সোলায়মান তুষার: রাজধানীর ইডেন কলেজে ভর্তির সুযোগ পেয়েছে ফয়সাল। এরকম কমপক্ষে ২০ হাজার ছাত্র ইডেন কলেজ, বদরুন্নেছা সরকারি মহিলা কলেজ, কুড়িগ্রাম সরকারি মহিলা কলেজসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সুযোগ পেয়েছে ভর্তির। এটি হয়েছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভুলের কারণে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বিষয়টি স্বীকারও করেছে। তবে দোষ চাপিয়ে দিয়েছে শিক্ষার্থীদের ওপর। অন্যদিকে মাঝেমধ্যে উল্টো ঘটনাও ঘটেছে । ছেলেদের কলেজে চান্স পেয়েছে মেয়েরাও। কলেজ বদলের জন্য ৫২ হাজার শিক্ষার্থী আবেদন করেছিলেন। এর মধ্যে ৪২ হাজার শিক্ষার্থীর ফল ঘোষণা করা হয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ৫০ ভাগ শিক্ষার্থীর ক্ষেত্রে ঘটেছে এই ঘটনা। পরীক্ষার দায়িত্বে থাকা স্নাতক পূর্ব অনুষদের ডীন অধ্যাপক মোবাশ্বেরা খানম বলেন, এই ভুল শিক্ষার্থীরাই করেছে। তিনি বলেন, প্রত্যেকের ৩টি করে কলেজ পছন্দের জন্য ছিল। তারা মেয়েদের কলেজ পছন্দ করেছে। ইন্টারনেটে ফরম পূরণের সময় শুধুমাত্র রোল নম্বর থাকায় কে ছেলে আর কে মেয়ে তা বোঝার উপায় ছিল না। আমরা মেধা অনুযায়ী সাবজেক্ট বণ্টন করেছি। এ সমস্যার সমাধান করতে আমরা অবশ্যই উদ্যোগ নেবো। কত শিক্ষার্থীর ক্ষেত্রে এ ঘটনা ঘটেছে জানতে চাইলে ডীন বলেন, সঠিক সংখ্যাটা এখনই বলা যাচ্ছে না। আমাদের কাছে আবেদন আসছে। আমরা বিষয়টি সমাধানের চেষ্টা করছি। বিশ্ববিদ্যালয় এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে মেয়েদের কলেজে ছেলেদের ভর্তির বিষয়টি শেষ পর্যন্ত স্বীকার করে নিয়েছে। জনসংযোগ ও প্রকাশনা দপ্তরের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক ফয়জুল করিম স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে ২রা এপ্রিল বলা হয় যেসব ছেলে শিক্ষার্থী নিজের দেয়া পছন্দক্রম অনুযায়ী ভুল কলেজ পছন্দ দিয়ে মেয়েদের কলেজ পেয়েছে তাদের বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ পরে সিদ্ধান্ত নিবে। ভুল আর দফায় দফায় সংশোধনীর ফলে নজিরবিহীন হয়রানি ও ভোগান্তির শিকার হচ্ছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজগুলোতে অনার্স ১ম বর্ষে ভর্তিচ্ছুক হাজার হাজার শিক্ষার্থী। ভর্তি কার্যক্রমের প্রথম দফায় মেধা তালিকায় ফল প্রকাশ করে তা আবার বাতিল, বিভাগ পরিবর্তনে জটিলতা, মেধা তালিকার পরিবর্তন, এমনকি শর্ত পূরণ না করলেও ইংরেজির মতো বিভাগ দেয়াসহ নানা তেলেসমাতি কাণ্ড হয়েছিল ২০১১-১২ শিক্ষাবর্ষের ভর্তি কার্যক্রমে। এখন চলছে রিলিজ স্লিপে ভর্তি প্রক্রিয়া। এখানেও লেজে-গোবরে অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এদিকে রিলিজ স্লিপ নিয়ে বিপাকে পড়েছে শিক্ষার্থী ও সংশ্লিষ্ট কলেজগুলো। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, দফায় দফায় ভুল এবং মেধা তালিকা বারবার সংশোধনের কারণে ঘোষিত তারিখে ভর্তি শেষ হবে না এবং ক্লাসও শুরু করা যাবে না। ভর্তি কমিটি অচিরেই নতুন তারিখ নির্ধারণ করতে হবে। বিভিন্ন কলেজ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় এ বছর ভর্তি কার্যক্রমই শুরু করেছে প্রায় ৫ মাস বিলম্বে। ফলে পুরো প্রক্রিয়াই বিলম্বে শুরু হয়েছে। গত ৬ই মার্চ অন-লাইনেই রিলিজ স্লিপের ফরম দেয়া শুরু হয়। ওয়েবসাইট থেকে রিলিজ স্লিপ নিয়ে শিক্ষার্থীরা আসন খালি থাকা কলেজে ভর্তির সুযোগ পাবে। কিন্তু ৩৬ ঘণ্টা পরই তা আবার প্রত্যাহার করে নেয়া হয়। প্রোগ্রামিং-এ ভুলের কারণে অনেক শিক্ষার্থী তাদের পছন্দের সাবজেক্ট পাননি। বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী ভর্তি পরীক্ষায় ফেল করেও পাস হিসেবে ভর্তির সুযোগ পেয়েছে। আর পাস করা শিক্ষার্থীকে ভুল করে ফেল দেখানোর কারণে ভর্তি হতে পারেনি। এবছরের জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অনার্স ভর্তি পরীক্ষার ফল মূল্যায়ন করেছে শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের আইসিটি বিভাগ। ফলে তারা যেসব ভুল করেছে সেগুলোকে স্বীকার করতে চাইছে না। আর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা কমিটিও এ ব্যাপারে দায় দিতে চাইছে না। ভুলগুলো চিহ্নিত করা হলে তারা অনেকটাই চেপে যাওয়ার নীতি অবলম্বন করছে। উল্লেখ্য, গত বছরের ২৩শে ডিসেম্বর ওই পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। তাতে সারাদেশে ৩ লাখ ৬১ হাজার ২০৬ জন শিক্ষার্থী অংশ নেয়। ১লা জানুয়ারি ভর্তি পরীক্ষার প্রথম ফল প্রকাশ করা হয়। ৭ দিন পর ৭ই জানুয়ারি তাতে বহু ভুল ধরা পড়ে। বিষয়টি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের দৃষ্টিতে আনা হলে ৯ই জানুয়ারি ওই ফল বাতিল করে সংশোধিত ফল প্রকাশ করা হয়। ভুলের কারণে কম নম্বর এমনকি ফেল করেও ইংরেজি বিভাগ পেয়ে যায় ১৪১৩ শিক্ষার্থী। দ্বিতীয় মেধা তালিকা প্রকাশের পর একই ধরনের ভুলের শিকার হচ্ছে শিক্ষার্থীরা। এবার ভর্তি কার্যক্রম শেষ হওয়ার পর আবার বিষয় পরিবর্তন নিয়ে শুরু হয়েছে নানা জটিলতা। শিক্ষার্থীরা জানান, ভর্তি নীতিমালা অনুযায়ী পছন্দের বিষয়ে পড়তে হলে সে বিষয়ে উচ্চমাধ্যমিকে জিপিএ-৩ পেতে হবে। কিন্তু অনেক শিক্ষার্থীর তা না থাকলেও তারা ওই বিষয় পাচ্ছে। আবার অনেক শিক্ষার্থী জিপিএ-৩ পেলেও পছন্দের বিভাগ পাচ্ছে না। গার্হস্থ্য অর্থনীতি মেয়েদের জন্য নির্ধারিত বিভাগ হলেও এটি জুটেছে অনেক ছাত্রেরও। এছাড়া ভর্তি কমিটি ফল প্রকাশের তারিখ নির্ধারণ করে দিলেও কাজের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় তা অনুসরণ করছে না। তারা বারবার সময় পরিবর্তন করছে। ২০১১-১২ শিক্ষাবর্ষে অনার্সে ভর্তির পরীক্ষার ফলাফল মূল্যায়নের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল আইন ও রীতিনীতি উপেক্ষা-অবজ্ঞা করে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা কমিটি অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের) আইসিটি বিভাগকে দায়িত্ব দেয়। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ প্রশ্নপত্র তৈরি করেছে। এর বাইরে ওএমআর শিট, রেজাল্ট শিট, ভর্তি ফরমসহ সব কাজই করে দিয়েছে শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের আইসিটি। এ জন্য শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের আইসিটি বিভাগকে মোটা অঙ্কের অর্থ দিতে হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, ভর্তি প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার আগেই ওয়েবসাইট থেকে নির্দেশিকা প্রত্যাহার করে ফেলা হয়েছে। এ ছাড়া ওয়েবসাইটে ভর্তির ব্যাপারে কোন হেলপ লাইন না থাকায় কলেজগুলো ও ভর্তি ইচ্ছুক শিক্ষার্থীরা বিপাকে পড়েছেন। মেধা তালিকায় ভর্তির ক্ষেত্রে, ভর্তি নির্দেশিকায় বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীদের ইংরেজি বিষয়ে ভর্তির জন্য পরীক্ষায় ১০ আর মানবিক ও বিজনেস স্টাডিজের শিক্ষার্থীদের ১২ নম্বর পাওয়ার শর্ত দেয়া হয়। ভর্তি করাতে গিয়ে দেখা যায়, এ শর্ত পূরণ করে না এমন শিক্ষার্থীরা ইংরেজির জন্য মনোনয়ন পেয়েছে। এভাবে ফলে আরও নানা বিষয়ে অসঙ্গতি ধরা পড়লে বিষয়টি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের টনক নড়ে। তারা ফলে সংশোধনী আনে। এতে আরও সমস্যার সৃষ্টি হয়। সে অনুযায়ী কলেজে কলেজে ৯ই জানুয়ারি সংশোধিত ফল যায়। নতুন ফলের কারণে প্রায় ৯০ ভাগ শিক্ষার্থীর মেধাক্রম পরিবর্তন হয়ে যায়। আর ৪ থেকে ৫ ভাগ শিক্ষার্থীর বিভাগ পরিবর্তন হয়। এছাড়া ভর্তি পরীক্ষার আবেদনকালীন কিছু কলেজে বিষয়ের সংযোজন অথবা বিয়োজন, আসন সংখ্যার পরিবর্তন, ছাত্রছাত্রীদের কোটা সংশোধন, পছন্দক্রমের সংশোধন, এইচএসসি অথবা সমমান পরীক্ষার তথ্য সংশোধনের কারণে কিছু ছাত্রছাত্রীর ভর্তি নির্দেশিকার নিয়ম অনুযায়ী বিষয় পরিবর্তন করতে হয়। এর ফলে কলেজে কলেজে মেধাতালিকায় পরিবর্তন হওয়ায় শিক্ষার্থীদের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। কলেজগুলোও শিক্ষার্থী ভর্তি করাতে গিয়ে হিমশিম খেতে হয়েছে।
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই এপ্রিল, ২০১২ ভোর ৪:৩০