somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

‘বাংলাদেশের নৃ-গোষ্ঠী’

২৭ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৫ রাত ১১:১৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

গারো রূপকথা

অনেক অনেক দিন আগের কথা। ময়মনসিংহের সুসংর্দুগাপুর এলাকায় গারোপাহাড়ের এক নিভৃত গ্রামে বাস করত এক যাদুকর। তার ছিল চারটি ছেলে। যাদুকর মারা যাবার সময় তার ছেলেদের বলল, বাবারা তোমরা শোন, আমার কাছে চারটা যাদুর ঢোল আছে। একটা সোনার ঢোল, একটা রুপোর ঢোল, একটা তামার ঢোল আর একটা টিনের ঢোল। তোমাদের চারজনকে আমি এই চারটি ঢোল দিয়ে যাব। এই চারটি ঢোলের যাদুর ক্ষমতা আছে। সেই ক্ষমতাবলে তোমাদের ভাগ্য ফিরে যাবে। তবে আমি জানিনা কার ভাগ্যে এই যাদুর ঢোল কি এনে দেবে এবং কে সুখের ভেতর দিয়ে জীবন যাপন করবে। আমি মারা যাবার পর তোমরা এই ঢোল নিয়ে গারো পাহাড়ের গভীর বনে চলে যাবে। সেখানে দেখবে এক জায়গায় র্গজন গাছের বন, একখানে আছে শালবন, একখানে আছে চিনার গাছের বন ও আর একখানে আছে র্অজুন গাছের বন। এই বনে গিয়ে ঢোল বাজাতে হবে। এই বলে যাদুকর মারা গেল।

যাদুকর মারা যাবার পর তার চার ছেলের মধ্যে বড়ছেলে বলল, আমি বড়ছেলে সুতরাং আমি সোনর ঢোল নেব। মেঝভাই নিল রুপোর ঢোল, সেজছেলে নিল তামার ঢোল আর ছোট ছেলে পেল টিনের ঢোল। চার ভাই ঢোল নিয়ে গারো পাহাড়ের গভীর বনে চলে গেল। বড়ভাই র্গজন গাছের বনে ঢুকে ডিম-ডিম করে ঢোল বাজাল। ঢোল বাজানোর সাথে সাথে ঢোলের ভেতর থেকে এক র্বমপরা সৈন্য। সৈন্যটি তলোযার উচিয়ে বলল, আমি তোমার দাস, তুমি আমার মনিব, বলো তুমি কি চাও? আমার যাদুর ক্ষমতায় আমি সেটা তোমাকে দিতে বাধ্য। বড়ছেলে বলল, আমাকে একটি রাজ্য দাও যে রাজ্যের রাজা হব আমি। তার সাথে সৈন্য সামন্ত, হাতি ঘোড়া পাইক পেয়াদা সব দাও। – জি আজ্ঞে হুজুর, এইবলে যাদুর সৈন্যটি আকাশের দিকে তলোয়ার উচিয়ে বলল, আমার মনিব যা যা চেয়েছে হয়ে যাও। সঙ্গে সঙ্গে বন হতে দুরে একটি রাজ্য হয়ে গেল। সেখানে সৈন্য সামন্ত, পাইক পেয়াদা, সব হয়ে গেল। বড়ছেলে রা্জা হয়ে সিংহাসনে আরোহণ করল। মেঝছেলে শালবনের ভেতর গিয়ে ডিম-ডিম করে ঢোল বাজাল। সাথে সাথে ঢোলের ভেতর হতে বেরিয়ে এলো এক সৈন্য। সে বলল- আমি তোমার দাস তুমি আমার মনিব। আদেশ কর কি চাই। মেঝছেলে বলল, আমাকে প্রচুর সোনাদানা, হীরে মানিক ও ধনদৌলত দাও। যেটা দিয়ে আমি একটি রাজ্য কিনে রাজা হব। মেঝছেলেও ধনদৌলত পেয়ে একটি রাজ্য কিনে রাজা হয়ে গেল। সেজছেলে চিনার বনের ভেতর গিয়ে ঢোল বাজাতেই আবার একটি সৈন্য বেরিয়ে এলো। সে সৈন্য কে বললু আমাকে সমুদ্রগামী জাহাজ, নাবিক, সোনাদানা আর প্রচুর ধনদৌলত দাও আমি সওদাগরী ব্যবসা করবো এবং দেশ বিদেশে ঘুরে বেড়াব। যাদুর সৈন্য তাকে সবকিছু দিলে সেও জাহাজে চড়ে রওনা দিল। এবার ছোট ছেলের পালা। সে র্অজুন গাছের বনের ভেতরে গিয়ে ঢোল বাজাতেই বেরিয়ে এলো এক পরীর মতো সুন্দর রাজকন্যা। রাজকন্যা বলল – আমার নাম বনকুসুম। এই বনে যে নানা রকম পারিজাত, নাগকেশর, বনতোষনী, বনওকরা, মধুমালতি, বকুল যুঁই, পলাশ,শিমুল ও অন্যান ফুল দেখছ সেই ফুল রাজ্যের রাজকন্যা আমি। এখন বল তুমি কি চাও। তোমার ভাইদের মতো ধন দৌলত, রাজ্য না আমাকে নিয়ে এই বনে বাস করতে। ছোটছেলের নাম ছিল সজিব দ্রং। সে বলল- আমি ধনদৌলত, রাজ্য, কিছুই চাই না। আমি তোমার সাথে এই বনেই বাস করতে চাই। এরপর তারা দুজনে বনের মধ্যে একটি বাড়ি বানালো। বাড়ির সামনে ফুলের বাগান। তার ধারে পুকুর। পুকুর র্ভতি লাল পদ্য ফুল। ফুলবাগানে নানা রং এর ফুল। হাজারো পাথির কিচির মিচির। কাঠবিড়ালীর ছুটোছুটি। রাতের আধারে হাজারো জোনাকি পোকা পিটপিট আলো জ্বেলে নেচে বেড়ায়। এদের সাথে আনন্দে কাটতে লাগলো ওদের সুখের জীবন।

অনেকদিন ভাইদের সাথে দেখা নেই তারা কেমন আছে তাই জানার জন্য একদিন সজিব দ্রং বড়ভাই এর রাজ্যে এলো। বড়ভাই খুব খুশি ছোট ভাইকে পেয়ে। বড়ভাই এর বিশাল রাজ্য । সৈন্য সামন্ত। আধিপত্য সবকিছু আছে। কিন্তু এতো বড় রাজ্যের রাজা হয়েও বড়ভাই এর মনে সুখ নেই। সারাদিন মনমরা হয়ে রাজপ্রসাদের ভেতরে থাকে। বড়ভাই তাকে জানালো তার মন্ত্রি ও সেনাপতি গোপনে তাকে মেরে ফেলে সিংহাসন দখল করার যড়যন্ত্র করছে। তাই সে রাজপ্রাসাদ ছেড়ে কোথাও বের হয় না। এইকথা শুনে সজিব দ্রং খুব দুঃখ পেল। সে বলল – এসব রাজ্য,ধনদৌলত ছেড়ে দিয়ে চলে এসো গারো পাহাড়ে। সুখে বাস করতে পারবে। বড়ভাই বলল – এইজন্যই বাবা বলেছিল কে জীবনে সুখি হবে আমি জানিনা। আসলে তুই বনকুসুমকে নিয়ে নিশ্চয় সুখে আছিস। এরপর সজিব দ্রং মেঝভাই এর রাজ্যে গেল। মেঝভাই তাকে খুব আদরে গ্রহন করল। মেঝভাই এর ও অবসহা একই রকমের। তার চার রানি। ছোট রানি হচ্ছে রাজ্যের সেনাপতির বোন। প্রাসাদ ষড়যন্ত্রে তারা লিপ্ত। ছোটরানি সেনাপতি ভাই এর সাহায্যে রাজাকে মেরে ফেলে নিজেই সিংহাসন দখল করতে চায়। এব্যাপারে রাজা খুবই উদ্বিঘ্ন। রাতে ঘুম নেই। মনে শান্তি নেই । সজিব দ্রং তাকেও বলল- এসব ছেড়ে দিয়ে গারো পাহাড়ে চলে এস। এরপর সে গেল সেজভাই এর কাছে। সে এখন আর জাহাজ নিয়ে বানিজ্য করতে যায় না। কারণ তার নাবিকরা জলদস্যুদের সাথে ষড়যন্ত্র করে তাকে হত্যা করে তার ধনসম্পদ লুন্ঠন করতে চাচ্ছে। তাকেও সে বলল – এসব ধনদৌলত ছেড়ে গারো পাহাড়ে চলে এস।

একদিন সত্যি সত্যিই তিনভাই চলে এলো। তারা দেখতে পেল বনের ভেতরে তাদের ছোটভাই তার স্ত্রী বনকুসুম কে নিয়ে খুব সুখেই দিন কাটাচ্ছে। তারাও আর গারো পাহাড় ছেড়ে গেলনা। বনকুসুমের তিন বোনকে তিনজনে বিয়ে করে আবার সুখে দিন কাটাতে লাগল। সহজ সরল জীবন সুন্দর সুখী জীবন।ভারতের মেঘালয় রাজ্যের গারো পাহাড় ও বাংলাদেশের ময়মনসিংহ জেলায় বসবাসকারী আদিবাসী সম্প্রদায়। ভারতে মেঘালয় ছাড়াও আসামের কামরূপ, গোয়ালপাড়া ও কারবি আংলং জেলায় এবং বাংলাদেশের ময়মনসিংহ ছাড়াও টাঙ্গাইল, সিলেট, শেরপুর, নেত্রকোনা, সুনামগঞ্জ, ঢাকা ও গাজিপুর জেলায় গারোরা বাস করে।গারোরা ভাষা অনুযায়ী বোডো মঙ্গোলীয় ভাষাগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত। জাতিগত পরিচয়ের ক্ষেত্রে অনেক গারোই নিজেদরকে মান্দি বলে পরিচয় দেন। গারোদের ভাষায় ‘মান্দি’ শব্দের অর্থ হল ‘মানুষ’। গারোদের সমাজে মাতৃতান্ত্রিক পরিবার প্রথা প্রচলিত। তাদের প্রধান ধর্মীয় ও সামাজিক উৎসবের নাম ‘ওয়ানগালা’; যাতে দেবতা মিসি আর সালজং এর উদ্দেশ্যে উৎপাদিত ফসল উৎসর্গ করা হয়। উল্লেখ্য ওয়ানগালা না হওয়া পর্যন্ত মান্দিরা নতুন উৎপাদিত ফসলাদি খেত না। আশ্বিন মাসে একেক গ্রামের মানুষদের সামর্থ্যানুযায়ী সাত দিন কিংবা তিনদিন ধরে এই উৎসব অনুষ্ঠিত হতো। অতীতে গারোরা সবাই তাদের নিজস্ব ধর্ম পালন করত। তাদের আদি ধর্মের নাম ‌’সাংসারেক’। ১৮৬২ সালে খৃষ্ট ধর্ম গ্রহণের পর থেকে বর্তমানে ৯৮ ভাগ গারোরাই খ্রীষ্ট ধর্মে বিশ্বাসী। খ্রীষ্ট ধর্ম গ্রহণের পর থেকে তাদের সামাজিক নিয়ম-কানুন, আচার-অনুষ্ঠানে বেশ পরিবর্তন এসেছে।

নৃ-গোষ্ঠীঃ খাসিয়া

বাংলাদেশের সিলেট জেলা ও ভারতের আসামে এই জনগোষ্ঠী বাস করে। সিলেটের খাসিয়ারা সিনতেং (Synteng) গোত্রভুক্ত জাতি। তারা কৃষিজীবী। ভাত ও মাছ তাদের প্রধান খাদ্য। তারা মাতৃপ্রধান পরিবারে বসবাস করে। তাদের মধ্যে কাঁচা সুপারি ও পান খাওয়ার প্রচলন খুব বেশি। খাসিয়াদের উৎপাদিত পান বাংলাদেশে খুব জনপ্রিয়। । চরম দারিদ্র্যের মধ্যে থেকেও এ সম্প্রদায়ের লোকজন শান্তিপ্রিয়। তাদের রয়েছে নিজস্ব নিয়ম-কানুন। তবে তাদের মধ্যে খাসিয়ারাই মাতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় পরিচালিত। তাদের সমাজ ব্যবস্থায় কোনো পুরুষ সম্পত্তির মালিক হয় না।পুরুষদের বিয়ে হলে তারা শ্বশুরবাড়ি গিয়ে ওঠে। তারাও এ অঞ্চলের অন্যান্য আদিবাসীর মতো একটি প্রাচীন সম্প্রদায় হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে সম্প্রীতি বজায় রেখে বসবাস করে আসছে। পাহাড়ের পাদদেশে বিভিন্ন টিলা এলাকায় তাদের বসবাস। দারিদ্র্য সীমার নিচে বাস করলেও তারা অত্যন্ত নিরীহ প্রকৃতির। তাহিরপুর, বিশ্বম্ভরপুর, দোয়ারাবাজার ও সদর উপজেলার সীমান্ত এলাকায় তারা বসবাস করছে। সুনামগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় প্রায় ২৫০টি খাসিয়া পরিবার বসবাস করছে। জানা যায়, খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে আর্যরা এ দেশে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করলে তারা আদিবাসীদের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। পরবর্তীকালে এ আদিবাসীরাই অনার্য বলে পরিচিতি লাভ করে। আর্য-অনার্য যুদ্ধে অনার্যরা পরাজিত হয়ে বনে জঙ্গলে আশ্রয় নেয়। পরে এ গহিন বনেই তারা বসবাস শুরু করে। ফলে তারা শিক্ষা দীক্ষা ও আধুনিক জীবন ব্যবস্থা থেকে দূরে থাকে। খাসিয়াদের সাংস্কৃতিক জীবন বেশ সমৃদ্ধ। তাদের ধর্মীয় ও সামাজিক অনুষ্ঠানগুলো খুব আকর্ষণীয়। তাদের ভাষায় রচিত গানগুলোও হৃদয়ছোয়া।

নৃ-গোষ্ঠীঃ মুরং

মুরং উপজাতিদের গো-বলি উৎসব।

মুরং বাংলাদেশের একটি জাতিগোষ্ঠি। মুরুং শব্দটি বহুবচন যার একবচন হল ‘ম্রো’। ‘ম্রো’ শব্দের অর্থ মানুষ। ম্রো ভাষায় ‘ম্রো’রা নিজেদের ‘মারুচা’ বলে থাকে। মুরুংদের ভাষা মৌখিক।

ম্রো পার্বত্য চট্টগ্রামের সর্বপ্রাচীন জাতি এবং বান্দরবান জেলার দ্বিতীয় বৃহত্তম জাতি। ম্রোদের আদি নিবাস মায়নামারের আরাকান রাজ্য। আনুমানিক ১৪৩০ খ্রিঃ অর্থাৎ আজ থেকে প্রায় ৫৯২ বছর আগে ম্রোরা বান্দরবান জেলার লামা, আলীকদম, থানছি ও নাইক্ষ্যংছড়ি এলাকায় আশ্রয় নিয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে থাকে। ম্রোরা মূলতঃ প্রকৃতি পূজারী হলেও অধিকাংশই বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। তবে কয়েক বছর আগে ম্রোদের মধ্যে একটা নতুন ধর্ম ‘ক্রামা’ আর্বিভাবের ফলে বর্তমানে ম্রোদের একটি অংশ ক্রামা ধর্মের অনুসারি। সপ্তদশ শতাব্দীর দিকে মুরুং উপজাতিরা আরকান থেকে পালিয়ে আলিকদমের বিভিন্ন পাহাড়ী উপত্যকায় স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে। তবে বার্মার আকিয়াব জেলায় এখনো মুরুং উপজাতীয় বসতি বিদ্যমান বলে জানা যায়।উপজেলা সদর থেকে দেড় কি.মিটার দুরে চিওনী পাড়া ও আমতলী এলাকায় এ সম্প্রদায়ের ২টি পাড়া রয়েছে। তাছাড়া প্রত্যন্ত পাহাড়ী এলাকা তৈন মৌজা, মাংগু মৌজা, চ্যৈং মৌজা, চাইম্প্রা মৌজা, তৈনফা মৌজা এবং তৈন খাল এলাকা ও মাতামুহুরী সন্নিহিত পাহাড়ী এলাকায় তাদের বসতি রয়েছে। তবে মাতামুহুরী নদী তীরবর্তী ও পাহাড়ে তাদের বসবাস উল্লেখ্যযোগ্য পরিমাণে। মুরুং সম্প্রদায়ের সমাজ ব্যবস্থা পিতৃতান্ত্রিক। মুরুংদের একটি অংশ আলীকদমের প্রত্যন্ত পাহাড়ী এলাকায় তাদের ‘‘কিম’’ ঘর তৈরী করে বসতি স্থাপন করেন। মুরুংরা তাদের ঘরে জীব জন্তুর মাথা ঝুলিয়ে রেখে থাকে। মুরুংদের মধ্যে কয়েকটি গোত্র রয়েছে; এর মধ্যে- ঙারুয়া, প্রেন্জু, জালা, কানবক, নাইজাহ, তাং, দেং প্রভৃতি। প্রত্যেক পাড়ায় তাদের মধ্যে নেতৃস্থানীয় একজনকে ‘কার্বারী’ নিযুক্ত করা হয়। মুরুং নারী-পুরুষ কঠোর পরিশ্রমী বলে এদের স্বাস্থ্য সুঠাম। মেয়েরাও পুরুষের পাশাপাশি পাহাড়ী জুমচাষে সমান পারদর্শী।

মুরংরা অত্যন্ত সল্পবসন পরিধান করে। মেয়েরা ‘ওয়াংকাই’ নামে একধরণের ছোট পরিধেয় ব্যবহার করে। যা নাভীর নীচ থেকে হাঁটুর উপরিভাগ পর্যন্ত পড়ে থাকে। এটি ৮ থেকে ১০ ইঞ্চি পর্যন্ত চওড়ামাত্র। মেয়েরা পায়ে “কক ক্যান” (নুপুর) কোমরে ‘‘রকম” (বিছা) পরে থাকে। পুরুষগণ ‘ডং’ (লেংটি-বিদ্রি) নামে একধরণের কিঞ্চিতকর বস্ত্র পরিধান করে। মুরুং মেয়েদের পাশাপাশি ছেলেরাও মাথায় লম্বা চুল রাখে। নারী-পুরুষরা মাথায় অধিকন্তু “চুরুত” (চিরুনি) গেঁথে রাখতে দেখা যায়। মুরুং মেয়েরা মাথায় কানে ও খোঁপায় বিভিন্ন ধরণের “পাও” (পাহাড়ী ফুল) গুজে রাখে। ছেলেরাও মাথার চুলকে খোপা আকারে বেঁধে রাখে। মুরংরা দাঁতের মধ্যে এক ধরণের রংয়ের প্রলেপ দিয়ে থাকে। লোহাকে উত্তপ্ত করে কাঁচা বাঁশের সাথে লাগিয়ে নির্গত রসকে দাঁতে লাগিয়ে দেয়। মুরুং সম্প্রদায়ের ছেলে একই গোত্রের কোন মেয়েকে বিবাহ করতে পারেনা। মুরুং সমাজে তিন পদ্ধতিতে বিবাহ হয়ে থাকে। রীতি অনুযায়ী মুরুং ছেলে কন্যার দেহের মূল্য বাবদ রৌপ্য মুদ্রায় ১১০/= টাকা, মায়ের দুধের দাম বাবদ ১০/= টাকা প্রদান করতে হয়। এসব রৌপ্য টাকা অবশ্য পরিশোধনীয় বলে গণ্য করা হয়। একই গোত্রের মধ্যে ধর্মীয়ভাবে বিবাহ নিষিদ্ধ। মুরুং দম্পতির মধ্যেও মনের মিল না থাকলে তালাক প্রথা বিদ্যমান রয়েছে।

মুরুং নৃত্যের মধ্যে ছেলে মেয়েরা গালে, ঠোঁটে ও কপালে রংয়ের প্রলেপ লাগায়। নৃত্যের আগে ১৫ থেকে ২০ জন মুরুং যুবক-যুবতী মুখোমুখী দাড়িয়ে অর্ধ চন্দ্রাকৃতি রচনা করে। এরপর তাদের তৈরী বাঁশির সুর ও বাজনার তালে তালে নৃত্য পরিবেশ করে থাকে। নাচে ও গানে বিবাহিত মেয়েদের অংশ নিতে দেয়া হয়না। মুরুং সম্প্রদায় নিজেরাই ‘‘প্লুং” নামের একটি বাঁশি তৈরী করে। পাহাড়ে উৎপন্ন ‘‘বুদুম’’ (এক ধরণের পাহাড়ী লাউ) এর শুকনো খোলের সাথে ৫/৬ বা ততোধিক “কাও” (বাঁশের কঞ্চি) এর টুকরা দিয়ে এ বাঁশীটি তৈরী করা হয়।

মুরুং সম্প্রদায় মূলতঃ প্রকৃতি পুজারী। তারা ইহকালকেই স্বর্বস্ব জ্ঞান করেন। তাদের মতে পরকাল বলতে কিছুই নেই। মুরুংদের ধর্মীয় বিধি নিষেধ সম্বলিত কোন ধর্মগ্রন্থ নেই। তাদের ধর্মবিশ্বাসে আকীর্ণ প্রধান উৎসবের নাম হলো “চিয়া-চট-প্লাই” অর্থাৎ গো-হত্যা উৎসব। গো-হত্যাকে ধর্মীয় অনুষঙ্গ হিসাবেই পালন করা হয়। প্রতিবছর জুমের ফসল ঘরে তোলার আগে মুরুং সম্প্রদায় মহাধুমধামের সাথে এ উৎসব করে। এছাড়া এ সম্প্রদায়ের পরিবারে কারো অসুখ বিসুখ হলে তারা রোগ বালাই থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার উদ্দেশ্যে ‘চিয়া-চট-প্লাই’ পালনের মানত করে থাকন। তারা “চাম্পুয়া” নামের অপর একটি উৎসব পালন করে থাকে। সৃষ্টিকর্তা তাদের ধর্মীয় বিধান কলাপাতায় লিপিবদ্ধ করেছিল বিশ্বাসে তারা কলাপাতা কেটে এ উৎসব করে থাকে। এ সম্প্রদায়ের অনেকে আবার ‘‘ক্রামা’’ নামের অপর একটি ধর্ম মতেও বিশ্বাস করে থাকে। মুরুং সম্প্রদায়ের কোন লোকের মৃত্যু হলে মৃতদেহ সপ্তাহ পর্যন্ত ঘরের মধ্যে রাখা হয়। মৃত ব্যক্তির পাশে শুকর, ছাগল ও মোরগ জবাই করে পরিবেশন করা হয়। মৃতকে নদী তীরবর্তী চিতায় দাহ করার আগ পর্যন্ত গান বাজনা ও নৃত্য পরিবেশনের মাধ্যমে উল্লাস করা হয়।

নৃ-গোষ্ঠীঃ মনিপুরি

মণিপুরী ভারত ও বাংলাদেশের একটি ক্ষুদ্র ও বৈশিষ্ট্যপূর্ণ জনগোষ্ঠীর নাম। এদের আদি নিবাস ভারতের মণিপুর রাজ্যে। মণিপুরীদের নিজস্ব ভাষা,বর্ণমালা, সাহিত্য এবং সমৃদ্ধ সংস্কৃতি রয়েছে। ভারতের মনিপুর রাজ্যে ও বাংলাদেশের সিলেট বিভাগের বিভিন্ন এলাকায় মণিপুরী সম্প্রদায়ের লোক বাস করে।অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগ থেকে ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমভাগ পর্যন্ত সংঘটিত বিভিন্ন সামাজিক, রাজনৈতিক ঘটনা প্রবাহের শিকার হয়ে এবং যুদ্ধজনিত কারণে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় মণিপুর রাজ্যের অধিবাসীরা দেশত্যাগ করে পাক-ভারত উপমহাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে আশ্রয় গ্রহণ করে। পার্শ্ববর্তী আসাম রাজ্যের কাছাড় জেলায়, ত্রিপুরা রাজ্যে এবং বাংলাদেশে ব্যাপক সংখ্যক মণিপুরী অভিবাসন ঘটে। বার্মা-মণিপুর যুদ্ধের সময় (১৮১৯-১৮২৫) তৎকালীন মণিপুরের রাজা চৌরজিৎ সিংহ, তার দুই ভাই মারজিৎ সিংহ ও গম্ভীর সিংহসহ সিলেটে আশ্রয়গ্রহণ করেন। যুদ্ধ শেষে আশ্রয়প্রার্থীদের অনেকেই স্বদেশে ফিরে যায়, কিন্তু বহু মণিপুরী তাদের নতুন স্থানে স্থায়ী বাসিন্দা হয়ে যায়। বাংলাদেশে আসা মণিপুরীরা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা, ময়মনসিংহের দুর্গাপুর, ঢাকার মণিপুরী পাড়া এবং প্রধানত বৃহত্তর সিলেটের বিভিন্ন স্থানে বসতি গড়ে তোলে। বর্তমানে সিলেট বিভাগের মৌলভীবাজার, সিলেট, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ জেলায় মণিপুরী জনগোষ্ঠীর লোক বাস করে।

ভাষাগত এবং ধর্মীয় ভিন্নতার কারণে বাংলাদেশের মণিপুরীরা তিনটি শাখায় বিভক্ত এবং স্থানীয়ভাবে তারা (১) বিষ্ণুপ্রিয়া, (২) মৈতৈ ও (৩) পাঙন নামে পরিচিত। মণিপুরের অধিবাসীদের মধ্যে এই তিনটি সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায় রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহের শিকার হয় এবং তারা বাংলাদেশে এসে পাশাপাশি বসতি স্থাপন করে। বিষ্ণুপ্রিয়ারা ককেশয়েড মহাজাতির আর্য-ভারতীয় উপপরিবারের অন্তর্গত এবং তাদের ভাষার নাম বিষ্ণুপ্রিয়া মনিপুরি ভাষা। মৈতৈরা মঙ্গোলয়েড মহাজাতির তিব্বতী-বর্মী উপ-পরিবারের অন্তর্গত এবং তাদের ভাষার নাম মৈ তৈ। পাঙনরা আর্য বংশদ্ভুত হলেও মৈতৈ ভাষায় কথা বলে এবং ধর্মীয়ভাবে তারা মুসলিম। বাংলাদেশের মণিপুরীদের মধ্যে বিষ্ণুপ্রিয়ারা সংখ্যাগরিষ্ঠ। পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০০৩ সাল নাগাদ বাংলাদেশে মণিপুরী বিষ্ণুপ্রিয়া জনসংখ্যা ৪০ হাজার এবং মণিপুরী মৈতৈ জনসংখ্যা ১৫ হাজার। ভাষাগত ভিন্নতা বাদ দিলে বিষ্ণুপ্রিয়া ও মৈতৈদের মধ্যে সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় ক্ষেত্রে তেমন পার্থক্য নেই।মণিপুরীদের সংস্কৃতি অত্যন্ত সমৃদ্ধ ও ঐতিহ্যবাহী। মণিপুরী সংস্কৃতির উজ্জ্বলতম দিক হলো মণিপুরী নৃত্য যা বিশ্বব্যাপী সমাদৃত। মণিপুরীদের মধ্যে ঋতুভিত্তিক আচার অনুষ্ঠান বেশি। বছরের শুরুতে হয় মণিপুরী বিষ্ণুপ্রিয়াদের বিষু এবং মৈতৈদের চৈরাউবা উৎসব। আষাঢ় মাসে জগন্নাথদেবের রথযাত্রা ও কাঙ উৎসবের সময় প্রতিরাত্রে মণিপুরী উপাসনালয় ও মন্ডপগুলোতে বৈষ্ণব কবি জয়দেবের গীতগোবিন্দ নাচ ও গানের তালে পরিবেশন করা হয়। কার্ত্তিক মাসে মাসব্যাপী চলে ধর্মীয় নানান গ্রন্থের পঠন-শ্রবন। এরপর আসে মণিপুরীদের বৃহত্ম উৎসব রাসপূর্ণিমা। অষ্টাদশ শতাব্দীতে মণিপুরের রাজা মহারাজ ভাগ্যচন্দ্র প্রবর্তিত শ্রীকৃষ্ণের রাসলীলানুকরন বা রাসপুর্ণিমা নামের মণিপুরীদের সর্ববৃহৎ অনুষ্ঠানটি বাংলাদেশে প্রায় দেড়শত বছর ধরে (আনুমানিক ১৮৪৩ খ্রী: থেকে) পালিত হয়ে আসছে। কার্ত্তিকের পুর্ণিমা তিথিতে দুরদুরান্তের ল ল ভক্ত-দর্শক মৌলবীবাজার জেলার সিলেটের কমলগঞ্জের মাধবপুর জোড়ামন্ডবের এই বিশাল ও বর্ণাঢ্য উৎসবের আকর্ষনে ছুটে আসেন। বসন্তে দোলপূর্ণিমায় মণিপুরীরা আবির উৎসবে মেতে উঠে। এসময় পালাকীর্ত্তনের জনপ্রিয় ধারা “হোলি” পরিবেশনের মাধ্যমে মণিপুরী তরুণ তরুণীরা ঘরে ঘরে ভিক্ষা সংগ্রহ করে। এছাড়া খরার সময় বৃষ্টি কামনা করে মণিপুরী বিষ্ণুপ্রিয়ারা তাদের ঐতিহ্যবাহী বৃষ্টি ডাকার গান পরিবেশন করে থাকে।

মণিপুরীদের নিজস্ব লৌকিক ধর্মের নাম “আপোকপা” যা অত্যন্ত প্রাচীন, আধ্যাত্মিকতায় গভীর ও দার্শনিকভাবে উচ্চস্তরের। প্রাচীন ধর্মবিশ্বাস অনুযায়ী সৃষ্টিকর্তা নিজের প্রতিকৃতি থেকে মানব জাতিকে সৃষ্টি করেছেন এবং প্রতিটি মানুষ সৃষ্টিকর্তার একেকটি ছায়া। এখনো মণিপুরী মৈতৈদের অনেকে এই ধর্মের অনুসারী। মণিপুরী বিষ্ণুপ্রিয়াদের একাংশের মধ্যের “আপোকপা” পূজার প্রচলন রয়েছে। অষ্টাদশ শতাব্দীতে মণিপুরীরা বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষিত হয়।

মণিপুরী জনগোষ্ঠীর প্রধান দুই জনগোষ্ঠীর মধ্যে ভাষার পার্থক্য রয়েছে, যেমন –

মৈতৈ
বিষ্ণুপ্রিয়া

মণিপুরী মৈতৈ ভাষাকে তিব্বতি-বর্মী উপ-পরিবারের কুকি-চিন দলে এবং বিষ্ণুপ্রিয়া ভাষাকে ইন্দো-আর্য উপ-পরিবারের বাংলা-অসমীয়া দলে অন্তর্ভুক্ত করা হয়, যদিও এই শ্রেণীকরণ নিয়ে ভাষাতাত্ত্বিকদের মধ্যে যথেষ্ট মতভেদ রয়েছে। অনেকে বিষ্ণুপ্রিয়া ভাষাকে মহারাষ্ট্রী-সৌরসেনী ভাষাশ্রেণীর আবার কেউ কেউ একে ইন্দো-মঙ্গোলয়েড উপশ্রেণীর তালিকাভুক্ত করা সমিচীন মনে করেন। উৎস ও বিকাশের ক্ষেত্রভুমি অভিন্ন হওয়ায় উভয় ভাষার মধ্যে ব্যাকরণগত সামঞ্জস্য রয়েছে। উভয় ভাষাতেই পার্বত্য নাগা ও কুকিভাষার প্রভাব পরিলতি হয়। শব্দভাণ্ডারের দিক থেকে উভয় ভাষাতেই ব্যবহৃত হয় এমন শব্দসংখ্যা চার হাজারেরও বেশি।

১৮৮৯ সনে প্রকাশিত ভারতবর্ষের ভাষা শ্রেণীবিভাগের প্রধান ভিত্তি স্যার জর্জ আব্রাহাম গ্রিয়ার্সনের Linguistic Survey of India-তে মৈতৈ ভাষার পাশাপাশি বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষাকে মণিপুরের অন্যতম ভাষা হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। দুইটি ভাষাই ভারতে স্বীকৃতি লাভ করেছে এবং আসাম ও ত্রিপুরা রাজ্যের স্কুলগুলোতে মণিপুরী মৈতৈ ও বিষ্ণুপ্রিয়া উভয় ভাষায় শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ করে দিয়েছে। মণিপুরি (মৈতৈ) ভাষা ভারতের অন্যতম রাস্ট্রভাষা এবং মণিপুর রাজ্যের রাজ্যভাষা। মণিপুর রাজ্যে মণিপুরী মৈতৈ ভাষায় স্নাতকোত্তর পর্যায় পর্যন্ত শিক্ষাগ্রহণের সুযোগ রয়েছে। তবে বিষ্ণুপ্রিয়া ভাষায় মণিপুরে শিক্ষাগ্রহণের সুযোগ নেই। ১৯৭৬ সাল থেকে বাংলাদেশ বেতার সিলেট কেন্দ্র থেকে প্রতি সপ্তাহে “মণিপুরী অনুষ্ঠান” শিরোনামে পর্যায়ক্রমে বিষ্ণুপ্রিয়া ও মৈতৈ ভাষায় অনুষ্ঠান প্রচার শুরু হয় এবং এই অনুষ্ঠানের সম্প্রচার এখনো অব্যাহত রয়েছে।সূর্যদেবতার উদ্দেশ্যে রচিত গীতিকবিতা ঔগ্রী মণিপুরী মৈতৈ সাহিত্যের প্রাচীনতম নিদর্শন, যা খ্রীস্টিয় ৩৩ অব্দে রচিত। ঐছাড়া অনেক প্রেমগীতি ও লোকগাথা মণিপুরী মৈতৈ সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। মণিপুরি (মৈতৈ) সাহিত্যের লিখিত অস্তিত্ব পাওয়া যায় খ্রিষ্টীয় অষ্টম শতাব্দী থেকে। অপরদিকে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষারও প্রাচীন সাহিত্যেভাণ্ডার রয়েছে। বরন ডাহানির এলা (বৃষ্টি ডাকার গান / ১৪৫০-১৫০০ খ্রী:), মাদই সরাহাল এলা (বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী লোকগান / ১৬০০-১৭০০ খ্রী:),খাম্বাথৈবীর প্রেমকাহিনী(১৫০০-১৬০০ খ্রী:), আপাঙর য়্যারী (লোককথা), পৌরেই (প্রবচন) ইত্যদি বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী লোকসাহিত্যর অমূল্য সম্পদ। উনিশ শতকের মধ্যভাগে তৎকালীন বৃটিশ ভারতের রাজনৈতিক এজেন্ট Colonel McCullock তাঁর Valley of Manipur and Hill Tribes গ্রন্থে ইংরেজি, মণিপুরী বিষ্ণুপ্রিয়া ও মণিপুরী মৈতৈ ভাষার তুলনামুলক সংক্ষিপ্ত অভিধান প্রণয়ন করেন।

হাতে বোনা কাপড় তৈরীতে মণিপুরীরা খুবই দক্ষ। নিজেদের কাপড় তারা নিজেরাই তৈরি করে থাকে। প্রায় প্রতিটি ঘরেই তাঁত রয়েছে। মণিপুরী হস্তশিল্প বিশ্বময় সমাদৃত। মণিপুরীদের বোনা তাঁতের শাড়ি, গামছা, চাদর,ব্যাগ ইত্যাদি অন্যান্য জাতির মধ্যেও সমান জনপ্রিয়।

বৃটিশ শাসনামলে মণিপুরী কৃষকদের সংগ্রামের ইতিহাস সর্বজনবিদিত। ১৯৪৩ সনে জমিদারী ও সামন্তবাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিল তৎকালীন মৌলবীবাজার মহকুমার ভানুগাছ পরগনার ভানুবিল গ্রামের মণিপুরী বিষ্ণুপ্রিয়া ও মণিপুরী মৈতৈ স¤প্রদায়ের কৃষকরা।

মানব সৃজনঃ

অপরূপ ধার্তি (পৃথিবী) সৃষ্টি হল। দিন যায়; এক সময় হাঁস-হাসিল সিরাম দান্ধিতে (বিন্না ঝোপে) বাসা বাধল, হাসিল দুটি ডিম প্রসব করল। হাসিল ডিমে তা দেয়, আর পুরুষ হাসটি খাদ্য সংগ্রহ করে আনে এভাবে করতে করতে একদিন ডিম ফুটল। আশ্চর্য! ডিম থেকে দুটি মানব শিশুর জন্ম হয়েছে। একটি পুরুষ শিশু ও অন্যটি মেয়ে শিশ।

এমনি সন্ধিক্ষণে হাস-হাসিল মহা চিন্তিত। কর্তব্য বিমুঢ় তখন তারা হমর সুরে (বিলাপ করে)

হায় হায় জালা পুরিরে

হায় হায় নুকিন মানেআ

হায় হায় বুসৗড় আকান কিন,

হায় হায় নুকিন মানেআ

হায় হায় তকারে দহকিন।

হায় হায় এহো ঠাকুরজিউ

হায় হায় মারাং ঠাকুরজিউ।

হায় হায় বুসৗঢ় আকানকিন

হায় হায় একিন মানেআ

হায় হায় তকারে দহকিন।

বঙ্গানুবাদ-

হায় হায় এ দুটি মানব

হায় হায় জন্ম নিয়েছে

হায় হায় এ দুটি মানব

হায় হায় কোথায় রাখিব।

হায় হায় ওহে ঠাকুরজী

হায় হায় পরম ঠাকুরজী

হায় হায় জনম নিয়েছে

হায় হায় এ দুটি মানব

হায় হায় কোথায় রাখিব।

হাঁস-হাসিলের করুন আর্তি, আকুল আবেদনে ঠাকুরজি সাড়া দিলেন। তাদের সামনে প্রকট হলেন তারা ঠাকুরজিকে নিবেদন করল কেমন করে এ মানব দুটিকে বাচাব? ঠাকুরজিউ তাদেরকে তুলো দিলেন এবং বললেন তোমরা যা যা খাও তার রস বের করে এ তুলো ভিজিয়ে নিও এবং এদেরকে চুষে খাওয়াবে। তারা ঠাকুর জিউ এর শিক্ষা মতে অনুরুপ ভাবে খাওয়াতে লাগল। শিশু দুটি চুষে খেয়ে হাটতে শিখল। শিশু দুটি বড় হতে হতে হাস-হাসিল চিন্তিত হল। বড় হলে এদেরকে কোথায় রাখা হবে।

তখন তারা আবার ঠাকুরজিউকে স্মরণ করলেন; তখন ঠাকুরজিউ তাদেরকে উপদেশ দিলেন তোমরা উড়ে গিয়ে এদের থাকার জন্য জায়গা পচ্ছন্দ করে আস। তখন তারা সূর্য অস্তের দিকে উড়ে গেল। প্রকৃতির নৈসর্গ লীলা ভূমি (হিহিড়ি-পিপিড়ি) এলাকাটি পছন্দ করল। ফিরে এসে তারা ঠাকুরজিউকে তাদের পছন্দমত জায়গার বিবরণ জানাল। তখন তিনি তাদেরকে বললেন অতি উত্তম। এখন তোমরা এদেরকে সেখানে নিয়ে যাও। তখন হাঁস-হাসিল শিশু দুটিকে পিঠে করে উড়ে নিয়ে যেখানে পৌঁছে দিল।

যেহেতু তাদের জন্মস্থান থেকে সূর্য অস্তের দিকে তাদেরকে পৌঁছে দেয়া হল, এই জন্যই এ পুরা কাহিনী মতে বলা হয়ে থাকে মানবের জন্ম সূর্য উদয়ের দিকে। হিহিড়ি-পিপিড়ি মানব শিশু দুটিকে পৌঁছে দেয়ারপর হাঁস-হাসিল দুটি কোথায় অন্তর্ধন হলেন সে বিষয়ে কোন বর্ণনা নেই। হয়তোবা মানব জন্মের লীলার জন্যই তাদের আগমন ঘটেছিল।

সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে নভেম্বর, ২০১৫ রাত ৮:০৪
১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মসজিদ না কী মার্কেট!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৮ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৩৯

চলুন প্রথমেই মেশকাত শরীফের একটা হাদীস শুনি৷

আবু উমামাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, ইহুদীদের একজন বুদ্ধিজীবী রাসুল দ. -কে জিজ্ঞেস করলেন, কোন জায়গা সবচেয়ে উত্তম? রাসুল দ. নীরব রইলেন। বললেন,... ...বাকিটুকু পড়ুন

সচিব, পিএইচডি, ইন্জিনিয়ার, ডাক্তারদের মুখ থেকে আপনি হাদিস শুনতে চান?

লিখেছেন সোনাগাজী, ১৮ ই মে, ২০২৪ সকাল ১১:৪৫


,
আপনি যদি সচিব, পিএইচডি, ইন্জিনিয়ার, ডাক্তারদের মুখ থেকে হাদিস শুনতে চান, ভালো; শুনতে থাকুন। আমি এসব প্রফেশানেলদের মুখ থেকে দেশের অর্থনীতি, রাজনীতি, সমাজনীতি, বাজেট,... ...বাকিটুকু পড়ুন

আকুতি

লিখেছেন অধীতি, ১৮ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৩০

দেবোলীনা!
হাত রাখো হাতে।
আঙ্গুলে আঙ্গুল ছুঁয়ে বিষাদ নেমে আসুক।
ঝড়াপাতার গন্ধে বসন্ত পাখি ডেকে উঠুক।
বিকেলের কমলা রঙের রোদ তুলে নাও আঁচল জুড়ে।
সন্ধেবেলা শুকতারার সাথে কথা বলো,
অকৃত্রিম আলোয় মেশাও দেহ,
উষ্ণতা ছড়াও কোমল শরীরে,
বহুদিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

ক- এর নুডুলস

লিখেছেন করুণাধারা, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:৫২



অনেকেই জানেন, তবু ক এর গল্পটা দিয়ে শুরু করলাম, কারণ আমার আজকের পোস্ট পুরোটাই ক বিষয়ক।


একজন পরীক্ষক এসএসসি পরীক্ষার অংক খাতা দেখতে গিয়ে একটা মোটাসোটা খাতা পেলেন । খুলে দেখলেন,... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্প্রিং মোল্লার কোরআন পাঠ : সূরা নং - ২ : আল-বাকারা : আয়াত নং - ১

লিখেছেন মরুভূমির জলদস্যু, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:১৬

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
আল্লাহর নামের সাথে যিনি একমাত্র দাতা একমাত্র দয়ালু

২-১ : আলিফ-লাম-মীম


আল-বাকারা (গাভী) সূরাটি কোরআনের দ্বিতীয় এবং বৃহত্তম সূরা। সূরাটি শুরু হয়েছে আলিফ, লাম, মীম হরফ তিনটি দিয়ে।
... ...বাকিটুকু পড়ুন

×