ত্রয়ীর স্কুলে প্রতিদিন আসা-যাওয়া করতে
তা প্রায় ত্রিশ টাকা লেগে যায় । ওর টিফিন
বাবদ খরচটা তেমন হয়না বললেই চলে ।
কারণ , ত্রয়ীর আম্মু বাসা থেকে টিফিন
তৈরী করে দেন ।
গেল বছর ত্রয়ীর বাবা হঠাত্ হৃদরোগে
আক্রান্ত হয়ে মারা যান ! সংসারের কর্তা
না থাকলে একজন মহিলার দ্বারা সংসার
চালাতে অনেকটাই হিমশিম খেতে হয় । যদিও
ত্রয়ীর আম্মু একটা স্কুলের শিক্ষিকা ।
শহরের মধ্যবিত্ত পরিবারে " আয় বুঝে ব্যয়
করাটাই যেন রীতি " ।
ত্রয়ীর জন্য ওর মা একটা রিক্সা ঠিক করে
দিলেন । ত্রয়ী এই রিক্সাতে করেই প্রতিদিন
স্কুল থেকে বাসা পর্যন্ত আসা-যাওয়া
করবে । মেয়েটা যে দিন দিন তাল গাছের মত
লম্বা হয়ে যাচ্ছে এ বিষয়টা ওর মায়ের
চোখকে এঁড়ায়নি ।
একটা মেয়ের সবচেয়ে বিশ্বস্থ বন্ধু মা ছাড়া
কেউ নন । পৃথিবীতে একটা মেয়ে শুধু তার
মায়ের কাছেই সবচেয়ে নিরাপদ । অনেকে
হয়তো আমার কথার প্রতিবাদ করতে চাইবে
। দেখুন , একটা মেয়ে তার বাবা , ভাই কিংবা
স্বামী দ্বারাও ধর্ষিত হয় ।
হ্যাঁ , ত্রয়ীর মা এবং ত্রয়ী পরস্পরের খুব
ভালো বন্ধু । আর বন্ধুত্ব সম্পর্কটাই
যেন পৃথিবীর সবচেয়ে খাঁটি একটা সম্পর্ক ।
হয়তো সে কারণেই ঈশ্বর পয়গম্বরদের
সাথে বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন ।
ত্রয়ী কাল থেকে যেই রিক্সায় করে স্কুলে
যাবে সেই রিক্সাওয়ালা ছেলেটার বাড়ি
বিরিশিরি এলাকায়। ত্রয়ীদের গ্রামের বাড়ির
পাশেই হৃদয়দের বাড়ি । ত্রয়ীর আম্মুর
পরিচিত বলেই হৃদয়কে এ দায়িত্বটা দেয়া
হয়েছে । হৃদয় একাদশ শ্রেণীতে ভর্তি
হয়েছিল । সংসারের অভাব-অনটন সীমা
অতিক্রম করায় তাকে বাধ্য হয়েই রিক্সা
নিয়ে নামতে হয়েছে ।
হৃদয় ছিল ক্লাসের ফ্রাস্ট ছিল । সে গণিত ,
রসায়ন ও পদার্থ বিদ্যায় এস. এস সি তে
জিপিএ-৫ পেয়েছিল ।
কিন্তু অভাগার কপালে সব বিষয়ে এ+ পাওয়া
হয়নি !
ময়মনসিংহের মত শিক্ষা শহরে এসে হৃদয়
যেন স্বপ্নের জগতে পা রেখেছে ।
হৃদয়ের ছোট বেলা থেকেই স্বপ্ন ছিল চাঁদে
যাবে ! তাই , রকেটের প্রতি ওর একটা নেশা
আছে । সে রিক্সার পেডেলে পা রেখে ভেসে
বেড়ায় তার স্বপ্নে !
ঠিক সকাল ন'টায় ত্রয়ীদের বাসার সামনে
হৃদয় তার রকেট নিয়ে হাজির !
আসলে বাস্তবে একটা অতি নগন্য রিক্সা
কী করে যে স্বপ্ন নভোযান হয়ে যায় তা
সত্যিই অদ্ভূত !
ত্রয়ী স্কুল ব্যাগটা কাধে নিয়ে আম্মুর কাছ
থেকে বিদায় নিল ।
বাসার গেইটের সামনেই দাঁড়িয়ে আছে একটা
রিক্সা ।
ত্রয়ী রিক্সাওয়ালা ছেলেটিকে জিজ্ঞেস
করল তোমাকেই কি আম্মু আমার আনা-
নেয়ার দায়িত্ব দিয়েছে ?
একটা অপ্রিয় সত্য কথা হচ্ছে ,
রিক্সাচালক , কুলি , মেথর অথবা অন্যান্য
ছোট পেশায় নিয়োজিত বিশাল
জনগোষ্ঠীর মানুষগুলোর কোনো নাম নেই
। আধুনিক যুগে রিক্সাওয়ালারা শিয়াল
মামাদের মত কোনো এক প্রকার মামা
শ্রেণীর মানুষ । এই শ্রেণীর মামা অনেক
দোকানদার , বাসের হেল্পার ইত্যাদি
অনেকেই ।
ত্রয়ী একটু চঞ্চল টাইপের মেয়ে বলেই
নগন্য রিক্সাওয়ালাকে তুমি ডেকে বসল
এবং জানতে চাইলো সেই রিক্সাওয়ালার
নাম ।
গম্ভীর টাইপের মানুষগুলো কেন যেন
অহংকারী হয়ে থাকে ।
কিন্তু চঞ্চল মানুষের দিলটা বড়ই সাচ্চা ।
ত্রয়ী আর হৃদয়ের মধ্যে দীর্ঘ কথা চলতে
থাকে । ত্রয়ী হৃদয়ের মনে লুকিয়া থাকা
দুঃখের কথা জেনে নিজেও ব্যথিত হয় ।
কারণ , সেও তো পিতৃহীন এক দুঃখীনি ।
ত্রয়ী জেএসসি তে গোল্ডেন এ+ পেয়েছে ।
এই গোল্ডেন এ+ পাওয়ার পেছনে হৃদয়েরও
অবদান ছিল । সে জটিল বিষয়গুলো ছন্দের
মাধ্যমে শেখাতে শেখাতে ত্রয়ীকে স্কুলে
আনা-নেয়া করত ।
ত্রয়ী আর হৃদয় এখন খুব ভালো বন্ধু হয়ে
গেছে ।
হৃদয় এবার এইচ এস সি পরীক্ষা দেয়ার কথা
ভাবছে । সে রিক্সা চালালেও দৈনিক দু-ঘন্টা
সময় নিয়মিত অধ্যয়ন করে ।
সুসং-দুর্গাপুর কলেজে সে শুধু টার্ম
পরীক্ষায় অংশ নেয়ার সুযোগ পায় ।
আসলে প্রত্যয়ী হৃদয় হেরে যেতে চায় না ।
ত্রয়ীটা ইদানিং হৃদয়কে বড্ড জ্বালাতন
করে ।
এইতো গতকাল হৃদয়কে পার্কে নিয়ে যেতে
বললো ।
ওর বান্ধবীদের সামনে হৃদয়কে ডেকে নিল
এবং ফুস্কা খাওয়াল । হৃদয়কে নিয়ে গেল
রেস্টুরেন্টে । অঁজপাড়া গাঁয়ের ছেলেটি
কোনোদিন ফাস্ট ফুড খায়নি ।
জীবনের প্রথম ওসব খাবার খেতে যেয়ে
নানান বিড়ম্বনার মুখে পরল হৃদয় ।
হদয় এইচ এস সিতে জিপি-এ পাঁচ পেয়েছে ।
পত্র-পত্রিকায় হৃদয়ের ছবি ছাপা হল ।
হৃদয়ের পাশে এসে অনেকেই দাঁড়াল । এরা
ক্ষণিকের জন্য আসে ।
কিন্তু এই হতদরিদ্র ছেলের পক্ষে
বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য প্রস্তুতি নেয়াটা
অনেক কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে । ত্রয়ীর
আম্মুর কাছ থেকে কিছু টাকা নিয়ে হৃদয়
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা
ফরম তোলে ।
যাতায়ত খরচ দেয়ার মত সাধ্য ছিলনা বলে
অন্য কোথাও পরীক্ষা দেয়া হয়নি হৃদয়ের ।
ত্রয়ী মুমিনুন্নেসা কলেজে ভর্তি হয় । হৃদয়
বাকৃবিতে এগ্রিকালচারে পড়ে । হৃদয়
ত্রয়ীদের বাসায় জায়গীর হিসেবেই থাকে
এবং ত্রয়ীকে পড়ায় ।
হৃদয়কে এখন আর রিক্সা চালাতে হয়না ।
রকেট বানানোর চিন্তাটা এখনো জীবিত
আছে ।
ত্রয়ী ঠিক করেছে হৃদয়ের কাছে সত্যটা
প্রকাশ করবে ।
কাল ১৪ ফেব্রুয়ারী । ত্রয়ী হৃদয়কে নিয়ে
বোটানিক্যাল গার্ডেনে যায় ।
ত্রয়ী হৃদয়কে তার সুপ্ত ভালোবাসার কথা
ব্যক্ত করে ।
ঐ মায়াবী চোখের দিকে চেয়ে হৃদয় নির্বাক
হয়ে যায় । দুজনেই নিষ্পলক দৃষ্টিতে
দুজনের দিকে চেয়ে থাকে ।
ত্রয়ীর প্রিটেস্ট পরীক্ষা চলছে । ত্রয়ী ও
হৃদয়ের সম্পর্কটা ত্রয়ীর আম্মুর চোখে
ধরা পড়ে যায় ।
হৃদয়কে ডেকে নিয়ে ত্রয়ীর আম্মু অপমান
করে । হৃদয় নিচু বংশের ছেলে, হৃদয় একজন
রিক্সা চালক , হৃদয় গরীব ।
হৃদয় আজ রাতে ত্রয়ীদের বাসা ছেড়ে চলে
যায় ।
এদিকে ত্রয়ীর মামা হৃদয়কে মেরে ফেলার
ছক আঁকে ।
ত্রয়ীকে কিছু না জানিয়ে হৃদয়ের এভাবে চলে
যাওয়াতে ত্রয়ী বেশ অভিমান করেছে ।
ত্রয়ীর টেস্ট পরীক্ষা শেষ । রাতে ত্রয়ী
আর তার আম্মু রাত ন'টার খবর দেখছিল।
@ ব্রেকিং নিউজ
...............
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী
ছাত্র হৃদয় সন্ধ্যে সাতটার দিকে
সন্ত্রাসীদের হাতে খুন ! ! !