somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

এটা শুধুই একটা গল্প, কারো জীবনের সাথে মিলে গেলে তা অনভিপ্রেত কাকতাল মাত্র !! (শেষ পর্ব)

২৩ শে আগস্ট, ২০১১ বিকাল ৪:১৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

Click This Link ( আনুশকা ১ম পর্ব)
Click This Link ( অর্ক ১ম পর্ব)
Click This Link ( আনুশকা ২য় পর্ব)
Click This Link ( অর্ক ২য় পর্ব)
Click This Link ( আনুশকা ৩য় পর্ব)
Click This Link ( অর্ক ৩য় পর্ব)


Click This Link ( অর্ক শেষ পর্ব)


সন্ধ্যার দিকে খুব ভয়ে ভয়ে বাসায় ফিরলাম।ঢাকা শহরে আমাদের যত আত্মীয় আছে সবাই চলে এসেছে। Engagement এর আয়োজন নিয়ে সবাই অতিরিক্ত রকমের ব্যস্ত। কিন্তু বিয়ের ঘটনাটা বাসায় কিভাবে জানাবো এই নিয়ে অনেক তোলপাড় চলছিল। অথচ যেভাবেই হোক জানাতে হবে। আমি দেরি না করে ভাইয়ার রুমে ঢুকে গেলাম। ভাইয়া আমার Engagement এবং বিয়ে উপলক্ষে দেশে এসেছে। আমি সব সময় বিপদে-আপদে ভাইয়ার সাপোর্ট পেয়েছি। এইবারও এর ব্যাতিক্রম কেন হবে এই ভেবে কাঁদো কাঁদো গলায় ভাইয়াকে সব জানিয়ে দিলাম। আমার ভীষণ ভয় লাগছিল। ভাইয়া শুনে অনেক রেগে গেল।রীতিমতো হুঙ্কার দিয়ে বলল,” বিয়ে করে ফেলেছ? মানে কি?

আমি তাড়াতাড়ি ভ্যা করে কেঁদে দিলাম। এই জিনিসটা আমি ভাল পারি। যখন তখন ভ্যা করে কেঁদে দিলে ৬০% ক্ষেত্রে বেশ ভাল কাজ হয়।“ এত তাড়াতাড়ি বিয়ে করতে চাই নি। আমিতো কখনও জানতামই না যে অর্ক আমাকে পছন্দ করে। কালই জানতে পারলাম। তারপর ঘোরের মাথায় বিয়ে করে ফেলেছি। কিন্তু ভাইয়া, অর্ক অনেক ভাল ছেলে। আমাকে মাফ করে দাও না। প্লিজ, তুমি বাকিটা ম্যানেজ দাও।“
“ আব্বু-আম্মুকে কি বলবি? তারা যে কত কষ্ট পাবে চিন্তা করেছিস?”
এই কথা শুনে আমার অনেক মন খারাপ হয়ে গেল। আসলেই তো ঘোরের মাথায় আব্বু-আম্মুর কথা ভুলে গেছি।আমার চোখ বেয়ে টপটপ করে পানি পড়তে লাগল। আর কিচ্ছু বলতে পারলাম না। ভাইয়া রুম থেকে বেড়িয়ে গেল।তারপর কি হল কিচ্ছু বলতে পারব না। আমি শুধু একমনে আল্লাহ্‌ আল্লাহ্‌ ডাকতে লাগলাম।


আমি ভয়ে ভাইয়ার রুম থেকে বের হই নি।বাইরে অনেক চিল্লা-চিল্লি হচ্ছিল। তিন-চার ঘণ্টা পর যখন সাড়াশব্দ, মানুষজনের কোলাহল থেমে গেল তখন রুম থেকে বের হয়ে আব্বু-আম্মুর রুমে গেলাম। ওখানে গিয়ে দেখি আব্বু-আম্মু আর ভাইয়া বসে আছে।আমি আস্তে আস্তে আব্বুর কাছে গিয়ে বসলাম।কিছুক্ষণ পর আব্বু আমার মাথায় হাত দিয়ে বলল,” এই রকম কেন করলি,মা।“
আমি কিছুই বলতে পারলাম না।
“ তোর যে নিজের পছন্দ আছে সেটা আমাকে বলতে না পারলেও তোর মাকেও তো বলতে পারতি।এত ভয় পাস আমাকে?”
আমি শুধু মাথা নাড়লাম। আমার Engagement ভেঙ্গে গেল।আব্বু-আম্মু কেমন জানি চুপসে গেল। আগের সেই সুরটা আর নেই।


পরদিন সকালে ভাইয়া আমাকে অর্ককে বাসায় নিয়ে আসতে বলল।আমি শুনে বললাম,” কিন্তু আব্বু-আম্মু?”
“ পালিয়ে বিয়ে করার সময় আব্বু-আম্মু কি হাওয়া হয়ে গিয়েছিল? তখন মনে ছিল না? ঢং দেখলে বাঁচি না!!! জীবন তো ঢং করেই কাটিয়ে দিবি।“
“ও।“ আমি স্পষ্ট বুঝতে পারলাম যে এখন থেকে কথায় কথায় পালিয়ে বিয়ে করার প্রসঙ্গ তোলা হবে আর আমাকে সারাজীবন পচানো হবে।


ভার্সিটি গিয়ে অর্কের সাথে দেখা করলাম। এক দিনে কেমন বদলে গেল। অন্যরকম লাগছিল। চোখে-মুখে আনন্দ। জিজ্ঞেস করতেই বলল যে ওর বাসায় তেমন ঝামেলা হয় নি।কিছুক্ষন গাই-গুই করে মেনে নিয়েছে। ভাইবোনদের মধ্যে বড় হওয়ার এটাই একটা সুবিধা! সব কিছু অনেক সহজে ম্যানেজ করা যায়।সব শুনে বললাম,” এইবার বাসায় চল?”
“ বাসায় যাব মানে?কার বাসায় যাব? সবে তো বাসা থেকেই আসলাম। আর তুই আমাকে তুমি তুমি করে বলছিস কেন? শুনতে যা বিচ্ছিরি লাগছে যে কি বলব!!!”
শুনে মেজাজ চরম উঠল।তুমি বলা যাবে না!!ভাব নেয়ার আর জায়গা পায় না।বললাম,” নাচতে নাচতে যে কালকে আমাকে বিয়ে করলি সবই এর খেসারত। ভাইয়ার সাথে কথা বলবি। উল্টাপাল্টা কিছু করবি না। আর তোকে ভুলে তুমি বলে ফেলসি। বদ!!“
“ দেখ , তোর যদি তুমি বলতে ইচ্ছা করে তুমি করে বল। আমার প্রবলেম নাই। অভ্যাস নাই তো তাই কেমন জানি লাগছে। তোকে রাগানোর জন্য বলসি।“
“ না। তোকে যে তুমি করে বলে ফেলসি ব্যাপারটা ভুলে যা। এখন চল।“
“ তুমি করে বললে হয় না?”
“ না। বলব না” ( অথচ আমার তুমি করে ডাকতেই ইচ্ছা করছিল। কি যে করি?? ভাল মতোই জানি যে আবার যদি তুমি করে বলি তাহলে আমাকে আবার পচান হবে! )
“ ভাইয়ার সাথে দেখা না করলে হয় না?”
“ দেখ, ঢং করবি না। সাহস থাকলে আয়।তোর বাসায় তো ঝামেলা মিটমাট হয়ে গেসে। কিন্তু আমাদের বাসায় এখনও বাকি।


ভাইয়ার সাথে অর্কের কি কথা হয়েছিল জানি না। ভাইয়া দারুণ ইমপ্রেসড। মুখে অবশ্য কিছুই বলে না। কিন্তু হাবেভাবে বোঝা যাচ্ছিল।ভাইয়াকে ও কায়দামতো মোটিভেইট করে ফেলেছে অর্ক। এই জিনিসটা ও অনেক ভালমতো পারে। কেন জানি একটু শান্তি শান্তি লাগতে লাগল। মনে হচ্ছিল সব ঠিক হয়ে যাবে। এরপরের ঘটনা গুলো বেশ দ্রুত ঘটতে লাগল। দিন চারেকের মধ্যেই অর্কের বাসা থেকে বিয়ের প্রস্তাব আসল। প্রথমে সবাই ঠিক করল যে একেবারে এমবিএ শেষ করে আমাকে উঠিয়ে নেয়া হবে। কিন্তু ভাইয়ার কাছে সবাই হার মানল। ভাইয়া মাত্র তিন মাসের জন্য দেশে এসেছিল। ওর ইচ্ছা ছিল আমার বিয়ে দেখে যাওয়ার।পরে আবার ঠিক হল যে পরীক্ষাটা শেষ হলেই বিয়ের অনুষ্ঠান করা হবে। মাত্র সপ্তাহখানেক পরেই আমাদের লাস্ট সেমিস্টার পরীক্ষা। পরীক্ষা শেষেই বিয়ে। কেমন জানি স্বপ্ন স্বপ্ন লাগছিল। এত কিছু ঘটে যাবে ভাবি নি। আম্মু-আব্বু ও আগের মত স্বাভাবিক হয়ে গেলেন। আর আমার খালা, মামী আর কাজিনরা ইচ্ছা মত আমাকে আর অর্ককে নিয়ে ফাজলামো করতে লাগল। কাজিনরা ফাজলামো করবে মানা যায়। কিন্তু খালা, মামী!!! আর তো পারি না।লজ্জায় মাথা কাটা যায় এই অবস্থা!!


ক্লাসে আমি এবং অর্ক দুজনই বেশ পপুলার ছিলাম। তাই পুরো ক্লাসকেই বিয়ের ব্যাপারটা জানানো হল। সবাই কি যে খুশি হয়ছিল যে কি বলব!! বুঝতে পারলাম বিয়ের সময় পুরো ৯০ জনকেই দাওয়াত দিতে হবে। কারণ একটু এদিক সেদিক হলেই আমার অথবা অর্কের ঘাড় মটকে যাবে। সবচাইতে বেশী লাফালাফি করল আমাদের পাঁচ ফ্রেন্ড। কিন্তু এদের লাফানোর স্টাইলটা একটু অন্যরকম। কোথায় একটু শুভকামনা- টামনা জানাবে তা না শোনা মাত্রই আমাদেরকে আচ্ছামত পচানো শুরু করল।বলে আমাদের মধ্যে নাকি কোন রোমান্স নাই, কোন কেমিস্ট্রি নাই,হেন নাই, তেন নাই, আমরা একজন আরেকজনকে তুই তুই করে বলি ইত্যাদি ইত্যাদি। এখন আড়ালেও যে আমরা একজন আরেকজনকে তুমি করে ডাকি সেটা আর খোলাসা করি নি। কারণ বললেই আরও কয়েকদফা আমাদের নিয়ে পচানো হবে।


পরীক্ষা দেয়ার ফাঁকে ফাঁকে আমরা বিয়ে নিয়ে নানান রকম প্ল্যান করতে লাগলাম। আমরা মানে আমি , অর্ক আর আমাদের বাকি তিন ফ্রেন্ড।কথায় কথায় নাবিলা একদিন বলল সেইন্ট মারটিন বিয়ের অনুষ্ঠান করলে কেমন হয়?? আমি শুনে একদম হা হয়ে গেলাম। কারণ এই ধরনের আজগুবি প্ল্যান ওর মাথাতেই আসা সম্ভব। কিন্তু আমার কেমন জানি ভীষণ সমুদ্র দেখতে ইচ্ছা করল। কি বলব মাথায় কিছু আসছিল না!! তখন ওই পুরো প্ল্যানটা বলল। থার্ড ইয়ারে আমরা কক্সবাজার এবং সেইন্ট মারটিনে স্টাডি ট্যুরে গিয়েছিলাম। তখন ক্লাসের অনেকেই যেতে পারে নি। মেয়েদের বেশী সমস্যা হয়েছিল,বাসা থেকে পারমিশন পায় নি। অনেকে আবার টাকা ম্যানেজ করতে পারে নি ইত্যাদি ইত্যাদি। বিয়েটা যদি সেইন্ট মারটিন হয় তাহলে হয়তো সবাই সমুদ্র দেখতে পাবে এবং ইচ্ছেমত মজা করতে পারবে। তাছাড়া বিয়ের অনুষ্ঠানটাও সারাজীবন মনে রাখার মত হবে। আমি সাথে সাথে সেন্ট মারটিন কল্পনা করতে লাগলাম। কি যে অদ্ভুত লাগছিল ভাবতে!!! সেইন্ট মারটিনে বিয়ের শাড়িটা লাল পরব নাকি নীল পড়ব ভাবতে লাগলাম!


পরদিন ভাইয়াকে গিয়ে সেইন্ট মারটিনের কথা বলে দিলাম। ভাইয়া সব শুনে বলল,” তোদের তো দেখি আবদারের কমতি নাই!! কিছু লজ্জাশরম কর!!” এই হল অবস্থা। যাই হোক, এইরকম বললে কি হবে,আমার ভাইয়া ভীষণ রকমের ভালো। ওর জীবনের একটা স্বপ্নই হল আমাকে ধুমধাম করে বিয়ে দেওয়া। আরেকটা কারণ হচ্ছে আমার মামা, খালারা সবাই প্রেম করে বিয়ে করেছেন কিন্তু সমস্যা হল প্রেম করে বিয়ে করায় অন্যরা অনেক চেতা ছিল তাই কারোর বিয়েতেই সেরকমভাবে ধুমধাম হয় নি। ফলস্বরূপ আমরা কখনই উনাদের বিয়েতে তেমন মজা করতে পারি নাই।তাই ভাইয়া সাথে সাথে রাজী হয়ে গেল। আচ্ছা আমার কি লজ্জা-শরম সত্যি কম!! বিয়ে হবে আমার। হিসেবমত আমার ভালোলাগা অনুযায়ীই সব প্ল্যান করতে উচিত। বিয়ের শাড়ি, গয়নাগাটি নিয়ে প্রতিদিন খালা –মামীদের যুদ্ধ চলতে লাগল। খালারা লাল বললে মামিরা অবধারিতভাবেই মেরুন বলতে লাগল। গয়নায় সূক্ষ্ম কাজ হবে নাকি ভারী কাজ হবে সেটা নিয়েও ব্যাপক গবেষণা চলতে লাগল, চায়ের পর চা শেষ হতে লাগল। আরে আমাকে জিজ্ঞেস করলেইতো ঝামেলা মিটে যায়।


ক্লাসের সবাইকে যখন সেইন্ট মারটিনে দাওয়াত দিলাম তখন সবার চোখগুলো দেখার মত ছিল!!ঠিক হল মেয়েরা হবে কনে পক্ষ। আরে ছেলেরা বর পক্ষ। আমার ফ্রেন্ডরা রীতিমত আনন্দে লাফাতে লাগল। আমি অর্কের দিকে তাকালাম। দেখি অর্ক ও আমার দিকে তাকিয়ে আছে।স্বপ্নময় যাত্রার খুব বেশী দূরে নই আমরা!!


তারপর একদিন খুব ঘটা করে আমরা সবাই রওয়ানা দিলাম।চারটা বড় বাস ভাড়া করা হয়েছিল।আমি ছিলাম আমাদের ক্লাসের মেয়ে এবং কাজিনদের সাথে। অর্ক ছিল ক্লাসের ছেলেদের সাথে। যেকোনো বিয়ের অনুষ্ঠানেই সবাই মনে হয় একধাপ এগিয়ে বেশী ফাজিল হয়ে যায়। কিন্তু আমার পিচ্চি পিচ্চি চার-ছয়-সাত-আট বছরের কাজিনরা যখন কানের কাছে সুর করে দুলাভাই দুলাভাই ডাকতে থাকে তখন মেজাজ কেমন লাগে!! কান ঝালা-পালা হয়ে গেল। অথচ মেজাজ খারাপ করতে পারছি না। কারণ মেজাজ খারাপ করলেই চেহারা খারাপ হয়ে যাবে। বিয়ের দিন পেত্নীর মত লাগবে। আমি বসে বসে বিয়ের কথা ভাবতে লাগলাম।এইবার সত্যি সত্যি কেন জানি লজ্জা লাগতে লাগল!

কোনরকম ঝামেলা ছাড়াই আমরা সেইন্ট মারটিন পৌঁছে গেলাম। বাসে আর জাহাজে প্রচণ্ড মজা করলাম সবাই।আগে থেকেই একটা রিসোর্ট পুরো বুক করা ছিল।পরদিন আমাদের গায়ে হলুদ । একটা হাল্কা হলুদ জামদানি পড়েছিলাম। হলুদ গাঁদা ফুল দিয়ে আমাকে সাজানো হয়েছিল। সাজানোর দায়িত্বে ছিল সুজা আপু। সুজা আপুর একটা বিশেষত্ব না বললেই না। এই মেয়ে নিজে কখনও সাজে না কিন্তু অন্যদের সাজিয়ে দিতে দিতে বিরক্ত করে ফেলে। উনাদের বাসায় গেলে উনি সাজুনিগুজুনির যাবতীয় এক্সপেরিমেন্ট আমার উপর করতেন। একবার আমার চোখে পাঁচ –ছয় রকমের আইশেড দিয়ে চোখ সাজানো হয়েছিল।সুন্দর তো লাগেই নাই বরং চোখের বারোটা বেজে গিয়েছিল। সেইন্ট মারটিনে সুজা আপুই আমার পারসোনা!! আমার বিয়েতে সাজিয়ে দেয়ার আনন্দে উনি রীতিমতো লাফাতে লাগলেন। আর আমি রীতিমত ঘামতে লাগলাম। আমি ও দশ বারো রকমের আল্টিমেটাম দিয়ে দিলাম।সাজ যখন শেষ হল তখন আয়নায় নিজেকে দেখে অবাক হয়ে গেলাম।

রিসোর্টের বাইরে ,বীচেই গায়েহলুদের প্রোগ্রাম হয়েছিল। পুরো বিদেশের মত। চারিদিক খোলা, শুধু উপরে রঙ- বেরঙের কাপড়ের ছাউনি দেয়া যেন রোদ না লাগে।পাশাপাশি দুইটা স্টেজ করা।চারিদিক ফুল দিয়ে সাজানো।ঢাকা থেকে প্রচুর ফুল নিয়ে আসার কারণ বুঝতে পারলাম।আবার মরিচ বাতিও ঝোলানো হয়েছে। রাতে জ্বলবে আর নিভবে! সোজা সামনে তাকালেই সমুদ্র আর সমুদ্রের ফুরফুরে হওয়া। সব মিলিয়ে অন্যরকম একটা পরিবেশ। এই রকম একটা এরেঞ্জমেন্টের জন্য তারেক ভাইকে ধন্যবাদ দিতেই হয়। এক ষ্টেজে আমাকে বসানো হয়েছিল। আর আরেক ষ্টেজে অর্ককে। অর্ক একটা অরেঞ্জ কালারের পাঞ্জাবী পরেছিল। জামাই মানুষ কোথায় একটু গম্ভীর হয়ে বসে থাকবে তা না। সবার সাথে হইচই করছে!! মিষ্টি আমার একদম পছন্দ না। অথচ মিষ্টি খেতে খেতে মুখ তিতা হয়ে গেল।সবাই মিষ্টির মধ্যে কি পায় আল্লায় জানে?? যাইহোক, গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে ব্যাপক নাচা-গানা হল।আমার খালা-মামিরা পর্যন্ত এই বয়সে এসে ধেই ধেই করে নাচল। দেখি আর অবাক হই। সবই মনে হয় সেইন্ট মারটিনের জাদু।এত কিছুর মাঝে, এত মানুষের ভিড়েও অর্ক আমার গালে অল্প একটু হলুদ লাগাতে ভুলল না। অবশ্য কেউ দেখে নি।

সকাল থেকেই অনেক টেনশন লাগছিল। কারণ আজ আমার বিয়ে। পালিয়ে বিয়ে করার দিন লজ্জা-শরম কোথায় ছিল কে জানে!! অথচ আজ ভয়াবহ লজ্জা লাগছে। মনে হচ্ছে হুট করে বড় হয়ে গেলাম। যাইহোক, নাস্তার তাগাদা পেয়ে খেতে গিয়ে দেখি অর্ক ও টেবিলে।সাথে রাশেদ , নাবিলারাও আছে। অর্কের পাশের চেয়ারটা খালি ছিল। বোধ হয় আমার জন্যই। ওর দিকে চোখ পড়তেই একটা হাসি দিল।হাসির মানেটা বুঝলাম। কিন্তু ওর সাথে কিভাবে বসব কিছুই বুঝে উঠতে পারলাম না। আমার কাজিনরা আমাকে টেনে –হিঁচড়ে ওদের সাথে বসাল।ইচ্ছা করছিল সব কয়টাকে ধরে আছাড় দেই। আমি পেছন ফিরে অর্কের দিকে তাকিয়ে একটা প্লাস্টিক হাসি দিলাম যার একটাই অর্থ হতে পারে!


দুপুরে বিয়ে পরানো হবে। সময় বেশী নেই। সুজা আপু আমাকে নিয়ে বসল।আমি আপুকে বললাম,” আপু , যাও দুলাভাইকে নিয়ে বীচে গিয়ে ঘুরে আসো। আমি নিজের সাজ নিজেই দিব। পুরা খ্যামটা সাজ দেব। দেখে সবাই বাকরুদ্ধ হয়ে যাবে,”
“ তোরে কতবার বলসি যে দুলাভাই দুলাভাই করবি না। খ্যাত শোনায়। ভাইয়া বলে ডাকবি। আর আমি সাজিয়ে দিলে সমস্যা কি? কালকে কত সুন্দর করে সাজিয়ে দিলাম। এইটারেই বলে ভালো মানুষের ভাত নাই।“
“ ঠিকই বলেছ। তুমি ভালো মানুষ হলেও সাজাও খারাপ।তুমি আমাকে পেত্নী বানায় দিবা। আমি বিয়েরদিন পেত্নী হতে চাই না।“
“ দেখ, লজ্জা –শরম কিছু কর। আর চ্যাটাং চ্যাটাং কথা থামা। বিয়েরদিন নিজে নিজে সাজা ভালো না। মানে অমঙ্গল হয়! বুঝলি কিছু?? “
“ হুম, বুঝলাম। এখন দয়া করে সাজ লিমিটের মধ্যে রেখ।“
“ অবশ্যই।“ বলেই সুজা আপু আমাকে ধরল। পুরো দুই ঘণ্টা কি জানি কি করল!পুরোপুরি বউ বানিয়ে ছেড়ে দিল। বিয়ের দিনই একটা মেয়েকে সবচেয়ে বেশী সুন্দর লাগে। এ যেন এর সার্থক প্রয়োগ!!মনে মনে সুজা আপুকে অনেক থ্যাংকস দিলাম।কারন সামনাসামনি দিলে এক্কেবারে মাথায় চড়ে বসবে। রিস্ক নিতে নাই!!


বিয়ের অনুষ্ঠানটাও ঠিক আগের জায়গায়। শুধু জাঁকজমক আরও বেশী।যেহেতু আমরা আগেই বিয়ে রেজিস্ট্রি কে ফেলেছি, তাই কাজীর ব্যাপারটা ছিল না। অনেকক্ষণ ষ্টেজে একা একা বসেছিলাম। অবশ্য অনেক লোকজন সাথে ছিল। অর্ককে আশেপাশে দেখছিলাম না। হঠাৎ দেখি অর্ক! সাথে বিরাট গ্যাং নিয়ে আসছে। কেমন জানি বীর পুরুষের মত লাগছে। আচ্ছা, বিয়ের দিন সব ছেলেকেই কি এমন দেখায়?আমাদের কাজিনরা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। একবার আমার কাছে এসে হাসাহাসি করে। তারপর আবার অর্কের কাছে গিয়ে হাসাহাসি করে। কিন্তু আমার হাসি আসে না। মেজাজ খারাপ হচ্ছিল। ভারী একটা শাড়ি পড়ে রাখতে অসম্ভব অস্বস্তি লাগছিল। আর গয়নাগুলোকে মনে হচ্ছিল বড়ই গাছের কাঁটার মত। গলায় বিঁধে যাবে এমন অবস্থা!!


কিছুক্ষণ পর আমরা খেতে বসলাম। এইবার আর বীচে নয় বরং কটেজের ভেতরে একটা বড় রুমে খাবারের আয়োজন করা হয়েছে। টেবিলে গিয়ে অবাক হয়ে গেলাম।এত রান্নাবান্না এরা করল কখন?? বিরাট এক খাসির রান আর আস্ত মোরগ রোস্ট অর্কের সামনে রাখা হয়েছে। আকার- আকৃতি দেখে মনে মনে কয়েকবার বললাম,” আজকে অর্কের খবর আছে!!” অর্ক আমার দিকে মলিন চেহারা করে তাকাল। আমি কি অভয় দিলাম জানি না তার আগেই আমার দুই মামী চলে আসলেন অর্ককে মুখে তুলে খাইয়ে দেয়ার জন্য। আমি ঢোঁক গিললাম। অর্ক বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে রইল।বেচারা!! আমি ছোটমামীকে কানে কানে বললাম,” মামী , অর্কের নিজস্ব দুইটা হাত আছে। নিজে নিজে খেতে পারবে। তুমি মামার কাছে গিয়ে বস। আর এইসব আজাইরা কাজ করা লাগবে না।প্লিয।“

মামী এত অবাক হলেন যে খ্যাঁক খ্যাঁক করে দানবীমার্কা হাসিতে ফেটে পড়লেন। আমি কি খুব হাসির কথা বলেছি?? এদেরকে কিছু বলাও মুশকিল।আমার কথায় তেমন কোন লাভ হল না।মিনিট খানেক পর খালামনিরা এসে বললেন, এটা নাকি ট্র্যাডিশন!!! মনে মনে বললাম,”ট্র্যাডিশনের খেতা পুড়ি।“ আর অর্ক বিরস বদনে খেতে লাগল।


এবার সালাম করার পালা। নিজের আর শ্বশুরবাড়ির মুরুব্বিদের দেখে পুরনো পিঠে ব্যাথা মাথা চাড়া দিয়ে উঠল।আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কয়জনকে সালাম করতে হবে মনে মনে গুনছিলাম। কিন্তু গুনন শেষ হবার আগেই সুজা আপু কানের কাছে এসে বলল,” শুরু করে দে।“ অতঃপর শুরু করে দিলাম। পুরো আধা ঘণ্টা সময় লাগল।ব্যাপক পরিশ্রমের কাজ!এবার বিদায় নেবার পালা।বিদায় আর কি নেব!আজকের দিনটাও সবাই এক সাথে থাকব। এইরকমই এরেঞ্জমেন্ট করা। কিন্তু আমার আব্বু-আম্মু অনেক ইমোশনাল হয়ে পড়লেন।আমি ঠিক করে রেখেছিলাম বিয়ের দিন হাউমাউ করে কাঁদব না। আমার পছন্দমতই বিয়ে হয়েছে!তাহলে কাঁদার কি হল? কিন্তু সব প্রতিজ্ঞা ভুলে হাউ মাউ করে সবাইকে জড়িয়ে কাঁদলাম।রীতিমতো মরা কান্না।চোখের কাজল ধুয়ে মুছে একাকার। আমার ছোট খালার বিয়েতে ও এইরকম হয়েছিল। ছোট খালা মরা কান্না কাঁদছিল আর আমরা সব কাজিনরা এই নিয়ে হাসাহাসি করছিলাম। হঠাৎ এই কথা মনে হওয়াতে আমি আমার পিচ্চি কাজিনদের খুঁজতে লাগলাম। দেখি সব কয়টা একসাথে দাঁড়িয়ে আছে। চোখে –মুখে গভীর ষড়যন্ত্র!!!


সন্ধ্যা নেমে গেছে।আমাদের বিয়ে হয়ে গেল।আজকের দিনটাকে কি বলা যায়? সবচাইতে আনন্দের দিন নাকি স্বপ্নের দিন?আমি তো শুধু অর্ককে চেয়েছিলাম। যে এত আড়ম্বর, এত উৎসব ,এত কিছুতো চাই নি।আমি ঘোরের মধ্যে চলে গেলাম।হঠাৎ হাতে টান পড়ল। তাকিয়ে দেখি অর্ক।ওর দিকে তাকিয়ে হাসলাম।“ এই রকম ঘোরমাখা চোখে তাকিয়ে আছ কেন? চল হেঁটে আসি।“
“ কোথায় হাঁটতে চাও?”
“ আরে বাবা, বীচে হাঁটব। সবাই তোমাকে ডাকছে।“
কটেজ থেকে বের হয়ে দেখি সবাই হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে। কালই সবাই চলে যাবে।শুধু আমরা দুজন আরও কয়েকদিন থাকব। এই দ্বীপেই যে আমাদের হানিমুন!!
সবাই হাঁটছি আমরা। বড় বড় ঢেউ এসে পায়ে লাগছে। আমি আর অর্ক অন্যদের চেয়ে বেশ পেছনে পড়ে রইলাম।অর্ক আমার হাত ধরে আছে। আহ,জীবন এত সুন্দর হয়!




------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------


“ মা, এতটুকুই লিখেছ? আর নেই কেন?”
আমি টিভি দেখছিলাম। ছেলের কথা শুনে ওর দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললাম।কিছু বললাম না। গত সাত বছর ধরে কান্না চেপে শুধু দীর্ঘশ্বাস ফেলে যাচ্ছি।
“ মা, বল না?”
“ কি বলব?”
“ বাবা কেমন ছিল?”
“তোমার বাবা একটা পাগল ছিল। আর অনেক দুষ্টু ছিল।“
“ আমার মতো দুষ্টু ,মা।“
“ হ্যাঁ, বাবা। ঠিক তোমার মতো।“
“ তুমি আর লিখো নি কেন, মা?”
“ বাবা, জিদ করে না।এখন পড়তে বস ।“
“ বল না?”
“ কারণ এরপর থেকে আমি ডায়েরি লেখা ছেড়ে দিয়েছি।“
“ কেন মা?”
ছেলেটা পুরো অর্কের মতো হয়েছে। এত জিদ, এত কৌতুহল!! আমি এখন কিভাবে বলি যে সেইন্ট মারটিন থেকে ফেরার পথে এক্সিডেন্টে তোমার বাবা মারা যায়। আমি কিভাবে যেন বেঁচে গেলাম। অথচ আমাদের একসাথে ফেরার কথা ছিল,এক সাথে থাকার কথা ছিল।কিন্তু ও আমাকে একা রেখে চলে গেল।সব শেষ হয়ে গেল।ভুল বললাম, সব শেষ হয়ে যায় নি। আমার চারপাশ এখনও অর্কময়।আমাদের ছেলেটাকে আমার ডায়েরি পড়তে দিয়েছি। যদি নিজে নিজে কিছু বুঝতে পারে।কারণ আমার মুখে বলার সাহসটুকু যে নেই!

“ বাবা,আরেকটু বড় হলেই সব জানতে পারবে। এখন বল পড়াশুনা না করলে বড় হবে কিভাবে? “
“ আচ্ছা, তাহলে পড়তে বসি।“
“ আমার লক্ষ্মী বাবা!!”
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে আগস্ট, ২০১১ বিকাল ৫:১৮
১৭টি মন্তব্য ১৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছি , অবৈধ দখলদার॥ আজকের প্রতিটি অন‍্যায়ের বিচার হবে একদিন।

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:১০



ধিক ‼️বর্তমান অবৈধভাবে দখলদার বর্তমান নরাধমদের। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশে । বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষমা চাইতে হলো ! রাজাকার তাজুলের অবৈধ আদালতে। এর চাইতে অবমাননা আর কিছুই হোতে পারেনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

আম্লিগকে স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধে আর কোন বাধা নেই

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:২২


মঈন উদ্দিন ফখর উদ্দিনের ওয়ান-ইলেভেনে সরকারের ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে ভারতের সহায়তায় পাতানো নির্বাচনে হাসিনা ক্ষমতায় বসে। এরপরই পরিকল্পিত উপায়ে মাত্র দুই মাসের মধ্যে দেশপ্রেমিক সেনা অফিসারদের পর্যায়ক্রমে বিডিআরে পদায়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৪৫


বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন

J K and Our liberation war১৯৭১

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯



জ্যাঁ ক্যুয়ে ছিলেন একজন ফরাসি মানবতাবাদী যিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের একটি বিমান হাইজ্যাক করেছিলেন। তিনি ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ তারিখে প্যারিসের অরলি... ...বাকিটুকু পড়ুন

এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ

লিখেছেন এ আর ১৫, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:৪০



এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ


২০০৪ সালের ২১ শে অগাষ্ঠে গ্রেনেড হামলার কারন হিসাবে বলা হয়েছিল , হাসিনা নাকি ভ্যানেটি ব্যাগে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×