somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ইসলামে সঙ্গীত

২৮ শে অক্টোবর, ২০১৬ দুপুর ১:১৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আমাদের মতো গান-পাগল জাত, নাচে-গানে ভরপুর, ‘বারো মাসে তেরো পার্বণ’ দুনিয়ায় বোধহায় আর নেই। হাজার বছর ধরে গ্রামের রাস্তায় একতারা বাজিয়ে নেচে নেচে গভীর দার্শনিক গান গায়নি আর কোনো জাতির ছিনড়ববস্ত্র উদাস বাউল। আমাদের চাষি-জেলে-তাঁতি-মাঝি-কামার-কুমোর, এমনকি সাপ-ধরা বেদে ও ছাদ- পেটানো পর্যন্ত প্রতিটি পেশা তার নিজস্ব মৌলিক গানে সমৃদ্ধ। দেবর-ভাবির পরিহাসের গান, নানা-নাতির গম্ভীরা বা কবিয়ালের তাৎক্ষণিক গান-যুদ্ধ তো বাংলার আশ্চর্য সম্পদ − দুনিয়ার কোনো জাতিরই নেই। তাই গান নেই তো বাংলাও নেই, বাঙালিও নেই। আর, একাত্তরে ? একাত্তরে গান আমাদের ‘দৃপ্ত স্লোগান, ক্ষিপ্ত তীর-ধনুক।’

তারপরেও অনেকেই মনে মনে অপরাধবোধে ভোগেন − কি জানি, গান গেয়ে গান শুনে গুনাহ্ করছি নাতো ! সেজন্যই নিরপেক্ষভাবে সবদিকের ইসলামি দলিল দেখিয়ে এ নিবন্ধ লেখা যাতে সবাই দলিলগুলো জেনে নিজের সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। এটা আরও দরকার এজন্য যে আমরাই একমাত্র জাতি যার সঙ্গীতকে উচ্ছেদ করার জন্য বোমা মেরে মানুষ খুন করার লোক আছে। তাই বুকের রক্ত ঢেলে আমাদের সঙ্গীতকে রক্ষা করতে হয়। পৃথিবীর অন্য কোনো জাতির এ অদ্ভুত ও ভয়ানক সমস্যাটা নেই।

বহু আগে কেউ মধ্যপ্রাচ্য থেকে এসে বাংলার মাটিতে দাঁড়িয়ে ফিসফিস করে বলেছিল − ‘গান হারাম’! সেই ফিসফিস হয়েছে কানাকানি, কানাকানি হয়েছে আলোচনা, আলোচনা হয়ে উঠেছে দাবি, কোথাও কোথাও দাবি হয়ে উঠেছে হুঙ্কার। ‘গান হারাম’ নাকি তাঁদের নিজস্ব মতামত নয়, এ নাকি একেবারে আলা- রসুলের নির্দেশ। উদ্ধৃতি : “সঙ্গীত, নৃত্য ও চিত্রশিল্পকলা হইল অশীল শিল্প ও কঠিনভাবে ইসলাম বিরোধী” − মওলানা মওদুদি ‘এ শর্ট হিস্ট্রি অব্ দ্য রিভাইভালিস্ট মুভমেণ্ট ইন্ ইসলাম’ পৃঃ ৩০।

তাই ? ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো’ হারাম ?
‘আমি বাংলার গান গাই’ কঠিনভাবে ইসলাম-বিরোধী ?
‘বাড়ির পাশে আরশিনগর’, ‘কান্দে হাছন রাজার মন ময়না’ অশীল শিল্প ?
‘মোর প্রিয়া হবে এসো রাণী’, ‘লাইলি তোমার এসেছে ফিরিয়া’ এবং বাংলার মায়েদের মধুকণ্ঠে ‘আয় আয় চাঁদমামা টিপ দিয়ে যা, চাঁদের কপালে চাঁদ টিপ দিয়ে যা’ সবই হারাম ?
কেন ? ভারতবর্ষের রাগৈশ্বর্য পরিপূর্ণ হয়ে নেই মিয়া তানসেন. আমির খসরু, ওস্তাদ আলাউদ্দিন, বড়ে গোলাম আলী, ছোটে গোলাম আলী, করিম খান, বিসমিলা খান, বেলায়েৎ হুসেন, কেরামত আলী, আলী আকবর, জাকির হুসেন, আলারাখা, আমজাদ আলী, রইস খান, নাজাকাতসালামত, আমানত-ফতে আলী, আর আমাদের নিলুফার ইয়াসমিন, আখতার সাদমানী, মোবারক হোসেন খান ও ওস্তাদ মুন্সী রইস উদ্দীনের অজস্র উপহারে ? হার্মোনিয়াম-তবলা-পাখোয়াজের সাথে গান হয় না আমাদের ইসলাম প্রচারকদের দরগাতেও ? (এর নাম ‘সামা’), বিদেশেও এক জামাতি কনফারেন্সে শুনেছি সাউণ্ড ভিশন সঙ্গীত-কোম্পানীর অ্যাডাম্স্-ওয়ার্ল্ড সিরিজের ইসলামি গান, বাদ্যযন্ত্রের কানফাটানো হুঙ্কারে গায়কের “আ-ল্- লা-হু আ-ক-বা-র” ছাড়া আর কিছুই বোঝা গেল না। টরণ্টোর ইসলামি-কনফারেন্সে দেখেছি গায়ক হালাল, গায়িকা হারাম, এবং বাদ্যযন্ত্র মাকরুহ । বছর দশেক আগে বাংলাদেশ জামাতিদের ১৬ই ডিসেম্বরের উৎসবও ছিল তাই।

গানকে হারাম, অপমানিত ও নিষিদ্ধ করেছে শারিয়াপন্থীদের (সবাই নন) কেতাব, সংগঠন, শারিয়া আইন এবং কোথাও কোথাও সরকারি আইনও। গানের কুৎসিৎ কথা, কুৎসিৎ অঙ্গভঙ্গি বা গানের অতিরিক্ত নেশায় জীবনের ক্ষতি ইত্যাদির সীমা টানেননি তাঁরা, পুরো সঙ্গীতকেই বাতিল করেছেন ঢালাওভাবে। উদাহরণ দিচ্ছি :

শারিয়া কোর্টে গায়িকার সাক্ষ্য নিষিদ্ধ − হানাফি আইন হেদায়া পৃষ্ঠা ৩৬১, শাফি’ আইন নং ও-২৪-৩-৩।
স্ত্রীকে কোনো বাদ্যযন্ত্র দেয়া যাইবে না − টি পি হিউগ্স্ − ডিকশনারী অব্ ইসলাম, পৃষ্ঠা ৬৭৫, শিকাগো।
চুরির মাল কতটা ‘সম্মানিত’ তার উপরেও চোরের হাত কাটা নির্ভর করে। যেমন, বাদ্যযন্ত্র চুরি করা বৈধ − মেমরি, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০০৪, অর্থাৎ বাদ্যযন্ত্র এতই নিকৃষ্ট যে ওটা চুরি করা যেতে পারে।
২০০৪ সালের জানুয়ারীতে আফগান সরকার সংসদে এসেই সর্বপ্রম যে অপকর্মটি করেছে তা হলো রেডিও-টিভি-বিচিত্রানুষ্ঠানে নারীর গান ও খবর পড়া নিষিদ্ধ, এ-আইন পাশ করা ও প্রয়োগ করা।
পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে শারিয়াপন্থীরা ভোটে জিতে ক্ষমতায় এসে প্রমেই ওই একই অপকর্ম করেছে। ওদের জন্য এটা হলো বেহেশতের সিঁড়ি। তাই বাংলাদেশেও ওরা সরকারি বা সামাজিকভাবে শক্তিশালী হওয়া মাত্রই ঐ অপকর্ম করবে তা নিশ্চিত নিশ্চিত।
কোরাণে হালাল-হারামের স্পষ্ট তালিকা আছে। গান হারাম হলে সে-তালিকায় গানের কথা অবশ্যই থাকত কারণ আলাহ কোনকিছু ভুলে যান না। তবু গানকে হারাম করতে কোরাণের বাহানা করা হয় প্রধানত দু’টো সুরা দিয়ে : (১) সুরা লোকমান ৬ − “একশ্রেণীর লোক আছে যারা মানুষকে আলাহ’র পথ হইতে গোমরাহ করার উদ্দেশ্যে অবান্তর কথাবার্তা সংগ্রহ করে অন্ধভাবে এবং উহা লইয়া ঠাট্টা-বিদ্রƒপ করে”, এবং (২)

বনি ইসরাইল আয়াত ৬৪ (আলাহ শয়তানকে বলছেন) −“তুই তাদের মধ্য থেকে যাকে পারিস স্বীয় আওয়াজ দ্বারা, অশ্বারোহী ও পদাতিক বাহিনী নিয়ে সত্যচ্যুত করে তাদেরকে আক্রমণ করো।”

তাঁরা বলেন সঙ্গীত হারাম কারণ সুরা লোকমান ৬-এর ‘অবান্তর কথাবার্তা’-ই নাকি সঙ্গীত (মওলানা মুহিউদ্দিনের কোরাণের অনুবাদ, পৃঃ ৭৮৩ ও ১০৫৩-৫৪), খবরটা তাঁদের কে দিল তার কোনো উলেখ নেই কিন্তু কথাটা মতলবি ও উদ্ভট তা বাচ্চাও বোঝে। অবান্তর কথাবার্তা অবান্তর কথাবার্তাই, অন্যকিছু নয়। একই খেলা করা হয়েছে বনি ইসরাইল ৬৪ নিয়েও। আজিজুল হক সাহেব তাঁর সহি বোখারী ৪র্থ খণ্ড ১৮ পৃষ্ঠায় এর অনুবাদ করেছেন (আলাহ শয়তানকে বলছেন) : “তুই তোর চেলাবেলা, লোক-লস্কর দ্বারা ও রাগ-রাগিনী গান-বাজনা ও বাদ্যবাজনা দ্বারা মানুষকে বিপথগামী করার চেষ্টা চালিয়ে যা।” অর্থাৎ রাগ-রাগিনী, গান-বাজনা ও বাদ্যবাজনা হলো শয়তানের অস্ত্র, তাই সেটা হারাম। অনুবাদটা ডাঁহা মিথ্যা। সঙ্গীতের আরবি শব্দ “মুসিকি”, আয়াতটায় মুসিকি নেই, আছে ‘সাওত’ অর্থাৎ ‘আওয়াজ’।

বিভিনড়ব বিষয়ে এক রসুলের দুই বিপরীত সুনড়বত দিয়ে ইসলামি কেতাবগুলো ভর্তি। গানেরও পক্ষে-বিপক্ষে কিছু হাদিস আছে। প্রমে বিপক্ষের তিনটি দেখাচ্ছি :

রসুল নিষিদ্ধ করিয়াছেন মদ্যপান, জুয়া ও সারিন্দা-জাতীয় বাদ্যযন্ত্র − আবু দাউদ।
রসুল বলিয়াছেন − আমার পরোয়ারদিগার আমাকে আদেশ করিয়াছেন সকল বাদ্যযন্ত্র ও বাঁশি উচ্ছেদ করিতে − মিশকাত ৩১৮।
রসুল বলিয়াছেন কেয়ামতের ইঙ্গিত হিসেবে গায়িকা ও বিভিনড়বরকমের বাদ্যযন্ত্রের আবির্ভাব হইবে − মিশকাত ৪৭০।
আমরা সটান বলতে পারি এগুলো মিথ্যা হাদিস কিন্তু গান-হারামকারীদের কাছে আমাদের কথার গুরুত্ব কিই বা। তাই চলুন যাঁদের কথার গুরুত্ব আছে সেই শারিয়া-নেতাদের উদ্ধৃতি থেকেই প্রমাণ করি গান হারাম তো নয়ই বরং গান হারাম বলাই হারাম। তাঁরা সহি হাদিসের উদ্ধৃতি দিয়েছেন কিন্তু হাদিসের নম্বরগুলো দেননি। নম্বরগুলো দিচ্ছি যাতে আপনারা মিলিয়ে নিতে পারেন ঃ বুখারী ৩৯৩১, ২য় খণ্ড ৭০, ৪র্থ খণ্ড ১৫৫, ৫ম খণ্ড ৩৩৬ ; মুসলিম ৯৮২, ও মিশকাত ৬ষ্ঠ খণ্ড।

“রসুল (সাঃ) বিবাহ-অনুষ্ঠানে গানের শুধু অনুমতিই দেন নাই বরং বালিকাদের গান শুনিয়াছেন।এমনি এক অনুষ্ঠানে যখন তাহারা গাহিতেছিল − ‘আমাদের মধ্যে এক রসুল আছেন যিনি জানেন আগামীকাল কি ঘটিবে’ − তখন তিনি তাহাদিগকে থামাইয়া বলিয়াছেন ‘এই বাক্যটি বাদ দাও এবং গাহিতে থাক।’ ইহাকে শুধু বিবাহ- অনুষ্ঠানের অনুমতি মনে করিবার কোনই কারণ নাই।” (অর্থাৎ বিয়ের অনুষ্ঠান ছাড়াও গানকে নবীজী অনুমতি দিয়েছেন)। ক্যানাডার সুবিখ্যাত ইমাম শেখ আহমেদ কুট্টি : Click This Link
“হজরত ওসর (রঃ)-এর আবাদকৃত শহরের মধ্যে দ্বিতীয় হইল বসরা। আরবি ব্যাকরণ, আরূয শাস্ত্র এবং সঙ্গীতশাস্ত্র এই শহরেরই অবদান” − বিখ্যাত কেতাব ‘আশারা মোবাশ্শারা’, মওলানা গরিবুলাহ ইসলামাবাদী ফাজেল-এ দেওবন্দ, পৃষ্ঠা ১০৬।
“ডেভিডকে আমরা দাউদ (আঃ) বলে জানি। তিনি মূলত ধর্মোপদেশকে, ও যোদ্ধা, জ্ঞানী ব্যক্তি সর্বোপরি একজন নবী ছিলেন। ইতিহাসের পাতায় তাঁকে আমরা দেখতে পাই একজন কবি ও সঙ্গীতজ্ঞ হিসেবেও” − সেনানায়ক মহানবী (সঃ) − যুদ্ধ ও শান্তি − ব্যারিস্টার তমিজুল হক, পৃষ্ঠা ১৭।
ব্যারিস্টারের লেখা ইসলামি কেতাবে যদি কারো মন না ওঠে তবে তাঁর জন্য আছেন অখণ্ড ভারতের সর্বোচ্চ ইসলামি নেতাদের অন্যতম, ভারতীয় কংগ্রেসের দু’দু’বার সভাপতি কোলকাতার ঈদের নামাজ পড়ানোর পেশ ইমাম মওলানা আবুল কালাম আজাদ। তিনি বলেছেন : “পয়গম্বর দাউদ (আঃ)-এর কণ্ঠস্বর অত্যন্ত মিষ্টি ছিল। তিনি সর্বপ্রম হিব্র“ সঙ্গীতের সঙ্কলন করেন ও মিশরের ও ব্যাবিলনের গাছ হইতে উচ্চমানের বাদ্যযন্ত্র উদ্ভাবনা করেন” − তাঁর তর্জুমান আল্ কুরাণ, ২য় খণ্ড পৃঃ ৪৮০ (Click This Link)
ব্যারিস্টারের লেখা ইসলামি কেতাব কারো অপছন্দ হলে তিনি এটাও দেখতে পারেন। এ নিয়ে যাঁরা বিস্তৃত গবেষণা করে মুস্তাফা কানাদি (http://www.shahbazcenter.org) কোরাণের ইউসুফ আলী’র ব্যাখ্যার (বিশ্বে সর্বাধিক প্রচলিত) উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছেন : “আলাহ প্রজ্ঞা হইল যে, স্থান-কালের পরিপ্রেক্ষিতে নবীগণের আধ্যাত্মিক গুণাবলী বিভিনড়ব রূপ ধারণ করে। ইহার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হইল দাউদকে গান ও সঙ্গীত দেওয়া হইয়াছিল।”
যাঁদের পড়ার ধৈর্য নেই কিন্তু নাটক-সিনেমার পোকা তাঁরা দেখুন পাকিস্তানি ছায়াছবি ‘খুদা কে লিয়ে’ − বোম্বের নাসিরুদ্দীন শাহ্ দরবেশ-এর দুর্ধর্ষ অভিনয় করেছেন। ওটাতেও সহি হাদিসের উদ্ধৃতি দিয়ে দেখানো হয়েছে ইসলামে গান হারাম তো নয়ই, বরং শক্তভাবে হালাল।
এতেও যদি কারো মন না ওঠে তবে সোজা চলে যান ইমাম গাজ্জালীর কাছে : ‘নবী করিম (সাঃ) হযরত আবু মুসা আশআরী (রাঃ) সম্পর্কে বলিয়াছেন − তাঁহাকে হযরত দাউদ (আঃÑ-এর সঙ্গীদের অংশ প্রদান করা হইয়াছে” − মুরশিদে আমিন, পৃষ্ঠা ১৭০ − এমদাদিয়া লাইব্রেরী।
এর পরেও আমাদের শুনতে হয় গান হারাম, গানের উৎসব রক্তাক্ত হয়ে যায় ঘাতকের অস্ত্রে। আর জাতি ভোগে অন্তর্দ্বন্দ্বে, গান গেয়ে গান শুনে গুনাহ্ করছি না তো !! না, করছেন না। ইসলাম তো স্বাভাবিক ধর্ম − সঙ্গীত কি অস্বাভাবিক হতে পারে ? পশু-পাখি-মাছেরা পশু-পাখি-মাছ হয়েই জন্মায় কিন্তু মানুষ হয়ে উঠতে মানুষের সুকুমার বৃত্তির দরকার হয়, সঙ্গীতই সেই সুকুমার বৃত্তি। সাহিত্য, কবিতা, চিত্রশিল্প ও ভাস্কর্যের ক্ষেত্রেও তা সত্য। হারাম তো শূকরের মাংস, গান কবে থেকে শূকরের মাংস হল ? আর, বাড়াবাড়ি করা ? ‘গান হারাম’ বলাই তো সেই বাড়াবাড়ি ! খোদ ইসলাম নিয়েই তো বাড়াবাড়ি নিষিদ্ধ (সুরা মায়েদা ৭৭, নিসা ১৭১ ও নবীজীর বিদায় হজ্বের ভাষণ)।

ইসলাম আপনার হৃদয়ে আছে, সেখানে প্রশড়ব করুন সৎভাবে। এবং তার জবাব নিয়ে শক্ত সোজা হয়ে দাঁড়ান। আপনার ইসলামের মালিকানা আর কারো হাতে ছেড়ে দেবেন না। মাথাটা নত করলেই ওরা আপনার পিঠে সুপারগু লাগিয়ে ঠেসে বসবে। আপনি সোজা হয়ে দাঁড়ালে তা পারবে না। অন্যের মতামতের ফটোকপি হবার জন্য আমাদের মাথাটা দেয়া হয়নি। ঘাড়ের ওপর সারাজীবন বোঝার মতো বইতেও দেয়া হয়নি, কাজে লাগানোর জন্যই দেয়া হয়েছে।

সঙ্গীত হল আমাদের সসীম জীবনে এক টুকরো অসীমের ছোঁয়া। চারদিকের আকাশবাতাস সাগর-পর্বত গ্রহ-নক্ষত্র, এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড এক বিপুল সুরস্রষ্টার মহাসঙ্গীত। তাই, গান শুনুন এবং বাচ্চাদের গান শোনান। গান করুন এবং বাচ্চাদের গান শেখান। গান যে ভালবাসে না সে মানুষ খুন করতে পারে। গানের মত বেহেশতি জিনিস যে অপদর্শনে শূকরের মাংস হয় সেটা আসলে ইসলামের ছদ্মবেশে অন্যকিছু, বিশ্ব-মুসলিমের মঙ্গলের জন্যই ওটাকে শক্তহাতে প্রতিহত করা প্রয়োজন।

শেষ করছি বর্তমান বিশ্বের অবিসম্বাদিত সর্বোচ্চ শারিয়া-নেতার উদ্ধৃতি দিয়ে। “সঙ্গীত এমন বিনোদন যাহা প্রাণে আনন্দ দেয়, হৃদয় তৃপ্ত করে এবং শ্রবণকে আরাম দেয়…উত্তেজনাপূর্ণ না হইলে ইহার সহিত বাদ্যযন্ত্র থাকিলে ক্ষতি নাই…আয়েশা বলিয়াছেন যখন এক আনসারের সাথে এক মহিলার বিবাহ হইতেছিল তখন রসুল (সাঃ) বলিলেন, ‘আয়েশা, তাহারা কি চিত্তবিনোদনের ব্যবস্থা করিয়াছে ? আনসারেরা চিত্তবিনোদন ভালবাসে’ (বুখারি)।” ইবনে আব্বাস বলিয়াছেন আয়েশা তাঁহার এক আত্মীয়াকে এক আনসারের সাথে বিবাহ দিলেন। রসুল (সাঃ) আসিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন ‘তাহার সাথে কি কোন গায়িকা দিয়াছ ?’ আয়েশা বলিলেন, ‘না।’ তখন রসুল (সাঃ) বলিলেন, ‘আনসারেরা কবিতা ভালবাসে। এমন কাউকে পাঠানো তোমার উচিত ছিল যে গাহিবে − আমরা আসিলাম তোমাদের কাছে, আমাদের সম্ভাষণ করো, আমরাও তোমাদের সম্ভাষণ করি’ (ইবনে মাজাহ), আয়েশা বলিয়াছেন ঈদুল আজহা’র দিনে মিনা’তে তাঁহার সহিত দুইজন বালিকা ছিল যাহারা ‘দফ’ (অনেকটা আমাদের ঢোলকের মতো – লেখক) বাজাইয়া গান গাহিতেছিল। রসুল (সাঃ) মুখ চাদরে ঢাকিয়া তাহা শুনিতেছিলেন (হাদিসে আছে তিনি মুখ ঢেকে শুয়েছিলেন), আবু বকর আসিয়া বালিকাদিগকে বকাবকি করিলেন। রসুল (সাঃ) মুখ বাহির করিয়া বলিলেন, ‘উহাদিগকে ছাড়িয়া দাও, আবু বকর। আজ ঈদের দিন’ (বুখারী ও মুসলিম), ইমাম গাজ্জালী তাঁহার এহিয়ে উলুম আল্ দ্বীন কেতাবে (‘গান শোনা’ অধ্যায়ে ‘অভ্যাস’ পরিচ্ছেদে) গায়িকাবালিকার উলেখ করিয়াছেন…‘ইহা নিশ্চিতরূপে প্রমাণ করে গান গাওয়া ও খেলাধুলা করা হারাম নহে…দলিলে আছে বহু সাহাবি ও পরের প্রজন্মের মুসলিম বিশেষজ্ঞরা গান শুনিতেন ও ইহাতে কোন দোষ দেখিতেন না। গবেষকদের মতে গান গাহিবার বিরুদ্ধে যেসব হাদিস আছে তাহা নির্ভরযোগ্য নহে।’ আইনবিদ আবু বকর আল্ আরাবি বলেন, ‘সঙ্গীত নিষিদ্ধের ব্যাপারে নির্ভরযোগ্য কোনই হাদিস নাই।’ ইবনে হাজম (১১শ’ শতাব্দীর স্পেন খেলাফতের বিখ্যাত শারিয়াবিদ − লেখক) বলিয়াছেন, ‘এই বিষয়ে (সঙ্গীত নিষিদ্ধের বিষয়ে − লেখক) যাহা কিছুই লিখা আছে সকলই মিথ্যা ও ভেজাল।’

(সুরা লোকমান ৬-এর ব্যাপারে) ইবনে হাজম বলেন, ‘এই আয়াতে আলাহ’র পথ নিয়া ঠাট্টা করার অভ্যাসকেই আলাহ নিন্দা করিয়াছেন, উহাকে নহে যেই অলস কথাবার্তা মানুষ করে মানসিক প্রশান্তির জন্যই, কাউকে আলাহ’র পথ হইতে পথভ্রষ্ট করার জন্য নহে।’ সুরা ইউনুস আয়াত ৩২-এর ভিত্তিতে যাঁহারা বলেন সঙ্গীত যেহেতু ‘সত্য’ নহে তাই সঙ্গীত নিশ্চয়ই ‘মিথ্যা’, তাহাদের যুক্তিকেও ইবনে হাজম ভুল প্রমাণ করিয়াছেন…তাই যে ব্যক্তি আলাহ’র প্রতি দায়িত্ব পালন ও ভাল কাজের শক্তিলাভের জন্য চিত্তবিনোদনের উদ্দেশ্যে গান শোনে সে আলাহ’র অনুগত বান্দা এবং তাহার এই কর্ম সত্য। পক্ষান্তরে, যে ব্যক্তি আলাহ’র প্রতি বাধ্য বা অবাধ্য হইবার চিন্তা না করিয়া গান শোনে, সে নিরপেক্ষ ও ক্ষতিকর নহে এমন কাজ করে যেমন পার্কে যাওয়া বা হাঁটিয়া বেড়ানো, কিংবা জানালায় দাঁড়াইয়া আকাশ দেখা, কিংবা নীল বা সবুজ কাপড় পরা, ইত্যাদি। যাহা হউক, সঙ্গীতের ব্যাপারে কিছু সীমাবদ্ধতা আছে, যেমন গানের কথায় যদি মদ্যপানের প্রশংসা থাকে ও লোককে মদ্যপানে উৎসাহিত করা হয়, তবে উহা গাওয়া বা শোনা হারাম। গানের পরিবেশনাও উহা হারাম করিতে পারে যেমন গানের সাথে শারীরিক উত্তেজক অঙ্গভঙ্গি।” কার উদ্ধৃতি দিলাম ? তিনি পুরো শারিয়া-বিশ্বের সর্বোচ্চ নেতা ডঃ ইউসুফ কারজাভী, বিশ্বময় বহু শারিয়া-ব্যাঙ্ক, দেশি ও আন্তর্জাতিক বহু শারিয়া-সংগঠনের প্রেসিডেণ্ট ও চেয়ারম্যান। উদ্ধৃতি দিলাম তাঁর বই “দ্য ল’ফূল অ্যাণ্ড প্রোহিবিটেড ইন্ ইসলাম” থেকে :

এর পরেও যদি কেউ বলেন গান হারাম তবে তাঁর উচিত ডঃ ইউসুফ কারজাভী’র সাথে বিতর্ক করে তাঁকে পরাজিত করা।

মুসলমান হতে হলে মানবদরদী হতেই হবে এবং মানবদরদী হতে হলে কাব্যসঙ্গীতময় হৃদয় থাকতেই হবে। তাই ভালো মুসলমান আর হিংস্র মুসলমানের একটি পার্থক্য হল সাঙ্গীতিক মন থাকা ও না-থাকা ॥

লেখক পরিচিতি

হাসান মাহমুদ

[email protected]
http://www.hasanmahmud.com/

In SHARIAKIBOLE.COM it is written as:-

সদস্য – ওয়ার্ল্ড মুসলিম কংগ্রেস উপদেষ্টা বোর্ড
সাধারণ সম্পাদক- মুসলিমস ফেসিং টুমরো- ক্যানাডা
রিসার্চ এসোসিয়েট- দ্বীন রিসার্চ সেন্টার, – হল্যান্ড
প্রতিষ্ঠাতা সদস্য, আমেরিকান ইসলামিক লিডারশীপ কোয়ালিশন
ক্যানাডা প্রতিনিধি, ফ্রি মুসলিমস কোয়ালিশন
প্রাক্তন ডিরেক্টর অফ শারিয়া ল’ ও প্রেসিডেন্ট, মুসলিম ক্যানাডিয়ান কংগ্রেস
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে অক্টোবর, ২০১৬ দুপুর ১:১৭
৪টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতীয় পণ্য বয়কটের কেন এই ডাক। একটি সমীক্ষা-অভিমত।।

লিখেছেন সাইয়িদ রফিকুল হক, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৩:১৫



ভারতীয় পণ্য বয়কটের কেন এই ডাক। একটি সমীক্ষা-অভিমত।।
সাইয়িদ রফিকুল হক

বিএনপি ২০২৪ খ্রিস্টাব্দে দেশে অনুষ্ঠিত “দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে”-এ অংশগ্রহণ করেনি। তারা এই নির্বাচনের বহু আগে থেকেই নির্বাচনে অংশগ্রহণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৩৮


এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।

ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×