মৃতিটাই আমাকে বিদ্ধ করে রাখে।
যাইহোক ধানমন্ডি ১৪ বা এখন যা ধানমন্ডি ৭ বলে পরিচিত তার মোড়েই ছিলো হাশেমচাচার ডিসপেনসারী। এই হাশেমচাচা আমাদের বিশেষ পরিচিত ছিলেন। অনেকদিন ধরে মানে এই বাড়িতে আসার পর থেকেই উনার সাথে জানাশোনা। জানাশোনা বলতে যে কোনো জ্বরজারি, মাথাধরার ঔষধ বা ছোটখাটো কাজে নার্স, কম্পাউন্ডার, গজ ব্যান্ডেজ এসব উনিই সরবরাহ করেছেন আমাদেরকে। বলতে গেলে উনি আমাদের দুঃসময়ের অগত্যার গতি। তো আজও আমার এই চরম দুঃসময়ে উনার ডিসপেনসারীর সামনে এসে নিজের অজান্তেই বুঝি থমকে দাঁড়ালাম আমি।
ভেতরে পা দিতেই হাশেমচাচা এই ভর দুপুরে আমাকে দেখে খুব অবাক হলেন। কিছুক্ষন হা করে দাঁড়িয়ে থেকে হই হই করে জানতে চাইলেন। কি হয়েছে? হঠাৎ এই অসময়ে? ব্যাপার কি? বাড়ির কারও কোনো বিপদ? আমি কিছুই বলতে পারছিলাম না, শুধুই হাঁপাচ্ছিলাম। উনি আমাকে বসতে বললেন। আমি ধপ করে সামনের চেয়ারে বসে পড়লাম। ডিসপেনসারীতে কি এক অদ্ভূত শীতলতা। মেঝেটা কি আরামদায়ক শীতল! মাথার উপরে ফ্যান ঘুরছে বন বন। আমি দম নিলাম। বুক ভরে শ্বাস টেনে নিলাম। আমার ধুলিমাখা পদতল এতক্ষনে শীতল মেঝের স্পর্শে একটু বুঝি আরাম পেলো।
সামনে টেবিলের উপরে এক কোনে রাখা টি এন্টি ফোনের দিকে চোখ গেলো আমার। কালো কুঁচকুচে ফোনটার গোল গোল ডায়ালের শেষ গোল্লায় ছোট্ট একটা লাল রং তালা দিয়ে ফোনটা লক করে রাখা। আমি কোনো ভদ্রতার বালাই না করে বললাম, চাচা আমি আপনার ফোন থেকে একটা ফোন করতে চাই। হাশেম চাচা কিছু না বলে সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন আমার দিকে। আমি বললাম, আমার অনেক বিপদ। উনি কিছু মুহুর্ত কিছু একটা ভাবলেন হয়তো। আমার নতুন বাবা বা তার মায়ের সাথে তার পরিচিতি বা সখ্যতা এবং এই আমি যে আমার নিজের বিপদে তার থেকে সাহায্য চাইছি এতে আবার তার নিজেরই কোন বিপদ আসে এসবই ভাবছিলেন বোধ হয়। তবুও তিনি আমার দিকে চেয়ে সাত পাঁচ কি যেন ভেবে আমাকে ফোনের তালাটা খুলে দিলেন।
আমি পকেট থেকে ছোট্ট কাগজে লুকিয়ে রাখা দোলনদের বাড়ির নাম্বার বের করে আনলাম। খুব তড়িঘড়ি হাতে সেই আগের আমলের ফোনের ডায়ালে আঙ্গুল ঘুরাতে লাগলাম। ছোট্ট তালার খোলা কড়াটা হা করে খোলা পড়ে রইলো পাশে। বুকের ভেতরের হাঁপরের শব্দ। হাত কাপছে। অবশ স্থবির আঙ্গুল চলতে চায়না যেন। মনে ভয় দোলনদের বাসায় ফোনটা কে ধরবে? সে কি একটু ডেকে দেবে দোলনকে? ওর বৌদি ধরলে তো কখনও উনি ডাকবেন না। যদি ওর দাদা ফোনটা রিসিভ করে কিংবা সেই সাদাচুলের ভয়ংকর পিসীমা? কি বলবো তখন আমি? কি করবো আমি তখন.....
কিন্তু আমার ভাবনা সব মিথ্যে করে দিয়ে ফোনটা ধরলো ওদের বাড়ির বুড়োমত একজন কাজের লোক। যাকে আমি কখনও দেখিনি কিন্তু তার কথা অনেক শুনেছি আমি দোলনের কাছে। উনি যোগেনদা। বহু বছর ধরেই ওদের বাড়িতে আর উনার আরেকটি পরিচয় উনি বাংলাদেশের বরিশালের মানুষ নাকি মানে উনাদের আদি আবাসভূমি এই বাংলাদশেই ছিলো। আমি বললাম, যোগেনদা, আমি বাংলাদেশ থেকে বলছি। আমার খুব বিপদ। দোলনকে একটু ডেকে দেন প্লিজ। আমার খুব সাংঘাতিক দরকার ওকে। জানিনা আমার আঁকুতিতে কি ছিলো, যোগেনদা দু সেকেন্ড চুপ থেকে তারপর বললেন, আচ্ছা ধরো, ডেকে দিচ্ছি আমি দোলনকে।
দোলন ফোনটা ধরতেই, ফুঁপিয়ে উঠলাম আমি। তড়িঘড়ি বললাম দোলন, দোলন আমার খুব বিপদ। আমাকে ওরা আটকে রেখেছে। আর কখনও যেতে দেবেনা তোমার কাছে। বলেছে আমার বাড়ি থেকে বের হওয়াও নিষেধ। তড়িঘড়ি হাউমাউ এসব বলার পরেও দোলন আমার কথা কিছুই বুঝতে পারছিলোনা। আমার ক্রমাগত হেঁচকি আর ফোঁপানীতে সব কথা অস্পস্ট জড়িয়ে যাচ্ছিলো। দোলন উদ্বিঘ্ন হয়ে উঠলো। অস্থির হয়ে জানতে চাইলো, কি হয়েছে? কি বিপদ? শান্ত হও। আমাকে ঠিক ঠাক স্পষ্ট করে খুলে বলো। আমি কিছুতেই বলতে পারছিলাম না। এ ক'দিনের চেপে রাখা কান্না, বুকের ভেতরের জমাট বেদনা দোলনের কন্ঠস্বর শোনার সাথে সাথে গলে জল হয়ে বাঁধ ভাঙ্গা বন্যার মত বেরিয়ে এসেছিলো। হাউমাউ কাঁদছিলাম আমি। হাশেমচাচা হা করে তাকিয়ে আমার কথা শুনছিলেন। এরপর উনি হঠাৎ উঠে গিয়ে কোথা থেকে যেন আমাকে এক গ্লাস পানি এনে দিলেন। পানি খেয়ে শান্ত হয়ে আমি দোলনকে সব খুলে বললাম,
আমাকে মিথ্যে বলে ডেকে আনা হয়েছে। আমার মায়ের অসুস্থতা বা বাড়ির কোনো বিপদ আপদই নয় আসলে আমিই ছিলাম তাদের বিপদের কারন। কারন ভীনদেশে, ভীন সংস্কৃতি, ধর্ম বা জাঁতের বিভেদীয় সম্পর্ক দোলনের বৌদি যেমনই মানতে পারেননি তেমনই মানতে পারেনি আমার নতুন বাবাসহ আমার নিজের মা ও তার পরিবার। তাদের সবচাইতে বড় ক্ষোভ বা ইগো বা রাগের কারণ যাই বলা হোক না কেনো সেটা হলো, কেনো তাদেরকে দোলনের বৌদি থেকে শুনতে হলো তাদের বাড়ির মেয়ে ওদের বাড়ির ছেলেকে নষ্ট করে ফেলেছে। দোলনের বাড়িতে এই সম্পর্কের পরিনতি কি পরিমাণ অশান্তি বা অশুভতার জন্ম দেবে তা ভেবেই এমনই উনারা অস্থির হয়ে উঠেছেন যে জানিয়েছেন যেন তাদের মেয়েকে তারা সামলান সে ব্যাপারে অনুরোধও করেছেন। যে কোনো মূল্যে এই পথ থেকে আমাকে সরাতেই হবে অন্যথা পরিমান ভালো হবে না। বৌদি থেকে এসব শোনার পরে আমার ইগোইস্টিক মা বা নতুন বাবার সন্মান ধুলোয় মিশে গেছে। তারা এখন যে কোনো পরিস্থিতিতেই এই পরিস্থিতি মোকাবেলায় বদ্ধ পরিকর। কাজেই আমাকে আর কখনও ফিরে যেতে দেওয়া হবে না ........ আর কখনও দেখা হতে দেওয়া হবে না দোলনের সাথে....
সব শুনে দোলন চুপ করে রইলো!
আমি বললাম,
-দোলন এখন একটাই পথ....
দোলন বললো,
-কি!
আমি নিশ্চিন্ত নির্ভরতায় বললাম,
- তুমি চলে আসো....
দোলন বললো,
- কোথায়?
আমি অবাক হয়ে বললাম,
- কোথায় আবার! বাংলাদেশে!
আমাকে আরও আরও অবাক করে দিয়ে দোলন বললো,
- পাগল নাকি? আমি কি করে এখন বাংলাদেশে যাবো! সেখানে কিছু জানিনা, চিনিনা.....
আমি স্তম্ভিত হয়ে গেলাম! আমার বাকরুদ্ধ হয়ে গেলো! আমি আর কিছুই বলতে পারছিলাম না। নিশ্চুপ শুনে গেলাম- দোলন বলে চলেছে-
- এইভাবে হুট করে কিভাবে যাবো আমি! তাছাড়া বাংলাদেশ সম্পর্কে তেমন জানিওনা। কোথায় উঠবো, কি করবো কিছুই জানিনা। বাংলাদেশে আমাদের তেমন কোনো আত্মীয়ও নেই। এখানে যা কিছু হত যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবেলার ক্ষমতা ছিলো আমার। এখন তো হুট করে কোনোভাবেই ডিসিশন নেওয়া ঠিক হবেনা। আমাকে সব ব্যাবস্থা করতে হবে। ধৈর্য্য ধরতে হবে....... শান্ত থাকতে হবে.......হুট করে বাংলাদেশে চলে যাওয়া সম্ভব না.....কিছুতেই না..... কোনোভাবেই না.......
আমার হাত থেকে রিসিভার পড়ে গেলো। টেবিলের পাশ ঘেষে পেঁচানো তারের মাথায় ঝুলতে থাকা রিসিভার হতে তখনও ভেসে আসছে দোলনের অস্থির কন্ঠস্বর- হেলো হেলো, কথা বলছোনা কেনো? শুনতে পাচ্ছো? শুনতে পাচ্ছো তুমি.....
আমার ঝাঁপসা হয়ে আসা চোখে দেখলাম হাশেমচাচা রিসিভারটা তুলে ক্রাডলের যথাস্থানে রেখে দিয়ে সেই ছোট্ট লাল রঙ্গের তালাটার কড়াটা ফোনের ডায়ালের শেষ গোল্লাটায় টিপ দিয়ে লাগিয়ে চাবিটা খুলে পকেটে রাখলেন। তারপর আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন, বললেন,
- ধৈর্য্য ধরো মা। শান্ত হও। পৃথিবীতে বেঁচে থাকা বড় কঠিন। যত বড় বিপদই হোক, অস্থির হইতে নাই। চলো তোমাকে বাড়িতে দিয়া আসি।
বাড়ি?
কোথায় আমার বাড়ি?
কোথায় আমার ঘর?
ঝাঁপসা চোখে বুঝি এসবই ভাবছিলাম আমি। আজ এতগুলো দিন পরেও সেসব যখন ভাবি আমার বুক ভেঙ্গে আসে। চোখ দিয়ে অনর্গল পানি ঝরতে থাকে। হাসিও পায়, কি বোকাটাই না ছিলাম আমি সেসব দিনে। নিজেকে মনে হয় বন্দী রাজকন্যা বা স্লিপিং বিউটির কোনো রাজকুমারীই ভেবেছিলাম যার অনেক দুঃখ বা বিপদে কোনো না কোনো অচিনদেশের রাজকুমার ঠিকঠিকই ঘোড়া ছুটিয়ে এসে যায় একদিন। বন জঙ্গল পাহাড়, পর্বত সাত সমুদ্দুর কোনো বাঁধাই বাঁধা থাকে না তাদের কাছে। রাজকুমারীর শত সহস্র বিপদেও তাকে রক্ষার যাদুকরী ক্ষমতা তো থাকে সেই রাজকুমারের হাতেই।
সে যাইহোক, এরপর পড়ে থাকে শুধুই দীর্ঘশ্বাস.....
কৈশোরোত্তীর্ণ সেই বয়সের সেই উথাল পাথাল কিচ্ছুটি না ভেবে বা জেনে বা বুঝে ঝুপ করে প্রেমে পড়ে যাওয়াটা বা সোজা কথা আগুনে বা অতল জলে ঝাঁপ দেওয়াটা সেটাই কি প্রেম? নাকি খুব ভেবে চিন্তে, আগ পাছ দেখে, সাত পাঁচ ভেবে প্রেমের সম্পর্কে পা বাঁড়ানো সেটাই প্রেম? কোনটা সত্যি? কোনটা সফল? আর প্রেমের সফলতাই বা কি? আজও তা জানা হলো না আমার....
মায়াবন বিহারিনী হরিণী
গহন স্বপন সঞ্চারিণী
কেনো তারে ধরিবারে করি পণ
অকারণ.......
একি খেলা আপন সনে- ১২
একি খেলা আপন সনে- ১১
একি খেলা আপন সনে- ১০
একি খেলা আপন সনে- ৯
একি খেলা আপন সনে- ৮
একি খেলা আপন সনে- ৭
একি খেলা আপন সনে- ৬
একি খেলা আপন সনে - ৫
একি খেলা আপন সনে- ৪
একি খেলা আপন সনে - ৩
একি খেলা আপন সনে- ২
একি খেলা আপন সনে - ১
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৯ সন্ধ্যা ৭:১৮