somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

শেকড়

১২ ই জানুয়ারি, ২০১৬ রাত ৮:৪১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



এক

অন্ধকার উঠানে কিসের যেন নড়াচড়া হচ্ছে। ইসহাক সাহেব চেঁচিয়ে উঠলেন, কে? কে ওখানে?
মাস্টার সাব, আমি।
তুই কে?
ইসহাক সাহেব উঠানে টর্চের আলো ফেললেন। ময়না মিয়া খালি গায়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার পায়ের সামনে কারা যেন গুটিশুটি হয়ে শুয়ে আছে। তার বউ-ছেলে-মেয়ে হবে হয়তো। একজনের মাথায় লম্বা চুল। ইসহাক সাহেব স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন।
ও, তুই! আজও এসেছিস?
ময়না মিয়া কাচুমাচু মুখে বলল, মাস্টার সাব, শুধু আইজ রাইতটা থাকমু। কাইল সূর্য উঠার আগেই যামু গা।
তুই তো দেখছি, আমার উঠানেই ঘরবাড়ি বানিয়ে ফেলবি। পুকুর পাড়ের কি অবস্থা?
ঐখানে হাঁটু পানি। যেমতে পানি বাড়তাছে, পুরা গেরাম ডুইব্বা যাইবো!
ইসহাক সাহেব টর্চ নিভিয়ে ফেললেন। তার কপালে ভাঁজ পড়েছে।
গ্রামে হু হু করে পানি ঢুকছে। বন্যার পানি। গতকাল শানপাড়া প্রাইমারী স্কুলের মাঠে তিনি পানি দেখেছেন। তাদের স্কুলটা যদিও উঁচু জায়গায় কিন্তু এভাবে পানি বাড়তে থাকলে....
তিনি হালকা গলায় বললেন, উঠান নোংরা করিস না।
জে, আচ্ছা।
ইসহাক সাহেব বাহিরের ঘরে এসে খাটে পা তুলে বসলেন।
সজিব হারিকেনের আলোয় গল্পের বই পড়ছিল। চেয়ার টেবিলে বসে গল্পের বই পড়তে তার ভাল লাগে না। মনে হয় পরীক্ষার পড়া পড়ছে। গল্প-উপন্যাস পড়তে হয় শুয়ে কিংবা সোফায় আরাম করে বসে।
গ্রামে এসে অবশ্য এভাবে পড়তে তার খারাপ লাগছে না। শুধু হারিকেনের আলোটা চোখে লাগছিল। কায়দা করে সে চিমনিতে কাগজ লাগিয়ে তা বন্ধ করেছে। মামাকে বিছানায় বসতে দেখে সজিব বই বন্ধ করল।
মামা, কার সাথে কথা বললেন?
ও ময়না মিয়া। ভাদাইম্যা একটা।
কেন, কি করেছে?
ও হতো এই গ্রামের বাদশা। এখন পথের ফকির।
এই অবস্থা কেন?
সম্পত্তি উড়িয়ে ফেলেছে। ওর বাপ আলী ব্যাপারী সারাজীবন দুই হাতে সম্পত্তি করেছে। ও দুই হাতে সেই সম্পত্তি উড়িয়েছে। রাজভাণ্ডার গেছে ফুরিয়ে।
রাজভাণ্ডার ছিল নাকি?
রাজভাণ্ডারের মতোই। আলী ব্যাপারী জীবনে কি করে নাই? ধানী জমিই ছিল তার শত বিঘা। বসতবাড়ির পাশেই ছিল বিশাল বাগান। মাছ ভরতি পুকুর ছিল চার-পাঁচটা। আলী ব্যাপারীকে কেউ কোনদিন মাছ কিনে খেতে দেখেনি। পুকুরে জাল ফেলা হয়েছে। ঝাঁকে ঝাঁকে উঠে এসেছে রুই-কাতলা। চেয়ারম্যান-মাতব্বরদের বাড়িতেও চলে গেছে সেই রুই-কাতলার ভাগ। গ্রামে তার সুনামও ছিল। চেয়ারম্যান বাড়িতে মেহমান এসেছে। বাজারে ভাল মাছ পাওয়া যাচ্ছে না। ব্যাপারী বাড়িতে লোক পাঠানো হল। সাথে সাথে বড় সাইজের দুটো রুইয়ের ব্যবস্থা হয়ে গেছে। স্কুল পরিদর্শনে ইন্সপেক্টর সাহেব এসেছেন। ব্যাপারী বাড়ির বাগান থেকে বড় বড় দুটো ডাব পাঠিয়ে দেয়া হল। ইন্সপেক্টর সাহেব সেই ডাবের পানি খেয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তুলতেন আর বলতেনÑ
বড়ই সুস্বাদু, বড়ই সুস্বাদু!
সেই বাড়ির ছেলের আজ এই দশা! বাপ মারলো। ময়নারে আর পায় কে? কাঁচা বয়স। হাতে কাঁচা পয়সা। চারপাশে নতুন নতুন রসিক বন্ধু এসে জুটল।
ময়নারে তাসের নেশায় ধরলো। পয়সাওয়ালা মানুষের কোন নেশাই পয়সা ছাড়া জমে না। চলল পয়সার খেলা। যখন নেশা কাটল, ময়না মিয়া স্তম্ভিত হয়ে দেখল তার সম্পদ বলতে রয়েছে তার স্ত্রী, দুই ছেলেমেয়ে আর এক প্যাকেট তাস।
এখন কি করে?
কি আর করবে? বউ পোলাপান নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ভিক্ষা করে।
সত্যি সত্যি ভিক্ষা করে?
ভিক্ষা করার মতই। বউটা বাড়ি বাড়ি কাজ করে। ময়না তো আর কাজকর্ম কিছু শিখে নাই। কি করে ওই জানে?
থাকে কোথায়?
বসতবাড়ি বিক্রির পর চত্রাগাড়ি পুকুর পাড়ে আশ্রয় নেয়। সেখানে ভায়োড় বানিয়ে থাকে।
ভায়োড় কি?
তুমি সিরাজগঞ্জের ছেলে ভায়োড় চিনো না?
দেখলে হয়তো চিনবো। নাম জানি না।
ইসহাক সাহেব ক্লাশে পড়ানোর ভঙ্গিতে বললেন, ভায়োড় হলো খড় দিয়ে তৈরি তাঁবু জাতীয় ঘর। দেখতে অনেকটা সাইবেরিয়ার ইগলুর মতো।
ও আচ্ছা।
ওর ভায়োড়টি বন্যার পানিতে ডুবে গেছে। এখন বউ বাচ্চা নিয়ে পরের বাড়ির উঠানে উঠানে থাকে। একটু আগে দেখলাম ওরা ছালা বিছিয়ে শুয়ে আছে।
সজিব হাই তুলে আবার গল্পের বইয়ে মনোযোগ দিল। গ্রামের মানুষের উত্থান-পতনের কাহিনী সে আগেও শুনেছে। কাঁচা পয়সা হাতে পেলে এরা জমিদার। সেই জমিদারী কেউ ধরে রাখতে পারে, কেউ পারে না। ভাইয়ে ভাইয়ে সম্পত্তি নিয়ে ঝগড়া করে। কেউ কেউ সবকিছু বিক্রি করে দিয়ে শহরে পাড়ি জমায়। প্রথম প্রথম অভিজাত এলাকায় থাকে। তারপর টাকা ফুরিয়ে গেলে তাদের ঠাঁই হয় শহরের ঘিঞ্জি এলাকায়। শহরে থাকতে থাকতে এক সময় হাঁপিয়ে উঠে। তখন বউ ছেলেমেয়ের সামনে ঘন ঘন দীর্ঘশ্বাস ফেলে আর গল্প করে- এক সময় গ্রামে তাদের বিশাল জমিদারী ছিল। গ্রামের মানুষজন তাদের কথায় উঠ-বস করতো। ইত্যাদি---ইত্যাদি।
ময়না মিয়া সম্পত্তি হারানো দলের। এদের প্রতি আগ্রহের কিছু নেই! এরা পড়ে থাকে অতীত নিয়ে! তবে তার ভায়োড়টি দেখার আগ্রহ হল।
পরদিন সকালে পুকুর পাড়ে এসে সজিব দেখল- গম্বুজ আকৃতির একটি ঘর পানিতে ডুবে আছে।
চারদিকে পানি থৈ থৈ করছে। সবকিছুকে ডুবিয়ে দিয়ে যে পানি দাঁড়িয়ে আছে, সেই পানিকে আপন মনে হচ্ছে না। এই পানির মধ্যে এক ধরনের হাহাকার আছে! গ্রামে এসে হাহাকার দেখতে তার ভাল লাগে না। সে গ্রামে আসে রিলাক্সের জন্য। গ্রামে এক ধরনের শান্তি আছে। গাছপালার পাতায় পাতায় যেন আনন্দ। সেই আনন্দ শুষে নিয়েছে এই পানি।
সে বাড়ির পথে পা বাড়াল। তখনই লোকটিকে দেখতে পেল। বিশাল দেহী একজন লোক তন্ময় হয়ে ভায়োড়ের দিকে তাকিয়ে আছে। সজিব বুঝল- এ ময়না মিয়া। চোখে অদ্ভুত দৃষ্টি। আনন্দ বা বেদনার ছায়া চোখে পড়লে সেই দৃষ্টি সহজে পড়ে ফেলা যায়। লোকটার চোখে না আছে আনন্দ, না আছে বেদনা, না আছে হতাশা। চোখে আশ্চর্য এক নির্লিপ্ত ভাব। ধন-সম্পদ শরীরে যে উজ্জ্বল আভা নিয়ে আসে, তা এখনও অবশিষ্ট আছে। সজিব এগিয়ে গেল।
আসসালামালাইকুম।
ময়না মিয়া হকচকিয়ে গেল। তাকে বোধহয় গ্রামের কেউ সালাম দেয় না। অপ্রত্যাশিত শ্রদ্ধা পেয়ে তাকে বেশ বিব্রত মনে হচ্ছে। সজিব অন্তরঙ্গ ভঙ্গিতে বলল, দেখছেন, দিন দিন কিভাবে পানি বাড়ছে? আর বোধহয় বাড়বে না।
ময়না মিয়া জবাব দিল না। ভাবলেশহীন চোখে দূরে তাকিয়ে রইল। সজিব সহজ গলায় বলল, ঐ ভায়োড়টি কি আপনার?
ময়নামিয়া না তাকিয়েই বলল, হুঁ।
সজিব আশ্বাসের স্বরে বলল, এই দুই চারদিন। তারপর পানি নামতে শুরু করবে। আপনি আবার ওখানে ফিরে যেতে পারবেন।
ময়না মিয়া বিড়বিড় করে বলল, তরল আগুন আগাইয়া আসতাছে। পুরা গেরাম খাইয়া ছাফ কইরা ফেলবো।
সজিব কৌতূহল নিয়ে তাকাল। লোকটি কি সুস্থ আছে, না পাগল হয়ে গেছে? চোখে অবশ্য পাগলের ছাপ নেই।
সজিব বলল, তরল আগুন বলছেন কেন? পানি তো কিছু পুড়াচ্ছে না?
তাড়াইয়া তো দিতাছে।
সজিব অবাক হল। লজিক এখনও পরিষ্কার। সেও রহস্য করে বলল,
তাড়িয়ে আর দিবে কই? এক সময় তাকে নামতেই হবে। মানুষকে দুনিয়ার কেউ পরাস্ত করতে পারে না।
ভাইজান কথাডা পুরাডা ঠিক না। মাইনষেরে কেউ পরাস্ত করতে না পারুক, কিন্তু হে নিজেই নিজের কাছে পরাস্ত হয়।
সজিব মনে মনে হাসল। নিঃস্ব হয়ে অনেকে দার্শনিক হয়ে উঠে। ধনী হয়ে দার্শনিক হয় খুব কম। বড়জোর ‘ভোগ-বিলাসী’ হয়।
সজিব লোকটির প্রতি কৌতূহলী হয়ে উঠল। তার ফিলোসফি মার্কা কথাবার্তা শোনার জন্য আরও ভাব জমানো দরকার। কিন্তু ময়না মিয়া মুহূর্তের মধ্যে বড় বড় পা ফেলে পাশের জঙ্গলে ঢুকে গেল।

দুই

সে বছর বন্যা ভয়াবহ রূপ নিল। শহর-গ্রাম বিচ্ছিন্ন হয় হয় অবস্থা। সজিব তড়িঘড়ি করে ঢাকায় চলে এল। তারপর দুই বছর কেটে গেছে। গ্রামে যাওয়া হয়নি।
এবার ছুটিতে সে গ্রামের পথ ধরল। ক্লান্ত দেহে সে যখন মামাবাড়ির উঠানে পৌঁছল, ইসহাক সাহেব তখন সেজেগুজে কোথায় যেন যাচ্ছিলেন। সজিবকে দেখে আনন্দে চেঁচিয়ে উঠলেন।
আরে সজিব যে! এতদিন পর মামার কথা মনে পড়ল? এত শুকিয়েছো কেন? ডাক্তারী পড়তে যেয়ে দেখি তুমি নিজেই রোগী হয়ে যাচ্ছো!
তিনি ঘরের ভেতর তাকিয়ে উঁচু গলায় বললেন, এই দেখো কে এসেছে?
পুরো বাড়িতে সারা পড়ে গেল।
সজিব হাসি মুখে বলল, আপনাকে দেখতে এলাম, মামা। আপনার শরীর ভাল?
হুঁ! তোমার মা কেমন আছে?
ভাল। মামা কোথাও বের হচ্ছিলেন নাকি?
হ্যাঁ। একটু মাতব্বর বাড়ি যাওয়ার দরকার ছিল। তুমি এই ঘরে এসে বসে। ঘরটা ঠাণ্ডা আছে। ইস্ ঘেমে টেমে কি অবস্থা!
মামা ঘরের সবগুলো জানালা খুলে দিলেন। ফ্যান ছাড়লেন। তারপর চিৎকার করে ডাকলেন, কাদের! কাদের!
কাদের প্রায় দৌঁড়ে এল।
‘কোথায় থাকিস? এত ডাকতে হয়? চট করে গাছে উঠ দেখি, কচি দেখে দুটো ডাব পার।
সজিব দ্রুত বলল, মামা, ডাব লাগবে না। আমি এখন গোসল করবো।
ডাব খেয়ে আগে ঠাণ্ডা হও! শহরে তো আর ডাব খাও না, খাও কোক। কাদের, ডাব কেটে তুই কলতলায় যা। পানি তোল।
সজিব লজ্জিত গলায় বলল, মামা, আপনি শুধু শুধু ব্যস্ত হচ্ছেন। আমি সাতদিন থাকার প্ল্যান নিয়ে এসেছি। আপনি ঘুরে আসুন।
সাতদিন না তোমার যতদিন খুশি থাক। কিন্তু কোন কষ্ট করা যাবে না। তাহলে তো আর আসতে চাইবে না।
মামা ঘড়ি দেখলেন।
যাই দেখি একটু। মাতব্বর সাহেব খবর পাঠিয়েছেন। না গেলে ভাববে ব্যাটারে আমি প্রশ্রয় দেই।
কিসের প্রশ্রয়?
এসব শুনে তোমার কাজ নাই। তুমি ফ্রেশ হয়ে বিশ্রাম নাও।
গোসল করতে যেয়ে সজিব গ্রামের ঘটনাটা কাদেরের মুখে শুনল।
ভাইজান, আইজ ময়নার বিচারের দিন।
ময়না কে?
ময়নারে চিনেন না। গ্রামের কাকপক্ষীও হেরে চিনে। ও আফনে তো গেরামে থাকেন না। ময়না হইল আমাগো গেরামের ‘আল্লাহর গজব’ খাওয়া মানুষ।
সজিবের মনে পড়ল দুই বছর আগে ময়না মিয়ার সাথে তার দেখা হয়েছিল। সে বিস্মিত হয়ে বলল, তার আবার কি হয়েছে?
কাদের দাঁত বের করে হাসল।
হেই ব্যাডার বউ পাশের গ্রামে যাইয়া আকাম করছে। জুয়ান বেডি। উপরে উপরে বাড়ি বাড়ি কাম করে। তলে তলে করে আকাম। পুরা গ্রামের ইজ্জত ডুবাইছে।
সজীব গম্ভীর হয়ে গেল। কাদের কল চেপে পানি তুলছে। তোলা পানিতে অন্যের সামনে গোসল করতে অস্বস্তি লাগে।
সে গম্ভীর স্বরে বলল,
কাদের, তুমি এখন যাও।
আমি গেলে আফনেরে পানি তুইল্লা দিবো কে?
আমি নিজেই তুলতে পারবো। তুমি যাও।
কাদের কলের হাতল ছেড়ে উঠে দাঁড়াল।
দ্যাইক্কেন, পিছলাইয়া পইড়েন না। তাইলে খালু আমার পিডে লাডি ভাঙবো।
সজিব গোসল সেরে ঘরে এসে বসল। কাদের নতুন শার্ট-লুঙ্গী পরে হাজির। তার মুখ হাসি হাসি।
ভাইজান, একটু ঘুইরা আহি? খালু আহার আগেই আইয়া পরমু।
কোথায় যাও?
ময়না মিয়ার বিচারডা একটু দেইক্কা আহি।
সজিব শান্তস্বরে বলল, চল, আমিও যাবো।

তিন

মাতব্বর বাড়ির উঠানে বিচারসভা বসেছে। মাতব্বর নাজিম উদ্দিন লহরদ্দি গ্রামের সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তি। তিনি চেয়ারে বসে আছেন। তার চোখ আধভোজা। তার সামনের টেবিলে এক গ্লাস পানি দেয়া হয়েছে। পিরিচ দিয়ে ঢাকা। তার পাশে বসে আছেন চেয়ারম্যান, মসজিদের ইমাম, হোমিও ডাক্তার সুরেশ বাবু। ইসহাক সাহেবকেও দেখা গেল। তিনি থমথমে মুখে বসে আছেন।
পুরুষ, মহিলা, শিশু, বুড়োতে পুরো উঠান গিজগিজ করছে। মহিলা ও শিশুদের মধ্যে উৎসব উৎসব ভাব। মহিলারা মুখে আঁচল চাপা দিয়ে ময়না মিয়াকে দেখছে। তাদের মুখ হাসি হাসি। কেউ কেউ বাচ্চা কোলে ভীড় ঠেলে ময়না মিয়াকে এক নজর দেখার চেষ্টা করছে। সজিব নিজেকে আড়াল করে দাঁড়াল। তার পিছনে কাদের। কে যেন চেঁচিয়ে উঠল!
পোলাপানের এখানে কি? যা এখান থেকে!
সবাই একযোগে বলল,
পোলাপাইন ভাগাও, পোলাপাইন ভাগাও। এইডা পোলাপাইনের বিষয় না।
বাচ্চাদের সরানো হল। কিন্তু ওরা আশেপাশের গাছের ডালে উঠে উঁকি-ঝুঁকি মারতে লাগল।
সবার দৃষ্টি যার দিকে সেই ময়না মিয়া কিন্তু নির্বিকার। সে মাটিতে বসে আছে। তার চোখ মাটির দিকে। চোখে মরা মাছের দৃষ্টি। মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। গায়ের বর্ণ আগের চেয়ে ম্লান হয়েছে। সে মাঝে মাঝে বিড় বিড় করে যেন কি বলছে। আশেপাশের কোলাহল তাকে একটুও স্পর্শ করছে না।
মাতব্বর সাহেব কেশে গলা পরিষ্কার করলেন। তারপর গম্ভীর গলায় বললেন,
ভাই সাহেব, আপনারা সবাই এখানে জমায়েত হইছেন। আমি আপনাদের উদ্দেশ্যে আগে দুইটা কথা বলতে চাই। আপনারা জানেন, আমার চৌদ্দ-পুরুষ ধরে এই ‘তাড়াশ’ গ্রামে বাস। ঢাকা শহরে আমার দুই-তিনটা বাড়ি আছে। আমার ছেলেমেয়েরা সেখানে থাকে। আমি থাকি না। কারণ সকাল-বিকাল এই গ্রাম না দেখলে আমার ভাল লাগে না। ‘তাড়াশ’ গ্রামবাসীর জন্য আমার মন পুড়ে! এই গ্রামের একটা ইজ্জত আছে। একজন বা দুইজন লোকের জন্য এই ইজ্জত যমুনায় বিসর্জন দেওয়া যায় না।
ভীড়ের মধ্যে গুঞ্জন উঠলঃ একদম খাঁটি কথা।
মাতব্বর সাহেব বলতে লাগলেন, আপনারা এখানে দশজন উপস্থিত হয়েছেন। আপনারাই ঠিক করেন ময়নারে কি করবেন। ওর বাপ গ্রামের মুখ উজ্জ্বল করেছিল, আর ও গ্রামের মুখে চুনকালি মাখাইছে।
পিছন থেকে একজন চেঁচিয়ে বলল, ময়না এবং হের বউরে মাটিতে পুইত্যা পাথর মারেন।
আরেকজন বলল, দুইডারেই জুতার মালা পরাইয়া পুরা গ্রাম চক্কর দেওয়ান।
কেউ বলল, বাজারের মধ্যে নিয়া দুইডারে সাতদিন কান ধইরা উঠ-বস করান।
মতামত দেওয়া চলতেই লাগল।
মাতব্বর সাহেব ভারিক্কি গলায় বললেন,
আপনারা চান গর্তের মধ্যে পুইত্যা দুইজনরে পাথর মারি?
কেউ কেউ বলল, হ চাই। এইডাই ওগো উচিত সাজা।
ইসহাক সাহেব ধমকে উঠলেন, এই ব্যাটা। এইটা কি আরব দেশ, পাথর মারতে চাও? ময়না মিয়া কোন অন্যায় করেনি। করলে করেছে ওর স্ত্রী।
ভীড়ের মধ্যে গুঞ্জন উঠল। মাতব্বর সাহেব ইসহাক সাহেবের দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকালেন। তার চোখে স্পষ্ট বিরক্তি। তিনি ইমাম সাহেবের সাথে কি যেন পরামর্শ করলেন। ইমাম সাহেব উঠে দাঁড়ালেন।
মাতব্বরের একজন লোক চেঁচিয়ে সবাইকে থামতে বললেন। ইমাম সাহেব বলতে শুরু করলেন। তার গলার স্বর জুম্মা নামাজের খুৎবা পাঠের মত ‘ভাব গম্ভীর’।
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম। নাহমাদুহু ওয়ানুসাল্লি আলা রাসুলেহিম কারিম।
ভাইসব, জামানা হইছে খারাপ। এই জামানায় ছেলে-মেয়ে, বাবা-মার কথা শুনে না। স্ত্রী-স্বামীর কথা শুনে না। এই সবই কিয়ামতের লক্ষণ। কিয়ামত অতি সন্নিকট। দুনিয়া ধ্বংস হওয়ার আগে ‘আইয়েমে জাহেলিয়াত’ যুগ কায়েম হবে। বেগানা নারী-পুরুষ অবৈধ মেলামেশা করবে। আল্লাহ পাক পবিত্র কোরআনে এই ব্যাপারে সবাইকে সতর্ক করে দিয়েছেন। তিনি সূরা নূরে স্পষ্ট বলেছেন,
‘হে মুহাম্মদ (সাঃ)! তুমি ঈমানদার স্ত্রী লোকদিগকে বলিয়া দাও তাহারা যেন নিজেদের চক্ষুগুলি নত করিয়া রাখে ও নিজেদের লজ্জাস্থানগুলির হেফাজত করে এবং তাহাদের সৌন্দর্য প্রকাশ না করে। কিন্তু উহার মধ্যে যতটুকু খোলা থাকে (উহার কথা স্বতন্ত্র) এবং নিজেদের ঘাড়ে উড়নি স্থাপন করে এবং সজোরে নিজেদের পদ নিক্ষেপ না করে।’
ময়না মিয়ার স্ত্রী মহাপাপী। ময়না মিয়া তার পরিবারকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। সেও মহাপাপী। ভাইসাব, দেহে ফোঁড়া হইলে ডাক্তার সাব কি করেন? হয় গেলে ফেলেন অথবা ছুড়ি দিয়া কেটে ফেলেন। (হোমিওপ্যাথি ডাক্তারকে এই সময়ে মহা-উৎসাহে মাথা নাড়তে দেখা গেল)
মনুষ্যসমাজ একটা দেহের মতো। কেউ ফোঁড়ার মতো দূষিত হলে তাকে উগরে ফেলতে হয়। নইলে সারা সমাজে ছড়িয়ে পড়ে।
অত্র এলাকার মাননীয় মাতব্বর সাব এবং অন্যান্য গণ্যমান্য ব্যক্তির মতামত নিয়ে ময়না মিয়ার প্রতি বিধান দেয়া হল।
এই বিধান মতে, ‘ময়না মিয়া আজ রাত শেষ না হতেই সপরিবারে এই গাঁ ছেড়ে চিরতরে চলে যাবে। সূর্য উঠার পর তাকে গাঁয়ে পাওয়া গেলে কঠিন শাস্তি দেওয়া হবে।’
রাতে খেতে বসে সজিব মামাকে বলল, ময়নামিয়ার জন্য ব্যাপারটা ভালই হল। এই গ্রামে সম্পত্তি হারানোর শোকে হয়তো কিছুই করতে পারছিল না। নতুন গ্রামে নতুন উৎসাহে জীবন শুরু করতে পারবে।
মামা হতাশ গলায় বললেন, পারলে তো ভালই। এই পরামর্শ আমি অনেক আগেই দিয়েছিলাম। ও কি বলে জানো? মানুষ সম্পত্তি করে ভোগের জন্য। আমি সেই ভোগের স্বাদ পাইছি। সম্পত্তি কইরা আর কি হইবো?
আমি বললাম, তোমার বউ ছেলে মেয়ের জন্য করো।
সে উদাস গলায় বলল, ওগোটা ওরাই জোগাড় করবো।
সজীব এরই নাম মন। ভিনগাঁয়ে যাচ্ছে। মন তো আর রেখে যাচ্ছে না। মন পরিবর্তন না হলে কিছুই হবে না।
পরদিন সকালে ‘তাড়াশ’ গ্রামে একটি অদ্ভুত দৃশ্য দেখা গেল।
শত শত নারী-পুরুষ পুকুর পাড়ে ভীড় করেছে। তারা বিস্মিত চোখে ময়না মিয়ার ভায়োড়টি দেখছে। যেন বিখ্যাত কোন ‘স্থাপত্য’ দেখছে। বন্যা শেষে ময়না ভায়োড়টি নতুন করে গড়েছিল। সেই ভায়োড় এখন খাঁ-খাঁ করছে। কারণ সূর্য উঠার আগেই সে বউ-বাচ্চা নিয়ে গ্রাম ছেড়ে চলে গেছে।

চার

সাত বছর পরের কথা। সিরাজগঞ্জ সদর হাসপাতাল। ডাঃ সজিব আহমেদ ডিউটি সেরে তার রুমে এসে বসল।
ইসহাক সাহেব হন্ততন্ত হয়ে তার রুমে ঢুকলেন। সজিব কিছু বলার আগেই তিনি বললেন,
সজিব, তোমার হাতে কোন রোগী আছে? না থাকলে আমার সাথে একটু এসো।
সজিব হতভম্ব। মামা এই কনকনে শীতের সকালে এতদূর থেকে এসেছেন! কারণ ছাড়া নিশ্চয়ই আসেননি? সে দ্রুত ব্যাগ গুছালো।
চলুন মামা।
তারা রিক্সায় উঠে বসল। সজিব ভিতরে ভিতরে ছটফট করছে। সে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে কয়েকবার মামার দিকে তাকাল। মামা কিছু বলছেন না। বিষণœ চোখে দূরে তাকিয়ে আছেন।
সজিব উৎসুক গলায় বলল,
মামা, সিরিয়াস কিছু?
ইসহাক সাহেব শান্ত গলায় বললেন,
তোমার ময়না মিয়ার কথা মনে আছে?
সজিব কিছুক্ষণ স্মৃতিতে ডুব দিয়ে বলল,
হ্যাঁ, হ্যাঁ, তার খবর কি?
গ্রাম ছাড়ার পর তারা অনেকদূরে একটি গ্রামে আশ্রয় পায়। কিন্তু একদিন ময়না মিয়া স্ত্রী-সন্তান রেখে চুপি-চুপি ‘তাড়াশে’ ফিরে আসে। তার পরিবার থেকে বলা হয়, সে নিজ গ্রাম ছাড়া অন্য কোথাও থাকতে চায় না। শত চেষ্টা করেও তারা রাখতে পারেনি। কিন্তু এখানে সে থাকবে কোথায়, খাবেই বা কী?
ময়না মিয়ার এক কথা, আপনারা খেতে দিলে খাব, না দিলে না খাব।
সারাদিন বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে রাতে হঠাৎ কারও দরজায় গিয়ে দাঁড়ায়।
‘মা, খালা আমাকে চারডা ভাত দিবেন? সারাদিন কিছু খাই নাই।’
কেউ খাবার দিত, কেউ দিত না। কোন কোন রাত না খেয়ে কাটিয়ে দিত।
মামা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। কিছুক্ষণ থেমে আবার বলতে শুরু করলেন।
প্রথম প্রথম আমার বাড়ির উঠানে ঘুমাতো।
আমি জিজ্ঞেস করতাম, তুই এই গ্রামে আবার চলে এলি কেন? এখানে তোর কে আছে?
সে রহস্যময় ভঙ্গিতে হেসে বলত- এই গ্রামেই যে আমার শেকড়। শেকড় উপরে ফেললে বাঁচমু কেমনে!
শীত পড়তেই ময়না মিয়া দো-চালওয়ালা মণ্ডলের জ্বালানি রাখা ঘরে আশ্রয় নেয়। কোন রকম তার দিন কেটে যাচ্ছিল। কিন্তু ঘরওয়ালারা একদিন তাকে সেখান থেকে তাড়িয়ে দেয়। এরপর সে যেখানে-সেখানে থাকতে শুরু করে। শরীরও দিন দিন খারাপ হতে থাকে। একে তো শীতকাল! তার উপর না খাওয়া, না ঘুম! ক’দিন থাকা যায়? তাকে আমার বাড়িতে নিয়ে এলাম। সে তখন কানে খুবই কম শুনত।
একদিন তার স্ত্রী সন্তানরা এসে হাজির। তাকে যতœ করে নিজেদের কাছে নিয়ে গেল। কিন্তু সাত-আটদিন পর এক সন্ধ্যায় খবর পেলাম, ময়না আবার গ্রামে ফিরে এসেছে। লজ্জায় আমার সাথে দেখা করছে না।
মামা চুপ করলেন। সজিব স্তব্ধ হয়ে শুনল। তারা ‘তাড়াশে’ পৌঁছে গেছে। পুকুরপাড়ে শত শত নারী-পুরুষের ভীড়।
মামা ধরা গলায় বললেন,
ঐখানে ময়না মিয়া অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। দেখ, কিছু করতে পার কিনা।
সজিব ভীড় ঠেলে ভেতরে ঢুকল। ময়না খোলা আকাশের নিচে শুয়ে আছে। সে পালস্ দেখল। পরান পাখি অনেক আগেই চলে গেছে।
সে স্তম্ভিত হয়ে কিছুক্ষণ ময়নার দিকে তাকিয়ে রইল।
কি প্রশান্ত একটি মুখ!
যে মাটির প্রতি তার এত টান, সেই মাটি পরম মমতায় তাকে তার বুকে শুইয়ে রেখেছে! সজিব ধীরে ধীরে ওর হাতটা নামিয়ে রাখল। তার মনে হল- প্রতিটি ধূলিকণা সমুদ্র সমান ভালবাসা নিয়ে ওর জন্য অপেক্ষা করছে। ওরা দ্রুত ময়নাকে ওদের জগতে নিয়ে যেতে চায়! এক

অন্ধকার উঠানে কিসের যেন নড়াচড়া হচ্ছে। ইসহাক সাহেব চেঁচিয়ে উঠলেন, কে? কে ওখানে?
মাস্টার সাব, আমি।
তুই কে?
ইসহাক সাহেব উঠানে টর্চের আলো ফেললেন। ময়না মিয়া খালি গায়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার পায়ের সামনে কারা যেন গুটিশুটি হয়ে শুয়ে আছে। তার বউ-ছেলে-মেয়ে হবে হয়তো। একজনের মাথায় লম্বা চুল। ইসহাক সাহেব স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন।
ও, তুই! আজও এসেছিস?
ময়না মিয়া কাচুমাচু মুখে বলল, মাস্টার সাব, শুধু আইজ রাইতটা থাকমু। কাইল সূর্য উঠার আগেই যামু গা।
তুই তো দেখছি, আমার উঠানেই ঘরবাড়ি বানিয়ে ফেলবি। পুকুর পাড়ের কি অবস্থা?
ঐখানে হাঁটু পানি। যেমতে পানি বাড়তাছে, পুরা গেরাম ডুইব্বা যাইবো!
ইসহাক সাহেব টর্চ নিভিয়ে ফেললেন। তার কপালে ভাঁজ পড়েছে।
গ্রামে হু হু করে পানি ঢুকছে। বন্যার পানি। গতকাল শানপাড়া প্রাইমারী স্কুলের মাঠে তিনি পানি দেখেছেন। তাদের স্কুলটা যদিও উঁচু জায়গায় কিন্তু এভাবে পানি বাড়তে থাকলে....
তিনি হালকা গলায় বললেন, উঠান নোংরা করিস না।
জে, আচ্ছা।
ইসহাক সাহেব বাহিরের ঘরে এসে খাটে পা তুলে বসলেন।
সজিব হারিকেনের আলোয় গল্পের বই পড়ছিল। চেয়ার টেবিলে বসে গল্পের বই পড়তে তার ভাল লাগে না। মনে হয় পরীক্ষার পড়া পড়ছে। গল্প-উপন্যাস পড়তে হয় শুয়ে কিংবা সোফায় আরাম করে বসে।
গ্রামে এসে অবশ্য এভাবে পড়তে তার খারাপ লাগছে না। শুধু হারিকেনের আলোটা চোখে লাগছিল। কায়দা করে সে চিমনিতে কাগজ লাগিয়ে তা বন্ধ করেছে। মামাকে বিছানায় বসতে দেখে সজিব বই বন্ধ করল।
মামা, কার সাথে কথা বললেন?
ও ময়না মিয়া। ভাদাইম্যা একটা।
কেন, কি করেছে?
ও হতো এই গ্রামের বাদশা। এখন পথের ফকির।
এই অবস্থা কেন?
সম্পত্তি উড়িয়ে ফেলেছে। ওর বাপ আলী ব্যাপারী সারাজীবন দুই হাতে সম্পত্তি করেছে। ও দুই হাতে সেই সম্পত্তি উড়িয়েছে। রাজভাণ্ডার গেছে ফুরিয়ে।
রাজভাণ্ডার ছিল নাকি?
রাজভাণ্ডারের মতোই। আলী ব্যাপারী জীবনে কি করে নাই? ধানী জমিই ছিল তার শত বিঘা। বসতবাড়ির পাশেই ছিল বিশাল বাগান। মাছ ভরতি পুকুর ছিল চার-পাঁচটা। আলী ব্যাপারীকে কেউ কোনদিন মাছ কিনে খেতে দেখেনি। পুকুরে জাল ফেলা হয়েছে। ঝাঁকে ঝাঁকে উঠে এসেছে রুই-কাতলা। চেয়ারম্যান-মাতব্বরদের বাড়িতেও চলে গেছে সেই রুই-কাতলার ভাগ। গ্রামে তার সুনামও ছিল। চেয়ারম্যান বাড়িতে মেহমান এসেছে। বাজারে ভাল মাছ পাওয়া যাচ্ছে না। ব্যাপারী বাড়িতে লোক পাঠানো হল। সাথে সাথে বড় সাইজের দুটো রুইয়ের ব্যবস্থা হয়ে গেছে। স্কুল পরিদর্শনে ইন্সপেক্টর সাহেব এসেছেন। ব্যাপারী বাড়ির বাগান থেকে বড় বড় দুটো ডাব পাঠিয়ে দেয়া হল। ইন্সপেক্টর সাহেব সেই ডাবের পানি খেয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তুলতেন আর বলতেনÑ
বড়ই সুস্বাদু, বড়ই সুস্বাদু!
সেই বাড়ির ছেলের আজ এই দশা! বাপ মারলো। ময়নারে আর পায় কে? কাঁচা বয়স। হাতে কাঁচা পয়সা। চারপাশে নতুন নতুন রসিক বন্ধু এসে জুটল।
ময়নারে তাসের নেশায় ধরলো। পয়সাওয়ালা মানুষের কোন নেশাই পয়সা ছাড়া জমে না। চলল পয়সার খেলা। যখন নেশা কাটল, ময়না মিয়া স্তম্ভিত হয়ে দেখল তার সম্পদ বলতে রয়েছে তার স্ত্রী, দুই ছেলেমেয়ে আর এক প্যাকেট তাস।
এখন কি করে?
কি আর করবে? বউ পোলাপান নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ভিক্ষা করে।
সত্যি সত্যি ভিক্ষা করে?
ভিক্ষা করার মতই। বউটা বাড়ি বাড়ি কাজ করে। ময়না তো আর কাজকর্ম কিছু শিখে নাই। কি করে ওই জানে?
থাকে কোথায়?
বসতবাড়ি বিক্রির পর চত্রাগাড়ি পুকুর পাড়ে আশ্রয় নেয়। সেখানে ভায়োড় বানিয়ে থাকে।
ভায়োড় কি?
তুমি সিরাজগঞ্জের ছেলে ভায়োড় চিনো না?
দেখলে হয়তো চিনবো। নাম জানি না।
ইসহাক সাহেব ক্লাশে পড়ানোর ভঙ্গিতে বললেন, ভায়োড় হলো খড় দিয়ে তৈরি তাঁবু জাতীয় ঘর। দেখতে অনেকটা সাইবেরিয়ার ইগলুর মতো।
ও আচ্ছা।
ওর ভায়োড়টি বন্যার পানিতে ডুবে গেছে। এখন বউ বাচ্চা নিয়ে পরের বাড়ির উঠানে উঠানে থাকে। একটু আগে দেখলাম ওরা ছালা বিছিয়ে শুয়ে আছে।
সজিব হাই তুলে আবার গল্পের বইয়ে মনোযোগ দিল। গ্রামের মানুষের উত্থান-পতনের কাহিনী সে আগেও শুনেছে। কাঁচা পয়সা হাতে পেলে এরা জমিদার। সেই জমিদারী কেউ ধরে রাখতে পারে, কেউ পারে না। ভাইয়ে ভাইয়ে সম্পত্তি নিয়ে ঝগড়া করে। কেউ কেউ সবকিছু বিক্রি করে দিয়ে শহরে পাড়ি জমায়। প্রথম প্রথম অভিজাত এলাকায় থাকে। তারপর টাকা ফুরিয়ে গেলে তাদের ঠাঁই হয় শহরের ঘিঞ্জি এলাকায়। শহরে থাকতে থাকতে এক সময় হাঁপিয়ে উঠে। তখন বউ ছেলেমেয়ের সামনে ঘন ঘন দীর্ঘশ্বাস ফেলে আর গল্প করে- এক সময় গ্রামে তাদের বিশাল জমিদারী ছিল। গ্রামের মানুষজন তাদের কথায় উঠ-বস করতো। ইত্যাদি---ইত্যাদি।
ময়না মিয়া সম্পত্তি হারানো দলের। এদের প্রতি আগ্রহের কিছু নেই! এরা পড়ে থাকে অতীত নিয়ে! তবে তার ভায়োড়টি দেখার আগ্রহ হল।
পরদিন সকালে পুকুর পাড়ে এসে সজিব দেখল- গম্বুজ আকৃতির একটি ঘর পানিতে ডুবে আছে।
চারদিকে পানি থৈ থৈ করছে। সবকিছুকে ডুবিয়ে দিয়ে যে পানি দাঁড়িয়ে আছে, সেই পানিকে আপন মনে হচ্ছে না। এই পানির মধ্যে এক ধরনের হাহাকার আছে! গ্রামে এসে হাহাকার দেখতে তার ভাল লাগে না। সে গ্রামে আসে রিলাক্সের জন্য। গ্রামে এক ধরনের শান্তি আছে। গাছপালার পাতায় পাতায় যেন আনন্দ। সেই আনন্দ শুষে নিয়েছে এই পানি।
সে বাড়ির পথে পা বাড়াল। তখনই লোকটিকে দেখতে পেল। বিশাল দেহী একজন লোক তন্ময় হয়ে ভায়োড়ের দিকে তাকিয়ে আছে। সজিব বুঝল- এ ময়না মিয়া। চোখে অদ্ভুত দৃষ্টি। আনন্দ বা বেদনার ছায়া চোখে পড়লে সেই দৃষ্টি সহজে পড়ে ফেলা যায়। লোকটার চোখে না আছে আনন্দ, না আছে বেদনা, না আছে হতাশা। চোখে আশ্চর্য এক নির্লিপ্ত ভাব। ধন-সম্পদ শরীরে যে উজ্জ্বল আভা নিয়ে আসে, তা এখনও অবশিষ্ট আছে। সজিব এগিয়ে গেল।
আসসালামালাইকুম।
ময়না মিয়া হকচকিয়ে গেল। তাকে বোধহয় গ্রামের কেউ সালাম দেয় না। অপ্রত্যাশিত শ্রদ্ধা পেয়ে তাকে বেশ বিব্রত মনে হচ্ছে। সজিব অন্তরঙ্গ ভঙ্গিতে বলল, দেখছেন, দিন দিন কিভাবে পানি বাড়ছে? আর বোধহয় বাড়বে না।
ময়না মিয়া জবাব দিল না। ভাবলেশহীন চোখে দূরে তাকিয়ে রইল। সজিব সহজ গলায় বলল, ঐ ভায়োড়টি কি আপনার?
ময়নামিয়া না তাকিয়েই বলল, হুঁ।
সজিব আশ্বাসের স্বরে বলল, এই দুই চারদিন। তারপর পানি নামতে শুরু করবে। আপনি আবার ওখানে ফিরে যেতে পারবেন।
ময়না মিয়া বিড়বিড় করে বলল, তরল আগুন আগাইয়া আসতাছে। পুরা গেরাম খাইয়া ছাফ কইরা ফেলবো।
সজিব কৌতূহল নিয়ে তাকাল। লোকটি কি সুস্থ আছে, না পাগল হয়ে গেছে? চোখে অবশ্য পাগলের ছাপ নেই।
সজিব বলল, তরল আগুন বলছেন কেন? পানি তো কিছু পুড়াচ্ছে না?
তাড়াইয়া তো দিতাছে।
সজিব অবাক হল। লজিক এখনও পরিষ্কার। সেও রহস্য করে বলল,
তাড়িয়ে আর দিবে কই? এক সময় তাকে নামতেই হবে। মানুষকে দুনিয়ার কেউ পরাস্ত করতে পারে না।
ভাইজান কথাডা পুরাডা ঠিক না। মাইনষেরে কেউ পরাস্ত করতে না পারুক, কিন্তু হে নিজেই নিজের কাছে পরাস্ত হয়।
সজিব মনে মনে হাসল। নিঃস্ব হয়ে অনেকে দার্শনিক হয়ে উঠে। ধনী হয়ে দার্শনিক হয় খুব কম। বড়জোর ‘ভোগ-বিলাসী’ হয়।
সজিব লোকটির প্রতি কৌতূহলী হয়ে উঠল। তার ফিলোসফি মার্কা কথাবার্তা শোনার জন্য আরও ভাব জমানো দরকার। কিন্তু ময়না মিয়া মুহূর্তের মধ্যে বড় বড় পা ফেলে পাশের জঙ্গলে ঢুকে গেল।

দুই

সে বছর বন্যা ভয়াবহ রূপ নিল। শহর-গ্রাম বিচ্ছিন্ন হয় হয় অবস্থা। সজিব তড়িঘড়ি করে ঢাকায় চলে এল। তারপর দুই বছর কেটে গেছে। গ্রামে যাওয়া হয়নি।
এবার ছুটিতে সে গ্রামের পথ ধরল। ক্লান্ত দেহে সে যখন মামাবাড়ির উঠানে পৌঁছল, ইসহাক সাহেব তখন সেজেগুজে কোথায় যেন যাচ্ছিলেন। সজিবকে দেখে আনন্দে চেঁচিয়ে উঠলেন।
আরে সজিব যে! এতদিন পর মামার কথা মনে পড়ল? এত শুকিয়েছো কেন? ডাক্তারী পড়তে যেয়ে দেখি তুমি নিজেই রোগী হয়ে যাচ্ছো!
তিনি ঘরের ভেতর তাকিয়ে উঁচু গলায় বললেন, এই দেখো কে এসেছে?
পুরো বাড়িতে সারা পড়ে গেল।
সজিব হাসি মুখে বলল, আপনাকে দেখতে এলাম, মামা। আপনার শরীর ভাল?
হুঁ! তোমার মা কেমন আছে?
ভাল। মামা কোথাও বের হচ্ছিলেন নাকি?
হ্যাঁ। একটু মাতব্বর বাড়ি যাওয়ার দরকার ছিল। তুমি এই ঘরে এসে বসে। ঘরটা ঠাণ্ডা আছে। ইস্ ঘেমে টেমে কি অবস্থা!
মামা ঘরের সবগুলো জানালা খুলে দিলেন। ফ্যান ছাড়লেন। তারপর চিৎকার করে ডাকলেন, কাদের! কাদের!
কাদের প্রায় দৌঁড়ে এল।
‘কোথায় থাকিস? এত ডাকতে হয়? চট করে গাছে উঠ দেখি, কচি দেখে দুটো ডাব পার।
সজিব দ্রুত বলল, মামা, ডাব লাগবে না। আমি এখন গোসল করবো।
ডাব খেয়ে আগে ঠাণ্ডা হও! শহরে তো আর ডাব খাও না, খাও কোক। কাদের, ডাব কেটে তুই কলতলায় যা। পানি তোল।
সজিব লজ্জিত গলায় বলল, মামা, আপনি শুধু শুধু ব্যস্ত হচ্ছেন। আমি সাতদিন থাকার প্ল্যান নিয়ে এসেছি। আপনি ঘুরে আসুন।
সাতদিন না তোমার যতদিন খুশি থাক। কিন্তু কোন কষ্ট করা যাবে না। তাহলে তো আর আসতে চাইবে না।
মামা ঘড়ি দেখলেন।
যাই দেখি একটু। মাতব্বর সাহেব খবর পাঠিয়েছেন। না গেলে ভাববে ব্যাটারে আমি প্রশ্রয় দেই।
কিসের প্রশ্রয়?
এসব শুনে তোমার কাজ নাই। তুমি ফ্রেশ হয়ে বিশ্রাম নাও।
গোসল করতে যেয়ে সজিব গ্রামের ঘটনাটা কাদেরের মুখে শুনল।
ভাইজান, আইজ ময়নার বিচারের দিন।
ময়না কে?
ময়নারে চিনেন না। গ্রামের কাকপক্ষীও হেরে চিনে। ও আফনে তো গেরামে থাকেন না। ময়না হইল আমাগো গেরামের ‘আল্লাহর গজব’ খাওয়া মানুষ।
সজিবের মনে পড়ল দুই বছর আগে ময়না মিয়ার সাথে তার দেখা হয়েছিল। সে বিস্মিত হয়ে বলল, তার আবার কি হয়েছে?
কাদের দাঁত বের করে হাসল।
হেই ব্যাডার বউ পাশের গ্রামে যাইয়া আকাম করছে। জুয়ান বেডি। উপরে উপরে বাড়ি বাড়ি কাম করে। তলে তলে করে আকাম। পুরা গ্রামের ইজ্জত ডুবাইছে।
সজীব গম্ভীর হয়ে গেল। কাদের কল চেপে পানি তুলছে। তোলা পানিতে অন্যের সামনে গোসল করতে অস্বস্তি লাগে।
সে গম্ভীর স্বরে বলল,
কাদের, তুমি এখন যাও।
আমি গেলে আফনেরে পানি তুইল্লা দিবো কে?
আমি নিজেই তুলতে পারবো। তুমি যাও।
কাদের কলের হাতল ছেড়ে উঠে দাঁড়াল।
দ্যাইক্কেন, পিছলাইয়া পইড়েন না। তাইলে খালু আমার পিডে লাডি ভাঙবো।
সজিব গোসল সেরে ঘরে এসে বসল। কাদের নতুন শার্ট-লুঙ্গী পরে হাজির। তার মুখ হাসি হাসি।
ভাইজান, একটু ঘুইরা আহি? খালু আহার আগেই আইয়া পরমু।
কোথায় যাও?
ময়না মিয়ার বিচারডা একটু দেইক্কা আহি।
সজিব শান্তস্বরে বলল, চল, আমিও যাবো।

তিন

মাতব্বর বাড়ির উঠানে বিচারসভা বসেছে। মাতব্বর নাজিম উদ্দিন লহরদ্দি গ্রামের সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তি। তিনি চেয়ারে বসে আছেন। তার চোখ আধভোজা। তার সামনের টেবিলে এক গ্লাস পানি দেয়া হয়েছে। পিরিচ দিয়ে ঢাকা। তার পাশে বসে আছেন চেয়ারম্যান, মসজিদের ইমাম, হোমিও ডাক্তার সুরেশ বাবু। ইসহাক সাহেবকেও দেখা গেল। তিনি থমথমে মুখে বসে আছেন।
পুরুষ, মহিলা, শিশু, বুড়োতে পুরো উঠান গিজগিজ করছে। মহিলা ও শিশুদের মধ্যে উৎসব উৎসব ভাব। মহিলারা মুখে আঁচল চাপা দিয়ে ময়না মিয়াকে দেখছে। তাদের মুখ হাসি হাসি। কেউ কেউ বাচ্চা কোলে ভীড় ঠেলে ময়না মিয়াকে এক নজর দেখার চেষ্টা করছে। সজিব নিজেকে আড়াল করে দাঁড়াল। তার পিছনে কাদের। কে যেন চেঁচিয়ে উঠল!
পোলাপানের এখানে কি? যা এখান থেকে!
সবাই একযোগে বলল,
পোলাপাইন ভাগাও, পোলাপাইন ভাগাও। এইডা পোলাপাইনের বিষয় না।
বাচ্চাদের সরানো হল। কিন্তু ওরা আশেপাশের গাছের ডালে উঠে উঁকি-ঝুঁকি মারতে লাগল।
সবার দৃষ্টি যার দিকে সেই ময়না মিয়া কিন্তু নির্বিকার। সে মাটিতে বসে আছে। তার চোখ মাটির দিকে। চোখে মরা মাছের দৃষ্টি। মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। গায়ের বর্ণ আগের চেয়ে ম্লান হয়েছে। সে মাঝে মাঝে বিড় বিড় করে যেন কি বলছে। আশেপাশের কোলাহল তাকে একটুও স্পর্শ করছে না।
মাতব্বর সাহেব কেশে গলা পরিষ্কার করলেন। তারপর গম্ভীর গলায় বললেন,
ভাই সাহেব, আপনারা সবাই এখানে জমায়েত হইছেন। আমি আপনাদের উদ্দেশ্যে আগে দুইটা কথা বলতে চাই। আপনারা জানেন, আমার চৌদ্দ-পুরুষ ধরে এই ‘তাড়াশ’ গ্রামে বাস। ঢাকা শহরে আমার দুই-তিনটা বাড়ি আছে। আমার ছেলেমেয়েরা সেখানে থাকে। আমি থাকি না। কারণ সকাল-বিকাল এই গ্রাম না দেখলে আমার ভাল লাগে না। ‘তাড়াশ’ গ্রামবাসীর জন্য আমার মন পুড়ে! এই গ্রামের একটা ইজ্জত আছে। একজন বা দুইজন লোকের জন্য এই ইজ্জত যমুনায় বিসর্জন দেওয়া যায় না।
ভীড়ের মধ্যে গুঞ্জন উঠলঃ একদম খাঁটি কথা।
মাতব্বর সাহেব বলতে লাগলেন, আপনারা এখানে দশজন উপস্থিত হয়েছেন। আপনারাই ঠিক করেন ময়নারে কি করবেন। ওর বাপ গ্রামের মুখ উজ্জ্বল করেছিল, আর ও গ্রামের মুখে চুনকালি মাখাইছে।
পিছন থেকে একজন চেঁচিয়ে বলল, ময়না এবং হের বউরে মাটিতে পুইত্যা পাথর মারেন।
আরেকজন বলল, দুইডারেই জুতার মালা পরাইয়া পুরা গ্রাম চক্কর দেওয়ান।
কেউ বলল, বাজারের মধ্যে নিয়া দুইডারে সাতদিন কান ধইরা উঠ-বস করান।
মতামত দেওয়া চলতেই লাগল।
মাতব্বর সাহেব ভারিক্কি গলায় বললেন,
আপনারা চান গর্তের মধ্যে পুইত্যা দুইজনরে পাথর মারি?
কেউ কেউ বলল, হ চাই। এইডাই ওগো উচিত সাজা।
ইসহাক সাহেব ধমকে উঠলেন, এই ব্যাটা। এইটা কি আরব দেশ, পাথর মারতে চাও? ময়না মিয়া কোন অন্যায় করেনি। করলে করেছে ওর স্ত্রী।
ভীড়ের মধ্যে গুঞ্জন উঠল। মাতব্বর সাহেব ইসহাক সাহেবের দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকালেন। তার চোখে স্পষ্ট বিরক্তি। তিনি ইমাম সাহেবের সাথে কি যেন পরামর্শ করলেন। ইমাম সাহেব উঠে দাঁড়ালেন।
মাতব্বরের একজন লোক চেঁচিয়ে সবাইকে থামতে বললেন। ইমাম সাহেব বলতে শুরু করলেন। তার গলার স্বর জুম্মা নামাজের খুৎবা পাঠের মত ‘ভাব গম্ভীর’।
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম। নাহমাদুহু ওয়ানুসাল্লি আলা রাসুলেহিম কারিম।
ভাইসব, জামানা হইছে খারাপ। এই জামানায় ছেলে-মেয়ে, বাবা-মার কথা শুনে না। স্ত্রী-স্বামীর কথা শুনে না। এই সবই কিয়ামতের লক্ষণ। কিয়ামত অতি সন্নিকট। দুনিয়া ধ্বংস হওয়ার আগে ‘আইয়েমে জাহেলিয়াত’ যুগ কায়েম হবে। বেগানা নারী-পুরুষ অবৈধ মেলামেশা করবে। আল্লাহ পাক পবিত্র কোরআনে এই ব্যাপারে সবাইকে সতর্ক করে দিয়েছেন। তিনি সূরা নূরে স্পষ্ট বলেছেন,
‘হে মুহাম্মদ (সাঃ)! তুমি ঈমানদার স্ত্রী লোকদিগকে বলিয়া দাও তাহারা যেন নিজেদের চক্ষুগুলি নত করিয়া রাখে ও নিজেদের লজ্জাস্থানগুলির হেফাজত করে এবং তাহাদের সৌন্দর্য প্রকাশ না করে। কিন্তু উহার মধ্যে যতটুকু খোলা থাকে (উহার কথা স্বতন্ত্র) এবং নিজেদের ঘাড়ে উড়নি স্থাপন করে এবং সজোরে নিজেদের পদ নিক্ষেপ না করে।’
ময়না মিয়ার স্ত্রী মহাপাপী। ময়না মিয়া তার পরিবারকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। সেও মহাপাপী। ভাইসাব, দেহে ফোঁড়া হইলে ডাক্তার সাব কি করেন? হয় গেলে ফেলেন অথবা ছুড়ি দিয়া কেটে ফেলেন। (হোমিওপ্যাথি ডাক্তারকে এই সময়ে মহা-উৎসাহে মাথা নাড়তে দেখা গেল)
মনুষ্যসমাজ একটা দেহের মতো। কেউ ফোঁড়ার মতো দূষিত হলে তাকে উগরে ফেলতে হয়। নইলে সারা সমাজে ছড়িয়ে পড়ে।
অত্র এলাকার মাননীয় মাতব্বর সাব এবং অন্যান্য গণ্যমান্য ব্যক্তির মতামত নিয়ে ময়না মিয়ার প্রতি বিধান দেয়া হল।
এই বিধান মতে, ‘ময়না মিয়া আজ রাত শেষ না হতেই সপরিবারে এই গাঁ ছেড়ে চিরতরে চলে যাবে। সূর্য উঠার পর তাকে গাঁয়ে পাওয়া গেলে কঠিন শাস্তি দেওয়া হবে।’
রাতে খেতে বসে সজিব মামাকে বলল, ময়নামিয়ার জন্য ব্যাপারটা ভালই হল। এই গ্রামে সম্পত্তি হারানোর শোকে হয়তো কিছুই করতে পারছিল না। নতুন গ্রামে নতুন উৎসাহে জীবন শুরু করতে পারবে।
মামা হতাশ গলায় বললেন, পারলে তো ভালই। এই পরামর্শ আমি অনেক আগেই দিয়েছিলাম। ও কি বলে জানো? মানুষ সম্পত্তি করে ভোগের জন্য। আমি সেই ভোগের স্বাদ পাইছি। সম্পত্তি কইরা আর কি হইবো?
আমি বললাম, তোমার বউ ছেলে মেয়ের জন্য করো।
সে উদাস গলায় বলল, ওগোটা ওরাই জোগাড় করবো।
সজীব এরই নাম মন। ভিনগাঁয়ে যাচ্ছে। মন তো আর রেখে যাচ্ছে না। মন পরিবর্তন না হলে কিছুই হবে না।
পরদিন সকালে ‘তাড়াশ’ গ্রামে একটি অদ্ভুত দৃশ্য দেখা গেল।
শত শত নারী-পুরুষ পুকুর পাড়ে ভীড় করেছে। তারা বিস্মিত চোখে ময়না মিয়ার ভায়োড়টি দেখছে। যেন বিখ্যাত কোন ‘স্থাপত্য’ দেখছে। বন্যা শেষে ময়না ভায়োড়টি নতুন করে গড়েছিল। সেই ভায়োড় এখন খাঁ-খাঁ করছে। কারণ সূর্য উঠার আগেই সে বউ-বাচ্চা নিয়ে গ্রাম ছেড়ে চলে গেছে।

চার

সাত বছর পরের কথা। সিরাজগঞ্জ সদর হাসপাতাল। ডাঃ সজিব আহমেদ ডিউটি সেরে তার রুমে এসে বসল।
ইসহাক সাহেব হন্ততন্ত হয়ে তার রুমে ঢুকলেন। সজিব কিছু বলার আগেই তিনি বললেন,
সজিব, তোমার হাতে কোন রোগী আছে? না থাকলে আমার সাথে একটু এসো।
সজিব হতভম্ব। মামা এই কনকনে শীতের সকালে এতদূর থেকে এসেছেন! কারণ ছাড়া নিশ্চয়ই আসেননি? সে দ্রুত ব্যাগ গুছালো।
চলুন মামা।
তারা রিক্সায় উঠে বসল। সজিব ভিতরে ভিতরে ছটফট করছে। সে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে কয়েকবার মামার দিকে তাকাল। মামা কিছু বলছেন না। বিষণœ চোখে দূরে তাকিয়ে আছেন।
সজিব উৎসুক গলায় বলল,
মামা, সিরিয়াস কিছু?
ইসহাক সাহেব শান্ত গলায় বললেন,
তোমার ময়না মিয়ার কথা মনে আছে?
সজিব কিছুক্ষণ স্মৃতিতে ডুব দিয়ে বলল,
হ্যাঁ, হ্যাঁ, তার খবর কি?
গ্রাম ছাড়ার পর তারা অনেকদূরে একটি গ্রামে আশ্রয় পায়। কিন্তু একদিন ময়না মিয়া স্ত্রী-সন্তান রেখে চুপি-চুপি ‘তাড়াশে’ ফিরে আসে। তার পরিবার থেকে বলা হয়, সে নিজ গ্রাম ছাড়া অন্য কোথাও থাকতে চায় না। শত চেষ্টা করেও তারা রাখতে পারেনি। কিন্তু এখানে সে থাকবে কোথায়, খাবেই বা কী?
ময়না মিয়ার এক কথা, আপনারা খেতে দিলে খাব, না দিলে না খাব।
সারাদিন বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে রাতে হঠাৎ কারও দরজায় গিয়ে দাঁড়ায়।
‘মা, খালা আমাকে চারডা ভাত দিবেন? সারাদিন কিছু খাই নাই।’
কেউ খাবার দিত, কেউ দিত না। কোন কোন রাত না খেয়ে কাটিয়ে দিত।
মামা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। কিছুক্ষণ থেমে আবার বলতে শুরু করলেন।
প্রথম প্রথম আমার বাড়ির উঠানে ঘুমাতো।
আমি জিজ্ঞেস করতাম, তুই এই গ্রামে আবার চলে এলি কেন? এখানে তোর কে আছে?
সে রহস্যময় ভঙ্গিতে হেসে বলত- এই গ্রামেই যে আমার শেকড়। শেকড় উপরে ফেললে বাঁচমু কেমনে!
শীত পড়তেই ময়না মিয়া দো-চালওয়ালা মণ্ডলের জ্বালানি রাখা ঘরে আশ্রয় নেয়। কোন রকম তার দিন কেটে যাচ্ছিল। কিন্তু ঘরওয়ালারা একদিন তাকে সেখান থেকে তাড়িয়ে দেয়। এরপর সে যেখানে-সেখানে থাকতে শুরু করে। শরীরও দিন দিন খারাপ হতে থাকে। একে তো শীতকাল! তার উপর না খাওয়া, না ঘুম! ক’দিন থাকা যায়? তাকে আমার বাড়িতে নিয়ে এলাম। সে তখন কানে খুবই কম শুনত।
একদিন তার স্ত্রী সন্তানরা এসে হাজির। তাকে যতœ করে নিজেদের কাছে নিয়ে গেল। কিন্তু সাত-আটদিন পর এক সন্ধ্যায় খবর পেলাম, ময়না আবার গ্রামে ফিরে এসেছে। লজ্জায় আমার সাথে দেখা করছে না।
মামা চুপ করলেন। সজিব স্তব্ধ হয়ে শুনল। তারা ‘তাড়াশে’ পৌঁছে গেছে। পুকুরপাড়ে শত শত নারী-পুরুষের ভীড়।
মামা ধরা গলায় বললেন,
ঐখানে ময়না মিয়া অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। দেখ, কিছু করতে পার কিনা।
সজিব ভীড় ঠেলে ভেতরে ঢুকল। ময়না খোলা আকাশের নিচে শুয়ে আছে। সে পালস্ দেখল। পরান পাখি অনেক আগেই চলে গেছে।
সে স্তম্ভিত হয়ে কিছুক্ষণ ময়নার দিকে তাকিয়ে রইল।
কি প্রশান্ত একটি মুখ!
যে মাটির প্রতি তার এত টান, সেই মাটি পরম মমতায় তাকে তার বুকে শুইয়ে রেখেছে! সজিব ধীরে ধীরে ওর হাতটা নামিয়ে রাখল। তার মনে হল- প্রতিটি ধূলিকণা সমুদ্র সমান ভালবাসা নিয়ে ওর জন্য অপেক্ষা করছে। ওরা দ্রুত ময়নাকে ওদের জগতে নিয়ে যেতে চায়!
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই জানুয়ারি, ২০১৬ রাত ৮:৪২
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মসজিদ না কী মার্কেট!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৮ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৩৯

চলুন প্রথমেই মেশকাত শরীফের একটা হাদীস শুনি৷

আবু উমামাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, ইহুদীদের একজন বুদ্ধিজীবী রাসুল দ. -কে জিজ্ঞেস করলেন, কোন জায়গা সবচেয়ে উত্তম? রাসুল দ. নীরব রইলেন। বললেন,... ...বাকিটুকু পড়ুন

সচিব, পিএইচডি, ইন্জিনিয়ার, ডাক্তারদের মুখ থেকে আপনি হাদিস শুনতে চান?

লিখেছেন সোনাগাজী, ১৮ ই মে, ২০২৪ সকাল ১১:৪৫


,
আপনি যদি সচিব, পিএইচডি, ইন্জিনিয়ার, ডাক্তারদের মুখ থেকে হাদিস শুনতে চান, ভালো; শুনতে থাকুন। আমি এসব প্রফেশানেলদের মুখ থেকে দেশের অর্থনীতি, রাজনীতি, সমাজনীতি, বাজেট,... ...বাকিটুকু পড়ুন

আকুতি

লিখেছেন অধীতি, ১৮ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৩০

দেবোলীনা!
হাত রাখো হাতে।
আঙ্গুলে আঙ্গুল ছুঁয়ে বিষাদ নেমে আসুক।
ঝড়াপাতার গন্ধে বসন্ত পাখি ডেকে উঠুক।
বিকেলের কমলা রঙের রোদ তুলে নাও আঁচল জুড়ে।
সন্ধেবেলা শুকতারার সাথে কথা বলো,
অকৃত্রিম আলোয় মেশাও দেহ,
উষ্ণতা ছড়াও কোমল শরীরে,
বহুদিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

ক- এর নুডুলস

লিখেছেন করুণাধারা, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:৫২



অনেকেই জানেন, তবু ক এর গল্পটা দিয়ে শুরু করলাম, কারণ আমার আজকের পোস্ট পুরোটাই ক বিষয়ক।


একজন পরীক্ষক এসএসসি পরীক্ষার অংক খাতা দেখতে গিয়ে একটা মোটাসোটা খাতা পেলেন । খুলে দেখলেন,... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্প্রিং মোল্লার কোরআন পাঠ : সূরা নং - ২ : আল-বাকারা : আয়াত নং - ১

লিখেছেন মরুভূমির জলদস্যু, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:১৬

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
আল্লাহর নামের সাথে যিনি একমাত্র দাতা একমাত্র দয়ালু

২-১ : আলিফ-লাম-মীম


আল-বাকারা (গাভী) সূরাটি কোরআনের দ্বিতীয় এবং বৃহত্তম সূরা। সূরাটি শুরু হয়েছে আলিফ, লাম, মীম হরফ তিনটি দিয়ে।
... ...বাকিটুকু পড়ুন

×