
প্রথম প্রেম, প্রথম চুম্বন অথবা প্রথম হৃদয়ের ভাঙ্গন। এসবের কোনোটার তীব্রতাই নাকি কোনোটার চাইতে কম নয়। এ কথার সত্যতা সেই জানে যে প্রেমে পড়ে হাবুডুবু খায়। ভেসে ওঠা হয়ে ওঠেনা তার আর কোনোদিন। চোখের সামনে ভেসে যেতে দেখা খড়, কুটো বা এক খন্ড কাঁঠ। কোনোকিছুই ধরে বাঁচার সাধ জাগেনা তখন আর তার। এই ডুবে যাওয়াটাই তখন আনন্দের। এই ডুবে যাওয়াতেই তখন তার সকল সত্য। সেই দিনটির কথা যখন আমার মনে পড়ে। এতগুলো দিন পরেও লজ্জায় রাঙ্গা হয়ে উঠি আমি। আজকালকার প্রেমিক প্রেমিকারা হয়তো এ কথা শুনে হাসবে। ভাববে এ আমার ঢঙ্গ বা ভড়ং। কিন্তু আমি জানি সে সত্য। আমি জানি সেই শিহরণ। প্রথম চুমুর স্মৃতি।
দিনটি ছিলো আষাঢ়ের দ্বিতীয় দিন। তার আগের দিনেই বর্ষামঙ্গল উৎসবে সারাদিন নেচে গেয়ে কাটিয়েছি আমরা। পরদিন ছুটির দিন থাকায় আগে থেকেই নৌকা ভ্রমনে যাবার কথা ছিলো আমাদের। ভোর হতেই শুরু হলো ঝুম বর্ষা। ঘন কালো মেঘে আকাশ ছিলো ছাওয়া। তবুও সেই বর্ষা কিংবা বাদল আটকে রাখতে পারেনি আমাদের সেই প্রনয় অভিসার। সেই প্রবল বরিষন ভেদ করেও আমরা হাজির হয়েছিলাম কাঁচমন্দিরের পেছনের চাতালে। তখন সকাল নটা বা দশটা হবে। এই মেঘ বাদলে নৌকায় যাওয়া ঠিক হবে না ভেবে মন্দিরের পেছনের দিককার শান বাঁধানো ঢাকা দেওয়া ধাপগুলির একটাতে বসেছিলাম আমরা।
চারিদিক মুখরিত রুমঝুম বৃষ্টির তানে। আমার পরণে চওড়া নীলপাড় সাদা রং শাড়ি। খোঁপায় গুঁজেছি তার কিছু আগেই বৃষ্টিস্নাত বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল। সামনে গাঢ় সবুজ রং কচুপাতার উপর বৃষ্টির জল পড়ে পড়ে হীরকখন্ড হয়ে সাথে সাথেই তা ভেঙ্গে পড়ছিলো। আমি অপলক চেয়ে দেখছিলাম সেই মোহময় দৃশ্য। দোলনের কাঁধে মাথা রেখে ওর পাশে বসেছিলাম চুপচাপ। সেই মায়াবী সৌন্দর্য্যে ডুবেছিলাম অনেকটা সময়। কোথাও ব্যাঙ ডেকে চলেছিলো একঘেয়ে সূরে ঘ্যাঙ্গর ঘ্যাঙ্গ, ঘ্যাঙ্গর ঘ্যাঙ্গ। মাঝে মাঝেই আকাশের বুক চিরে চারিদিক আলোকিত করে বিদ্যুতের ঝিলিক উঠছিলো। কামিনী ফুলের গাঢ় মাতাল করা গন্ধ, কি এক অপরুপ মাদকতা ছড়াচ্ছিলো চারিদিকে। সেই মাদকতায় হারালাম আমরা।
সেই আবেশিত মোহময় বাদলের দিনে রবিঠাকুর কি অলখে বসে দেখেছিলেন, দুটি প্রেম পিয়াসী জীবন্ত মূর্তী চিত্রের আকুল ভালোবাসা? লিখেছিলেন কি বহুদূর হতে আমাদেরকেই স্মরণীয় করে কোনো মেঘ মল্লার রাগ প্রধান প্রেম সঙ্গীত? সকলের অগোচরে নীরবে নিভৃতে অস্ফুটে কি বেঁজেছিলো সেদিন কোনো নেপথ্য কবিতা? জানা নেই, জানা নেই তার কিছুই আমার। শুধু আজও হৃদয়ে বাজে, সেই অপঠিত কবিতা। হৃদয় জুড়ে আজও বাজে গুন গুন সুর,
অধরের কানে যেন অধরের ভাষা।
দোঁহার হৃদয় যেন দোঁহে পান করে।
গৃহ ছেড়ে নিরুদ্দেশ দুটি ভালোবাসা
তীর্থযাত্রা করিয়াছে অধর সংগমে।
দুইটি তরঙ্গ উঠি প্রেমের নিয়মে
ভাঙিয়া মিলিয়া যায় দুইটি অধরে।
ব্যাকুল বাসনা দুটি চাহে পরস্পরে
দেহের সীমায় আসি দুজনের দেখা।
প্রেম লিখিতেছে গান কোমল আখরে
অধরেতে থর থরে চুম্বনের লেখা।
দুখানি অধর হতে কুসুমচয়ন,
মালিকা গাঁথিবে বুঝি ফিরে গিয়ে ঘরে।
দুটি অধরের এই মধুর মিলন
দুইটি হাসির রাঙা বাসরশয়ন॥
এরপর পৃথিবীর সকল শোক তাপ দুঃখ কষ্ট ভুলেছিলাম আমরা। এতদিনের সকল না পাওয়ার বেদনাগুলো কোথায় যে হারিয়ে গেলো একে একে, কোন অগোচরে লুকালো তারা, সে জানা নেই আমার। আমরা তখন নতুন জীবনের স্বপ্নে বিভোর দুটি ডাহুক ডাহুকী। আমি ধরেই নিলাম আমাকে আর কখনও ফিরে যেতে হবে না আমার পুরোনো গ্লানিময় পরিমন্ডলে। যেখানে আমার কেউ নেই, আমার জন্য অপেক্ষা করে নেই কেউ কোথাও। এ যাবৎকালের সকল উপেক্ষা, অবহেলা বা নিজের সাথে নিজের করা সকল সংগ্রামের ইতিহাস ধুলো চাপা পড়ে গেলো আমার দোলনের ভালোবাসার কাছে। দোলন তখন আমার পৃথিবী। আমি নিশ্চিন্ত নির্ভরতায় জেনে গেলাম দোলন আর কখনও আমাকে এক ফোটা দুঃখ পেতে দেবে না কোনো ভাবেই। আমার এই এতটুকু জীবনে ভেতরে ও বাইরের ক্রমাগত লড়াই এ ক্লান্ত শ্রান্ত আমি। অবসর নিলাম নিজের দায়িত্ব থেকে।
বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত ও শীত পেরিয়ে এলো বসন্ত। দোল পূর্নিমার সন্ধ্যায় দোলন আমাদের কিছু কাছের বন্ধুদেরকে নেমতন্ন করলো। সারাদিন বসন্ত উৎসবের পর আমরা বেশ ক্লান্ত পরিশ্রান্ত হলেও আমার উৎসাহের কোনো কমতি ছিলো না। দোলনদের বাড়িতে সেই আমার প্রথম যাওয়া। ওর কাছে এত শুনেছি ওদের বাড়ির কথা যে ওদের মোড়ের নুয়ে পড়া তাল গাছ হতে শুরু করে খিড়কী দুয়ার, পেছনের পুকুর, বারবাড়ির প্রশ্বস্ত চাতাল সবই মনে হলো যেন অনেক দিনের চেনা। আমি একের পর এক ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম ঐ বাড়ির আনাচে কানাচে।
ওদের সিড়িঘরে কিছুটা অন্ধকারাছন্ন ভুতুড়ে নীরবতায় পা দিতেই নাকে আসলো এক অদ্ভুত ধোঁয়াশা গন্ধ। পরে জেনেছিলাম বড় বড় ধান আর চালের ডোল রেখে দেওয়ায় আবদ্ধ ঘরে অমন নেশা লাগা গন্ধের সৃষ্টি হয়েছিলো। পায়ে পায়ে উঠে আসলাম ছাঁদে। বিশাল ছাদের এখানে ওখানে শেওলা জমা দাঁগ। এককোনে কিছুটা উঁচু জায়গায় বয়ামে করে আঁচার শুকুতে দেওয়া হয়েছে। কুলবরই আর তেঁতুলের আঁচারের পাশে আমি দেখলাম কুলোয় করে শুকুতে দেওয়া হয়েছে সোনালী রঙ আমসত্ব। জীভে জল এসে গেলো আমার। কিন্তু কে কি বলে ভেবে আর হাত দিলাম না। ছাদের আলসেতে ভর দিয়ে দেখছিলাম নীচের আম বাগান আর নানা রকম ফলের বাগানের দৃশ্য। হঠাৎ পেছনে দোলন এসে দাঁড়ালো। আমাকে ওমন চোরের মত একা একা ছাঁদে দাঁড়িয়ে দেখে সে বোধহয় একটু অবাকই হয়েছিলো! দোল উৎসবের আনন্দযজ্ঞে সেই বিকেলেও মেতে উঠেছিলো সবাই নীচে ওদের প্রশ্বস্ত চত্বরে। কিন্তু সেই হোলির আনন্দ থেকেও বেশি আনন্দ ছিলো আমার সেদিন দোলন, আমার এক ও অদ্বিতীয় ভালোবাসার আবাসস্থলটির ক্ষুদ্র আনাচ কানাচ গলি ঘুঁচি আবিষ্কারে।
দোলন হঠাৎ ওর মুঠোভর্তি আবীর আচমকা আমার দুগালের ছড়িয়ে দিতে হাত বাড়ালো। আমি বুঝে উঠেই পালাতে চাইলাম কিন্তু সে আমাকে বন্দী করে ফেললো। তারপর মুঠো মুঠো আবীরের রঙ্গে আমাকে রাঙ্গিয়ে তুললো। আর তারপর সেই পড়ন্ত বিকেলের সোনারঙ আলোয় দুটি তৃষিত অধর ঢেলে দিলো একে অন্যের অধরে শত সহস্র শতাব্দীর প্রেম সূধা।
হঠাৎ পিছনে চোখ পড়তেই দেখলাম, ধপধপে চুলের শ্বেত শুভ্র বসনা এক নারীমূর্তী। যার চোখে সেই বিকেলে দেখেছিলাম ভয়ঙ্কর জলন্ত আগুনের ফুলকি।
সে আগুনে দগ্ধ ও ভস্মীভুত হয়ে গেলাম আমি। ভীষন অপরাধীর মত মন নিয়ে পালিয়ে এলাম সেদিন ওবাড়ি থেকে। কিন্তু এরপর....
একি খেলা আপন সনে- ৮
একি খেলা আপন সনে- ৭
একি খেলা আপন সনে- ৬
একি খেলা আপন সনে - ৫
একি খেলা আপন সনে- ৪
একি খেলা আপন সনে - ৩
একি খেলা আপন সনে- ২
একি খেলা আপন সনে - ১
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই নভেম্বর, ২০১৭ রাত ৮:৪৪

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




