দোলন! দোলনের সাথে যখন আমার প্রথম দেখা হলো। প্রথম দেখাতেই দোলন আমার হৃদয় দুলিয়ে দিলো। তার অন্তর্ভেদী সুগভীর সমুদ্র নীল চোখের চাহনীতে ক্ষনিকের জন্য আমার হৃদ স্পন্দনই বুঝি বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো। জানিনা বোকার মতন ঠিক কি করেছিলাম আমি সে সময়। মানে কতক্ষন তাকিয়ে ছিলাম হা করে ওর দিকে। তবে হাতের কনুই এ প্রচন্ড এক চিমটিতে আমার সম্বিত ফিরেছিলো। নায়লা আমার হাতে চিমটিটা দিয়েই ক্ষান্ত হলো না, কানে কানে ফিসফিস করে বললো, ওমন কেবলার মত হা করে তাকিয়ে দেখছিস কি? লজ্জা পেয়ে তড়িঘড়ি সামনে পা বাড়ালাম! ফিরে এলাম আমরা আমাদের আপন কুটিরে।
কিন্তু আমার যে কি হলো এরপর! সারা সন্ধ্যা আমি আনমনা হয়ে রইলাম। চোখে বিঁধে রইলো একটি বিকেল আর বকুল বিথীতে সবুজ ঘাসের গালিচায় একটি গাছের গোঁড়ায় বসে থাকা ঝাঁকড়া চুলের সেই বংশীওয়ালা। এমন তো কখনও হয় না। কত দিন কত মানুষকেই তো দেখছি ঘরে বাইরে পথে ঘাটে! আজ আমার একি হলো! মনে হলো যেন সে কত দিনের চেনা। তার জন্যই অপেক্ষা করে ছিলাম আমি এই আঠারোটি বছর! আমি বার বার হারিয়ে যাচ্ছিলাম কোথায় যে। আমার অবস্থা দেখে নায়লা মজা শুরু করলো।
ওগো বাঁশিওয়ালা, বাজাও তোমার বাঁশি
শুনি আমার নতুন নাম,
এই বলে তোমাকে প্রথম চিঠি লিখছি
বুঝলে তো?
আমি তোমার বাংলাদেশের মেয়ে.....
তোমার চরণে হবে কি একটু ঠায়?
হা হা হা ... উচ্ছল হাসি আর দুষ্টুমীতে মেতে উঠলো ও। নায়লা আমার সেই প্রবাসী জীবনের সাথী, হরিহর আত্মা নায়লা। আমরা একই রুমেই থাকতাম। একই খাবার ভাগ করে খেয়েছি। একই দুঃখ এবং শোকও ভাগ করে নিয়েছিলাম আমরা দুজনা। আর আমার সেই প্রথম প্রেম, উদাসী মন, উড়ু উড়ু হৃদয় সকল আবেগ ও অনুভুতির সঙ্গীই ছিলো সে। কত লুকানো বিকেল, কত আনন্দ সুখের স্মৃতি, কত বেদনা আর কত অভিমান যে আমি গচ্ছিত রেখেছিলাম ওর বুকের সিন্দুকে। সে সব আর কখনও কাউকেই বলা হয়নি আর হবেও না কোনোদিন, সে বেশ জানি।
সে যাইহোক, সে রাতে রাতের খাবারের পর, লাইট অফ করে শুয়ে ছিলাম আমরা। জানালা দিয়ে সেদিন আকাশভাঙ্গা জ্যোস্না, আমাদের গাঁয়ে এসে পড়ছিলো সেই স্নিগ্ধ মধুর তীব্র আলো। জানালার শিক গলে বাঁকা বাঁকা জ্যোস্না-নকশা আমার বুকের পরে শাড়ির আঁচলের কুঁচির ভাঁজে ভাঁজে সৃষ্টি করেছিলো আরেক নকশা। আজও মাঝে মাঝেই পূর্ণ শশীকলায় খেলে যাওয়া জ্যোস্নায় তাকালেই আমার মনে পড়ে সেই জ্যোস্না আঁকা শাড়ির কুঁচির ভাঁজে খেলে যাওয়া স্মৃতিময় রাত। নায়লা একা একা বক বক করে চলেছিলো। আমার কানে কিছুই ঢুকছিলো না। এক সময় সে এই জ্যোস্না ঢল দেখেই বুঝি গাঁইতে শুরু করলো,
চাঁদের হাসির বাঁধ ভেঙ্গেছে, উছলে পড়ে আলো
ও রজনীগন্ধা তোমার গন্ধ সুধা ঢালো।।
নায়লার গান আর চাঁদের আলোর হাসি একাকার হয়ে যাচ্ছিলো সেই মায়াবী রাতে। আমি অপলক চেয়ে রইলাম। জানালা গলে গাঢ় নীল আকাশের বুকে তখন ফাগুনের শ্বেত শুভ্র মেঘ। ভেসে যাচ্ছিলো যেন অমল ধবল পালের কোনো আকাশ খেয়াযান। নায়লা গাইছিলো আর মন্ত্রমুগ্ধের মত আমি ডুবে যাচ্ছিলাম সেই গানের বাণীতে বাণীতে, প্রতি চরণের অমৃতধারায়, ওর গানের সাথে সাথে পাখা মেলে দিয়েছিলো রাত প্রহরের সেই উদাসী মেঘমালা।
নীল গগণের ললাটখানি, চন্দনে আজ মাখা
বাণী বনের হংস মিথুন মেলেছে আজ পাখা-
পারিজাতের কেশর নিয়ে, ধরায় শশী ছড়াও কি এ
ইন্দ্রপূরীর কোন রমণী বাসর প্রদীপ জ্বালো ।।
ও রজনীগন্ধা তোমার গন্ধ সূধা ঢালো-
জানালা দিয়ে কোনো রজনীগন্ধার গন্ধ ভেসে আসছিলো না সেদিন। তবে কোনো এক অজানা ফুলের গন্ধে তখন চারিধার মৌমিতাল। অনেক পরে জেনেছিলাম সে নাকি ছাতিমফুলের গন্ধ ছিলো। ছাতিমফুলের ঝাঁঝালো গন্ধটা দূর হতে ভেসে আসছিলো বলেই বুঝি অজানা অচেনা এক মাদকতার সৃষ্টি করেছিলো সেই রাতে। হঠাৎ আমার খুব কান্না পাচ্ছিলো! আমার মনে হচ্ছিলো এই বিশাল পৃথিবীতে আমার কোথাও কেউ নেই? যার বুকে মুখ গুঁজে আমি ঢেলে দিতে পারি আমার সকল দুঃখজল। আমি ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলাম। আমার কান্নার শব্দেই বুঝি নায়লা আমার পাশে উঠে এলো। আমরা দু'জন বহুরাত অবধি বসে রইলাম পাশাপাশি বারান্দার আলসে ঘেসে। কাঁধে কাঁধ রেখে বয়ে নিতে চাইলো বুঝি আমার সকল দুঃখ এই উচ্ছল প্রানবন্ত বন্ধুটি আমার...
কয়েক দিনের মাঝেই নায়লা খবর নিয়ে এলো। তার হাড়ির খবর। নাম ধাম পরিচয়, বংশ ও কূলের। আর সেদিন দুপুরেই হঠাৎ দেখা হয়ে গেলো তার সাথে সঙ্গীত ভবনের রিহার্সেল চত্বরে। নতুন এবং পুরোনোরা মিলে চলছিলো আসন্ন বসন্ত উৎসব অনুষ্ঠানের রিহার্সেল! আমরা যখন পৌছুলাম সেখানে রিহারসেল ততক্ষনে শুরু হয়ে গেছে। গোল সার্কেলে বসে তখন গানের ছেলেমেয়েরা গাইছে বসন্ত সঙ্গীত। তড়িঘড়ি এক কোনায় গিয়ে একটু জায়গা করে বসতেই উল্টোদিকে চোখ পড়লো। সেই অন্তর্ভেদী সমুদ্র নীল চোখ। এক দৃষ্টে তাকিয়ে আছে আমারই দিকে। বিশাল সে প্রাঙ্গনের সমবেত সঙ্গীতে তখন গমগমে চারিধার- চারিদিকে আছড়ে পড়ছিলো সেই সূর ও বাণী-
রাঙ্গা হাসি রাশি রাশি অশোকে পলাশে
রাঙ্গা নেশা মেঘে মেশা প্রভাত আকাশে
নবীন পাতায় লাগে রাঙ্গা হিল্লোল.....
রাশি রাশি অশোক পলাশ শিমুলের রাঙ্গা আবীর লাগলো বুঝি আমার চোখে মুখে। রাঙ্গা হয়ে উঠলাম আমি। কি এক অজানা অচেনা অজানা নেশায় ডুবে যাচ্ছিলাম জানিনা। রাঙ্গা হিল্লোলে আলোড়িত তখন আমার হৃদয়। সে হৃদয় তাহার আপন হাতে দোলে। আমার গলা দিয়ে স্বর বের হচ্ছিলো না। চারিদিকে সঙ্গীতের মূর্ছনা আর আমার সারা দেহে এক অজানা কাঁপন। কি এক ঘোর আবেশে সন্মোহিত নিবদ্ধ আমার দুই চোখ ঐ আঁখির কোলে। আসন্ন বসন্তের আগমনে সকলে গাইছে গলা ছেড়ে আর আমি বিভোর কোনো এক অজানা সন্মোহনের মায়াজালে।
বেনু বন মর্মরে দখিন বাতাসে
প্রজাপতি দোলে ঘাসে ঘাসে
মৌমাছি ফিরে যাচি ফুলেরও দখিনা
পাখায় বাঁজায় তার ভীখারীরও বীণা
মাধবী বিতানে বায়ু, গন্ধে বিভোল...
আমার মনের অজানা সব অলিগলিতে উড়ে চললো লক্ষ প্রজাপতি। মৌমাছিদের গুন গুন গুঞ্জরনে বিভোরিত তনুমন। রিহার্সেল শেষ হতে সেদিন সন্ধ্যা হয়েছিলো। মাসব্যাপী এই রিহার্সেল আমাদেরকে কাছাকাছি এনে দিলো খুব দ্রুত।
প্রেমে পড়লাম আমি। সে এক উথাল পাথাল প্রেম....
দোলন আমার স্বপ্নলোকের রাজকুমার। যার হাতে অবলীলায় তুলে দেওয়া যায় এ হৃদয়, পরম নিশ্চিন্ততায়, নির্ভরতায়। কোনো দিন কেউ আমাকে এই অভয় দেয়নি। কোনোদিন আমার খুব কাছের কেউ হয়নি। কোনোদিন আমার আপন কেউ ছিলো না কোনোদিন কেউ আমাকে বাড়িয়ে দেয়নি কোনো আশ্বাস বা সহযোগীতার হাত। কোনোদিন কেউ আমাকে ভালোওবাসেনি খুব অবলীলায় বা নিসংকোচে। দোলন আমার সেই আশ্রয়। যার বুকে মুখ লুকিয়ে ঢেলে দেওয়া যায় গত জীবনের সকল দুঃখ তাপ।
দোলনের সাথে পরিচয় বা এই প্রনয়ের পর অনেকটাই বদলে গেলাম আমি। আমি বলতে গেলে ভুলেই গেলাম আমার গত জীবনের সকল অপ্রাপ্তি। আমার মন সব সময় ভরে থাকতো অজানা এক ভালো লাগার আনন্দে। আমার ধ্যান, জ্ঞান ভালো লাগা এবং ভালোবাসার প্রতিটা তন্ত্রীতে মিশে গেলো একটাই নাম। সে দোলন।
রোজ সকালে ঘুম ভেঙ্গে উঠেই যার মুখটা মনে পড়তো সে দোলন। তড়িঘড়ি স্নান সেরে, কোনোমতে শাড়ি পরে ক্লাসের অনেক আগেই আমি ছুটতাম শুধু বাড়তি সময়টুকু দোলনের পাশে থাকবো বলে। ও রোজ আমার জন্য প্লাস্টিক ব্যাগে করে আনতো সকালের শিশিরভেঁজা ফুল। কখনও বেলী, কখনও জুঁই, কামিনী, শিউলি কিংবা মাধবীলতা। ওদের বাগানের ফুল। ওর বৌদির হাতের লাগানো ফুলগাছের সেই স্নিগ্ধ সজীবতায় আমি খুঁজে ফিরতাম এক অজানা মমতার স্পর্শ! যে মমতার ছোঁয়া প্রোথিত থাকে কোনো শতবর্ষী বটবৃক্ষের শিকড়ে শিকড়ে। কোনো স্বর্নলতার সাধ্য কি সেই মমতার ঘ্রান পাবার?
দোলনের কাছে আমি অবাক হয়ে শুনতাম ওদের একান্নবর্তী সংসারের গল্প! কি অপরিসীম মমতায় ওর বড় বৌদি বড় করেছেন ১০ বছরের মা হারা এই দেবরটিকে। এই মাতৃসমা বড় বৌদি যে ওর কাছে মায়ের মতই ভালোবাসার তা আমি খুব বুঝতাম ওর শ্রদ্ধা আর মমতায় মেশানো আলাপচারিতায়। মনে মনে আমিও দেখতাম বড় বৌদির মুখ, তার মাতৃস্নেহ কোনো এক অজানা কল্পনায়। ওর ফ্যামিলী এলবামের ছবিগুলি দেখে দেখে আমার মনে হত সবাই আমার যেন শত জনমের পরিজন। ওর ছোট টিফিন বক্সে বৌদির হাতের বানানো পায়েস কিংবা চাপাতি-সব্জীতে লেগে থাকতো এক অন্যরকম ভালোবাসার ঘ্রান। আমরা দুজন ভাগাভাগি করে খেতাম সে সব খাবার কোনো বকুল কিংবা কদম ছায়ায় বসে।
প্রায় বিকেলেই আমরা হেঁটে যেতাম বহুদূর। দোলনের সাইকেলের পিছে চড়ে মাঝে মাঝেই চলে যেতাম কোপাই নদী বা খোয়াই এর হাঁট। ঘুরে বেড়াতাম নদী তীর ধরে। ঘুরে ঘুরে কিনতাম নানা রকম শিল্পকর্ম বা অকারণ হাবিজাবি। এক সাথে গান গাইতাম দুজনে গলা ছেড়ে।
মোট কথা হাওয়ায় ভেসে উড়ে যাবার ছিলো সেই দিনগুলো.....
একি খেলা আপন সনে- ৭
একি খেলা আপন সনে- ৬
একি খেলা আপন সনে - ৫
একি খেলা আপন সনে- ৪
একি খেলা আপন সনে - ৩
একি খেলা আপন সনে- ২
একি খেলা আপন সনে - ১
ছবিঃ নেট থেকে -Heinz Koslowski