১
সলিম সাহেবের ঘুম আসছে না। রাত প্রায় দুইটা। বিছানায় এ পাশ-ওপাশ করছেন প্রায় দেড়ঘন্টার মত। এর মধ্য কয়েকবার উঠে পায়চারিও করেছেন রুমের মধ্য। বিছানায় শুয়ে থেকে ঘুম না আসলে পাঁচ মিনিট সময়কে মনে হয় পাঁচ ঘন্টা। ঘুমানোর জন্য বাসি পত্রিকা নিয়ে নাড়াচাড়া করেছেনও কতক্ষন। দেশের বুদ্ধি ব্যবসায়ীদের দেয়া বিভিন্ন বুদ্ধির রসদ সম্পাদকীয়ও পড়েছেন। পত্রিকায় তিনি সব পড়লেও সম্পাদকীয় কখনও পড়েন না,অথচ উচ্চশিক্ষিত লোকদের কাছে সম্পাদকীয়টাই পত্রিকার আসল পাতা। এটা সলিম সাহেবও জানেন। কিন্তু না পড়ার কারন হল,তার ধারনা এইসব বড় বড় লেকচার মারা লোকগুলাই তাদের দেয়া লেকচার ফলো করে না। অথচ টিভি টকশো,পত্রিকার কলামে বড় বড় মহান বানী ছাড়ে। তার অফিসেরই এক উর্ধ্বতন কর্মকর্তা কিছুদিন আগে অবসরে গেছে। তার এখন নতুন চাকরি হল পত্রিকায় কলাম লেখা। সেই বড় বড় বাণী ছাড়েন নীতি-নৈতিকতা সম্পর্কে। অথচ এই লোকটিই ঘুষ ছাড়া একচুলও নড়ত না চাকরি থাকা অবস্থায়। যাইহোক, কিছুক্ষন তার এই অপছন্দের কলামও পড়লেন ঘুম আসার জন্য। কিন্তু না,ঘুমতো আসছেই না উল্টো মনে নানা রকম জল্পনা-কল্পনা ভেসে আসছে। সবচেয়ে বেশি মনে আসছে রোকেয়ার কথা। কেন যেন মনে হচ্ছে সে খুব তাড়াতাড়িই রোকেয়ার কাছে চলে যাবে। কারন মৃত্যুর পূর্বে নাকি মানুষের ছোটবেলা বা অনেক অনেক আগের স্মৃতি মনে আসে বারবার। গত কয়েকদিন আগে শুতে গেলেই সলিম সাহেবের ছোটবেলার স্মৃতি মনে নাড়া দিয়ে উঠত। বাবা-মা,দাদা-দাদী নিয়ে মোটামুটি বিশাল পরিবার ছিল তাদের। সলিম সাহেব ছিল পরিবারে সবার ছোট। সবাই তাকে আদর করে সলু সলু বলে ডাকত। কোন দুষ্টামি করলেই দাদা এসে তার কান মলে দিত। সেই ছোট্র সলুই আজ সলিম সাহেব। অবসরপ্রাপ্ত রাজস্ব কর্মকর্তা। সলিম সাহেবের বয়স এখন সত্তুর অতিক্রম করে গেছে। চাকরি থেকে অবসর নেয়ার পর রোকেয়াই ছিল তার সবচেয়ে কাছের মানুষ। সারাজীবনে রোকেয়াকে যে সময় সে দিতে পারেনি অবসরে যাওয়ার পর মাত্র চার বছরেই মনে হয় তার চেয়ে বেশি সময় দিয়েছে। অথচ যখন সময় দেয়ার দরকার ছিল তখনই সারাদিন অফিস আর দেশ-বিদেশ নিয়ে পরে থাকত সলিম সাহেব। তবে এ নিয়ে রোকেয়ার মনে খুব একটা ক্ষোভ ছিল না। সে হাসিমুখেই সব মেনে নিত। সেই রোকায়াও চিরতরে চলে গেল দু মাস আগে। গত তিন দিন ধরে সারারাত সলিম সাহেবের ঘুম হয় না। নানা ব্যপার তার মাথায় ঘোরে। ঘুম না হওয়া রোগ রোকেয়া থাকতেও ছিল। অবসরে যাওয়ার পর প্রায় রাতেই ঘুম হত না। তখন অবশ্য রাতটা ভালোই কেটে যেত। রোকেয়ারও মনে হয় ঘুম হত না। সে উঠে বলত চলো ছাদে যাই। সলিম সাহেব কিছুটা ইতস্তত বোধ করতো। কারন এতো রাতে যদি ছাদে গিয়ে বুড়ো-বুড়ি গল্প করে আর কেউ যদি দেখে ফেলে তাইলে হয়ত তার কিছুটা লজ্জা লাগবে। কিন্তু তারপরও যেত। রোকেয়া আগেই চা বানিয়ে ফ্লাস্কে রেখে দিত। দুজনে চুপি চুপি গভীর রাতে ছাদে গিয়ে চা খেত আর গল্প করতো। সলিম সাহেবের মন হত সে চামড়া ঢিলে হয়ে যাওয়া কোন বৃদ্ধ না,সদ্য কলেজে উঠা কোন তরুন।যে পাশের বাড়ির মেয়েকে পটিয়ে চুপি চুপি বাড়ির ছাদে এসে প্রেম করছে। রোকেয়া সংসারিক কথাই বেশি বলতো। সলিম সাহেবের এসব ভালো লাগতো না। তারপরও সে মুগ্ধ হয়ে শুনতো রোকেয়ার কথা। সলিম সাহেবের মনে হত রোকেয়ার কন্ঠ এখনও সেই উনিশ বছরের যুবতী রোকেয়ার মতই রয়ে গেছে। যে খুব সুন্দর গান গাইত। বিয়ের পর সলিম সাহেব রোকেয়াকে একটি হারমোনিয়ামও কিনে দেয়। হারমোনিয়মটি এখনও আছে। কিন্তু এই হারমোনিয়ামে গান গাওয়া হয় না অনেক বছর। রোকেয়ার প্রথম সন্তান মারা যায় জন্মের এক সপ্তাহের মাথায়। তারপর থেকে রোকেয়া কেমন যেন একটু গম্ভীর হয়ে যায়। গান গাওয়া ছেড়ে দেয়। সলিম সাহেবেও কখনও অনুরোধ করেনি গান গাইতে। গান শুধু গলার ব্যাপার না,মনেরও ব্যাপার। রোকেয়ার হয়ত গানের উপর থেকে মন উঠে গেছে,তাই তাকে আর অনুরোধ করেই বা কী লাভ। তবে রোকেয়া মারা যাওয়ার কিছুদিন আগে সলিম সাহেব হঠাৎ করেই কী যেন মনে করে রোকেয়াকে একটি গান গাইতে বলে। রোকেয়া কিছুক্ষন চুপ করে থেকে হঠাৎ করেই হো হো করে হেসে উঠে। সলিম সাহেব চমকে গিয়ে রোকেয়ার হাসির দিকে তাকিয়ে থাকে। সে এ হাসির মানে বোঝে না। কিন্তু এ হাসিকে তার গানের চেয়েও বেশি সুমধুর মনে হয়। সেই হাসি তার কানে এখনও বাজে। সে এখনও সেই হাসির শব্দে আনমনা হয়ে যায়।
২
চাকরি থেকে অবসরে যাওয়ার পর সলিম সাহেব মোটামুটি এক কোটি টাকার মত পায়। ছোট ছেলেকে ব্যবসা দিয়ে আর কিছু টুকটাক জমি-টমি কিনে এখনও ব্যাংকে তার তিরিশলক্ষ টাকার মত আছে। সলিম সাহেবের তিন ছেলে এক মেয়ে। বড় ছেলে বউ বাচ্চা নিয়ে কানাডাতে সেটেল। মেয়েটাকেও কিছুদিন আগে তার বর অস্ট্রেলিয়াতে নিয়ে গেছে। বাসায় আছে শুধু মেঝ ছেলে আর ছোট ছেলে। ছোট ছেলেটা পড়াশোনায় খুব একটা ভাল করেনি তাই চাকরি-বাকরি বাদ দিয়ে ছোটখাট একটা ব্যবসা শুরু করেছে কিছুদিন হল। সলিম সাহেবের সারাদিন বাসায় সময় কাটে নাতি আর নাতনীর সাথে গল্প করে। নাতি ক্লাস সিক্সে পড়ে আর নাতনীটা নার্সারীতে। রোকেয়া মারা যাওয়ার পর সারাদিন কাজ ছাড়া বাসায় বসে থাকতে কেমন যেন কয়েদি কয়েদি লাগে তার। তাই রোকেয়া মারা যাওয়ার পর সলিম সাহেবে মনে মনে একটা সিদ্ধান্ত নেয়। সে গ্রামে চলে যাবে,সেখানে একটা বড় করে বাংলো বানাবে। গ্রামে তার বন্ধু যারা বেঁচে আছে তাদের নিয়ে সে সেই বাংলোতে উঠবে। চার-পাঁচ জন হলেই হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে হল লাইফটা যেমন ছিল ঠিক তেমন করেই বাকি সময়টা সে সেই বাংলোতে কাটিয়ে দিবে। ঘুম না আসলে সারা রাত ধরে কার্ড খেলবে। মাঝে মাঝে সিনেমা দেখতে যাবে। প্রায়ই বন্ধুরা সবাই মিলে বাংলোর আশে পাশে কোন বনের ভিতর গিয়ে চড়ুইভাতির আয়োজন করবে। মাঝে মাঝে গানের আসর বসাবে। রফিক থাকলে ভাল হত। ওর গানের গলা খুব ভাল। সেও গত বছর ওপারে চলে গেছে। নতুন করে আবার সিগারেট ধরবে। বিয়ের পর আস্তে আস্তে সে সিগারেট ছেড়ে দেয়। এখন আবার ধরবে। হঠাৎ করেই কোন অজানার উদ্দেশ্যে ঘুরতে চলে যাবে। প্রতি ঈদে ঈদে সেই বাংলো ছেড়ে ঢাকা আসবে পরিবারের সাথে ঈদ করতে। ঈদ শেষে আবার চলে যাবে সেই বাংলোতে। সারাদিন হইহুল্লোড়ে মাতিয়ে রাখবে বাংলোটা। রাতে ঘুম না আসলে রুমে ইজি চেয়ারে আধশোয়া অবস্থায় থেকে চোখ বন্ধ করে সলিম সাহেব প্রায়ই মনে মনে এরকম একটা আবহ তৈরি করে আনন্দ পেতে চেষ্টা করে। এসব ভাবতে ভাবতেই সলিম সাহেব একসময় ঘুমিয়ে পরে। সকালে তার পাঁচ বছরের ছোট্ট নাতনীটি নুপুর পায়ে রুম-ঝুম করতে করতে এসে তার দাড়ি ধরে টান দিয়ে বলে " দাদু দেখনা আমি কী সুন্দর টিপ পরেছি" সলিম সাহেব চোখ কচলাতে কচলাতে তাকে কোলে নেয়। গালে একটা চুমু দিয়ে বলে " টিপতো তুমি কপালে ঠিক মত পরতে পারোনি,দাও আমি ঠিক মত পরিয়ে দিচ্ছি"। সলিম সাহেব ঘুমুতে যাওয়ার আগে ভাবতে থাকা তার বাংলোর কথা ভুলে যায়। মনে হয় তার বাকি জীবনটা এই ছোট্ট শিশুকে কেন্দ্র করেই ঘুরতে থাকবে এবং একসময় শেষ হয়ে যাবে।
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৫ সন্ধ্যা ৬:৫৩