somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

নাগরিক সনদপত্র এবং-

২৮ শে আগস্ট, ২০০৯ সকাল ৯:৫৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

সকাল
ভোর নিয়ে আমার ভেতরে প্রবল কাঙ্ক্ষা সচল!
সকাল নিয়ে ততটা নয়। সকালে ঘুম কেটে যায়, চোখের কোণে জমে ওঠা পিঁচুটির মত ক্লান্তি ঝরে যায়। মুখের ওপরে বালিশের দাগ আর ঘুম ঘুম ওম মুছে যায়। সকালে আমরা ব্যস্ত, সকালে আমরা দ্রুত হয়ে উঠি। তাই সকাল অনেক সময়েই আমার প্রিয় সময় না। তবে মাঝে মাঝে সকাল খুব কামনার হয়। চুলের গন্ধ মাখা বালিশে মুখ ডুবিয়ে সকাল আসে। এলোমেলো পায়ে এসে বিছানার চাদর আঁকড়ে ধরে। সকালের আগমনে জানালা চৌকাঠ ভেসে যায়।
ভোর তখন অভিমানী শরৎ, মেঘের মত চলনশীল। স্মৃতিহীন স্রোতের মত ভেসে চলে গেছে সে'সময় একটু আগেই। সকালের দাপটে।
সকালে বেণীগুলো থরে থরে সেজে ওঠে। ফ্রকের কুঁচিগুলো ফুলে ওঠে। শাদা জুতোর আঁকিবুকি ফিতে গোল গোল পাঁকে ফুলের মত হাসতে থাকে, দুলতে থাকে। গাঢ় নীল হাফ-প্যান্টেও ঝলমলে রোদ্দুর জমা হতে থাকে। কালরাতে খুব বৃষ্টি হয়েছে। কারা যানো দরজার বাইরে পানির ছোট একটা হ্রদ জমিয়েছে রাতের ঘুমে। সবাই অচেতন ছিলো যখন, তখন তারা এসে রেখে গেছে হ্রদ আর রোদ। পানির আয়না ভেঙে যায় দাপুটে জুতোর লাফানোয়। ছিটে ছিটে ওঠে হাসিমুখো বিন্দু রোদের শরীরে ঝিকিয়ে ওঠা ছুরির ফলার মতো। আমাদের ক্লান্তি ধুয়ে মুছে যায়।

দুপুর
দুপুর খুব সাধারণ। আটপৌরে হয়েছে তখন সকালের রোদ। থরে থরে জমে ওঠা বেণী আর হাফ-প্যান্ট ফিরে গেছে বাসায়। দুপুরের বুড়োটে ঝিমে তারা বাইরে ঘোরে না। বাউণ্ডুলে রোদ হা হা করে দৌড়ে বেড়ায় খালি ফুটপাতে, ময়লাটে বারান্দায়। শুকাতে দেয়া কাপড় থেকে চুমুর চুমুকে বাষ্প শুষে নেয় চকিতেই। গ্রীলের লোহায় মাঝে মাঝে কিছু রেখেও যায়- দুপুরের রোদ বড়ো খেয়ালি!
এই রোদে চকচকে ত্বকও পুড়ে তামাটে হতে থাকে, তামাটে থেকে কালো হতে থাকে। আমাদের সবার চামড়ায় রোদের পরশ খুব ছাপ রেখে গেছে গ্রীষ্মে। এখন শরতের রোদ, পুরোনো স্বভাব পুরোপুরি ছাড়েনি বলে আমরা পুড়ি, ধীরে ধীরে বার-বি-কিউ হয়ে উঠি নধর কুক্কুটের মাংসের মতো। আমাদের মেরিনেশন ঘটেছে নোনা-ঘামে। লবণে ঝলসে গেছে শার্টের ভাঁজ, নিভৃত আস্তিন। সেখানে শাদা শাদা নোনাদাগ পড়ে গেছে অনেকের, যারা বেশি ঘামে। শরীর শীতলের কত রকমারি উপায়...

এখন দুপুরগুলো দীর্ঘ। অচল পাথরের মত চেপে বসে, শ্লথগতিতে গড়িয়ে চলে, স্বল্পঢাল রাস্তায় যেভাবে ভারি-চাকা গড়ায়...

বিকেল
বিকেল এলেও উষ্ণতা কমে না। রোদের ঝাঁজ কমে আসে, রাগের তীব্রতা। আমাদের মনে তবু স্বস্তি নেই। আর কত বাকি দিনের, রাত এলো না কেন এখনও? এমন প্রশ্নে আমরা পেঁচিয়ে যেতে থাকি। সাপের মত কুণ্ডলি-পাকানো গরম বাতাস আমাদের জামায়, হাতে, মুখে জড়িয়ে থাকে। বিকেল অস্থির। সবার তাড়াহুড়োয় আমরা সবাই কোনো না কোনো জরুরি কথা ভুলে যাই। আজকে হয়তো কারো সাথে দেখা করার কথা, কাউকে কোনো জরুরি কিছু ফেরত দেবার কথা। কারো কাছে আমরা আজই টাকা পেতাম অনেকগুলো। এরকম টুকিটাকি চিন্তাগুলো গলে পড়ে যায় ফুটো পকেট দিয়ে। মাঝে মাঝে হঠাৎ মনে পড়ে যাবার দুরন্ত-ভুলে আমরা মনেও করে ফেলতে পারি, আজকে বাসার গ্যাসের বিলটা দেয়া হয়নি! এরকম অস্থির বিকেল দৌড়ে চলে যায়। যাবার সময়টাতে আমরা অস্থিরতায় তাকে বিদায় জানাতেও ভুলে যাই। খেয়ালও করি না, বিকেলের রোদ মরে যাবার সময় কী করুণ চোখে তাকিয়ে ছিল। সেই চাহনির কোলে, চোখের পাঁপড়ির ভেতর আমাদের ক্লান্ত হয়ে ঘরে ফেরা কৈশোরের গল্পটা ছিল।

যেদিন খেলতে গিয়ে আমরা মারামারি করেছিলাম।

যেদিন জুতো ছিঁড়ে গেলো বলে বাসায় ফিরে বকা খাওয়ার ভয় ছিলো।

যেদিন গোলাপি ফ্রকের মেয়েটার সামনে সাইকেল নিয়ে ঘ্যাঁচ করে ব্রেক কষেছিলাম আমরা।

যেদিন মহল্লার বড়োভাই ধাম ধাম করে আমাদের পিঠে কিল ঘুষি দিয়েছিলো হাতাহাতির সময়ে।

সেই সময়টা গোল, নিষ্পলক চোখ মেলে বিকেলের কোলে শুয়েই থাকে। আমাদের অস্থিরতায় খুব দ্রুতই হারিয়ে যায়।

সন্ধ্যা
সন্ধ্যা বড়ো রূপসী। নীলের ভেতর হলুদ আর কমলা, লাল আর গোলাপি গুলে সন্ধ্যা আসে। আর চলে যায়। সন্ধ্যায় বাতাসে যে পোকাগুলো ওড়ে, তাদের নাম আমাদের জানা নেই। ঠিক কখন ট্র্যাফিকের লাইটগুলো জ্বলে ওঠে তাও আমাদের খেয়াল করা হয় না। আমাদের ঘামে ভেজা শরীরগুলো শুকিয়ে উঠতে থাকলে আমরা স্থবির হই। বিকেলের সেই বিজাতীয় অস্থিরতা কমে আসতে থাকে। রক্তের ভেতর ঘাম শুকিয়ে আসে। টান জাগে চাঁদের। টান পড়ে বাড়ির। কেউ কেউ এসময়ে গোপনেই বেরিয়ে পড়ে। কেউবা এ'সময়ে খুব অসময়ের অনিয়ম-ঘুম থেকে উঠে বিপন্ন হয়ে যেতে থাকে অযথাই! কালো হয়ে আসতে থাকা আকাশে আরও বেশি কালো পাখিরা জোরে জোরে উড়তে থাকে। সশব্দে। আমরা নাগরিক মাথা হেলিয়ে এক পলকের জন্যে তাদের দিকে তাকিয়ে বিরক্তই হই হয়তো। 'এত চেঁচামেচির কী আছে?'- এই ভাবনা বাসের হর্নের মতো আমাদের মনের মাঝে ছুটে বেড়ায়। সন্ধ্যা নেমে চুল এলিয়ে ঢলে পড়ে রাতে। আমাদের নিশাচর চোখ জ্বলে, নিভে- গাড়ির অবিশ্রাম হেডলাইটের মতো

রাত
রাতের কোনো গল্প নেই। বাইরের রাত আর ভেতরের রাত আলাদা। ভেতরে প্রথাগত জীবন, মানবিক সম্পর্ক। সকালে ছেড়ে যাওয়া আধবোনা উলের সোয়েটার আমরা হাতে তুলে নেই। সুতোর এক মাথায় মা ছিলেন, আরেকপাশে বাবা, নিচের দিকে এক কোণে বোনেরা, ভাইয়েরা। তাদের সুতোগুলো গুটিয়ে আবার বুনতে শুরু করি। ফেলে রাখা সুতোতে কথা জমে আছে। আমরা কথা বলি।

ওদের কথা আমরা সারাদিন ভাবি নাই। আরো ভাবি নাই চারপাশে অচল, নিথর গাছগুলোর কথা। তারাও সারাদিন আমাদের মতোই আলো মেখেছে, আঁধার মেখেছে। থোক থোক রঙ তাদের শরীরেও জমেছিলো, আমরা দেখিনি বোধহয়। ওরা রাতে কী করে? ঘুমায়? নাকি জেগে জেগে কথা বলে আমাদের মতোই! এখানেই ভেতর বাহির ফেড়ে ফেলা তরমুজের ফালি ফালি হয়ে যায়। আমরা ভেতরে বসে সুতো বোনার ফাঁকে টের পাই না, গাছেরা ফিসফিস করে। তাদের পাতা আর ডালের মাঝে নিঃশব্দ আগুন ধরে যায়। আগুনে অদৃশ্যে পুড়তে থাকে ছাল, বাকল, কাঠ। কাঠের গভীরে কান্না জমানো ছিলো যে! সেই কান্না আগুনের ভেতরে হু হু করে কাঁদতে থাকে। গাছেদের পুরোনো স্বপ্ন আর চিন্তাগুলোও চলাচল করতে করতে পুড়ে যেতে থাকে। আমরা বাইরে তাকালে এগুলো দেখি না। দেখার চোখ আমাদের বুজে গেছে, যেদিন আমরা ভেতরে চলে গেছি সেদিনই।

সেইদিনের স্মৃতিও আমরা ভুলে গেছি। বৃক্ষের সাথে মানবের বিদায়ের ক্ষণে কী কথা হয়েছিলো কে জানে! কে বলতে পারে! সে'সময়ে তারা কেঁদেছিলো, নাকি হাসিমুখে একে অপরকে বিদায় জানিয়েছিলো, তা আমাদের পুরোপুরি অজ্ঞাত। আমরা কেবল এখন ভেতরে বসে নিথর, দোদুল্যমান ছায়াটে গাছ দেখতে পাই। আগুনের ঘ্রাণ এলেও, তা আমাদের কাছে অচেনা লাগে।

তবে কেউ কেউ সে গন্ধ পায়। উন্মাতাল মানুষের জাত, বেজাতের পশুদের মতো শুঁকে শুঁকে তারা এই প্রবল দহনের খোঁজ পেয়ে যায়। ভালোবাসার মতো আগুনে তারাও পুরে যেতে চায়, এই আকাঙ্ক্ষার কোনো দাম নেই মানবের কাছে আর! তাই তারা, গুটিকয় মানুষ, জনপদ ছেড়ে চলে যায়। চুক্তি-মোতাবেক, আমরা তাদেরকে ভুলে গেছি, এই জগতের প্রয়োজন বা উপযোগ নেই। বেখাপ্পাদের জায়গা পেছনে, গুদামঘরে।

রাত ফুরিয়ে গেলে আমাদের জনপদে, ভোর এসে সব দৃশ্য ও আগুন নিভিয়ে দেয়। একারণেই ঘুম পায় আমার। আগুনের ভালোবাসা হারিয়ে কোমল ঘুম কামড়ে ধরে আমাদের। আমাদের কাছে তাই ভোর প্রিয়!


***
২৮.৯.৮


সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই জানুয়ারি, ২০১০ বিকাল ৩:৪৪
২৫টি মন্তব্য ২৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ঝিনুক ফোটা সাগর বেলায় কারো হাত না ধরে (ছবি ব্লগ)

লিখেছেন জুন, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ৮:০৯

ঐ নীল নীলান্তে দূর দুরান্তে কিছু জানতে না জানতে শান্ত শান্ত মন অশান্ত হয়ে যায়। ১৯২৯ সালে রবার্ট মোস নামে এক ব্যাক্তি লং আইল্যান্ড এর বিস্তীর্ণ সমুদ্র... ...বাকিটুকু পড়ুন

মামুনুলের মুক্তির খবরে কাল বৃষ্টি নেমেছিল

লিখেছেন অনিকেত বৈরাগী তূর্য্য , ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ৯:৪৯


হেফাজত নেতা মামুনুল হক কারামুক্ত হওয়ায় তার অনুসারীদের মধ্যে খুশির জোয়ার বয়ে যাচ্ছে। কেউ কেউ তো বলল, তার মুক্তির খবরে কাল রাতে বৃষ্টি নেমেছিল। কিন্তু পিছিয়ে যাওয়ায় আজ গাজীপুরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

'চুরি তো চুরি, আবার সিনাজুরি'

লিখেছেন এমজেডএফ, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৮


নীলসাধুকে চকলেট বিতরণের দায়িত্ব দিয়ে প্রবাসী ব্লগার সোহানীর যে তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছিল তা বিলম্বে হলেও আমরা জেনেছি। যাদেরকে চকলেট দেওয়ার কথা ছিল তাদের একজনকেও তিনি চকলেট দেননি। এমতাবস্থায় প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

বরাবর ব্লগ কর্তৃপক্ষ

লিখেছেন নীলসাধু, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১১:২২

আমি ব্লগে নিয়মিত নই।
মাঝে মাঝে আসি। নিজের লেখা পোষ্ট করি আবার চলে যাই।
মাঝেমাঝে সহ ব্লগারদের পোষ্টে মন্তব্য করি
তাদের লেখা পড়ি।
এই ব্লগের কয়েকজন ব্লগার নিজ নিক ও ফেইক... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছাঁদ কুঠরির কাব্যঃ অপেক্ষা

লিখেছেন রানার ব্লগ, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১১:২৩



গরমের সময় ক্লাশ গুলো বেশ লম্বা মনে হয়, তার উপর সানোয়ার স্যারের ক্লাশ এমনিতেই লম্বা হয় । তার একটা মুদ্রা দোষ আছে প্যারা প্রতি একটা শব্দ তিনি করেন, ব্যাস... ...বাকিটুকু পড়ুন

×