সবাই মোটামোটি জানেন, দেশের একটি পাবলিক ভার্সিটি - বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) মারামারির ঘটনাকে কেন্দ্র করে হল খালি করার নির্দেশ দিয়ে অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এই ঘটনা ঘটেছে গতকাল। এর পর ব্লগে আপনারা এনিয়ে অনেক পোস্টই পড়েছেন। ফেসবুকেও অনেকে মেসেজ-স্ট্যাটাসের ছড়াছড়ি বুয়েটিয়ান-প্রাক্তন বুয়েটিয়ানদের প্রোফাইল জুড়ে। যেকোন কারণেই হোক, গতকাল বুয়েটে অবস্থানের কারণে ঘটনার সামান্য অংশের প্রত্যক্ষদর্শী আমি। আসুন, একটু আলোচনা করা যাক ঘটনাটি নিয়ে।
প্রথমত: কি ঘটেছিল আসলে? খেলা দেখার জন্য এই মারামারি'র সূত্রপাত?
খেলা দেখার কারণটা আসলে মূখ্য না, কারণ খেলা দেখার জন্য গেট অবরোধ করা হয়েছিল এটুকু ঠিক আছে, এরপর যা ঘটলো সেটা খেলার সাথে জড়িত না। কি ঘটলো? গুজব আর অতিরঞ্জন বাদ দিলে যা দাড়ায়, গ ব্যাচের একজন, ক ব্যাচের (বয়সের বিভাজনে: ক>খ>গ) বড়ভাই এর সাথে বেয়াদবি করে, ভালই বেয়াদবি করে, পরবর্তীতে ক ব্যাচের কয়েকজন ঐ ছাত্রকে চড় থাপ্পর দেয় - কাহিনীটা এখানেই শেষ হয়ে যেতে পারতো কিন্তু সেটা শেষ না হয়ে একটা আবাসিক হল পর্যন্ত গড়ায় - আরেকটি ব্যাচ খ ঘটনার সাথে ইনভল্বড হয়। এইখানে আসলে কি হয়েছিল সেটি মূখ্য নয়: প্রথম কারণ, একেকজনের কাছে একেক রকম তথ্য। একেক ব্যাচের মুখে আপনি একেক রকম তথ্য পাবেন, কোনটি বিশ্বাসযোগ্য সেটি যাচাই করা দূরহ।
আমি আবারও বলছি, এই হলের ঘটনায় এগজাক্টলি কি হয়েছিল সেটি মূখ্য নয়! কেন হয়েছে - এটি ভাবার সময় এসেছে।
একেবারে ঘটনার প্রথম দিকে যাই। বুয়েটে সিনিয়র-জুনিয়র রিলেশন বেশ উপভোগ্য - সবাই যেখানে এই জিনিসটা নিয়ে গর্ব করে - সেখানে নিচের ব্যাচের একজন বড়ভাইকে শাসিয়েছে! সে এই সাহসটা কোথা থেকে পেল?
বেশি চিন্তা করার দরকার নেই - সে যে পলিটিক্যাল আশ্রয়ে আশ্রিত এইটা মোটামোটি সবাই জানেন। অর্থাৎ, নোংরা পলিটিক্স এখন বুয়েটের চিরায়ত সম্পর্কে চিড় ধরাতে সক্ষম।
খেয়াল করুন, পুরো ঘটনায় সাধারণ ছাত্রদের কোন অবদান নেই।
বুয়েটের বড়ভাইরাও জুনিয়রদের বেশ ভালভাবেই ট্রিট করে, সেই রীতিটাও যেন ভেঙে গেল। তারা জুনিয়রদের ওপর চড়াও হল (যে যাই বলুক হয়েছে আসলেই) - সেটার ভিত্তি হয়তো আছে, জুনিয়র ব্যাচের পলিটিক্যাল ফিগারের কাছে মার খাওয়ার পর তারাও রিএ্যক্ট করবে। যে ঘটনাই হোক, আসল কাহিনীর সূত্রপাত কিন্তু পলিটিক্যাল ফিগারকে কেন্দ্র করেই। এরপর হয়তো হাতেগোণা দু'একজন সাধারণ ছাত্র ইনভল্বড হয়ে যেতে পারে - যেটা নির্ভর করছে আপনি ঘটনাটাকে কিভাবে রটাতে পারেন। যদি আপনাকে এই তথ্য দেয়া হয় - অমুক ব্যাচের লোকজন আপনার ব্যাচের লোকজনকে পিটিয়ে মাথা ফাটাচ্ছে, তাহলে অবশ্যই আপনি ছুটে যাবেন, যদি মেরুদন্ড থাকে। আসল ঘটনা কি সেটা আসলে তখন যাচাই করার মত পরিস্থিতি থাকে না, কারণ উত্তেজিত অবস্থায় মানুষের অতকিছু বিচার করার বুদ্ধি থাকে না।
যাই হোক - যে ভয়টা করা হচ্ছিল - হল ভ্যাকেন্ট করে দেওয়া হয়েছে। অনির্দিষ্টকালের জন্য - কবে যে খুলবে তার কোন ঠিক ঠিকানা নাই - প্রতিক্রিয়া হিসেবে বুয়েটিয়ানরাই বিশেষ করে, তাদের ফেসবুকের ওয়ালগুলো স্ট্যাটাসে ভরে ফেলেছেন। যে স্ট্যাটাসগুলো বুয়েটিয়ান হওয়ার প্রতি লজ্জ্বা, গ্লানি সহ অনেক উচ্চবাচ্যে ভরপুর এবং কেউ কেউ আসল ঘটনা না জেনেই "ব্যাচভিত্তিক সমস্যা" টাইপের কিছু আখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করছেন।
মজার ব্যাপার হল, অনেক সাধারণ বুয়েটিয়ান ছাত্রছাত্রীই জানে না আসলে হয়েছে কি! তাদের কাছে এখন বিচিত্র সব উৎস থেকে বিচিত্র সব খবর যাচ্ছে - কেউ বিভিন্ন ব্যাচের মধ্যে, কেউ ডিপার্টমেন্টের মধ্যে ক্ষেপানোর চেষ্টা চালাচ্ছে। আবার অনেকে এখনো ভেবে বসে আছেন - খেলা দেখার জন্যই এই মারামারির সূত্রপাত!!!
দেখুন, বুয়েটিয়ানরাই যখন আসল খবরটা কি সেটাই জানেনা, সেখানে বাইরের লোকজন সত্যটা জানবে - এমনটা ধারণা করাই বোকামি। অনেকে সিনিয়র-জুনিয়র ইস্যু তুলতে চাইছেন ঘটনার রেশ ধরে।
আমি বলবো, যেই ঘটনায় দোষী ছাত্ররা রাজনৈতিক মদদপুষ্ট, তাদের দায়ভার সাধারণ ছাত্রদের কাধে ফেলছেন কে কোন লজিকে? যেই ছেলেগুলো কাণ্ড ঘটিয়েছে, তারাতো ক্লাসও করেনা। সাধারণ ছাত্রদের সাথে তাদের কম্পেয়ার করাটাই প্রথমত: বড় রকমের বোকামি আর দ্বিতীয়ত: অসম্মানজনক। আর পুরো ব্যাপারটা কি আপনার কাছে কাকতালীয় মনে হয়? সামান্য কারণের জন্য লীগ করা জুনিয়র ছেলেটা বড়ভাই এর ওপর চড়াও হল কেন? ওদের উদ্দেশ্যই ছিল হয়তো ক্যাম্পাস বন্ধ করা। খুব স্বাভাবিক, কারণ একটি বিদায়ী ব্যাচ - যারা কয়েকমাস পরই ক্যাম্পাস থেকে বেড়িয়ে যাবে, সে ব্যাচের পলিটক্যাল লিডাররা যত পারে, চাইবে ছাত্রত্ব ধরে রাখতে। তাই ঝামেলা শুরু করা থেকে শেষ পর্যন্ত পুরোটাই রাজনৈতিক মদদপুষ্ট।
এরপর সবচেয়ে অবাক করা যেটা, অনেকে অনেক কথাই বলছেন কিন্তু দোষীদের বিচার চাই - একথাটা কারো মুখেই শুনলাম না। ছেলেপেলেরা এই যে এত সাহস পেয়েছে - কি জন্য? কর্তৃপক্ষের মেরুদণ্ডহীনতার জন্যই তো? হ্যা। মারামারির পর হল প্রভোস্ট দের মিটিং হয় এবং সবাই মিলে হল ভ্যাকেন্ট করার সিদ্ধান্ত নেয়। সাময়িকভাবে এটাই হয়তো সলুশন, কিন্তু এই ভ্যাকেন্ট যদি মাস গড়িয়ে যায় তাহলে প্রশাসন কে দিতে হবে ধিক্কার। যে হলে মারামারি হয়েছে, ঘটনার পরেই প্রভোস্ট (অথবা সহকারী প্রোভোস্টও হতে পারেন, সিউর নই) স্যারকে হলের সামনেই দেখা গেছে। তারা কিন্তু চাইলেই অভিযুক্তদের শাস্তি দিতে পারেন - যাতে ভবিষ্যতে কেউ নিয়ম ভাঙার আগে দু'বার চিন্তা করে। যদি জড়িতদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা না নেওয়া হয়, দু'দিন পরই হয়তো আরো বড় কোন অপরাধে বুয়েটবাসীরা আবার খবরের শিরোনাম হবে!
অতএব হে লজ্জিত বুয়েটিয়ানরা, আপনারা গ্লানিবোধে জর্জরিত ঠিক আছে, তবে শুধু কি হল কি হল রে জাতীয়, বিশেষণে বিশেষণে ভরপুর স্ট্যাটাস দিয়ে দায়মুক্তি ঘটেছে না ভেবে, শক্ত কন্ঠে অপরাধীদের বিচারের দাবি তুলুন। এক শতাংশ কুলাঙ্গারের দায় কেন আপনারা নিজের কাধে নেবেন, এর থেকে সবাই একতাবদ্ধ হয়ে কুলাঙ্গারদের তাড়িয়ে দিয়ে ক্যাম্পাসে সুস্থ পরিবেশ ফিরিয়ে আনুন!

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




