গতকাল রাতে, ঘুমানোর আধাঘণ্টা আগে, বারান্দায় দাঁড়িয়ে, চোখের সামনে খোলা প্রান্তর আর অন্ধকার আকাশকে রেখে, ভাবছিলাম - বুড়ো মানুষরা কি ভাবে? বুড়ো মানুষরা কি নিয়ে কথা বলে?
মায়ের শরীর খারাপ ছিল। জ্বর, কাশি। ১০০র আসেপাশে শরীরের তাপমাত্রা। মুখে রুচি নেই। কিছু খেতে চাইছেন না।
করোনা কী?
জানিনা।
বাসায় আমি, বাবা, আমার স্ত্রী - তিনজনের করোনা হয়ে গেছে গত ডিসেম্বর মাসে। মায়ের হয় নি। বোনের হয় নি। আলহামদুলিল্লাহ,
করোনার কারনে কোন ক্ষতির মধ্য দিয়ে যেতে হয় নি আমার পরিবারের। আবারো আলহামদুলিল্লাহ।
বাসায় বুয়া নেই আজ কিছু দিন। সবাইকে বাসার কাজে হাত লাগাতে হয়েছে। মা ও কিছু কাপড়চোপড় ধুয়েছেন। তারপর থেকেই ঠাণ্ডা। জ্বরজ্বর ভাব। জ্বর।
আশা করি, মা দ্রুত সুস্থ্য হয়ে উঠবেন।
আমার প্রায়ই ২০১৪ সালের কথা মনে পড়ে। মে মাস। বা জুন। ঠিক মনে নেই। রমজান শেষ হচ্ছিল তখন প্রায়। বাকি ছিল, ধরুন, ১০টা রোজা। এরমধ্যে আম্মুর কাঁপুনি দিয়ে জ্বর। বুকের ভেতরে ক্রমাগত কম্পনের অনুভূতি। ডক্টর বললেন লাংসের বায়পসি করতে। আমার মনে পড়ে, বায়পসির প্রেসক্রিপশন নিয়ে আম্মু যখন বাসায় ফিরছিলেন, তিনি অঝোরে কাঁদছিলেন। আমাদের পরিবারে জড়িয়ে ধরার চল নেই। বাবা - মা, স্নেহের সাথে জড়িয়ে ধরে আদর করেন নি আমাদের। অনেক পরিবারে এই চল থাকে। অনেক পরিবারে থাকে না। আমাদের নেই। ছিল না। তার অর্থ এটা নয় যে আমাদের পরিবারের বন্ধন দুর্বল। আমাদের পরিবারের বন্ধন, অনেক রকম পারস্পারিক বিরোধিতা ও মতের অমিল সহই, আলহামদুলিল্লাহ আবারো, অনেক শক্ত।
আমার মা'কে ঐ একদিনই, জীবনে, যদ্দুর মনে পড়ে, আমি কাঁধের পাশে হাত রেখে, জড়িয়ে ধরে আস্তে আস্তে নিয়ে আসছিলাম, দরজা থেকে, ঘরের ভেতর। তিনি কাঁদছিলেন যেদিন। যেদিন ডক্টর বলেছিল, লাংসের বায়পসি করা লাগবে। খারাপ সংবাদ কিছু যদি আসে, তা গ্রহণ করবার জন্যে যেন আমরা মানসিকভাবে শক্ত থাকি। মাকে রুমে নিয়ে এসে বসানোর পর, মা চোখ মুছে বলেছিলেন - ধ্যার। মরলে মরবো। আল্লায় কপালে যা রাখসেন, তার ব্যতিক্রম তো কিছু হবে না। সেই দিন আমি বুঝেছিলাম, আমার মা কোন ধাতুতে গড়া মানুষ।
ধানমণ্ডি ১ এ আনোয়ারা মেডিকেলে আম্মুর বায়পসি যেদিন করতে নিয়ে যাই, এক প্যারালাল পৃথিবীর বাস্তবতা আমার চোখে ধরা পড়ে। এমন কিছু যে পৃথিবীতে এক্সিস্ট করে, ঐ দিনের আগে আমি আসলেই তা বুঝি নি।
আমি একদম কমবয়সী শিশুকে দেখেছিলাম, ক্রন্দনরত মায়ের কোলে চেপে যে বায়পসি করতে এসেছিল। আমি পরীর মতো সুন্দর ফুটফুটে ৮- ৯ বছরের মেয়েকে দেখেছিলাম, পৃথিবীর সমস্ত আধার চেহারায় নিয়ে বসে থাকা তার পিতামাতার পাশে। সেও বায়পসি করতে এসেছিল। আমি বয়োবৃদ্ধ সফেদ দাড়িওয়ালা মানুষকে দেখেছিলাম, বায়পসি করতে এসেছিলেন তিনিও। আমিও গিয়েছিলাম, আমার মায়ের সঙ্গে। আমার বাবাও সাথে ছিলেন।
আমার মনে পড়ে, আমার মায়ের পীঠ বরাবর সুঁই ঢোকানো হয়, লাংসের সেল বের করে আনার জন্যে।
আমার মনে পড়ে, আমার মা যখন মেডিকেল থেকে বের হয়ে তার সিঁড়িতে দাঁড়ান, লাংসে খোঁচা লাগার ফলে তার কাশির দমকের সঙ্গে রক্ত বের হচ্ছিল।
যেদিন বায়পসির রিপোর্ট দেয়া হবে, সেদিন আমাকে জীবনের সবচে কঠিন পরীক্ষার সামনে ফেলে দেন আমার বাবা। তিনি বলেন, মায়ের বায়পসির রিপোর্ট নিয়ে তিনি বাসায় ফিরবেন না। তিনি অফিসে যাবেন। আমাকেই আম্মুর হাতে রিপোর্ট তুলে দিতে হবে।
আমার মা। এতটুকুই তো যথেষ্ট, আমার জীবনে তিনি কে - তার ব্যাখ্যা দেবার জন্যে। সেই মা'কে, তার জীবনের, হতেপারে, সবচে কঠিনতম সংবাদটি দেয়ার দায়িত্ব আমার কাঁধে পড়লো।
এরপরের দৃশ্যটা আমার আজও মনে পড়লে আমার চোখে পানি এসে পড়ে। আমি আর বাবা, দু'জনে মেডিকেল থেকে রিপোর্ট হাতে বেরিয়ে ধানমণ্ডি ১ এর রাস্তায় বসে কাঁদছি। আমার এক ডাক্তার বন্ধু বলে দিয়েছিল, বায়পসির রিপোর্ট, পাতার একদম শেষে লেখা থাকে।
লেখা ছিল - নো কার্সেনোজেনিক সেলস ফাউন্ড।
আমি আর আব্বু বসে কাঁদছিলাম, কুল কিনারহীন এক বিপদ থেকে বেঁচে গিয়ে। আমি আর আব্বু কাঁদছিলাম, কৃতজ্ঞতাপূর্ণ অন্তরে।
আমার সেই ডাক্তার বন্ধু, যে এখন তার ডাক্তার স্ত্রীকে নিয়ে ইংল্যান্ডের একটা হসপিটালে প্র্যাকটিস করে, আমার মনে পড়ে, সেদিন বিকেলে গিয়ে যখন ওর সঙ্গে দেখা করে রিপোর্টটা আরেকবার দেখাই, ওর ঠোঁটের কোনে ম্লান হাসির রেখা।
আনন্দ, ছিল হয়তো। ছিল একটা কষ্টও। ওর বাবা লাংস ক্যান্সারে ভুগে মারা গিয়েছিলেন, তার ২ বছর আগে। শেয়ার বাজারে ধ্বস নামলে, ওর বাবা প্রায় সব হারিয়েছিলেন। তাদের দেড় - দুই কাঠার ওপর দাঁড়ানো, খিলগাঁও, সিপাহীবাগের ৩তলা বাড়িটা ছাড়া। সলিমুল্লাহ মেডিকেলের ডক্টর হয়েও, ওর বাবাকে বাঁচাতে পারে নি ও। আল্লাহ বাচিয়ে দিলেন আমার মা'কে।
সেই যুদ্ধজয়ী মা' আমার, তার আবারো শরীর খারাপ আজ-কাল। আল্লাহ চাইলে সেরে যাবেন।
কিন্তু আমার মাথায় প্রায়ই ঘোরে আজকাল এ প্রশ্ন, বুড়ো মানুষদের মাথায় কি চলে। তারা কি ভাবে। তারা কি নিয়ে কথা বলে।
আমার বাবা - মা, আমার দাদা-দাদি, নানা-নানিকে নিয়ে খুব বেশী কথা বলেন না। আমার পরিচিত বয়োবৃদ্ধ স্যার, আমার আত্মীয়স্বজন যারা, তাদেরও দেখি না তাদের বাবা - মাকে নিয়ে কথা বলতে, যারা গত হয়েছেন।
এই প্রশ্ন আমাকে প্রায়ই তাড়িয়ে বেড়ায়, হয়তো, হয়তো একদিন আমার বাবা - মা আমাকে ছেড়ে চলে যাবেন। যদি না আমার আয়ুরেখা তাদের চে' সংক্ষিপ্ত হয়।
কেমন হবে সেই দিন, কেমন হবে সেই রাত, যেই রাতে তিনি, তারা - আমাকে ছেড়ে চলে যাবেন?
মানুষ এসমস্ত প্রশ্ন দ্বারা তাড়িত হয়। কিন্তু এসমস্ত বিষয় নিয়ে কথা বলতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে না। আমিও করি না।
আমি জানতে চাই, বয়োবৃদ্ধ যারা, তারা তাদের পিতামাতা হারানোর শোককে কাটিয়ে ওঠেন কীভাবে? তাদের পৃথিবী গড়ে ওঠে কাকে, কাদের কেন্দ্র করে? কীভাবে পৃথিবীর সবচে গুরুত্বপূর্ণ দুজন মানুষের অনুপস্থিতি একসময় তাদের সয়ে যায়? কীভাবে তারা প্রাসঙ্গিকতা হারায়?
কীভাবে কোন মানুষ প্রাসঙ্গিকতা হারায়, এ পৃথিবীতে?
বুড়ো মানুষরা কি ভাবেন? কি চলে, তাদের মস্তিষ্কে? কি বিষয়ে কথা বলতে পছন্দ করেন তারা?
কীভাবে তারা বেঁচে থাকেন, পছন্দের সকল মানুষকে হারিয়ে, একে একে?
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে মার্চ, ২০২১ রাত ১১:১৮