
পাঠক হিসেবে কেউ যদি আমাকে প্রশ্ন করেন বলুনতো ২০১০ সালের বাংলা চলচ্চিত্রের সেরা ছবি কোনটি ? এক কথায় আমি বলবো - অপেক্ষা। দ্বিতীয় সেরা বাংলা ছবি কোনটি ? এমন প্রশ্ন করা হলে আমি বলবো দ্বিতীয় সেরা বাংলা ছবি হচ্ছে গৌতম ঘোষ পরিচালিত মনের মানুষ। মনের মানুষ ছবিটি মুক্তি পাওয়ার পূর্বেই দর্শক মহলে মনের মানুষ ছবির বিষয় সম্পর্কে একটি আলোচনা শুরু হয়েছিল। কারণ প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার মাধ্যমে মনের মানুষ ছবিটি একটু ভিন্নভাবে দর্শক হৃদয়ে জায়গা নিয়েছে। কিন্তু ব্যতিক্রম দেখলাম অপেক্ষা ছবির বেলায়। মিডিয়ার কোনো সাড়া শব্দ নেই, শুধু প্রথম আলো পত্রিকার বিনোদন পাতার (২০ নং পাতায়) একটি কলামে দুই কলামের ছোট একটি এ্যাড যেখানে লেখা আছে ৩১শে ডিসেম্বর ২০১০ তারিখে বলাকা সিনে ওয়ার্ল্ড (ঢাকা) ও রাজশাহীর উপহার প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পাবে অপেক্ষা ছবিটি।
এই ছবিটির পরিচালক আবু সাইয়ীদ (চলচ্চিত্রকার)। পরিচালক আবু সাইয়ীদ ইতিপূর্বে কীত্তনখোলা (২০০০ সাল, ১৬ মিমি ফরমেট, রঙ্গীন, ৯৬ মিনিট) নামে একটি ছবি করেছিলেন যা বাংলাদেশে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরুস্কার পেয়েছে। এছাড়াও চলচ্চিত্রকার আবু সাইয়ীদ এর উল্লেখযোগ্য ছবি হচ্ছে শঙ্খনাদ (২০০৪ সাল, ১৬ মিমি ফরমেট, রঙ্গীন, ১০২ মিনিট), নিরন্তর (২০০৬ সাল, ১৬ মিমি ফরমেট, রঙ্গীন, ৯৫ মিনিট), বাশি (২০০৭ সাল, ১৬ মিমি ফরমেট, রঙ্গীন, ৮৫ মিনিট) এবং রুপান্তর (২০০৮ সাল, ১৬ মিমি ফরমেট, রঙ্গীন, ৮৬ মিনিট) । আবু সাইয়ীদ তাঁর ভিন্ন ধর্মী চলচ্চিত্রের জন্য দেশে বিদেশে বিভিন্ন চলচ্চিত্র উৎসবে একাধিক আন্তর্জাতিক পুরুস্কার পেয়েছেন। যাইহোক, পরিচালকের কথা শুনে ৩১শে ডিসেম্বর ২০১০ বিকেল ৪টায় বের হলাম ছবিটি দেখবো বলে। বলাকা সিনে ওয়ার্ল্ডে ১৫০ টাকা দিয়ে টিকেট কেটে হতাশ হলাম কারণ দর্শক নেই। মনে সন্দেহ জাগলো ছবিটি মনে হয় তেমন কিছুই হবে না কারণ ততক্ষন পর্যন্ত ছবি সম্পর্কে কিছুই জানা নেই। হলমুখে প্রবেশ করতেই এটিএন বাংলার সাংবাদিকরা চেপে ধরলেন সাম্প্রতিক বাংলা ছবি নিয়ে কিছু কথা বলতে হবে। বাধ্য হয়ে ক্যামরার সামনে দাড়িয়ে কিছু কথা বললাম। সবকিছুর মধ্যেও মনে একটা সাহস ছিল আবু সাইযীদ পরিচালিত ছবি সাধারন মাপের হবে না ।

সূতরাং ছবিটি দেখার জন্য বসলাম। শুরু হয়ে গেলো ছবি। ছবির ইন্ট্রো দেখেই বুঝে নিলাম কেনো এ ছবির নাম অপেক্ষা রাখা হয়েছে। কিন্তু অপেক্ষা নামের গভীরতা বুঝতে বুঝতে আমি হারিয়ে গেলাম ছবির মাঝে। মাঝখানে চোখে দুফোটা জল জমা হলো, রুমাল বের করে মুছে ফেললাম । অপেক্ষা ছবিতে প্রতিটি চরিত্রের শক্তিশালী অভিনয়, কাহিনীর বাস্তবতা এবং ছবিতে ঘটনার পরিপ্রেক্ষিত চোখের জল আটকাতে পারলো না। এক কথায় বলতে গেলে এ ছবি সম্পর্কে দর্শকদের প্রতি আমার অনুরোধ - ইসলামের নামে বোমা হামলা, জঙ্গীবাদ, জিহাদী কর্মকান্ড, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা প্রভৃতি ঘটনার নাটকীয় বিশ্লেষন দেখতে হলে প্রত্যেক বাবা-মা এবং সকল তরুন তরুনী, যুবক, বৃদ্ধ কিংবা প্রতিটি মসজিদের ইমাম সাহেব, হুজুর, ওলামা মাশায়েখসহ সবাইকে এ ছবিটি দেখার অনুরোধ জানাচ্ছি। স্কুল, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের নিকট আমার অনুরোধ ছবিটি সবাইকে দেখিয়ে ছবির ঘটনা নিয়ে উম্মুক্ত আলোচনা করুন তাহলে অবশ্যই ছবির মর্ম কথা সবাই অনুধাবন করতে পারবেন। সমাজ জাগরণে চলচ্চিত্রের ভুমিকা কী তা জানতে হলে দেখতে হবে অপেক্ষা ছবিটি। কারণ আমি বিশ্বাস করি, শুধু ছবি দেখিয়ে একটি দেশে যেমন বিপ্লব সৃষ্টি করা যায় তেমনী একটি ছবি দেখিয়ে সমাজকে বদলে দেওয়া সম্ভব। আধুনিক পৃথিবীতে সমাজ জাগরণের সবচেয়ে শক্তিশালী মাধ্যম হচ্ছে চলচ্চিত্র। সূতরাং অপেক্ষা ছবিটি হতে পারে সমাজ জাগরণের হাতিয়ার।

ছবির কাহিনী সংক্ষেপঃ
রবিউল ও রন্জু বাংলাদেশের দুটি ভিন্ন জেলার দুজন যুবক। দুজনই শিক্ষিত, ভদ্র। রবিউল ঢাকায় থাকে, গান বাজনা করে। ছবিতে রবিউলকে প্রথমেই একটি গানের রেকডিং স্টুডিওতে গান গাইতে দেখা যায়। কারণ সে একটি গানের এলবাম বের করবে। রবিউল তাঁর আদরের বৃদ্ধা দাদির কাছে ছোট বেলা থেকে পরম আদরে বড় হয়েছে। রবিউলের আপনজন বলতে তাঁর একমাত্র দাদি যিনি গ্রামে থাকেন। দীর্ঘদিন রবিউল বাড়ি যায়নি তাঁর দাদির সাথে দেখা করতে। রবিউলের দাদি রবিউলের অপেক্ষায় বসে থাকে। তিনি প্রতি সপ্তাহে রবিউলকে একটি করে চিঠি লিখেন। রবিউল সে চিঠির উত্তর পাঠায়। কিন্তু রবিউলের বৃদ্ধা দাদি বয়সের কারণে সবকিছু ভুলে যায়। তিনি শুধু অপেক্ষায় থাকেন রবিউলের জন্য, রবিউল কবে আসবে ???
অন্যদিকে রন্জু কলেজ পড়ুয়া একজন ছাত্র। রন্জুর বাবা মা গ্রামে থাকেন কিন্তু রন্জু পড়াশোনার জন্য কলেজের পাশে একটি হোস্টেলে থাকেন। কলেজ ছুটিতে রন্জু বাড়িতে আসে। বাবা মার আদরের একমাত্র সন্তান রন্জু। নামাজি, নম্র, ভদ্র স্বভাবের একটি ছেলে। মেধাবী এই ছেলেটি হঠাৎ করে কেমন যেনো চুপচাপ হয়ে গেলো রন্জুর মায়ের অভিব্যক্তি। সেবার রন্জু ব্যাগ ঘুচিয়ে চলে গেলো কলেজ হোস্টেলে। বাবা মায়ের অনুরোধ অবহেলা করে রন্জু চলে যায়। রন্জুর মায়ের আক্ষেপ ছেলেটা দিনদিন কেমন যেনো হয়ে যাচ্ছে। ছবিতে ঘটনাক্রমেই জানা যায় রন্জু একটি ইসলামী জঙ্গি গ্রুপের সক্রিয় সদস্য। হরকাতুল জিহাদ গ্রুপের হয়ে রন্জু বিভিন্ন এসাইনমেন্টে অংশগ্রহণ করে। এ গ্রুপের সদস্যদের অন্যতম কাজ হচ্ছে দেশের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে বোমা হামলা চালানো। ইসলামের শান্তির ধর্মের নামে এ গ্রুপটি সারাদেশে সিরিজ বোমা হামলা সহ যাবতীয় বোমা হামলা পরিচালনা করে। এমনি একটি অনুষ্ঠানে বোমা হামলা চালালে মারা যায় রবিউল নামের সেই ছেলেটি। কয়েকজন সাংবাদিক এবং পুলিশ যখন রবিউলের লাশটি তার বৃদ্ধা দাদির কাছে নিয়ে যায় তখন দাদি বিশ্বাস করতে চায় না রবিউল মারা গেছে। কারণ তিনি রবিউলের জন্য অপেক্ষা করে বসে আছেন। রবিউলের জন্য তাঁর দাদির হাহাকার দর্শক চোখে ভিজে আসছিল। দর্শক, তাহলে এই কী অপেক্ষা ???

সারাদেশে পত্রপত্রিকায় জঙ্গিবাদ নিয়ে মানুষ স্বোচ্ছার হয়ে উঠে, সাংবাদিকরা জঙ্গিবাদ নিয়ে বিশেষ রিপোর্ট ছাপেন, পুলিশের তৎপরতা বেড়ে যায়। পুলিশি তৎপরতার অংশ হিসেবে এক রাতে পুলিশ রন্জুর গ্রামের বাড়িতে যায়। গভীর রাতে রন্জুর খোঁজে পুলিশ দেখে রন্জুর বাবা মা চমকে ওঠে। পুলিশ রন্জুর ঘরে সন্দেহজনক আলামত খুঁজতে থাকে। বের হয়ে আসে কতোগুলো জিহাদী বই। পুলিশের মুখে ছেলের এ নতুন পরিচয় রন্জুর বাবা মাকে ভীষন ভাবনায় ফেলে দেয় কারণ তারাও এ ছেলেটিকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখেছিল। রন্জু একদিন অনেক বড় হবে, মানুষের মতো মানুষ হবে, দেশের জন্য কাজ করবে। রন্জুর মায়ের বুক ফেটে যায়, স্বপ্ন ভেঙ্গে যেতে থাকে। ওদিকে রন্জুর বাবা রন্জুকে খুঁজতে বের হয়, কলেজে যায় কিন্তু খোঁজ মেলে না কারণ রন্জু কলেজ ছেড়েছে আরও দুমাস আগে। সুতরাং কেউ বলতে পারে না রন্জুর খবর। অন্যদিকে রবিউলের দাদি ভুলে যায় রবিউল মারা গেছে। সুতরাং তিনি রবিউলকে চিঠি লিখে যায়। রবিউলের চিঠির উত্তর না পেয়ে রবিউলের দাদি তাঁর খোজে বাস স্ট্যান্ডে চলে যায়। তিনি শুধু অপেক্ষায় থাকেন রবিউল কবে বাড়ি ফিরবে।
ওদিকে রন্জুর বাবা রন্জুর খোঁজে এক সাংবাদিকদের সহযোগীতা চায়। কিন্তু রন্জু বিভিন্নভাবে বোমা তৈরী করে, অস্র পরিচালনা প্রশিক্ষণ নেয়, জিহাদের জন্য কাজ করে। রন্জুদের বোমা হামলার কৌশল পাল্টে যায়। কখনো সরাসরি হামলা আবার কখনো চায়ের ফ্লাক্সে করে বোমা হামলা চালানো হয়। পরিচালক এ ছবিতে খুবই দক্ষতার সাথে দেখিয়েছেন কিভাবে একজন সাধারণ ছাত্র জঙ্গি হয়ে যায় আবার কিভাবে একজন সাধারন মানুষ জঙ্গিদের হামলার শিকার হয়ে জীবন দেয়।
জঙ্গিবাজদের কারনে একজন বাবা মায়ের সন্তানকে নিয়ে সবরকম স্বপ্ন ধুলোয় মিশে যেতে চায়। আবার জঙ্গিবাদের শিকার রবিউলের মৃত্যু এক অসহায় বৃদ্ধার আত্ননাদে আকাশ বাতাস ভারি হয়ে ওঠে। ছবিতে মুখোশ পড়া মাওলানাদের কীর্তিকলাপ পরিচালক যত্নের সাথে চরিত্রের মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলতে পেরেছেন। ছবির শুরুতে রবিউলের কন্ঠে একটি গান ছবিকে অন্য একটি ভিন্ন মাত্রার পরিবেশ এনে দিয়েছে। রবিউলের জন্য দর্শকদের যেমন কষ্ট হয় তেমনী কষ্ট হয় রন্জুর বাবা মায়ের জন্য। বোমাবাজির জন্য একসময় রন্জু জঙ্গিদের কমান্ডার নির্বাচিত হয়। বোমাবাজদের বিদেশী এজেন্টদের কাছ থেকে সাহার্য সহযোগিতা বাড়তে থাকে। অবশেষে রন্জুর বাবা মা অপেক্ষায় থাকে কবে ফিরে আসবে রন্জু যেমনটি অপেক্ষা করে জীবনের শেষ বেলায় পৌছে যায় রবিউলের দাদি কারণ রবিউলতো আর আসছে না। জঙ্গি তৎপরতার নায়ক মাওলানারা তাদের কৌশল পাল্টাতে থাকে। জঙ্গিবাদ থেকে পরিত্রানের উপায় কী এসব প্রশ্নের কোনো উত্তর না দিয়েই ছবিটি শেষ হয়। শুধু মনে দাগ কেটে যায় সেসব মানুষদের জন্য যারা বোমা হামলার শিকার হয়ে জীবন দিয়েছেন। সেসব পরিবারের সদস্যদের জন্য সহমর্মিতা প্রকাশ করছি। জঙ্গিবাদ দমনে সমাজের সবার শুভবোধের উদয় হোক।
একনজরে অপেক্ষাঃ

ছবির নামঃ অপেক্ষা
গল্প, চিত্রনাট্য, পরিচালনায়ঃ আবু সাইয়ীদ
সম্পাদনাঃ সুজন মাহমুদ
সঙ্গীতঃ ফুয়াদ নাসের বাবু
অভিনয়েঃ
মিরানা জামান, জয়ন্ত চট্রোপাধ্যায়, টিনু করিম, উজ্জল মাহমুদ, মিঠু বর্মন, নার্গিস, আহসানুল হক মিনু সহ আরও অনেকে।
সময়ঃ ৯০ মিনিট
দেশঃ বাংলাদেশ
ভাষাঃ বাংলা (ইংরেজী সাবটাইটেল সহ)
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে জানুয়ারি, ২০১১ সকাল ১০:১০

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




