somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ভৌতিক গল্পঃ ~~ঢাকা মেট্রো-ভ-৬৬-৬৬-৬৬~~(১)

১৩ ই জানুয়ারি, ২০১৩ দুপুর ১:০৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

(১)

প্রচন্ড শীতে জমে যাওয়ার মতো অবস্থা । এবার বাংলাদেশে প্রচন্ড শীত পড়েছে । এই তো কিছুদিন আগেই তো নীলফামারিতে রেকর্ড ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছিল । ১৯৬৮ সালে সিলেটের শ্রীমঙ্গলে ২.৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছিল । অনেকের আশংকা যে পৌষ মাসেই এ অবস্থা ! তাহলে মাঘের সময় তো রিতিমতো বরফ পড়বে । বাংলাদেশের জলবায়ু ভয়াবহ আকার ধারন করেছে । আসলে বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের ফলসরূপ এই ছোট্ট দেশটাকেও দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে । শৈত্য প্রবাহের দরুন রোদ উঠার পরও প্রচন্ড ঠান্ডা থেকে যাচ্ছে । ফলাফল সরূপ মৃত্যু হচ্ছে বস্ত্রহীন গরিব মানুষগুলোর । গলায় পেচানো মাফলারটার প্যাচ খুলে নিয়ে কান নাক ভাল করে ঢাকলো রুদ্র । ভয়াবহ বাতাস চারিদিকে । প্রচন্ড বাতাসে গায়ে জড়ানো চাদরটার একাংশ পতাকার মতো উড়ছে । কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ গেইটের বিপরিত পাশে একটা টং দোকানের পাশে দাড়িয়ে আছে সে । ঘাড় ফিরিয়ে একটু পিছনে একটা মাকের্টের ভিতর করিডোরে দাড়ানো নীলাকে দেখে নিলো রুন্দ্র । মেয়েটা সেলোয়ার কামিজের উপর একটা উলের সোয়েটার পড়ে তার উপর জড়িয়েছে কাশ্মিরি শাল । শালের উপরের অংশ ঘোমটার মতো মাথার উপর দিয়ে রেখেছে যাতে কানে ঠান্ডা না লাগে । ঘাড় ফিরিয়ে মূল সড়কের দিকে এগিয়ে গেলো রুদ্র । বাসটা এখান দিয়েই আসার কথা । কিন্তু খুব বেশি দেরি করছে , বাস এখানে আসার কথা সেই রাত দশটায় । অথচ এখন সোয়া এগারোটা বাজে , তবুও বাসের দেখা নেই । রাগ লাগছে রুদ্রর , এতো ঠান্ডার মাঝে এভাবে দাড়িয়ে থাকার কোন মানে হয় ? রাগ ঝাড়তেই যেন রাস্তায় পরে থাকা ছোট একটা পাথরে সজোরে লাথি মারলো সে , পাথরটা গড়িয়ে গিয়ে রাস্তার পাশে ড্রেইনে গিয়ে পড়লো । পাথর পরার শব্দটাও বাতাসের শো শো শব্দ গ্রাস করে নিলো । মাঝে মাঝে দূরে রাস্তা দিয়ে আসা ছোট ছোট গাড়ি অথবা ট্রাকের আলো দেখতে পাওয়া যায় । টং দোকানটাও এখনি বন্ধ করে দিবে । বিরক্ত হয়ে ফোন বের করে ডঃ আসিফকে ফোন করলো রুদ্র । "হ্যালো । আসিফ ভাই ? কি মিয়া ? বাস কই ? আরে ভাই তাড়াতাড়ি করেন না । দাড়ায়ে থাকতে থাকতে তো কুলফি আইসক্রিম হয়ে যাব ।" অপর প্রান্তের কথা শুনে ফোন কেটে দিল রুন্দ্র । তারপর নীলার দিকে এগিয়ে গেল সে । তাদের বিয়ে হয়েছে মাত্র ছয়মাস আগে , ব্যাস্ততার কারনে নীলাকে নিয়ে বের হওয়া যায় নি । কিছুদিন আগে অর্থপেডিক্স ডিপার্টমেন্টের ডঃ রাশেদই প্রথম এই ট্যুরটার কথা প্রথম তোলে । ট্যুরটা হবে কুমিল্লা টু বান্দরবান । প্রস্তাবটা সবাই মিলে লুফে নেয় , আসলে ডাক্তারদের জীবনে অবসর জিনিসটার খুব অভাব । সামান্য অবসর যাপনটা তাই লুফে নিতে দেরি হয় না কারো । তাছাড়া স্পন্সর করছে স্কয়ার আর ইনসেপ্টা নামক ঔষধ কম্পানি । খরচের ব্যাপারটা নিয়েও তাই ভাবতে হচ্ছে না । নীলাকে নিয়ে তাই যেতে কোন অসুবিধাই দেখতে পায়নি রুদ্র । প্রচন্ড শীতে সামান্য কাঁপছে নীলা , চোখ কুচকে রেখেছে সে । টং দোকানে জ্বলতে থাকা ৬০ ওয়াটের নগ্ন বাল্বের আবছা আলোয় রুদ্র দেখতে পেলো নীলার চশমার কাঁচ ঝাপসা হয়ে আছে । হটাত্‍ করেই খুব বেশি মায়াবি লাগলো মেয়েটাকে । নীলাকে অবাক করে দিয়ে ওর চোখ থেকে চশমাটা খুলে নিলো রুদ্র , তারপর চাদরের এক কোন দিয়ে মুছে দিলো চশমার কাঁচ । নীলার অবাক হওয়া চোখজোড়া তখনও তাকিয়ে আছে রুদ্রের দিকে । কাঁচ মোছা শেষ করে নীলার দিকে তাকাতেই রুদ্র দেখলো মেয়েটা মুচকি হাসছে । রুদ্রর ভাল লাগলো খুব । প্রিয় মানুষের হাসি যে কতো বড় ভ্যাকসিন হতে পারে তার কিছুটা রুদ্র বোঝে , মাঝে মাঝে সে নীলাকে বলে "বুঝছো টমেটো বেগাম তুমি হইলা গিয়া আমার পেইনকিলার । আমার প্যারাসিটামল ।" নীলা হেসে ফেলে এসব কথা শুনে । হাসতে গিয়ে মাঝে মাঝে চোখে পানি চলে আসে তার । রুদ্র আলতো করে মুছে দেয় সে পানি । চশমাটা আবার নীলার চোখে পরিয়ে দেয় রুদ্র । বাসের হর্ণ শোনা যায় রাস্তা থেকে । এক হাতে নীলার হাত অন্য হাতে সুটকেসটা ধরে বাসের দিকে এগিয়ে যায় রুদ্র । ডঃ আসিফ আর বাসের হেল্পার দাড়িয়ে আছে সামনে । হেল্পারের হাতে সুটকেসটা ধরিয়ে দেয় রুদ্র । হেল্পার সেটা নিয়ে লাগেজ বক্সে ঢোকাতে ব্যাস্ত হয়ে যায় । "কি ব্যাপার ভাই ? এতো দেরি যে ?" জিজ্ঞেস করে রুদ্র । "আরে বলিস না , সবাই আসতে এতো দেরি করছে যে বাস ঠিক টাইমে ছাড়তেই পারি নাই । চল্ চল্ আর দেরি করে লাভ নাই । ডঃ আসিফের পিছন পিছন বাসের সামনের দিক ঘুড়ে দরজার সামনের দিকে এগোলো রুদ্র । বাসের হেডলাইটের আলো তাদের তিনজনের লম্বা ছায়া ফেলল রাজপথে , অধিভৌতিক করে তুললো দৃশ্যপট । হটাত্‍ কেন যেন বাসের সামনের নাম্বারপ্লেটের দিকে চোখ গেলো রুদ্রর । সেখানে লেখা "ঢাকা মেট্রো -ভ-৬৬-৬৬-৬৬" । ঠিক এসময় এক ঝলক বাতাস বয়ে গেলো , রাস্তার ধুলো , গাছের পাতা কাঁপিয়ে দিলো । ঘাড়ের কাছে ঠান্ডা অনুভূতি হলো রুদ্রর । হাতের বাহুর কাছে লোমগুলো দাড়িয়ে গেলো , ব্যাথা লাগলো রুদ্রর । নীলার হাত ধরে টান দিলো সে , বাসে উঠলো । বাসের মাঝামাঝিতে তাদের সিট । আশেপাশের সিটে বসা মুখগুলো রুদ্রের পরিচিত । তাদের অর্থপেডিক্স ডিপার্টমেন্টেরই সবাই । সর্বমোট ৩৫ জন যাত্রী । একটু পর হেল্পার এসে উঠলো বাসে । বাসের ভিতরে লাইটগুলো বন্ধ করে দেওয়া হলো । চলতে শুরু করলো বাস । মেডিকেল রোডের অবস্থা বড়ই খারাপ । জায়গায় জায়গায় প্রমান সাইজের গর্ত হয়ে আছে , বাস ভীষনভাবে দুলছে । ভিতরে যাত্রীরা মোটামুটি আলুভর্তা হয়ে যাওয়ার জন্য যথেষ্ঠ । একটু পর বাস চিটাগাং রোডে উঠে আসলো , ঝাকুনি থেমে গিয়েছে ততক্ষনে । ডান দিকের সারিতে সিট পেয়েছে রুদ্র আর নীলা । জানালার পাশে নীলা বসেছে , মেয়েটা বরাবরই জানালার পাশে বসতে ভালবাসে । তাছাড়া অলিখিত সিস্টেম হিসেবে জানালার পাশের সিটে স্ত্রীদের বসিয়ে পাশের সিটে স্বামীরা বসে থাকেন । সুতরাং যেভাবেই চিন্তা করা হোক না কেন নীলাকে জানালার পাশেই বসতে হবে । রাত এগারোটা বেজে চল্লিশ মিনিট , বাসের সবাই ঘুমাচ্ছে , নীলাও ঘুমিয়ে আছে । জেগে আছে শুধু বাস ড্রাইভার , হেল্পার আর রুদ্র । অস্বস্থি লাগছে রুদ্রর , এমনটা কখনো আগে হয়নি তার সাথে । কেন যেন তার মনে হচ্ছে কোথাও বড় ধরনের গড়মিল রয়ে গেছে , কিন্তু কেন মনে হচ্ছে সেটা সে জানে না । মানুষের পাঁচটা ইন্দ্রিয়দের পর ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় নামে একটা আলাদা ইন্দ্রিয় আছে । যাকে ইংরেজিতে সিক্সথ্ সেন্স বলে । মূলত এটি মানুষের অবচেতন মনের একটি অবাস্তব ভাবনা মাত্র । অনেকটা স্বপ্নের মতো । তবে প্রাচীন কালে মানুষরা বিশ্বাস করতো মানুষের স্বপ্নের সাথে বাস্তবের সংযোগ রয়েছে । অতি অদ্ভুত হলেও সত্য সিক্সথ্ সেন্স ব্যাপারটা অনেকের ক্ষেত্রে সত্য হয় । বিশেষ করে সামরিক বাহিনীর সদস্যদের এ সম্পর্কে জ্ঞান দেওয়া হয় । যাতে শক্রুর পদক্ষেপ সম্পর্কে তারা আগেই সতর্ক হয়ে যেতে পারে ।

(২)

অস্বস্থি নিয়েই ঘুমানোর চেষ্টা করলো রুদ্র । কিন্তু ভালো ঘুম হলো না , দুঃস্বপ্ন দেখলো সে । দেখলো বাসটা এক্সিডেন্ট করেছে , খাদে পড়ে গেছে সেটা , একটা গাছের ডালের সাথে অস্থায়ী ঠেস দিয়ে দুলছে বিপদজনক ভঙ্গিতে । সে খাদের কাছে দাড়িয়ে আছে , নীলা এখনো রয়ে গেছে বাসের ভিতরে । হাত বাড়িয়ে রুদ্রকে কাতর গলায় ডাকছে নীলা , রুদ্র নীলার হাত ধরতে চাইছে কিন্তু কিছুতেই পেরে উঠছে না । বহু কষ্টে নীলার হাত চেপে ধরলো সে , ঠিক সে মুহূর্তেই গাছটা উপরে আসলো মাটি থেকে । বাস সহ রুদ্র অসীম শূন্যতায় রওনা হলো , আর্তচিত্‍কার বের হয়ে এলো গলা দিয়ে , ঐ অসীম পরার মাঝে কোন বিরতি নেই । হটাত্‍ ঝাকি মতো খেয়ে জেগে উঠলো রুদ্র , ঘামে জ্যাকেটের ভিতরে তার টিশার্টের পিছনের অংশ ভিজে গিয়েছে । অস্বস্থি লাগলো ভীষন , জ্যাকেটের চেন একটু আলগা করে দিলো সে । পাশ ফিরে নীলার দিকে তাকালো রুদ্র , মেয়েটা গুটিসুটি মেরে শুয়ে আছে একপাশে কাত হয়ে । গায়ের শালটা একপাশে ঝুলে আছে , ঠিক করে দিলো রুদ্র । আবছা আলোয় নীলার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো সে , ঘুমালে নীলাকে একদম ছোট বাচ্চাদের মতো নিষ্পাপ লাগে । নীলার পাশ দিয়ে বাহিরে তাকালো রুদ্র , বাসের জানালায় কুয়াশা জমে সাদা হয়ে আছে , কুয়াশা ঘনিভূত হয়ে পানি হয়ে নেমে যাচ্ছে কাঁচ বেয়ে । সে পানির ধারা আকাঁবাকা কয়েকটা রেখা তৈরি করেছে জানালায় গায়ে ,বাহিরে কালিগোলা অন্ধকার । মাঝে মাঝে দু একটা ট্রাক অথবা বাস প্রচন্ড গতিতে পাশ কাটিয়ে যাচ্ছে , বাতাসের শব্দের ফলে বুঝতে পারছে রুদ্র । হটাত্‍ বিকট শব্দ হলো , বাস নিয়ন্ত্রনহীনের মতো আচরন শুরু করলো । বাসের সব যাত্রী জেগে গিয়েছে ততক্ষনে , আতংকিতো চিত্‍কার করছে মেয়েরা । ভয়ার্ত চোখে সামনে তাকিয়ে আছে রুদ্র , খেয়াল নেই কখন যেনো নীলা তার বাহু শক্ত করে জড়িয়ে ধরেছে । নীলার হাতের বড় বড় নখগুলো একটু একটু করে তার মাংসপেশীতে বসে যাচ্ছে , উত্তেজনায় ব্যাথা টের পাচ্ছে না রুদ্র । বাস ড্রাইভার অবশেষে বাস নিয়ন্ত্রনে আনলো অনেক কায়দা কসরত্‍ এর পর , জানানো হলো যে বাসের বাম দিকের পিছনের চাকা পামচার হয়েছে । যাত্রীরা মোটামুটি শান্ত হয়ে আবার ঘুমাতে চেষ্টা করলো , দু একজন বাহিরে নেমে গেলো প্রাকৃতিক ডাকে সাড়া দিতে । রুদ্রর অস্বস্থি ভাবটা আরেকটু প্রকট হলো , অস্থিরতা ক্রমশ বাড়ছে তার । নীলা তার বাহু তখনো জড়িয়ে ধরে আছে , তবে এখন আস্তে করে ধরেছে । আলতো করে নীলার হাত ছাড়িয়ে উঠে দাড়ালো রুদ্র , নীলা কিছু বললো না , জানে যে রুদ্র এখন সিগারেট খাবে । বাসের বাহিরে নেমে সামনের দিকে এগোলো রুদ্র , একটা মেহগনি গাছে ঠেস দিয়ে দাড়িয়ে সিগারেট ধরালো একটা । বাসের হেডলাইট নেভানো হয়নি , হেডলাইট দুটোর মাঝামাঝি নিচের দিকে নাম্বার প্লেট লাগানো । নাম্বারপ্লেটের নাম্বারগুলোর মাঝে কোথায় যেন একটা ঘাপলা আছে , কিন্তু কিছুতেই ধরতে পারছে না সে । রাস্তার পাশেই ঘন বন বোধহয় , বনের ভিতর থেকে শেয়াল অথবা কুকুরের কান্নার মতো আয়োয়াজ শোনা যাচ্ছে , গায়ে কাঁটা দিলো রুদ্রর । নিজের কাছেই অবাক লাগলো ব্যাপারটা , কুকুরের ডাক শুনে এভাবে কখনো ভয় পেয়েছে কিনা মনে করতে পারলো না । চাকা মেরামত প্রায় শেষ হয়ে এসেছে , বাসে এসে উঠলো সে । বাসের ভিতরে লাইট জ্বালানো , নীলা জেগে রয়েছে , কিন্তু তার চোখজোড়া এখনো লাল । রুদ্রকে আসতে দেখে শুকনো হাসি হাসলো , রুদ্রও হাসতে চেষ্টা করলো কিন্তু অস্বস্থি মাখানো হাসিতে কোন প্রাণ ছিল না । একটু পর বাস আবার চলতে শুরু করলো , নিভে গেলো বাসের ভিতরে লাইট । সারাটা সকাল হাসপাতালে ডিউটি করেছে , স্নায়ুগুলো সব ক্লান্ত হয়ে আছে রুদ্রর , বেশিক্ষন জেগে থাকতে পারলো না সে , একটু পরই ঘুমিয়ে পরলো । ঘুম যখন ভাঙ্গলো তখন দেখলো বাস থেমে আছে একটা হোটেল এর সামনে । নীলা তাকে ডেকে তুলেছে , বাসের যাত্রীরা সব নামছে এক এক করে । বাহিরে তখনো ঘুটঘুটে অন্ধকার , নীলাকে নিয়ে বাস থেকে নামলো রুদ্র । ডাঃ আসিফ আর ডাঃ রাফিদকে এক জায়গায় দাড়িয়ে থাকতে দেখে এগিয়ে গেলো সেখানে । "আসিফ ভাই বাস থামলো কেন ? কোন সমস্যা ?" জিজ্ঞেস করলো রুদ্র । "আরে মিয়া কইয়ো না । বাসের ড্রাইভার রাস্তা ভুল করছে । হেয় তো কক্সবাজারের রাস্তায় চইলা আইছে । এখন বান্দরবানের রাস্তা অনেক পিছনে । সামনে নাকি একটা শর্টকাট রাস্তা আছে । জাভেদ আর রাসেল কথা বলতেছে হোটেল ম্যানেজারের সাথে ।" বলল আসিফ । ডাঃ আসিফ আবারও ডাঃ রাফিদের সাথে কথা বলায় ব্যাস্ত হয়ে গেলো । নীলাকে নিয়ে হোটেলে ঢুকলো রুদ্র , দু কাপ চায়ের অর্ডার দিলো । "ড্রাইভার রাস্তা ভুল করলো কেন ?" নীলা জিজ্ঞেস করলো । "বুঝলাম না । চিনে না বোধহয় । এসব ভাড়া করা বাসগুলো এ রুটে চলাফেরা করে না , রাস্তাঘাটও ঠিকমতো চিনে না । টাকা দেখতেই লুফে নিছে আরকি ।" জবাব দিলো রুদ্র । দুজনের মাঝে আর কথা হলো না , চুপচাপ চা খেলো ।

একটু পর বাসের হেল্পার সবাইকে বাসে উঠতে বললো , সবাই উঠার পর বাস চলতে শুরু করলো আবার । সুবেহ সাদিক হয়ে গেছে ততক্ষনে , বাহিরে কালিগোলা অন্ধকারের গাঢ়ত্ব কমে গেছে , তবুও আবছা আলোয় খুব সামান্যই দৃষ্টি চলে । একটু পর বাস বাম দিকে মোড় নিলো , রাস্তা ক্রমশ উপরের দিকে উঠে গিয়েছে , রাস্তার অবস্থাও তেমন ভালো নয় । ঝাকি খাচ্ছে বাস , বিপদজনক ভঙ্গিতে কাত হয়ে যাচ্ছে এপাশ ওপাশ । একটু পর রাস্তার দুপাশে পাহাড়ের অবয়ব দেখতে পেলো সবাই , বান্দরবান জেলায় যে তারা এসে গিয়েছে তার পূর্বলক্ষন । পাহাড়ের পেট কেটে তৈরি করা হয়েছে এই রাস্তা , পাহাড়ের উপরে ঘন বনের ছায়া এসে পড়েছে রাস্তার উপর । যেন বিশাল কোন দানব গ্রাস করে নিচ্ছে আগুন্তুকদের । ঘাড়ের কাছে আবারো সেই শিরশিরে অনুভূতি হলো রুদ্রর , ভয় পেলো বোধহয় , নিজেকে ধমক দিলো সে । অল্পতেই ভয় পেয়ে যাওয়ায় নিজের উপরই বিরক্ত হলো রুদ্র , এদিকে নীলা আবারও আগের মতো রুদ্রর বাহু চেপে ধরেছে । নীলা হাতের নখ চেপে বসেছে রুদ্রর মাংশপেশিতে , ব্যাথা পেয়েও কিছু বলল না সে । অবশেষে বাস মোটেলের সামনে এসে পৌছালো । সবাই একে একে নামলো বাস থেকে । মোটেলটা দেখতে পুরোনো , মনে হচ্ছে অনেক আগে তৈরি করা হয়েছে , অবাক হলো সবাই । ডাঃ রাশেদ আর ডাঃ আসিফ ভিতরে ঢুকলো , রিসিপশনিস্ট লোকটা নাক মুখে চাদর মুড়ি দিয়ে আছে । তার শরীরের নিচের অংশ কাউন্টার ডেস্কের নিচে আর উপরের অংশটা কালো চাদরে ঢাকা । "ভাই এখানে বোধহয় আমরা ১৭ টা রুম বুকিং দিয়েছি , এটাই পর্যটন মোটেল না ?" জিজ্ঞেস করলো ডাঃ রাশেদ । লোকটা মাথা ঝাকালো কেবল , কোন কথা বললো না । "আসলে কোন সাইনবোর্ড দেখিনি তো , তাই আরকি শিওর হলাম । রুমের চাবিগুলো দিবেন কাইন্ডলি ?" হেসে বলল রাশেদ । এবারও লোকটা কোন কথা না বলে একসাথে কতোগুলো চাবি রাখলো ডেস্কের উপর । আসিফ সেগুলো গুনে দেখলো , ঠিক ১৭ টাই আছে । আসিফ খুশি হলো এই ভেবে যে লোকটা তাদের জন্যই অপেক্ষা করছিলো , লোকটাকে ধন্যবাদ দিয়ে বাহিরে বের হয়ে এলো দুজনে । বাহিরে এসে নাটকিয় ভঙ্গিতে ডাঃ আসিফ বললো "সুতরাং ভদ্রমহোদয় ও ভদ্রমহিলাগন বান্দরবানে আপনাদের স্বাগতম । যারা জুটি হিসেবে এসেছেন তারা উপরতলায় রুম পাবেন , আর যারা ব্যাচেলর তাদেরকে নিচতলাতে রুম নিয়েই সন্তুস্ট থাকতে হবে আমার মতো ।" তার বলার ভঙ্গিমায় সবাই হেসে উঠলো , একে একে তার হাত থেকে চাবি নিয়ে যে যার রুমে যেতে লাগলো । রুদ্র চাবি নিয়ে দেখলো তার রুম নাম্বার ২২২ , উপরতলায় উঠে বাম দিকে রুমটা । নীলাকে সাথে নিয়ে উপরে উঠে এলো সে , রুমটার সামনে এসে দরজায় চাবি ঢুকালো । বান্দরবানে বেশ শীত , এলোমেলো বাতাস বইছে সারাক্ষন । নীলা তার গায়ের শালটা আরো ভালমতো জড়িয়ে নিলো । রুমের দরজা খোলার সময় দরজাটা ক্যাচ ক্যাচ শব্দ করে প্রতিবাদ জানালো , ভিতর থেকে ভ্যাপসা একটা গন্ধ নাকে এসে ঝাপটা মারলো । মনে হলো রুমটাতে অনেকদিন কেউ ঢুকে না , অস্বস্থি ভাবটা আবারও চেপে বসলো রুদ্রর মনে । নিজেকে শাষন করলো সে , রুমে ঢুকে রুমের সুইচ বক্স খুঁজলো , সুইচ বক্সে হাত লাগার পর লাইট জ্বালালো । মিট মিট করে জ্বলে উঠলো রুমের দুটো টিউব লাইট , রুমে একটা ডাবল বেড , একটা আলমারি আর একটা টি টেবিল আছে । আর আছে একটা এটাস্টড্ বাথরুম । নীলার দিকে ফিরে মুচকি হাসলো রুদ্র তারপর নাটকিয় ভঙ্গিতে বলল "ম্যাডাম আপনি কি দয়া করে এই গরীবখানায় পদধূলি দিবেন ?" । মিষ্টি করে হাসলো নীলা তারপর বলল "এই অবস্থায় ফাইজলামো করো কিভাবে তুমি ? ৭.৩০ বের হতে হবে ভুলে গিয়েছো ?" । "না ম্যাডাম ভুলি নি , আপনি ফ্রেশ হয়ে আসুন তারপর একটু ঘুমিয়ে নিতে হবে ।" বলল রুদ্র । নীলা আর কথা না বলে বাথরুমে ঢুকলো , সে বের হবার পর রুদ্র ঢুকলো বাথরুমে । বের হয়ে দেখলো নীলা ঘুমিয়ে পরেছে , রুমের লাইট অফ করে বিছানায় গিয়ে নীলার পাশে শুয়ে পরলো রুদ্র । ঘুমে চোখ প্রায় জড়িয়ে এসেছে , হটাত্‍ জানালার দিকে চোখ পরতেই মনে হলো কেউ একজন রক্তলাল চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকে , চোখে ক্রোধের আগুন জ্বলছে । ঝট করে উঠে বসলো রুদ্র , চোখ কচলে ভাল করে তাকালো সে । কিন্তু কাওকে দেখতে পেলো না । ব্যাপারটাকে চোখের ভুল মনে হলো , কিন্তু মনের অস্বস্থির মাত্রাটা বাড়লো আরেকটু । আবার শুয়ে পরলো রুদ্র , সারাদিনের ক্লান্তিতে চোখে ঘুম নেমে আসতে দেরি হলো না ।

(চলবে)

কিছু কথাঃ

১৪ই জানুয়ারি তারিখটা আর ২০০২ সালটা আমার জন্য এবং আমার পরিবারের জন্য স্মরনীয় একটা মূহুর্ত । সালটাকে তো আর ফিরে পাবো না , তাই তারিখটাকেই প্রতিবছর স্মরন করি । আমার এখনো মনে পরে গভীর রাতে আমি , আমার ছোট বোন নিধি আর আমার ছোট ফুফু জেগে ছিলাম । আব্বা রাত ৩ টায় বাসায় এসে আমাদের দুই ভাইবোনকে বলল "তোমাদের ছোট একটা বোন হয়েছে ।" আব্বা ছোট বোনটার জন্য কাপড় নিয়ে গেলেন । ভোর হতেই হসপিটালে চলে গেলাম আমরা । গিয়ে দেখলাম আধবোজা চোখে একটা ছোটখাট পুতুল মিটমিট করে তাকাচ্ছে সবার দিকে । সেই ছোট্ট পুতুলটার নাম রাখা হয় "নাফিসা সালসাবিল নিঝু" । আমার কলিজার টুকরো বোনটা চোখের সামনেই কিভাবে যেন এতো বড় হয়ে গেলো । নিঝু হাসলে তার দুগালে টোল পরে । আম্মা হাসলে তার দু গালেও টোল পরে , আম্মার এই দুর্লভ গুনটা সয়ংসম্পূর্নভাবে পেয়েছে নিঝু । নিঝুর ছোটবেলার আধো আধো কথা বলা , প্রথম হাটতে শেখা , প্রথম আবদার করা অথবা প্রথম স্কুলে যাওয়ার দিনগুলো এখনো চোখের সামনে ভাসে । গত নয়টা বছর কখনো তার জন্মদিন মিস হয়নি , কষ্টকর ব্যাপার হলো এবার মিস হচ্ছে । আমি আমার ফুলপরিটার কাছ থেকে প্রায় ১০০ কিঃমিঃ দূরে । কুমিল্লা থেকে চলে আসার সময় জন্মদিন উপলক্ষে তার একটাই আবদার ছিল , ফোন করে যেন তাকে উইশ করি । সে অতটুকুতেই খুশি । "হ্যাপি বার্থডে ফুলপরি বেগাম । তোমাকে অনেক ভালবাসি । :-*"
গল্পের এ পর্বটা তাকে উত্‍সর্গ করলাম ।
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই জানুয়ারি, ২০১৩ দুপুর ১:১০
১১টি মন্তব্য ১১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

স্মৃতিপুড়া ঘরে

লিখেছেন আলমগীর সরকার লিটন, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৩০



বাড়ির সামনে লম্বা বাঁধ
তবু চোখের কান্না থামেনি
বালিশ ভেজা নীরব রাত;
ওরা বুঝতেই পারেনি-
মা গো তোমার কথা, মনে পরেছে
এই কাঠফাটা বৈশাখে।

দাবদাহে পুড়ে যাচ্ছে
মা গো এই সময়ের ঘরে
তালপাতার পাখাটাও আজ ভিন্নসুর
খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে... ...বাকিটুকু পড়ুন

গরমান্ত দুপুরের আলাপ

লিখেছেন কালো যাদুকর, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৫৯




মাঝে মাঝে মনে হয় ব্লগে কেন আসি? সোজা উত্তর- আড্ডা দেয়ার জন্য। এই যে ২০/২৫ জন ব্লগারদের নাম দেখা যাচ্ছে, অথচ একজন আরেক জনের সাথে সরাসরি কথা... ...বাকিটুকু পড়ুন

রাজীব নূর কোথায়?

লিখেছেন অধীতি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:২৪

আমি ব্লগে আসার পর প্রথম যাদের মন্তব্য পাই এবং যাদেরকে ব্লগে নিয়মিত দেখি তাদের মধ্যে রাজীব নূর অন্যতম। ব্যস্ততার মধ্যে ব্লগে কম আসা হয় তাই খোঁজ-খবর জানিনা। হঠাৎ দু'একদিন ধরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বৃষ্টির জন্য নামাজ পড়তে চায়।

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৩৮



ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে বৃষ্টি নামানোর জন্য ইসতিসকার নামাজ পড়বে তার অনুমতি নিতে গিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এটির অনুমতি দেয়নি, যার জন্য তারা সোশ্যাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

=তুমি সুলতান সুলেমান-আমি হুররাম=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৩৬



©কাজী ফাতেমা ছবি

মন প্রাসাদের রাজা তুমি, রাণী তোমার আমি
সোনার প্রাসাদ নাই বা গড়লে, প্রেমের প্রাসাদ দামী।

হও সুলেমান তুমি আমার , হুররাম আমি হবো
মন হেরেমে সংগোপনে, তুমি আমি রবো।

ছোট্ট প্রাসাদ দেবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×