হৈচৈ চেচামেচিতে সামসু মাঝির ঘুম ভেঙ্গে গেল। সে ঘুমায় নৌকায়। নৌকাটা বেশ জোরে জোরে দুলছে। সে চোখ খুলে ছইয়ের দিকে তাকিয়ে রইল। ছইয়ের ফাঁক-ফোকর দিয়ে ভোরের আলো আসছে। এত হৈচৈ কিসের? কোন যাত্রাপার্টি বা বেদেদের নৌকা এলো না তো! এরা এলে খালের পাড়ে ভীড় লেগে থাকে। লোকজন উঁকি-ঝুকি দিয়ে তাদের কার্যকলাপ দেখার চেষ্টা করে। সামসু মিয়া উঠে বসল। পাশে তার স্ত্রী এবং ছেলে বেঁহুসের মতো ঘুমাচ্ছে। সে নিঃশব্দে ছইয়ের বাইরে এলো এবং চমকে উঠল। গ্রামবাসী খালের পাড়ে হুমড়ি খেয়ে পড়েছে। খালের মধ্যে কার যেন একটা লাশ ভাসছে। তরতাজা লাশ। আগ্রহী দু’একজন মাঝি কোমড় পানিতে নেমে লাশটা টেনে উঠানোর চেষ্টা করছে। করিম ব্যাপারী উঁচু গলায় ধমকে উঠলেন।
ঐ মিয়া লাশ উঠাও কেন? আগে পুলিশরে খবর দাও। কার না কার লাশ? পরে ঝামেলায় পড়বা।
যারা লাশ উঠাতে যাচ্ছিল, তারা থমকে দাড়াল। কিছুক্ষন ইতস্তত করে পাড়ে উঠে এলো। গ্রামবাসী হুমড়ি খেয়ে লাশ দেখছে। বোঝার চেষ্টা করছে-এটা তাদের পরিচিত কারো লাশ কিনা। যেই দেখছে, না তাদের পরিচিত কেউ না। তারা স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেলছে এবং নানা মন্তব্য করছে। কিন্তু পুলিশকে খবর দিতে কেউ আগ্রহ দেখাচ্ছে না।
সামসু মিয়া ঘুম থেকে উঠে নৌকায় বসেই হাত মুখ ধোয়। আজ হাতমুখ ধুতে গা ঘিন ঘিন করছে। লাশ পানিতে ভাসছে। সেই পানিতে হাতমুখ ধোয়া! সে লাফ দিয়ে পাড়ে নামল।
মাঝিরা ভীড় করে দাড়িয়ে আছে। করিম ব্যাপারী মাঝিদের দিকে তাকিয়ে ভৎর্সনার স্বরে বলছেন,
দাড়ায় দাড়ায় তামাশা দেখলে হইব? লাশ পঁচলে সমস্যা হইব তোমাদেরই। নৌকায় তোমাদের সংসার। দূর্গন্ধে পানি ব্যবহার করতে পারবা?
সামসু মিয়া চিন্তিত মুখে লাশের দিকে তাকিয়ে রইল। এই খালের পানিই এখন তাদের ভরসা। গোসল থেকে শুরু করে রান্না-বান্না সবই করতে হয় এই পানি দিয়ে। দূরন্ত পদ্মা তার ভিটেমাটি খেয়ে ফেলেছে। সে উঠে এসেছে নৌকায়। সাথে স্ত্রী-ছেলে, হাড়িপাতিল। শুধু সে একা না। তার মতো শত শত মানুষ পদ্মার শিকার। তারা সংসার পেতেছে নৌকায় ।
হারুন মাঝি চিন্তিত মুখে বলল, ব্যাপারী সাব কি করতাম?
সোজা থানায় যাও। পুলিশ এসে লাশ উঠাক।
খালের পাড়ের বাজারে করিম ব্যাপারীর বিশাল দোকান। পাড়ের লোকজন করিম ব্যাপারীকে মানে। আর ব্যাপারী সাহেব তো ঠিক কথাই বলেছেন। পানি দূর্গন্ধ হলে তারা বিপদে পড়বে।
সামসু মিয়া থমথমে মুখে বলল, চল থানায় যাই।
থানার অসি সাহেবকে খালের পাড়ে নিয়ে আসতে আসতে প্রায় দু’ঘন্টা পার হয়ে গেল। ততক্ষনে জোয়ার শুরু হয়ে গেছে। জোয়ারের টানে লাশ ইছাপুর গ্রাম থেকে আরও উত্তরের দিকে সরে গেছে।
ওসি সাহেব তিন চারজন কনস্টেবল নিয়ে খালের পাড়ে দাড়িয়ে কিছুক্ষন লাশের অবস্থান দেখলেন। তারপর ঘুরে দাড়িয়ে বললেন, এই লাশ আমরা তুলতে পারব না। এটা এখন আমাদের এখতিয়ারে নাই। পাশের জৈনপুর গ্রামের সীমানায় চলে গেছে। যা করার ওখানকার থানার অফিসারদেরকে করতে হবে।
তারা একটা সিএনজি নিয়ে এসেছিলেন। চারদিকে ভটভট শব্দ তুলে মুহূর্তে চলে গেলেন। লাশটা জোয়ারের টানে ভাসতে ভাসতে আরো দিকে যাচ্ছে।
সামসু মিয়া হাঁটতে হাঁটতে জৈনপুর গ্রামের দিকে চলল। তার সাথে অন্যান্য মাঝিরা। জৈনপুর থানায় খবর দিয়ে তারা ওসি সাহেবকে নিয়ে এলেন।
ওসি সাহেব ভ্রু কুঁচকে বললেন, আমাদের খামোকা খবর দিয়েছেন। এই লাশ এখন আমাদের আওতায় নাই। আপনারা মুরাদপুর থানায় খবর দেন।
সামসু মিয়া চুপ করে দাড়িয়ে রইল। তার রাগ লাগছে। হাটতে হাটতে এতদুর এসেছে। এখানে এসেও একই কথা শোনে! বেলা অনেক হয়েছে। ক্ষিধেয় তার পেট চো চো করছে। সে একদলা থু থু ফেলে বলল, শালা দিনডাই মাটি।
অন্যান্য দিন এইসময় এক থাল পান্তা খেয়ে সে বেড়িয়ে পড়ে। তার আরেকটা নৌকা আছে। যাত্রী নিয়ে একগ্রাম থেকে আরেক গ্রামে ছুটে।
হারুন মাঝি বলল, সামসু ভাই অখন কি করতাম। ফিরা যাইবেন?
না। তুই এখানে দাড়া। লাশটার দিকে খেয়াল রাখ। মজিদ, খালেক তোরা আয় আমার সাথে। মুরাদপুর থানায় যাই।
তারা সবাই মুরাদপুর থানায় এলো। মুরাদপুর থানার ওসি সব শুনে ঝিম মেরে বসে রইলেন।
সামসু মিয়া বিনীত ভঙ্গিতে বলল, স্যার লাশটা এখন আপনাগো থানার আওতায় আছে। আপনারা যদি তাড়াতাড়ি একটু উঠানোর ব্যবস্থা করতেন। লাশ পঁচলে পুরা খালের পানি দুষিত হইব।
ওসি সাহেব অনিচ্ছা স্বত্বেও তার বিশাল ভুড়ি নিয়ে উঠে দাড়ালেন। তারা রওনা হবেন, এমন সময় হারুন মাঝি দৌড়ে এলো।
হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, সামসু ভাই লাশটা ভাটার টানে আবার আমাগো গ্রামের দিকে ফিরা যাইতাছে।
ওসি সাহেব ধপাস করে চেয়ারে বসে পড়লেন। বললেন, আমাদের এখন করার কিছু নেই।
সামসু মিয়া বলল, স্যার আপনারা ইচ্ছা করলে লাশটা থামাইয়া উঠায় ফেলতে পারেন।
ওসি সাহেব ধমকের সুরে বললেন, ঐ মিয়া তুমি পুলিশের কাজকর্ম কিছু বোঝ? পুুলিশের কোড অব কন্ডাক্ট আছে। বিভিন্ন ধারা উপধারা আছে। ৫৫ ধারায় স্পষ্ট উল্লেখ আছে-এক অঞ্চলের থানার কাজকর্মে আরেক অঞ্চলের থানা হস্তক্ষেপ করতে পারবে না। তোমার সাথে এইসব আলাপ করে কী লাভ?
সামসু মিয়া থানা থেকে বের হয়ে এলো। কেন জানি তার মুখে কিছুক্ষন পরপর থু থু জমছে। সে শব্দ করে থু থু ফেলল এবং অস্ফুট স্বরে বলল, শালা!