গত ২১ আগস্ট, ‘বিরাট ব্যর্থতা ও নীরবতার এক কাহিনিঃ Bangladesh Protest—বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ’ শিরোনামে একটি লেখা লিখেছেন মোহিত রায়। লেখাটি পাওয়া যাবে এই লিঙ্কে। লেখাটি আমি মনোযোগ দিয়ে পড়েছি এবং লেখাটির অনেক বক্তব্যের সাথেই আমি একমত। যদিও লেখাটিতে আছে বেশ কিছু ঐতিহাসিক তথ্যের গরমিল, অর্ধ সত্য এবং অসম্পূর্ণ বয়ান— যে কারণে প্রয়োজনবোধ করেছি একটি প্রতিব্যাখ্যার।
লেখাটির শুরুতে যে ব্লার্ব ব্যবহৃত হয়েছে সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে ২০-এর কোটা আন্দোলনের কথা।আদতে ২০২০-এ কোন কোটা আন্দোলনই হয়নি, ২০১৮ সালে যে আন্দোলনটি হয়েছিলো সেই আন্দোলনের ফলশ্রুতিতে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্পূর্ণ কোটা ব্যাবস্থা প্রত্যাহার করে একটি প্রজ্ঞাপন ইস্যু করেছিলেন। আন্দোলনটি সেখানেই শেষ হয়ে গেছিলো। উল্লেখ্য, সেই ১৮ সালের আন্দোলনের মুল উদ্দেশ্য ছিলো ৫৬% কোটা কাঠামো ১০%-এ নামিয়ে আনা।কিন্তু প্রধানমন্ত্রী ‘রাগের বশবতি’ হয়ে সম্পূর্ণ কোটা কাঠামোটি বাতিল করেছিলেন।
লেখার শুরুরভাগে লেখক লিখেছেন “ভারতবিরোধিতা ছিল পাকিস্তান সৃষ্টির মূল কথা। ভারতবিরোধিতা মানে পাঁচহাজার বছরের ভারতীয় সংস্কৃতির বিরোধিতা, ভারতীয় সংস্কৃতির বহুত্ববাদী চিন্তার বিরোধিতা”। ইতিহাসের ছাত্র হিসাবে যতদূর জানি সেই তথ্যের আলোকেই বলতে চাই, ভারতবিরোধিতা নয় বরং উপমহাদেশের মাইনরিটি মুসলিম জনসংখ্যার নিরাপত্তা আর স্বাধিকারের দাবিতেই পাকিস্তান আন্দোলনটি এসেছিলো এবং এই আন্দোলনের এক পর্যায়ে জিন্নাহর পক্ষ থেকে কনফেডারেল ভারতের প্রস্তাবও দেওয়া হয়েছিলো যেখানে মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলগুলো স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল বলে বিবেচিত হবে। কিন্তু, ভারতীয় জাতীয় নেতৃবৃন্দের বিরোধিতায় সেই কনফেডারেল ব্যাবস্থা কার্যকর হতে পারেনি।
লেখক ভারত বিরোধিতা মানে যে ৫ হাজার বছরের ‘ভারতীয় সংস্কৃতির’ বিরোধিতার কথা বলেছেন, সেই বক্তব্যটিও একটি দুর্বল ব্যাখ্যার উপর প্রতিষ্ঠিত। আদৌতে ভারতীয় সংস্কৃতি বলে কি কোন সংস্কৃতি আছে? ভারত একটি বহু জাতীর, বহু সংস্কৃতির দেশ। সেই দেশের উত্তর-দক্ষিণ যেমন ভিন্ন, পূর্ব-পশ্চিমও ঠিক তেমনই ভিন্ন। বাংলাদেশ সেই পূর্ব ভারতীয় সংস্কৃতির একটি অংশ, এবং বাংলাদেশের সিংহভাগ জনগোষ্ঠী সেই সংস্কৃতির জন্য গর্বিত। আর গর্বিত বলেই একসময় পশ্চিম পাকিস্তানিরাও বাঙ্গালিদের অর্ধ মুসলিম বলতো।
লেখককে জানিয়ে রাখি, এখনো বাংলাদেশে বারো মাসের তেরো পার্বণ হয়, হয় নবান্ন উৎসব, বৈশাখী মেলা, যাত্রাপালা এবং আরও বহুকিছু। সাম্প্রতিক কোটা আন্দোলনেও সেই হাজার বছরের বাঙ্গালি সংস্কৃতি প্রতিফলিত হয়েছে, যেটি দুখঃজনকভাবে ভারতীয় মেইন্সট্রিম মিডিয়াতে প্রচার পায়নি। এই আন্দোলনের শিক্ষার্থীরা রাত জেগে পুলিশের চোখ রাঙ্গানি উপেক্ষা করে রাস্তায় রাস্তায় আলপনা এঁকেছে; প্রদীপ দিয়ে শহীদ মিনার, জাতীয় সংসদ সাজিয়েছে; তারুণ্যের ভাষায় রঙ্গিন গ্রাফিটি এঁকেছে; পথনাটক, কবিতা আর প্রতিবাদের গান দিয়ে রাস্তা উত্তাল করে রেখেছে। এই গান নির্বাচনে কে হিন্দু লেখক বা কে মুসলিম লেখক তা বিবেচনা করা হয়নি। মুক্তির মন্দির সোপানতলে তোলে, বা ধন ধান্যে পুষ্পে ভরা, কিংবা কারার ঐ লৌহ কপাট— সবগুলোই সমানতালে ব্যবহৃত হয়েছে। হয়তো প্রশ্ন করতে পারেন, বঙ্গবন্ধুর মূর্তি ভাঙ্গা, বা ইসলামিক ক্যালিগ্রাফির দেয়াল লিখন তাহলে কোন সংস্কৃতির প্রতিফলন। এই প্রশ্নের উত্তর আছে একটি দীর্ঘ রাজনৈতিক ব্যাখ্যায় যেটি এই স্বল্প লেখনীতে দেওয়া সম্ভব নয়। তবে বলে রাখি, যেকোন বিপ্লব-অভ্যুত্থানে অনেক দল-মতবাদের লোক থাকে যারা প্রত্যকে, প্রত্যেকের স্বার্থসিদ্ধির জন্য আন্দোলনে যুক্ত হয়। এই আন্দোলনেও স্বাভাবিকভাবেই প্রতিক্রিয়াশীল কিছু শক্তি যুক্ত হয়েছিলো। কিন্তু আন্দোলনের প্রাণ তাঁদের হাতে কখনই ছিলো না, ছিলো মধ্যবিত্ত প্রগতিশীল একটি গোষ্ঠীর হাতে। এই আন্দোলনে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চবিত্ত পরিবারের ছেলেমেয়েদের যে অংশগ্রহণ আমরা দেখেছি, তা সাবেক সরকারেরও কল্পনাতীত ছিলো।
লেখক ‘ভারতবিরোধিতার স্রোত বাংলাদেশের ধমনীতে চিরপ্রবহমান’ বলে যে মত দিয়েছেন সেই বিরোধিতার মূল কিন্তু তিনি খোজার চেষ্টা করেননি। এর মূল যতটা না সাম্প্রদায়িক, তার থেকে অনেক বেশি রাজনৈতিক এবং আর্থসামাজিক। লেখক কি ভেবে দেখেছেন, অসংখ্য নদী বিধৌত পলিমাটির বাংলাদেশের প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে ভারত বিরোধিতার যে প্রসার হয়েছে সেটি কি শুধুই সাম্প্রদায়িক, নাকি কৃষিনির্ভর অর্থনীতির পানি সংকটের সাথে সম্পর্কিত? কিংবা শহুরে শিক্ষিত সমাজের ভারত বিরোধিতার মূলই বা কোনটি? এখানে গনতন্ত্রহীনতা আর একনায়কতন্ত্রের প্রতি ভারতের অগাধ সমর্থনের কি কোনই ভূমিকা নেই? আর ‘২২ শতাংশ থেকে ৭ শতাংশের সংখ্যালঘু’ তথ্যও —একটি অতি প্রচলিত বয়ান। ১৯৪৭ পূর্ববর্তী ৩০% হিন্দু জনসংখ্যা এবং ১৯৭১ সালের যুদ্ধ পূর্ববর্তী ২০%, কেন আজকে ৯% (সংখ্যাটি ৭ নয়)হল, তা বুঝতে এর ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট এবং ডেমোগ্রাফির বিভিন্ন ফ্যাক্টরকে আমলে নিতে হবে। মনে রাখবেন, ১৯৪৭ সালে পূর্ব বাংলার জনসংখ্যা ছিলো ৪ কোটির কিছু বেশি, আর ৭১ সালে সেটি ছিলো সাড়ে সাত কোটি। বর্তমানে যেটি ১৮ কোটির কাছাকাছি।
লেখক দ্বিতীয় অনুচ্ছেদে বাংলাদেশ সম্পর্কে একটি মিথ্যা দূর করার চেষ্টা হিসাবে বলেছেন, বাংলা ভাষার লড়াই থেকে বাংলাদেশের জন্ম হয়নি। ঠিক কোন সূত্র থেকে তিনি এই ঐতিহাসিক তথ্যটি পেয়েছেন যে বাংলা ভাষার লড়াই থেকে বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে তা আমার কাছে ঠিক বোধগম্য হয়নি। আমার পড়া কোন ঐতিহাসিকই কখন এ দাবি তাঁদের লেখনীতে করেননি, এমনকি পাকিস্তানি লেখরাও এ দাবিটি কখনো তোলেননি।
লেখক তার লেখনীর একপর্যায়ে ৬ দফার প্রসঙ্গ এনেছেন এবং বলেছেন এই ৬ দফার শেষেরটি বাদে সবই ছিল পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনৈতিক বিষয় সংক্রান্ত। লেখকের অবগতির জন্য জানাতে চাই, ৬ দফার মূল উদ্দেশ্য ছিলো পাঞ্জাবি-পশতু কেন্দ্রিক শাসন ব্যাবস্থা ভেঙ্গে একটি কনফেডারেল পাকিস্তান তৈরি করা, যেখানে অঞ্চলগুলো প্রতিরক্ষা এবং বৈদেশিক কূটনীতি ব্যাতিত সর্ব বিষয়ে স্বাধীনভাবে পরিচালিত হবে। ৬ দফার প্রথম ২টি দফাই ছিলো শাসন ব্যাবস্থার বিকেন্দ্রীকরণ সম্পর্কিত। মাঝের ৩টি দফা ছিলো অর্থনৈতিক বৈষম্যদূরীকরণ সম্পর্কিত এবং শেষ দফাটি যথার্থভাবে পুব পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা সম্পর্কিত। কারণ ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের সময় পূর্ব পাকিস্তানের নিরাপত্তার কথা চিন্তা না করে আইয়ুব সরকার সেনাবাহিনী ও রসদ নিয়োজিত করেছিলো পশ্চিম পাকিস্তানের প্রতিরক্ষায়।
কোটা আন্দোলন প্রসঙ্গে লেখক প্রশ্ন করেছেন, ১ অগস্ট বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট ছাত্রদের দাবি মেনে নিলেও, ছাত্ররা নতুন করে সরকার পতনের যে ডাক দেয় সেই আন্দোলন তবে কাদের? উত্তর খুঁজতে হলে ২৫ থেকে ২৯ তারিখের ঘটনা প্রবাহের প্রতি একটু নজর দিতে হবে। ছাত্র আন্দোলনের দুই সমন্বয়কদের গোয়েন্দা বাহিনীর লোকদের ধরে নিয়ে পিটিয়ে রাস্তায় ফেলে যাওয়া আর পরবর্তীতে ৬ সমন্বয়কদের ডিবি কার্যালয়ে ২ দিন আটকিয়ে রেখে আন্দোলন প্রত্যাহারের ঘোষণা পাঠ করানোর মধ্যেই লুকিয়ে আছে ১ দফার উত্তর। মনে রাখবেন, এ সবকিছু যখন হচ্ছে তখনো কিন্তু থেমে থাকেনি পুলিশি হত্যা। ঠিক এই মুহূর্তেই ছাত্রদের উদ্ধারে নেমে পড়েছিলো শিক্ষক-আইনজীবীসহ সমাজের বিভিন্ন পেশাজীবী শক্তি। যেটি হাসিনার ১৬ বছরের শাসনামলে কখনই একসাথে ঘটেনি।
আর লেখক যে প্রশ্ন করেছেন সরকার পতনের পরেও শ’ খানিক ব্যাক্তির প্রাণ কিভাবে গেল— তার উত্তর খুঁজতে পৃথিবীর ইতিহাসে ঘটে যাওয়া অন্যান্য বিপ্লব-অভ্যুত্থান পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহের দিকে একটু নজর দিতে হবে। আন্দোলনের প্রথম থেকেই হিন্দু সম্প্রদায় আক্রান্ত বলে যে অভিযোগ লেখক করেছেন সেটিও সঠিক নয়। বরং আন্দোলনে নিহত ছাত্রদের মধ্যে ২ জন ছিলেন হিন্দু ধর্মাবলম্বী। অসংখ্য হিন্দু ছাত্র-ছাত্রী এই আন্দোলনে প্রত্যক্ষ ভূমিকা রেখেছেন, অনেকেই সামাজিক মাধ্যমের প্রোফাইল পিকচার লাল রঙে রাঙ্গিয়েছেন।
বাংলাদেশের গণতন্ত্র নিয়ে ভারতের মাথা ঘামানোর দরকার আছে কিনা বলে যে প্রশ্নের অবতারণা লেখক করেছেন, তার উত্তরে বলব— অবশ্যই আছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমাবিশ্ব যদি গণতন্ত্র এবং মানবাধিকারকে উন্নয়ন এবং কূটনৈতিক যোগাযোগের প্রধান শর্ত হিসাবে দেখতে পারে, তাহলে পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্র বলে দাবিদার ভারতেরও উচিত, নিদেনপক্ষে তার প্রতিবেশীদের গণতান্ত্রিক আর মানবাধিকার চর্চার উপর নজর দেওয়া। মনে রাখবেন— গণতন্ত্র, আইনের শাসন আর মানবাধিকার চর্চাই পারে সংখ্যালঘুসহ সকল শ্রেণীর মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে। স্বৈরতন্ত্র কেবলই দ্বিধাবিভক্ত সমাজকে উস্কে দিয়ে সামাজিক সংহতি বিনষ্ট করে।