ঢাকার মাটিতে পা দিয়েই অবাক হলাম! আমার সাথে নতুন বাবার যোগাযোগ বা সম্পর্কটা কখনই তেমন গাঢ় ছিলো না। উনি ছিলেন উনার মত আমি আমার মত। উনি আমার ভালো মন্দের ব্যাপারে কখনও মাথা ঘামাননি। আমাকে কখনও ভালোও বাসতে আসেননি, ঘৃনাও করতে আসেননি। আমার থাকা বা না থাকা নিয়ে তার কখনও কিছুই আসলে যায় আসেনি। বলতে গেলে উনার কাছে আমি ছিলাম অদৃশ্য কোনো উপেক্ষিতাই। আমি যেদিন ঢাকা ছাড়ি সেদিনও উনি আমাকে কিছুই বলতে যাননি। আমার ঢাকা ছাড়া বা উনার বাড়িতে এক কোনে পড়ে থাকা বা সারা বাড়ি দাঁপিয়ে বেড়ানোতেও মনে হয় উনার কিছু যায় আসতো না। সেই উনি আজ আমাকে এয়ারপোর্টে নিতে এসেছেন। বেশ অবাক হলাম। ধ্বক করে উঠলো বুকের ভেতর। তবে কি মা ......
কিন্তু উনাকে বেশ নির্লিপ্ত দেখাচ্ছিলো। উনি কোনো কথা বললেন না আজও তবে উনার সাথে আসা গার্ডটি আমার ব্যাগ নিয়ে চললো সামনে সামনে তারপর বাবা আর তারপর আমি পিছে। গাড়িতে উঠবার পরেও উনি আমাকে কিছুই বললেন না।
বাড়িতে পৌছুতেই সবার আগে দৌড়ে আসলো তিতলী। এ ক'মাসে কি যে সুন্দর হয়েছে ও! কোঁকড়া চুলে ঝুঁটি বাধা। লাল টুকটুকে একটা সিল্কের ফ্রক । যেন একটা পরীবাচ্চা। সে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলো। সাদর অভ্যর্থনা বলতে সে এই তিতলীর আদরটুকুই ছিলো। আমি ওকে কোলে নিয়ে মায়ের রুমে গেলাম। ধরেই নিয়েছিলাম মা শয্যাশায়ী হয়তো অনেক অসুস্থ হবেন। কিন্তু ঘরে ঢুকে মাকে ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে চুল আঁচড়াতে দেখলাম। আগের থেকেও যেন ধপধপে সুন্দর কিন্তু দৃঢ় কঠিন মুখে সদ্যস্নাত আমার আজীবনের পরমা সুন্দরী মা আমার দিকে তার পদ্মকোরক চোখ তুলে তাকালেন। সে চেহারায় কি ছিলো জানিনা। আমি চমকালাম! কিছু না বলে ফিরে গেলাম নিজের ঘরে। আমার সাথে মিথ্যে বলা হয়েছে তা বুঝতে আমার সময় লাগলো না। কিন্তু কেনো? কেনো এই মিথ্যে? কেনো এই লুকোচুরি?
সে কেনোর উত্তর পেতে বেশিক্ষন দেরী করতে হলো না আমার। বিকেলের পর পরই গোল মিটিং বসলো আমার নতুন বাবার মায়ের ঘরে। সেখানে আমার তলব পড়লো। আমার নিজের দাদু, দাদী, মা, নতুন বাবা ও তার মা আগে থেকেই ছিলেন সেখানে। আমি ঘরে ঢুকে উনাদেরকে দেখে একটু অবাকই হলাম। নতুন বাবার মা আমাকে সামনের খালি টুলটা দেখিয়ে বসতে বললেন। আমি সেখানে বসতেই মা উঠে এসে আমার গালে প্রচন্ড চড় কষিয়ে দিলেন। আমি ঘটনার আকস্মিকতায় হতবিহ্বল হবার আগেই উনি অজস্র অকথ্য কটু কথার বর্ষন আর সাথে আঘাতে আঘাতে আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন। মায়ের হিংস্র মূর্তী আর একের পর এক আঘাতের যন্ত্রনার পরেও স্থির হয়ে বসে রইলাম আমি। মা একের পর এক আমার মাথায় গালে যেখানে সেখানে মেরেই চলেছিলেন। আর...
এতদিন পরে মায়ের এই উগ্র মূর্তী আর উন্মাদনাময় কার্য্যকলাপের সাথে সাথে আমি জানলাম আমার প্রতি এই বাড়িতে আসার পরে মায়ের সেই উদাসীনতা ও অবহেলার কারণ। এক অজানা প্রশ্নের উত্তর পেলাম আমি। মা বলছিলেন, হতভাগী, বদ মেয়ে সারাজীবন আমার হাড় জ্বালিয়ে খেয়েছে, যেমন ছিলো বাবা তেমনি হয়েছে মেয়ে। আমাকে তিল তিল করে শেষ করতে জন্ম হয়েছিলো এ দুজনের এ পৃথিবীতে। কোনোদিন শান্তি দেয়নি এই ডাইনীটা আমাকে, এই ডাইনীও জন্মেছে আমাকে আগুনের কুন্ডুলীতে বসে আজীবন জ্বালানোর জন্যই। তোর জন্মই হয়েছে আমার মুখে চূন কালী মাখাবার জন্য। তোকে আঁতুড় ঘরে না হলেও তোর বাবার অন্তর্ধানের সাথে সাথেই আমার জীবন্ত কবর দেওয়া উচিৎ ছিলো...
এমনই সব অশ্রাব্য অকথ্য কথার বাক্য বর্ষনে হতবাক হয়ে বসে ছিলাম আমি। খুব মন দিয়ে শুনছিলাম মায়ের অভিযোগগুলো। এক ফোটা ব্যাথা বোধ ছিলো না আমার, ছিলোনা চোখের কোনে কোনোই অশ্রুজল। এই অকথ্য কথন, অবিরাম আঘাত আমাকে একটুও বিচলিত করেনি। আমি শুধু মন দিয়ে শুনছিলাম, মন দিয়ে ভাবছিলাম কি অপরিসীম ঘৃনা বুকে চেপে রেখেছিলো আমার মা এতটা বছর ধরে। কি অপরিসীম কষ্ট, ক্ষোভ, বেদনা জমে আছে মায়ের বুকে। এত কিছুর পরেও আমার বুক চিরে একটি দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। মা মনে হয় ভুলে গিয়েছিলেন আমার জন্মদাতা পিতার পিতা এবং পৃথিবীর সবচাইতে সহনশীল মা আমার দাদী তার সামনেই বসেছিলেন সেদিন। মা উন্মাদিনীর মত তার সারাজীবনের হতাশা ক্লান্তি অপ্রাপ্তির যন্ত্রনা বিভৎস্য কদর্যতায় সেদিন উগড়ে দিয়ে চলেছিলেন। আমার উপরে আক্রোশ সেদিন যেন থামছিলোনাই না তার। আমি চুপচাপ বসে রইলাম। আমার চোখ ঝাঁপসা হয়ে উঠেছিলো বটে তবে গড়িয়ে পড়েনি এক বিন্দু অশ্রুজল। সেই ঝাঁপসা চোখে দেখলাম মা এক পর্যায়ে থামলেন। ক্লান্ত হয়েই বুঝি কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন। আমার নতমুখী দাদী, দাদু , নতুন বাবা, তার মা কেউ মাকে আটকায়নি সেদিন। আমাকে এত এত আঘাত করার পরেও তারা কোনো বাক্য ব্যায় করেনি। কারণ এ শাস্তি আমার প্রাপ্য। আমি এ বাড়ির সন্মান ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছি। শুধু এ বাড়িরই না আমার জন্মদাতা পিতার পিতা এবং মাতাও সে লজ্জায় আজ লজ্জিত।
নতুন বাবার আদেশে আমাকে গৃহবন্দি করা হলো। আমাকে আর ফিরে যেতে দেওয়া হবে না সে কথাটাও সাফ জানিয়ে দেওয়া হলো। দোলনদের বাড়ি থেকে যেদিন আমাদের এই ভুল সম্পর্কের কথা আমার নতুন বাবা এবং মাকে জানানো হয়েছে সেদিনই নাকি এই ডিসিশন নেওয়া হয়েছে এবং এতে শুধু আমার নতুন বাবা এবং মাই নন, আমার আপন দাদু এবং দাদীরও মত আছে। আমার আর কখনও ফিরে যাবার অধিকার নেই সেখানে। আমার প্রানের শান্তি নিকেতনে আর কখনও ফেরা হবে না আমার, আমার কোনো অধিকার নেই দোলনকে ভালোবাসার। সেই ভালোবাসার অপরাধ আমাকে আজ সকল অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে।
নতুন বাবার আদেশে শুধু গৃহবন্দিনীই নয় আমি আমার ঘর বন্দী হয়ে রইলাম এরপরের আরও কয়েকটা দিন। আমার অনেক অনেক নিরানন্দময়তার মাঝেও এই বাড়িতে প্রিয় একটি বিলাস ছিলো ভোরের বাগান। সেই ভোরেও বাগানের দরজা আমার জন্য বন্ধ হয়ে গেলো। তিনবেলা খাবার নিয়ম করে আসতো আমার ঘরে। পড়েই থাকতো আমি ছুঁয়েও দেখতাম না । যাইহোক আসলে সে কয়েকদিন আমি শুধু ভাবছিলাম আর ভাবছিলাম। আমার সেই উনিশ বছরের জীবনের সকল চাওয়া পাওয়া, প্রাপ্তি অপ্রাপ্তি, নিয়তির করুণ পরিহাস এবং জীবন যুদ্ধে অদৃশ্য এক প্রতিকূলতার সাথে প্রতিনিয়ত লড়াই করে চলা এবং সফল হবার অদম্য বাসনার নীরব লড়াই সবই ছিলো সে ভাবনার বিষয়বস্তু। সব কিছুর মাঝে নিশ্ছিদ্র একটি আনন্দময় সুখের গল্পটাই ছিলো দোলন। সেই দোলনকেও কি হারাতে হলো?
একটা সময় গা ঝাঁড়া দিয়ে উঠলাম আমি। না, কিছুতেই না। আমি মানিনা কারো শাসন বারণ। আমি আর মানবোনা কারো বাঁধা নিষেধ। কোনো ভাবেই মেনে নেবো না আমার ওপর আজীবন চাপিয়ে দেওয়া অন্যদের ইচ্ছে অনিচ্ছেগুলোকে। এই একটামাত্র জীবন আমার। শুধুই আমার। এর উপরে কারো কোনো অধিকার নেই। কারো কোনো দাবী দাওয়া নেই। অনেক সয়েছি আমি। আর না । কিছুতেই না। আমার সকল পথ চলার দায় একমাত্র আমার। আমার সকল পরিনতির জন্য এরপর শুধু আমি একাই দায়ী হতে চাই। যা আসবে তার পরিনতিতে তার জন্য কারো কোনো দায়বদ্ধতা নেই। এই দায়ভার একা আমারই। আমার জীবনের সকল সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতা থেকে আমি আজ থেকে সকলকেই বিদায় দিলাম।
এক দুপুরে সকলের চোখ ফাকি দিয়ে বাড়ি থেকে পালালাম আমি। কোথায় পালাচ্ছি, কেনোই বা পালাচ্ছি, কি জন্য কিছুই জানতাম না। শুধু জানতাম এখান থেকে আমাকে পালাতে হবে । তার থেকেও বড় কথা আমাকে দোলনের কাছে যেতে হবে। এই পৃথিবীতে আমার একমাত্র শুভাকাঙ্খী এবং একমাত্র ভালোবাসা দোলন। যে কোনোভাবেই হোক, যে কোনো মূল্যেই হোক দোলনের কাছে যেতেই হবে আমাকে। দোলন আমাকে কথা দিয়েছে পৃথিবীর কোনো শক্তিই আমাদেরকে আটকাতে পারবেনা। আমাদের দুজনাকে বিছিন্ন করতে পারবেনা একে অন্যের থেকে। এক রাশ আশায় ছুটছি তখন আমি। কোথায় যাচ্ছি জানিনা।
বাড়ি থেকে পালাবার সময় খেয়াল করিনি কিন্তু তপ্ত গরম পিচের রোডে পা পড়তেই পায়ের তালু ছ্যাৎ করে উঠলো। বুঝলাম স্যান্ডেল পরে বের হইনি। তাকিয়ে দেখলাম পরনে রয়েছে হাউজকোট, চুলও খোলা। এইভাবে কোনোদিন আমি বাড়ির বাইরে বের হইনি। কপর্দকশূন্য, এলোথেলে পাগলিনীর মত খোলা চুল, খালি পা। আমার পরিচিত কেউ দেখলে তখন আমাকে মনে হয় ভাবতো আমি পাগলই হয়ে গেছি। আসলেও আমি পাগলই হয়ে গিয়েছিলাম। আমার বোধ বুদ্ধি, জ্ঞান সকলই লোপ পেয়েছিলো। মাথায় শুধু একটাই চিন্তা দোলনের কাছে যাবো। কিন্তু ....
কোথায়!
where will I get you my love?
where will I find you forever?
I want you more than you'll ever know,
I am sending my love to you wherever you are. . .
একি খেলা আপন সনে- ১১
একি খেলা আপন সনে- ১০
একি খেলা আপন সনে- ৯
একি খেলা আপন সনে- ৮
একি খেলা আপন সনে- ৭
একি খেলা আপন সনে- ৬
একি খেলা আপন সনে - ৫
একি খেলা আপন সনে- ৪
একি খেলা আপন সনে - ৩
একি খেলা আপন সনে- ২
একি খেলা আপন সনে - ১
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৯ সন্ধ্যা ৭:২০