somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আমার আব্বু

১০ ই জুলাই, ২০১২ সন্ধ্যা ৭:৫০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

মা বাবা পৃথিবীতে বোধহয় সবচেয়ে আপনজন। এরচেয়ে আপন কেউ কখনো হয়নি, হতে পারেনা।
কতই না অবহেলা করি বাবা , মা কে। রাগ করে ফোনটা ঠাস করে রেখে দেই। কিন্তু তাঁরা সব ভূলে যান এক মূহুর্তে। সারাক্ষন চিন্তা করেন আমরা তাঁদের সন্তানরা কেমন আছি, কি করছি।

মা বাবার মধ্যে কে বেশী প্রিয় ? এই প্রশ্নের উত্তর দিতে যাওয়াটা স্বার্থপরতা হয়ে যাবে। কিন্তু মেয়েরা নাকি বাবার বেশী প্রিয় হয়, আর বাবারাও নাকি মেয়েদের কাছে বেশী আদর পায়!
জানিনা শোনা কথাটা কতটুকু যুক্তিনির্ভর।
কিন্তু আমার ক্ষেত্রে বোধহয় কথাটা একেবারে ভূল না।
আমার জন্মের অনেক আগে থেকেই আব্বু নাকি বলতো যে আমার মেয়েই হবে, কিন্তু আম্মু বলতো ছেলে হবে।
আব্বু বলতো না না ছেলে বাচ্চাদের চঞ্চলতা আমার একটুও ভালো লাগেনা। সারাক্ষন ছেলেরা খুব শোরগোল করে এরচেয়ে মেয়েই ভালো,মেয়েরা অনেক শান্ত শিষ্ট।
আসলে আমার আব্বু এতটা শান্ত একজন মানুষ, সবকিছুতে খোঁজেন প্রশান্তি আর নীরবতা।
ছোট থাকতে দেখতাম টিভির সাউন্ড একটু জোরে দিলেই খুব রাগ করতেন আব্বু।
যাইহোক আব্বুর কথা মেনে নিয়েই বোধহয় আমার জন্ম হলো।
৩ জুলাই রাত ১১.৪০ মিনিটে আমার জন্ম।এতো রাতে ঐসময় রাজশাহীতে সব মিষ্টির দোকানই প্রায় খালি। মিঠুমামা খুঁজে নিয়ে আসলো কালো জাম।
আমার আম্মু বেশ কালো, আব্বু মিষ্টি দেখে বললো কালো জাম নিয়ে আসছো! মেয়ে বোধহয় কালো হয়ে গেলো!
আম্মুর কাছে শোনা আব্বু নাকি আমি ছোট থাকতে আমাকে কোলে নিয়েই চেম্বারে কাজ করতো।
এখন ভাবতে খুব অবাক লাগে এই ব্যস্ত মানুষটা যে কিনা ছুটির দিনেও সন্ধ্যার আগে গোসল করার টাইম পায়না সে কি সত্যি আমাকে কোলে নিয়ে কাজ করতো!!
ছোট থাকতে আব্বু দেখতাম এমনি এমনি বাজারে নিয়ে যেতো আর একটা করে খেলনা কিনে দিতো। অথচ আমি কখনোই খেলনা চাইতাম না।
ঈদের সময় আমার একটা ভালো জামা কিনতে হবে এই নিয়ে আব্বুর থাকতো একটা বিশেষ চিন্তা!
না বলে কয়েই একটা করে জিনিস বাসায় এনে হাজির করতো, তার মধ্যে আছে মুনিয়া পাখিগুলোও
আব্বু আমাকে কখনো বকেছে মনে পড়েনা। আম্মু ছিল যেমনই রাগী আব্বু ততটাই ঠান্ডা।
পড়াশোনা,খেলা কোনকিছুর জন্যই আব্বু কোনদিন বকেনি আসলে। আর আমিও ছোট থাকতে খুবই শান্ত ছিলাম।
তখন নওগাঁতে বিশাল বিশাল মিঠা পানির নানারকম মাছ পাওয়া যেত। প্রায়ই বিশাল একটা বোয়াল বা কাতলা বা আইড় বা চিতল মাছ এনে দেখতে ডাকতো। ছোট থাকতে এই ব্যাপারটা খুব এনজয় করতাম।
ছোট থাকতে আমার প্রায়ই খুব অসুখ হতো, হঠাৎ ই হয়তো জ্বরে পড়ে গেছি।৪ বছর বয়সে টাইফয়েড হয়েছিলো, কোনভাবেই ভালো হচ্ছিলনা। নওগাঁতে প্রপার ট্রিটমেন্ট হচ্ছিলো না।
আমাকে রাজশাহীতে নিয়ে যাওয়া হলো, সেখানেও খুব একটা ভালো ছিলাম না। সেটা ১৯৯১ এর দিকে। কিছুই খেতে পারতাম না, যা খেতাম বমি করে দিতাম। পেটে খাবার একমুহূর্ত রাখতে পারতাম না। আব্বু রোজই দুইতিন বার ফোন করে খোঁজ নিতো আমি কেমন আছি। একদিন ফোনে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে আম্মুর কাছে।
আমিতো তখন এতো বুঝতাম না। পরে আব্বু যখন ফোন করে তখন আমি বলি আব্বু তুমি এতো বোকা কেনো?
আমারতো অসুখ ভালো হয়ে গেছে!!
মনে পড়ে শীতকালে লেপমুড়ি দেয়া নিয়ে একটা খেলা খেলতাম আব্বুর সাথে।
স্কুলে একটা দুষ্টু ছেলে ছিলো, সবাইকে ধরে মারতো। একদিন আমাকেও ধরে মারলো।
আম্মু বললো ছেলেটাকে আচ্ছা শিক্ষা দিতে হবে। আব্বু বললো থাক আমি ই বলে আসবো।
আব্বু ছেলেটার মাথায় হাত দিয়ে বলে আসলো আর এইরকম করোনা বাবা আচ্ছা?
আবারও ছেলেটা আমাকে মারলো, আম্মু বললো আগেই বলছিলাম আমি ছাড়া কাজ হবেনা!!
আম্মু এমন কড়া কথা শুনিয়ে আসলো যে ছেলেটা আর আমাকে মারার সাহস পায়নি।
আব্বু আসলে এইরকমি কাউকে কিছু বলতে পারেনা।
আব্বু আর আম্মু দুইজন উত্তর মেরু আর দক্ষিন মেরু।
কিন্তু আব্বু সবকিছুই তার শান্ত কোমল স্বভাব দিয়ে সুন্দর করে সাজিয়ে নেয়।
ভাড়া একটা ছোট্ট বাসা থেকে আজকের বিশাল আর অনেক সুন্দর বাসাটা আব্বুর দিনরাত অক্লান্ত পরিশ্রমের ফসল। কোনদিন জমিজমা, সম্পত্তির উপর আব্বুর লোভ ছিলনা। কিন্তু আমরা যখন প্রায় বলি এটা থাকলে ভালো হতো ওটা থাকলে ভালো হতো তখন যেনো আব্বু ছোটে টাকার পেছনে। নিজের প্রতি চাওয়া নেই কোন খালি তার মাথায় যেন ঘুরে আমার দুই মেয়ের জন্য অনেক কিছু লাগবে অনেক কিছু!!
এমনকি আমি অবাক হই এত ব্যস্ততার মাঝে এটা কখন ভাবলো যে মেয়ের বিয়ে দিলে রুপার টিফিন ক্যারিয়ারে করে খাবার দিয়ে আসতে হবে মেয়ের বাড়িতে?
একদিন সত্যি খুব রাগ করে আম্মুকে বললাম তোমরা কি ভাবো যে মেয়ের এমন এক ফকিরের সাথে বিয়ে হবে যার বাড়িতে খাবার থাকবেনা?
তাই তোমাদের খাবারও দিয়ে আসতে হবে?
আমি কিন্তু খাবার দিয়ে গেলে সত্যি ওটা আবার ফেরত দিয়ে দিবো!!!
আস্তে আস্তে আমি বড় হলাম, ভার্সিটি কোচিং করতে সর্বপ্রথম বাসার বাইরে এলাম। আব্বু সবসময় ফোন করে বলতো পড়ো, ঘুড়ে বেড়িও না, টাকাপয়সার কোন সমস্যা নাই।
যতবার ফোন করতো ততবার টাকার কথা বলতো।
এখনো যতবার ফোন করে ততবার দুইটা কথা জিগ্গেস করতে কখনো ভোলে না, এক কোন সমস্যা নাইতো?
দুই, টাকা আছে?
আমি বলি, তুমিতো জানোই আমার এটিএম এ অলটাইম কয়েকহাজার টাকা জমা থাকে। তাহলে যতবার ফোন করে ততবার টাকার কথা কেন যে বলে!!
প্রায়ই বিভিন্ন চাকরির ইন্টারভিউ দেই।কয়েকদিন আগে এক জায়গায় ইন্টারভিউ দিতে যাবো তখন আব্বু ঢাকায়। আমি পৌছার আগেই আব্বু সেখানে পৌছে গেছে।
আমার চাকরি , আমার কেরিয়ার নিয়ে ভাবতে ভাবতে আব্বু ইদানিং অনেক নার্ভাস।
ইন্টারভিউ শেষে যখন বের হই, আবার দেখি পকেট থেকে কয়েক হাজার টাকা বের করে আমাকে দিচ্ছে।
বলো কেন তুমি আমাকে টাকা দিচ্ছো?
কেনো!!
আমার কাছে টাকা আছে।
আব্বুর এক বন্ধু বলে তোমার আর তোমার বাপের মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে তোমার বাপ তার বাপের কাছে টাকা চেয়ে নিয়েছে আর তোমার চাইতে হয়না!
আব্বু তখন বলে টাকা কেনো দিচ্ছি!! সেটাতো বুঝবেনা!!
ইদানিং দেখি আব্বু প্রায় প্রায় বলতে থাকে আমার ছোট মেয়েটা এবার আর্টস থেকে গোল্ডেন এ প্লাস পেয়েছে।
বলো কতো মানুষই তো এখন পাচ্ছে, এতো না বললে হয়না?
সেটাও হয়তো আমরা বুঝবোনা উনি কেনো নিজের মেয়ের সাফল্য এতটা বলেন!
আব্বুর কাছে চেয়ে পাইনি এমন জিনিসের নাম আমি মনে করতে পারিনা।
চাকরিপ্রার্থী আমি আর আমার জন্য পেপারে আদ্যপান্ত পড়ে নিয়ে যেকোন সার্কুলার নিয়ে আব্বু তীরের গতিতে আমাকে জানিয়ে দেয়!
এমনকি মানা করা সত্তেও সিভি পাঠানোর ঠিকানা টা পর্যন্ত মেসেজে জানিয়ে দেয়।
যেমন করে অসুখ হলে ঔষধ খাবার সময়টা মনে করে দেয়।
আমি বিজি থাকলে দেয় এসএমএস।
আমার ঔষধ আমারই খাওয়ার কথা মনে থাকেনা।
এমনকি আম্মু দিনে / দুইদিনে একবার ঔষধের কথা বললেও আব্বু এত ভয়ঙ্কর ব্যস্ততার ফাঁকে ঠিকই মনে করিয়ে দেয় নির্দিষ্ট সময়ে।
আমি হয়তো আমার ২৫ বছরের জীবনের আব্বুকে নিয়ে ৯৯ ভাগ কথাই এখানে বলতে পারিনি কিন্তু তারপরো এই লেখাটা লিখতে গিয়ে কয়েকবার চোখ মুছে ফেলেছি।
কেনো?
সব মেয়ের বাবারা আর বাবার আদরের মেয়েরা জানেন ঠিকনা?


উৎসর্গ
সব আব্বুকে:)


সর্বশেষ এডিট : ১১ ই জুলাই, ২০১২ রাত ১২:২৩
২৪টি মন্তব্য ২৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মামুনুলের মুক্তির খবরে কাল বৃষ্টি নেমেছিল

লিখেছেন অনিকেত বৈরাগী তূর্য্য , ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ৯:৪৯


হেফাজত নেতা মামুনুল হক কারামুক্ত হওয়ায় তার অনুসারীদের মধ্যে খুশির জোয়ার বয়ে যাচ্ছে। কেউ কেউ তো বলল, তার মুক্তির খবরে কাল রাতে বৃষ্টি নেমেছিল। কিন্তু পিছিয়ে যাওয়ায় আজ গাজীপুরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

'চুরি তো চুরি, আবার সিনাজুরি'

লিখেছেন এমজেডএফ, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৮


নীলসাধুকে চকলেট বিতরণের দায়িত্ব দিয়ে প্রবাসী ব্লগার সোহানীর যে তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছিল তা বিলম্বে হলেও আমরা জেনেছি। যাদেরকে চকলেট দেওয়ার কথা ছিল তাদের একজনকেও তিনি চকলেট দেননি। এমতাবস্থায় প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

বরাবর ব্লগ কর্তৃপক্ষ

লিখেছেন নীলসাধু, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১১:২২

আমি ব্লগে নিয়মিত নই।
মাঝে মাঝে আসি। নিজের লেখা পোষ্ট করি আবার চলে যাই।
মাঝেমাঝে সহ ব্লগারদের পোষ্টে মন্তব্য করি
তাদের লেখা পড়ি।
এই ব্লগের কয়েকজন ব্লগার নিজ নিক ও ফেইক... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছাঁদ কুঠরির কাব্যঃ অপেক্ষা

লিখেছেন রানার ব্লগ, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১১:২৩



গরমের সময় ক্লাশ গুলো বেশ লম্বা মনে হয়, তার উপর সানোয়ার স্যারের ক্লাশ এমনিতেই লম্বা হয় । তার একটা মুদ্রা দোষ আছে প্যারা প্রতি একটা শব্দ তিনি করেন, ব্যাস... ...বাকিটুকু পড়ুন

মসজিদে মসজিদে মোল্লা,ও কমিটি নতুন আইনে চালাচ্ছে সমাজ.

লিখেছেন এম ডি মুসা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সকাল ১০:২৩

গত সপ্তাহে ভোলার জাহানপুর ইউনিয়নের চরফ্যাশন ওমরাবাজ গ্রামের এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। লোকটি নিয়মিত মসজিদে যেত না, মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়েনি, জানা গেল সে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসী ছিল, স্বীকারোক্তিতে সে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×