ওদের বাড়ি থেকে ফিরে আসার দু'দিনের মাথায় দোলনের বড় বৌদি আমাকে একটি চিরকুট পাঠালেন। হলের দারোয়ান এসে সে চিরকুটি দিয়ে গেলো যখন তখন দেখলাম চিরকুটে বৌদি লিখেছেন, উনি আমার সাথে একান্তে কিছু কথা বলতে চান। আমি খুব অবাক হলাম। কারণ উনি লিখেছেন উনার সাথে এই একান্ত সাক্ষাৎ সম্পর্কে আমি যেন দোলনকে কিছু না জানাই। এটা আমার আরও বেশি অবাক হবার কারণ। বুঝলাম না আমি এই কথা দোলনকে না জানানোর কি আছে? জানালে সমস্যা কি? কি যেন এক অকারণ আশঙ্কায় দুরু দুরু করছিলো মন। বৌদি নিষেধ করেছেন দোলনকে কিছু না জানাতে অথচ আমি দোলনকে কোনো কিছুই কখনও লুকাই না, লুকাইওনি কোনোদিন। সাত পাঁচ ভেবে শেষ পর্যন্ত আমি বৌদির কথা অমান্য করে দোলনকে জানানোর সিদ্ধান্ত নিলাম।
খবরটা শুনে দোলনও বেশ অবাক হলো। একটু গম্ভীর হয়ে উঠলো ও। কিন্তু আমাকে সে আশ্বাস দিলো। বললো কোনো চিন্তা না করতে। ও বললো, বৌদি যখন ডেকেছে আমার যাওয়া উচিৎ। তবে উনি ভালো বলুক আর মন্দ বলুক তা নিয়ে আমাকে মাথা না ঘামাতে। আমি যেন মোটেও বিচলিত না হই সে ব্যাপারে পই পই বলে দিলো। আমার খুবই ভয় করছিলো। লজ্জাও লাগছিলো। বার বার চোখে ভেসে উঠছিলো সেদিন বিকেলে ওদের ছাদের উপরে দেখা সাদা ধপধপে ঐ শনচুলো বুড়িটার অগ্নি দৃষ্টিটাকেই। না জানি কি লাগিয়েছে বুড়িটা দোলনের বৌদিকে। দোলনের কাছে জেনেছি উনি দোলনের বিধবা পিসীমা। ১৩ বছর বয়সে বিধবা হয়ে এ বাড়িতেই কাটিয়েছেন তার সারাটা জীবন। ভীষন বদরাগী আর সনাতনী উনি। সেদিন বিকেলে দোলনের এক গাঁদা বন্ধু বান্ধবের হুল্লোড় উনার মোটেও পছন্দ হয়নি। সকলে বিদায় নেবার পরে নাকি চল্লিশ ঘড়া জল ঢেলে উঠোন পরিছন্ন করেছেন। উনার নাকি সূচিবায় আছে। দিনের মধ্যে চৌদ্দবার স্নান করেন। বলতে গেলে ভেঁজা কাপড়েই নাকি থাকতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। ওতেই উনার মানষিক শান্তি। আত্মার পরিশুদ্ধি হয়।
সে যাইহোক সকল লজ্জা ভয় কাটিয়ে পরবর্তী ছুটির দিনে আমি দোলনের সাথেই ওদের বাড়িতে গেলাম। দোলন বসে রইলো বারবাড়িতে। আমাকে ভেতরে নিয়ে গেলেন এক পুরোনো ঝিঁ গোছের কেউ একজন। তখন ভর দুপুর। সারাবাড়ি খা খা করছিলো কি এক আশ্চর্য্য মৌনতায়। চারিদিকে শনশান শূন্যতা। অথচ দু'দিন আগেও যখন এ বাড়ি ঘুরে গেলাম সারা বাড়ি গমগম করছিলো অতিথি অভ্যাগত এবং এ বাড়ির সকল বাসিন্দাদের পদচারনায়। আজ এই ভর দুপুর বলেই কিনা জানিনা সবাই হয়তো রেস্ট নিচ্ছেন যার যার ঘরে তবু এক মহা শূন্যতা ঘিরে ছিলো বাড়িটিকে। ঝিঁটি আমাকে সোজা বৌদির শোবার ঘরের দরজায় নিয়ে গেলো।
দরজায় টোকা দিতেই বৌদি বললেন, "ওকে ভেতরে পাঠিয়ে দে আর তুই জলখাবার নিয়ে আয় মেয়েটার জন্য। ওর সাথে আমার কথা আছে।" আমার ভীষন লজ্জা লাগছিলো। লজ্জায় পা সরছিলো না ভেতরে যেতে। ঝিঁ ইশারা করলো। আমি পায়ে পায়ে গিয়ে দাঁড়ালাম বৌদির সামনে। বৌদি একটা ছোট নীচু জলচৌকিতে বসে ছিলেন। সুঁচ সুতো এবং একটি কাপড়ে কি যেন নকশা বুনছিলেন উনি। সে সব পাশে সরিয়ে রেখে আমাকে বসতে বললেন সামনের চেয়ারে।আমার খুব অস্বোয়াস্তি হচ্ছিলো। আমি জড়োসড়ো হয়ে বসলাম।
বৌদি বললেন, সহজ হয়ে বসো মেয়ে। তোমাকে কিছু কথা বলতে এখানে ডেকেছি আমি। উনার শান্ত শিষ্ঠ অদ্ভুত ব্যাঞ্জনাময় স্বরের মাঝে কি ছিলো জানিনা। আমার অন্তর কেঁপে উঠলো। ঘর পোড়া গরু আমি সিঁদুরে মেঘ দেখলেই যে শুধু ভয় পাই তাইই নয় আমি খুব খেয়াল করেছি আমার জীবনের দুঃসময়ের মুহুর্তগুলোতে আমার খুব ইনট্যুইশন কাজ করে । আমি বুঝতে পারি ঠিক এর পরবর্তীতে কি ঘটতে যাচ্ছে আমার জীবনে। আমি নিশ্চিৎ বুঝে গেলাম বৌদি আসলে কি বলতে ডেকেছেন আমাকে। কি বলতে চান উনি।
যে ঝিঁটি আমাকে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলো সে একটি ট্রেতে করে নাড়ু, নারকেলের চিঁড়ে, নিমকী আরও কি কি যেন নিয়ে এলো। ট্রেটা আমার পাশে নীচু টিপয়ের উপরে রেখে চলে গেলো সে। বৌদি আমার হাতে একটি সবুজ রং পানীয়ের গ্লাস তুলে দিলেন। বললেন, এই নাও কাঁচা আমের শরবৎ খাও। আমাদের বাগানের আম। খুব ভালো আম। উনি আমার হাতে যে অপূর্ব সুন্দর সবুজ পান্না রঙ্গের পানীয়ের গ্লাসটি তুলে দিলেন, আমি কিছু না বলে গ্লাসটি হাতে ধরে রইলাম। উনি বললেন,
"দেখো তোমাকে আমি আজ এখানে যে কথা বলতে ডেকেছি সে কথা শোনার পরে তোমার ভেতরে কি প্রতিক্রিয়া হবে আমি জানিনা তবে নিশ্চিতভাবেই আঁচ করতে পারি মোটেও তা আনন্দের হবে না। তুমি হয়তো অপমানও বোধ করতে পারো। কিন্তু আমার উপদেশ থাকবে সেটা তুমি করবে না। কারণ এখানে আসলে আমাদের করণীয় খুব একটা কিছু নেই। আমি, তুমি, দোলন সবাই আমরা নিয়তির হাতে বাঁধা।"
এতগুলি কথা একসাথে বলে থামলেন উনি। আমি স্থির বসে ছিলাম সেই পান্না সবুজ রঙ্গ তরলটির দিকে তাকিয়ে। পায়ের নীচে হিম শীতল নকশা কাটা সাদা কালো চেকবোর্ড ডিজাইনের মেঝে। সেই শীতলতা পা দিয়ে আমার শিরদাঁড়া বেয়ে উঠছিলো তখন। একটি খুব অজানা শীতল শিরশিরে অনুভুতি। উনি ফের বলতে শুরু করলেন,
"দোলনের সাথে যে তোমার একটি গাঢ় সম্পর্ক গড়ে উঠেছে তা আমরা আসলে জানতাম না। সেদিন দোলপূজোর দিনে তুমি আমাদের এখানে না আসলে তা হয়তো জানা হত যখন তখন আর এ ক্ষতি পূরণের সময় থাকতো না।" -
চমকে উঠলাম আমি! ক্ষতি! কি ক্ষতি করেছি আমি তাদের! চোখে ভাসলো ফের সেই শনচুলো বুড়ির অগ্নিদৃষ্টি। উনি বলেই চলেছিলেন-
"আসলে যে সম্পর্কের সুতো ধরে তোমরা আগাচ্ছো তা বড়ই অমজবুত ও ভুল সুত্র। তোমাদের বয়স কম। এত বিচার বুদ্ধি বিবেচনা যে নেই সে আমি জানি। তাই তোমাকে এসব বলতে আমার আজ এখানে ডাকা। তুমি বা তোমরা যা ভাবছো তা কখনও কোনোদিন এ বাড়িতে গৃহীত হবে না। কোনোভাবেই না। আর আমার দৃঢ় ধারনা তোমার পরিবারও এ সম্পর্কের স্বীকৃতি দেবেনা। কাজেই এখনও সময় আছে মেয়ে। তুমি এ ভুল করো না। আমিও একটি মেয়ে। আমি তোমার কষ্ট বুঝি এবং বুঝবোও। তবুও তোমাকে অনুরোধ করছি, এ কষ্ট স্বীকার করে নিয়ে জীবনের আরও বড় কষ্টকর পথে না হাঁটবার জন্য। কথাগুলো আমি দোলনকেই বলতে পারতাম কিন্তু দোলনকে না বলে তোমাকে বলার কারণ কি জানো? কারণ মেয়েরাই সব পারে। দোলন হয়তো পারবেনা এ কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে। আর তাই এ কঠিন কাজটি তোমাকেই করতে হবে।"
আমার পায়ের তলায় মাটি দুলছিলো। লজ্জা ক্ষোভ, ঘৃনা আর অভিমানে মাথা ঘুরছিলো আমার। তবুও আমি শান্ত থাকলাম। শান্ত থাকার অভিনয় করলাম। এ অভিনয় তো বহু আগেই শিখে গেছি আমি। সবকিছু শোনার পর গ্লাসটি মেঝের উপরে নামিয়ে রাখলাম আমি আর তারপর সোজা উঠে হেঁটে বেরিয়ে এলাম। উনি আমাকে ফিরে ডাকলেন না একটাবারো। আমি নিশ্চিৎ জানি উনার প্রশ্নবোধ্য চোখ দুটি আমার পিঠে গাঁথা ছিলো।
দোলন বাগানেই বসেছিলো। আকাশে আসন্ন শীতের বিকেলের সূর্য্য তখন হেলে পড়েছে। ওদের বারবাড়ির সিঁড়ি হতে সামনে বিস্তৃত সোজা সরু রাস্তাটি ধরে আমি ওকে কিছু না বলে একা বেরিয়ে এলাম। পেছনে পড়ে রইলো ইউক্যালিপটাসের সারি বাঁধা সরু পথটি। আমার মাথা কাজ করছিলো না তখন। আমি শুধুই সামনে এগুচ্ছিলাম। বেশ কিছু কাঁঠবিড়ালী এদিক ওদিক ছুটোছুটি করছিলো। আমার এই চরম অপমান ও পরম দুঃখের মুহুর্তেও আমি অবাক হয়ে দেখলাম পথের ধারে যত দূর চোখ যায় বিছানো চাদরের মত বিস্তৃত লজ্জাবতী গাছ। হালকা বেগুনী গোলাপী রঙ্গের তুলতুলে ঝুরি ঝুরি ফুলে ছেয়ে আছে। কি অপরূপ সৌন্দর্য্য! পৃথিবীতে মানুষ নামক প্রানীদের মাঝে কত জটিলতা, কুটিলতা অথচ প্রকৃতির সৌন্দর্য্যে সে সবের বালাই নেই। কি অপরুপ সৌন্দ্রয্য আর মায়াময়তা নিয়ে পথের ধারে পায়ের কাছে পড়ে আছে লজ্জাবতীর সজ্জা। অবাক হতে হয়। দোলন হতবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলো। আমি বেশ কিছুদূর যেতে ও দৌড়ে এসে আমার হাত ধরলো। জানতে চাইলো কি হয়েছে?
আমি উত্তর দিলাম-
কিছু না ........
দূরে কোথাও তখন কোকিল ডাকছিলো, কুহু কুহু কুহু কুহু....
আমার মনে তখন -
কি জানি কিসেরও লাগি প্রাণ করে হায় হায় -
পিক কিবা কুঞ্জে কুঞ্জে কুহু কুহু কুহু গায় .......
আমি হেঁটে চলেছিলাম সামনে। গন্তব্যবিহীন, উদ্দেশ্য বিহীন কোথায় চলেছিলাম জানিনা আমি। পথের উপরে বিশাল একটি গাছ হলুদ হলুদ অপূর্ব ক্ষুদে ফুলে ছেয়েছিলো। বাবলাই হবে বোধ হয়। দোলন নিশব্দে আমার পাশে পাশে হাঁটছিলো। আমি নির্ভয়ে হেঁটে চলছিলাম সেই অজানা অচেনা রাস্তায় । হয়তো সেদিন দোলন আমার পাশে ছিলো তাই সন্ধ্যা হবার পরেও এই অচেনা বনাঞ্চলে কোনো ভয় ছিলো না আমার। যদিও আমি জানতাম বাকী জীবনটা এরপর আমার একাই হাঁটতে হবে......
বুকের মধ্যে শূন্যতার কাঁপন। কি এক অজানা ব্যাথায় বুক ভেঙ্গে যাচ্ছিলো আমার কিন্তু আমি প্রানপনে চাইছি আমি কোনোভাবেই ভেঙ্গে পড়বোনা। কাঁদবোনা আমি। কিছুতেই না........
একি খেলা আপন সনে- ৯
একি খেলা আপন সনে- ৮
একি খেলা আপন সনে- ৭
একি খেলা আপন সনে- ৬
একি খেলা আপন সনে - ৫
একি খেলা আপন সনে- ৪
একি খেলা আপন সনে - ৩
একি খেলা আপন সনে- ২
একি খেলা আপন সনে - ১